রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু
পুণ্ড্রের পাঁচালী-২৬ (তেজস্বিনী-৩য় পর্ব )
সাজেদুর রহমান
রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী
পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু
সাতশ পঞ্চাশ সালে বাংলায় অতি তরুণ নেতা গোপালের অসাধারণ
বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সিংহাসন আরোহণ করেন। নাগ রাক্ষসী সাথে শক্তির পরিক্ষায় না
গিয়ে কৌশলে পরাজিত করেন। একজন নবীন নেতার পক্ষে এই অর্জন খুবই বিরল ঘোটনা এবং এই
ঘোটনাটি ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। আমার আজকের এই লেখা নাগ রাক্ষসীর পরিচয়ের বাইরে
অন্যকিছু নিয়ে লেখব।
ছোট বেলায় রাক্ষস আর পেত্নির গল্প না শুনে একটি বাঙালীও বড়
হয়নি। ভূত-পেত্নি-ডাকিনী-যোগিনী-শাকচুন্নি, অশরীরী, প্রেত,
পেত্নী, ব্রহ্মদৈত্য, পিশাচ,
ডাইনী, শাঁকচুন্নী, যক্ষ,
মামদো গল্পে শোনা ভয়ঙ্কর রুপী নারীর ছবি। মাথায় গেঁথে থাকা
এই ছবি গুলির দিকে যখন চেয়ে থাকি, সত্য তখন থেকে যায় এর
সবকিছু থেকে দূরে,
অন্য কোথাও, যার সন্ধান এখনো
অজানা।
পুণ্ড্রের পাঁচালীর এই পর্বে রাক্ষসী বলতে গত্রদেবী বা
প্রধানপুজরিনী কিংবা বৈদ্য বা শল্য চিকিৎসক পরিচয় খুঁজব। তেমনি ডাইনী যোগিনীর তত্ত
তালস করব। ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের সম্পৃক্ততা আসলে মস্তিষ্কে গেঁথে যাওয়া কিছু তৈরি
ধারণা ছাড়া আর কিছু নয়- এই কথার বাইরে হাঁটব।
রাক্ষসীদের পরাজয় কিংবা গণতন্ত্রের সূচনা
গোপাল নামের এই নেতার খুবই অল্প পরিচিতি। তবু গোপালের বীজয়ের
কথা সুদূর তিব্বত পৌঁছেছিল এবং সেখানকার ঐতিহাসিক লামা তারনাথ গোপালের সিংহাসন
আরোহণ নিয়ে এক রূপকথার অবতারণা করেন।
তাঁর কাহিনীর সারকথা- দেশে দীর্ঘদিন যাবৎ অরাজকতার ফলে
জনগণের দু:খ-কষ্টের আর সীমা ছিল না। দেশের
শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিরা একমত হয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একজন ‘রাজা’
নির্বাচিত করেন। কিন্তু ‘নির্বাচিত রাজা’
রাতে এক কুৎসিত নাগ রাক্ষসী কর্তৃক নিহত হন। এরপর প্রতি
রাতেই একজন করে ‘নির্বাচিত রাজা’
নিহত হতে থাকেন। এভাবে বেশ কিছু বছর কেটে গেল। অবশেষে একদিন
চুন্ডাদেবীর এক ভক্ত এক বাড়িতে এসে দেখে সে বাড়ির সকলেরই মন খুব খারাপ। কারণ, ঐদিন ‘নির্বাচিত’
রাজা হবার ভার পড়েছে ঐ বাড়িরই এক ছেলের উপর। আগন্তুক ঐ
ছেলের পরিবর্তে নিজে রাজা হতে রাজি হন। পরবর্তী সকালে তিনি রাজা ‘নির্বাচিত’
হন। সে রাত্রে নাগ রাক্ষুসী এলে তিনি চুন্ডাদেবীর
মহিমাযুক্ত লাঠির আঘাতে রাক্ষুসীকে মেরে ফেলেন। পরের দিন তাকে জীবিত দেখে সকলেই
আশ্চর্য হয়। পরপর সাতদিন তিনি এভাবে রাজা ‘নির্বাচিত’ হন। অবশেষে তাঁর অদ্ভুত যোগ্যতার জন্য জনগণ তাঁকে স্থায়ীভাবে রাজা রূপে ‘নির্বাচিত’
করে।
পাল আমলের মুদ্রায় নারী
প্রাচীনতম সভ্যতা সমূহের তত্ততালাশ করলে দেখি, কৃষিকেন্দ্রিক
প্রাচীন সমাজে তাই নারীরাই ছিল অধিপতি। নবপলিয় যুগ থেকে চলে আসা রীতি অনুযায়ী বছরান্তে
ফসল কাটার পরে গত্রদেবী তার পুরুষ সঙ্গীকে বলি দিয়ে দেবতার পুজা করত। ভূমীর
উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য এই পূজার আয়জন হাজার দেড়েক বছর চল ছিল।
কিন্তু নারীতন্ত্রের এই আধিপত্য বৈদিক ধর্মের প্রসার কালে
এসে খয় ধরতে শুরু করে। কৃষিকাজ যেহেতু মেয়েদের আবিষ্কার, সেহেতু বাংলায় এই আধিপত্য বিলোপ ঘোটান সহজ ছিল না। তৃতীয়-চতুর্থ খ্রিস্টপূর্ব
শতকে, ‘সমগ্র দেশের প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ নারীদের অধীন; এটা এই জন্য যে অনেক ধনী উত্তরাধিকারিণী আছেন, এবং প্রচুর যৌতুক দেওয়া হয়।’
পাঁচশ খৃস্টাব্দে বরেন্দ্র অঞ্চলের গত্রদেবীর পুরুষ সঙ্গীরা
আর সহজে বলি হতে চাচ্ছিল না। এ বিষয়ের নাথা মুনি মিন নাথের ইতিহাসে। নারীদের দেশে
বন্দী মিন নাথকে উদ্ধার করে গরক্ষনাথ।
নারীতন্ত্রের এই আধিপত্য বিলোপ ঘোটান গোপাল নামের সাধারণ এক
ভূমিপুত্র। ৭৫০ সালে তিনি গত্রদেবী বা প্রধানপুজরিনীকে রাক্ষসী হিসেবে বধ করে
গণতান্ত্রিক ভাবে অধিপতি হয়েছিলেন। আমাদের অঞ্চলে নারীদের এই ঐতিহাসিক পরাজয় ভারতবর্ষের
ইতিহাসে অন্য মাত্রা যোগ করে।
বাংলার কৃষিসভ্যতার শুরুতে সাপের উপদ্রব খুবই ছিল; সাপের কামড়ে অনেককেই প্রাণ দিতে হত; অন্ত্যজ বর্ণের যাযাবর
ডোম-শবর-পুলিন্দ-নিষাদ-বেদে প্রভৃতিদেরই অন্যতম বৃত্তি ছিল সাপ-খেলানো, যাদুবিদ্যার নানা খেলা দেখানো ইত্যাদি।
এ বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন-সাপ বিদ্যায় পারদর্শী কোন নারী
গত্রপ্রধান নাগ রাক্ষুসী। মনসা-পূজাই তাহার অন্যতম সাক্ষ্য। পুণ্যতোয়া নদী করতোয়ার
তীরের পোদদের দেশ পুণ্ড্রে গুপ্তযুগের শেষভাগে এই প্রথার পূর্ণ বিকাশ ঘটে।
রুমানিয় পন্ডিতের নাম মির্চা ইলিয়াদ তার গবেষণায় দেখান বাংলার
সাপুড়েরা একধরনের শামান। তিনি শামানবাদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার মতে এখানকার লোকে
বিশ্বাস শামান বা ওঝাদের রয়েছে অলৌকিক ক্ষমতা, তারা বশীকরণ
মন্ত্র জানে,
তারা বাণ মারতে পারে। রোগবালায় দূর করতে পারে।
বাঙলার প্রাচীন সমাজটি ছিল তান্ত্রিক। এই তান্ত্রিকতার
চর্চা নারী কেন্দ্রিক। শাক্ত মতে বিশেষত তন্ত্র সাধনার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো একজন
নারী।
ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের নিরিখে আমাদের দেশের তন্ত্র ও
শক্তিসাধনার ইতিবৃত্ত এখনও প্রকৃত অধিকারীর মনোযোগ পায়নি। নারীদেরকে পুরুষদের মত
বারংবার আলোচনা করা হয়নি।
অব্যাখ্যাত শক্তিসাধনার ইতিবৃত্ত
মাতৃদেবীর পূজার উদ্ভব এখাই ঘটেছিল। লক্ষ্মীর পূজার
সুতিকাগার এই অঞ্চল। জানা যায়, মনুবংশীয় মঙ্গল রাজা সৰ্ব্ব প্রথম লক্ষ্মীর পূজা
করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না প্রাক্-আর্য কৌম সমাজের ধ্যান-ধারণা নিজস্ব পরিবেশ
থেকেই শক্তি সাধনার আয়জন।
প্রাচীন বাংলার নারীকেন্দ্রিক এই শক্তিসাধনাটি ছিল আর্যদের
তুলনায় সুশোভন ও আদর্শকি। যেখানে আর্যদের পুরুষ তান্ত্রিক নিষ্ঠুর ধর্ম বিশ্বাসে
নরবলি একটা উৎসব সেখানে বাংলার নারী তান্ত্রিকের ধর্মবিশ্বাসে স্বামীহন্তী
পূজারিণীকে আনুষ্ঠানিক শোক পালন করতে হতো।
আর্য অনার্যদের মাঝে চেতনাগত পার্থক্য দেখি। ঋষিরা চাচ্চেন—ইন্দ্র আমাদের সহান হোন, তিনি আমাদের বিজয় দিন, শত্রুরা দূরে পলায়ন করুক, ইত্যাদি; আর বাঙালির মেয়েরা চাইছে—‘রণে রণে এয়ো হব, জনে জনে সুয়ো হব,
আকালে লক্ষ্মী হব, সময়ে পুত্রবতি হব’।
ব্রতের এই ছড়াটি থেকে আমরা পাচ্ছিঃ রণে রণে এয়ো রব, জনে জনে সুয়ো হব,
অকালে লক্ষ্মী হব, সময়ে পুত্রবতী
হব।এ কামনা যাদের মেয়েরা করতে পারে তারা অন্যব্রত হলেও আর্যদের চেয়েও যে সভ্যতায়
নীচে ছিল তা তো বলা যায়না। রণচণ্ডীর যে মূর্তীখানি এই ছড়ার মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে
পাই, মেয়েদের হৃদয়ের যে একটি সংযত সুশোভন আদর্শ আমাদের কাছে উপস্থিত হয়, তাতে করে তাদের অন্যব্রত ছাড়া অকর্মা অমন্ত এ-সব উপাধি দেওয়া চলে না।
চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী দূর্গা-
কালী-বাসুলী- তারা-শিবানী। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার
শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তি লাভ করে করে নারী শক্তি
থেকে।
রাক্ষসী জরা রাজা জরাসন্ধর অস্ত্র পাচার করেন
পূজার এই অব্যাখ্যাত শক্তিসাধনা বাংলায় নারীকেন্দ্রিক
তান্ত্রিক ধারণাটি পল্লবিত হয়েছিল।
গোকুলের ডাইনী কিংবা পুণ্ড্রের অসুরিণী
কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রের
মধ্যে থাকা মন্ত্র-
ওঁ শয়ং চেতনায়ং সর্ব শক্তি ভুতয়াং দিব্য তিলং স্বহাঃ
মন্ত্রটি ডাকিনীবিদ্যা মূল মন্ত্র। ডাকিনী বা ডাইনী গোকুলে দেবীর
মর্যাদা পায়। জ্ঞানী- স্ত্রীলিঙ্গে ডাকিনী বা ডাইনীরা।
গোকুল এলাকায় ডুমপুকুরের ধাপ ও কাঁঠালতলার ধাপ, রোজাকপুর (গোকুল থেকে পশ্চিমে) এবং বৃহত্তর বগুড়ার গিরিরডাঙ্গা, নিজগিরিরডাঙ্গা,
গোলাবাড়ি, পোড়াদহ, রানীপারা,
মহিষাবান, ছাইহাটা ইত্যাদি
প্রত্যন্ত অঞ্চলে অধিবাসী ছিলেন।
সমকালীন উৎস থেকে ডাইনিদের তালিকা- ‘গয়, বিমল,
শ্ৰীশ, শ্রীধর, মঙ্গলায়ন,
মঙ্গল, রঙ্গবল্লীশ, রঙ্গোজী ও দেবনায়ক,
ইহার গোকুলে নবনন্দ নামে কথিত’।
ডাইনিদের যে চিত্তাকর্ষক তালিকা পাই তা আমাদের একেবারেই
অপরিচিত নয়। অদ্ভুত সংবাদ- ডাকিনী, রাকিণী, লাকিনী,
কাকিনী, শাকিনী এবং হাকিনী নামের
দেবীরা একটা ও সংষ্কৃত না।
তবে সংস্কৃতে জরা শব্দের মানে হছে বৃদ্ধাবস্থা। কিংবদন্তির
ঐতিহাসিক মতে এখানে রাক্ষসী জরা মানে বৈদ্য বা চিকিৎসক। এই রাক্ষসী অনেক জ্ঞানের
ভারে বৃদ্ধা হয়েছিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে রাক্ষসী জরা রাজা জরাসন্ধর অস্ত্র পাচার
করেন।
শল্য চিকিৎসক জরা রাজা জরাসন্ধর প্রাসাদে থাকতেন।
রাজা জরাসন্ধর বন্দধু পুণ্ড্রের রাজার প্রাসাদে থাকত অসুর-অসুরিণী।
আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থে অসুর ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীকে অসুর বলা হচ্ছে।
“অসুরানাং ভবেত বাচা গৌড় পুন্ড্রোদ্ভবা সদা”।
অসুর থেকে অসুরিণী। চকচকে কৃষ্ণবর্ণের অসুরিণীদের মদ্ধে ঊষা, রিত্নাসুর আমাদের অতীত নারী চরিত্রের উজ্জ্বল প্রতিভু। এছাড়াও প্রাচীন রাঢ়
এবং সুহ্ম প্রদেশসহ এ অঞ্চলের সভ্যতা বিনির্মাণে অসুরিণীদের অন্যোন্য ভূমিকার কথা
জানতে পারি বিদেশী পর্যটকদের বিবরণে।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন মতে বগুড়ার করতোয়া নদী কূলে অবস্থিত
মহানগড়ে কোল-মুন্ডা জনগোষ্ঠীর নারী সমাজ খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক থেকে পূর্ব ভারতে
এক নতুন সভ্যতা প্রবর্তনে অবদান রাখে।
ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত মৃৎশিল্পের নমুনা
বিশ্লেষণ করলে দেখি-বৈদিক যুগে প্রতিমা পূজার প্রথা প্রচলিত ছিলো। পোড়ামাটির প্রতিমার
তত্ততালাশ করলে প্রতিভাত হয় যে, বৈদিক ধর্মাচারের
গোড়াপত্তন হয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষের হাত ধরেই। নানাবিধ লৌকিক আচারের সাথে
সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাস-সংস্কারের মিশ্রণে বৈদিক ও পৌরাণিক ধর্ম-বিশ্বাসের
পৌনঃপুনিক বিবর্তনের পথ বেয়ে বাঙালির জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসবসমূহ এখন
প্রচলিত। পুণ্ড্রর যন্ত্র-তন্ত্র-মন্ত্র চর্চা গৌরব ময় ইতিহাস হারায়ে বসেছি।
যোগিনী
যন্ত্র-তন্ত্র-মন্ত্র রহস্য
বৌদ্ধ তন্ত্রযানের দুজন মহাগুরু নাড়োপা এবং নিগু কিংবা কম্বলপাদ
এবং শিলাদেবী যন্ত্র-তন্ত্র-মন্ত্র বিদ্যায় অসম্ভব দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তাদের
ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার প্রমাণ পাই বৈদিক সাহিত্যে।
কৃষিকেন্দ্রিক প্রাচীন নারীজীবনের নানারকম গোপন ও গভীর
রহস্যের সঙ্গে জড়িত। সে সময়ে নারী সমাজে নিজেদের বিভিন্ন ধরনের জাদুকরী বা
অতিমানবিক ক্ষমতা অর্জনের চর্চা ছিল। জাদুকরী ক্ষমতা নিয়ে যিনি কাজ করেন, বা ক্ষমতা রাখার দাবি করেন, তাকে ডাইনি বলা হয়ে
থাকে।
ডাইনী বা ডাকিনীবিদ্যার অতিব ভয়ঙ্কর সাধনা চলত আসামের কামরূপ-কামাখ্যা মন্দিরে। আবহমান
কাল ধরে বাংলা একটা বড় অংশের মানুষ বিশ্বাস করে এসেছেন, নারী অধ্যুষিত কামরূপ-কামাখ্যা আকাশে-বাতাসে
ভেসে বেড়াচ্ছে যাদু।
গ্রাম-শহরের হাটে-ঘাটে জাদুর পশরা নিয়ে বসা
জাদুকরেরা গা
ছমছম করা ডাকিনী সাধনা গল্পরা করে।
মায়ং
থেকে ঘুরে আসা মনুষজন জানাচ্ছেন, গ্রামে
প্রবেশ করলে দেখা মেলে বহু তান্ত্রিক ডাকিনী সাধনা করছে। এছাড়াও
যোগিনী-তত্ব,
ভূতশাস্তির ঔষধ, মন্ত্রে
শাকিনীদমন ও ঐন্দ্রজালিক ও ডাকিনীবিদ্যা বিষয়ক সাধনা ব্যাপকভাবে চর্চিত হতে দেখা
যায়।
দর্শনার্থী আকর্ষণ করার জন্য তান্ত্রিকরা ভূত, প্রেত,
যোগিনী, ডাকিনী, পিশাচ সাধনার কথা বলে। তবে নানা গুহ্য, মন্ত্র, যন্ত্র,
ধারণী প্রভৃতি ধ্যান-কল্পনায়, পূজাচারে,
আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে এবং গুহ্য, রহস্যময়,
স্বার্থকযন্ত্র, মন্ত্র, ধারণী,
বীজ,
মণ্ডল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য চর্চা আদিম কাল থেকে বাংলায়
হয়েছে।
বজ্রযান কে বলা হয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম। মন্ত্র এবং যন্ত্র
-এ দুই হল বজ্রযানের সাধনার উপকরণ। বিহারের বিক্রমশীলা বিহারটি ছিল বজ্রযানী
বৌদ্ধদের অন্যতম কেন্দ্র। বজ্রাচার্য নাঢ়োপা অতীশ দীপঙ্করের শিক্ষক ছিলেন।
নাড়োপা বিক্রমশীলা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় অতীশকে বিক্রমশীলার প্রধান পদে
অভিষিক্ত করে যান।
যোগিনী-তত্ব আবিষ্কারক কম্বলপাদ সম্বন্ধে ন্যারো-পার বোন
নিগু-মা বলেন,
তিনি এবং কম্বলপাদ ভিন্ন আয় কেউ মন্ত্রযান জানেন না। চুরাশি
সিদ্ধাচার্যের অন্যতম নাড়োপা এবং নিগু
ডাকিনী উভয়েই চর্যাপদ রচনা করেছেন, দুজনেই ছিলেন
হেবজ্রের উপাসক।
কৌতুহলোদ্দীপক এক মন্ত্র-
‘ওম মনিপদ্মে হূম’
জপ করা হয়।’আহা, মনিই প্রকৃত পদ্ম’
– অনেকের মতে,
এই মন্ত্রটি বুদ্ধ এবং প্রজ্ঞাপারমিতার এবং বোধিসত্ত্ব এবং
তারা দেবীর যৌনমিলনের প্রতীক। তবে বজ্রযান কেবলি যৌন সাধনপন্থা নয়, বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের একটি রহস্যময় রূপ।
রহস্যময় শয়তানি বিদ্যা কিংবা ভয়ঙ্কর জাদু বিদ্যা সভ্যতার শুরু থেকে এই দুইয়ের প্রতিই মানুষের সীমহীন সেই
আগ্রহ এখনো আছে। সেই আকাংখা তান্ত্রিক ধারার শুরু হয়েছিল যা সিদ্ধ ধারা নামে। এই
ধারার অনুগামীদের লক্ষ্য ছিল সিদ্ধি বা অমরত্বের সাধনা।
ব্যাক্তিজীবনে এবং সামাজিক জীবনে ঝাড়-ফুঁক-মন্ত্র-ওঝা-তান্ত্রিক
সিদ্ধদের প্রয়োজনীয়তা আছে। আবহমান কাল ধরে বাংলার মানুষ গভীর বিশ্বাসকে লক্ষ্য করে
কোকা পণ্ডিত ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ নামে বই লেখেন। বইটি মুলত নানা
তন্ত্র শাস্ত্র হতে সংগৃহীত মন্ত্র-তন্ত্র-শ্লোকের সংকলিত রূপ। কোকা পণ্ডিতের বৃহৎ
ইন্দ্রজালের ‘বশীকরণ-পদ্ধতি’
ব্যাপক জনপ্রিয়।
যেখানে নারী পুরুষকে বসে আনতে বেস্ত। জাদুবিশ্বাসের এই নারীকে
ডাকিনী বলা হয় (যোগিনীতন্ত্রম)।
কোকা পণ্ডিত ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ বইয়ের প্রচ্ছদ
অতীন্দ্রিয় যোগিনী কিংবা মায়াবী যক্ষী কুবন্না
যোগিনীতন্ত্র হিন্দু ও বৌদ্ধতন্ত্রের ঐতিহ্যের অংশ। যোগিনী হিসাবে
এমন নারীদের
কথা বলা হয় যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্যার পথের প্রাগ্রসর তান্ত্রিক।
ডোম্বিযোগিনী,
সহজযোগিচিন্তা, লক্ষ্মীঙ্করা, মেখলা,
কঙ্কাল গঙ্গাধরা, সিদ্ধরাজ্ঞী ও
অন্যান্যদের মত প্রচুর নারীরা সম্মানিত যোগিনী ইতিহাস ক্ষেত।
মহাস্থানের প্রত্ন স্থান যোগীর ভিটা বা ধাপ বাংলায় যোগিনী
সাক্ষ্য বহন করছে। এখানকার বেশ কিছু নারী ছিলেন, যেমন নারায়ণ-শিলা,
গণেশ, ভৈরব, বৌদ্ধ জম্ভিল,
হারীতী, একজটা, নৈরাত্মা,
ভৃকুটি প্রভৃতির দেবদেবীর যাঁরা যথেষ্ট বিদুষী ছিলেন। দর্শন
রচনা ও চর্চা করতেন তাঁরা,
জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিদ্যায় ছিলেন পারদর্শী, তাঁদের আয়ত্তে ছিল তীর-ধনুক চালনা, জাদুবিদ্যা, শিক্ষকতা ও গুরুর দায়িত্ব পালন করা। ফলে আদিকালে নারীরা কেবল গুরুপত্নীই নন, সাক্ষাৎ গুরুও ছিলেন।
মূর্তিতত্ত্বের ইতিহাস অনুযায়ী এসব যোগিনী আদিবাসী
কৌম-সমাজের তান্ত্রিক। পূর্ব-ভারত তথা বাঙলা অঞ্চলে ধর্মের আবির্ভাবের আগেও
মানুষের মধ্যে আধ্যাত্দিক চর্চা ছিল। আবার ধর্মের আবির্ভাবের পরও এই চর্চা অব্যাহত
ছিল।
তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে, মিরান্ডা সাউ
বলেন যে, নারীর শাশ্বত রূপ,
অর্থাৎ তার মধ্যে কতগুলো বিশেষ মানবিক গুণের সমাহার – যেমন,
দয়ামায়া, স্নেহ, সেবা,
ক্ষমাশীলতা, ধৈর্য, সহ্যশক্তি ইত্যাদি,
তেমনি দেখা যায় মারামারি, দাঙ্গাবাজি,
খুন বা যুদ্ধে প্রায়শই নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে বিরত
থাকা, সেইসঙ্গে আবার কোনো কোনো নারীর ভেতর দেখা যায় কুটিলতা, জটিলতা,
হিংসা, লোভ, প্রতিশোধস্পৃহার প্রবল উপস্থিতি।
সিংহল জয়ী বিজয় সিংহের কাহিনীতে বাংলার নারীর মায়াবী যক্ষীর
রুপে পাই। ওই কাহিনী অনুযায়ী, বিজয়ের অনুচরেরা কুবন্না
নামে এক মায়াবী যক্ষীর খপ্পরে পড়লে বিজয় তাকে হারিয়ে নিজের সঙ্গীদের মুক্ত করলেন।
তারপরে তার সাহায্যে আবার যক্ষরাজ কালসেনকে তার কন্যার বিবাহের সময়ে বধ করে তার
পোষাক গায়ে দিলেন।
কুবন্নার ইতিহাসের নথিপত্রের মাতৃদেবীর পুজার লীলাকেন্দ্র
বাংলায় নারীদের চিত্র পাই তা রীতিমত কৌতুককর ও ভয়াবহ। ধর্মের নামে অর্থহীন
অত্যাচার সমগ্র বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে কুৎসিত এবং জঘন্য দৃষ্টা। মনুর পরে
ব্রাহ্মণ্যবাদী নিষ্ঠুরতায় যিনি সবচেয়ে বেশী কৃতিত্বের পরিচয় দেন তিনি হলেন
শংকরাচার্য।
গর্ভবতী নারীদের প্রসব বন্ধ করা থেকে শুরু করে যৌনাকাঙ্খা
চিরতার্থ করার মত বিভৎস সব যাদু বিধানের চর্চা হতো তখন। এসময়ে বিশ্বাস করা হতো
বশিকরণের মাধ্যমে মানুষকে দাস বানিয়ে রাখা যায়।
মধ্যযুগে রেনেসাঁর আলো যতই ছড়াক না কেন, জ্যোতিষীদের হাত থেকে কেউই রক্ষা পায়নি! অর্থনৈতিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক অস্তিরতা প্রভৃতি কারণে জনমানসে তখনও ভবিষ্যত জানার প্রবল
স্পৃহাই এর কারণ ছিল।
বৈদিক সাহিত্যের অমানবিক ও নিষ্ঠুর অধ্যায়ের বাইরে প্রত্নতাত্বিক
আলামত ও ‘সামাজিক ইতিহাস’ ঘাঁটলে নারীর সম্মান দেবার ঘটনা বিরল।
খুব সম্প্রতি ডাইনি সন্দেহে ভারতে এক দম্পতিকে পিটিয়ে হত্যা
বাঙালিত্বের শেকড়ে আছে নিন্দাবাদ
বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে মাতৃকারা পাপের প্রতীক। নারী
সম্পর্কে এ ধরনের বহু নিন্দাবাদ প্রচলন ঘটে বৈদিক ধর্ম প্রচার কালে। ইষ্টসিদ্ধির
জন্যে প্রয়োজন মতো নারীকে ডাইনি বলে অত্যাচার করা হয়। কলহণ অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে
সহমরণে সতী হওয়ার বিবরণ দেন; এক স্ত্রী সহমরণে যাননি, তার প্রভূত নিন্দাও তিনি করেন। রাজতরঙ্গিনী-তে শূদ্র অশিক্ষিত, রুচিহীন;
ডোম্বী বর্বর; কিন্তু কলহণ বড়
শিল্পী এবং সৎ ঐতিহাসিক;
তাই অপক্ষপাত চিত্রণে দেখি দ্বিজ ব্রাহ্মণও বহুবার ওই রূপে
চিত্রিত। কলহণ শিল্পীর দায়িত্ব পালন করেছেন, কবি-ঐতিহাসিকের
সততা রক্ষা করেছেন।
নারী সম্পর্কে বহু নিন্দাবাদ করেও তিনি বারে বারেই
নিঃস্বর্থ প্রজাহিতৈষিণী,
আত্মত্যাগে অকাতর বহু নারীকে চিত্রিত করেছেন। তেমনই ভবভূতি
যে-সমাজে বাস করতেন তা নারী সম্পর্কে নিষ্ঠুর, কিন্তু কবি
ভবভূতির ক্রান্তদর্শিতা তাঁকে এমন একটা লোকোত্তর বোধে উৰ্ত্তীৰ্ণ করেছিল যেখানে
তাঁর কাছে প্ৰতিভাত হয়েছিল যে, নারী সমাজে কখনও সুবিচার
পায়নি–যথা স্ত্রীণাং তথা বাচাং সাধুত্বে দুর্জনো জনঃ।’
গ্রামবাংলার মানুষের মুখে ফেরে ডাইনিদের লোমহর্ষক কাহিনী।
তাদের নির্মম কাহিনী কারণে কালে কালে হাজার হাজার ঐন্দ্রজালিক, ডাইনি হত্যা করা হয়েছিল।
ঐতিহ্য-পরম্পরায় নারীকে এক ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বোধ
হতে পারে। নামে নারীই 'শক্তি',
কিন্তু শক্তি সাধনের ষটকর্মে সাধনসঙ্গিনীর যে সব লক্ষণ
নির্দেশ করা হয়েছে,
তার থেকে সম্মাননা বা অবমাননার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অমৃতভাষিণী ও মন্ত্রসিদ্ধকারী মোহময়ী কুহকিনী, সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পদ্মিনী নারী শান্তিদায়িনী অপর পক্ষে রক্তনেত্রা, নির্লজ্জা,
হাস্যহীনা, নিদ্রালু ও বহুভক্ষিণী
উল্লেখ করা যায়। কিংবা ভূত-পেত্নি-ডাকিনী-যোগিনী-শাকচুন্নি, অশরীরী...ভূত,
প্রেত, পেত্নী, ব্রহ্মদৈত্য,
পিশাচ, তাল, বেতাল,
একানড়ে, ডাইনী, বাইনী,
শাঁকচুন্নী, যক্ষ, মামদো,
গোভূত, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে কোথাও কোথাও নারীদের সম্মানিত করার তথ্য পাই। বিরল এই
ঘটনা আমাদের সভ্যতার অন্যতম পীঠস্থান পুণ্ড্রে পাই।
নারীর অনিবার্য আখ্যান
পুণ্ড্র বা বরেন্দ্র অঞ্চলের কথিত আছে, রাজাদের মধ্যে রামপালের বিশেষ খ্যাতি ছিল ন্যায়বিচারক হিসেবে। পুত্র যক্ষপাল
এক প্রজার পত্নিকে ধর্ষণ করায় তাকে প্রাণদণ্ড দিয়েছিলেন তিনি। তখন শোকে কাতর হয়ে
ব্রহ্মপুত্র নদে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন তাঁর পত্নি ও পুত্রবধূ।
নারীর সম্মান দেবার এই আখ্যান অনিবার্য ভাবেই চলে আসে। যেমন
ভাবে ভবানন্দ বিপন্ন হয়ে দেবীকে ডাকলেন। ভক্তের স্তবে তুষ্ট হয়ে মহামায়া ভূতসেনা
পাঠালেন,
তারা দিল্লি আক্রমণ করলে--
ডাকিনী যোগিনী শাঁখিনী পেতিনী গুহ্যক দানব দানা।
ভৈরব রাক্ষস বোক্কস খোক্কস সমর দিলেক হানা।।
"শীতলা", "মনসা",
"ওলা" এইসকল দেবীর নামে মারণ ব্যাধির দাবী রূপে
প্রচলিত। বসন্ত রোগের "শীতলা দেবী", কলেরার "ওলা
দেবী" গ্রামে-গঞ্জে প্রচন্ডভাবে বিদ্যমান।
এইসকল দেব-দেবীরা আধ্যাত্মিক নন। এদের কেউ কালনাগিনীর মতো
ভয়ংকর। ষষ্ঠী,
নানাপ্রকারের চণ্ডী, নরমুণ্ডমালিনী
শ্মশানচারী কালী,
শ্মশানচারী শিব, পর্ণশবরী, জাঙ্গুলী প্রভৃতি অনার্য গ্রাম্য দেবদেবীরা এইভাবেই ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মকর্মে
স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়; দুই চারি
ক্ষেত্রে তাহাদের কিছু কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়।’- (অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়/ বাঙালীর ইতিহাস আদি পর্ব, পৃষ্ঠা-৪৮১) থেকে জানি, ভুত প্রেতের আছর থেকে শুরু করে রোগব্যাধীর নিরাময় এমন কি সাপে কাটলেও তার
প্রতিকারের জন্য আলাদা আলাদা যাদুবিদ্যার আশ্রয় নিত এরা, আর এইসব কাজ করার জন্য নারী ওঝা ছিল!
Comments