পুণ্ড্রের পাঁচালী - ৬ ( কান পেতে থাকি )


পুণ্ড্রের পাঁচালী - ৬ ( কান পেতে থাকি )
সাজেদুর রহমান
করতোয়া নদী

পৃথিবীটা এক অদ্ভুত যায়গা। অনেক রহস্যময় ঘটনা এখানে ঘটে। আমরা বুদ্ধি দিয়ে যুক্তি দিয়ে তা বিচার করে ব্যাখ্যা করি। কখনো পারি। কখনো বা পারি না। মাঝে মাঝে আমাদের থমকে দাঁড়িয়ে যেটে হয়। বুদ্ধির অতিত রহস্যময়তা অভিভুত করে। যেমন ধরা যাক আজকের বাঙ্গালী ভুমিপত্রের আগমনের ব্যাপারটা।

এই জনপদের ভূমিপুত্র হলো দ্রাবিড়। যারা এসেছে সিন্ধু নদের তীর থেকে। এদের হাতেই রহস্যময় ভাবে বিলুপ্ত সিন্ধু সভ্যতা। ভারত বর্ষের মানচিত্র দেখলে বোঝা সম্ভব সিন্ধু নদ আর করতোয়ার দূরত্ব। উপমহাদেসের মধ্যাঞ্চল আর্যবরত পেড়িয়ে কোন পথে, কি ভাবে, ইতিহাসের কোন পর্যায়ে দ্রাবিড় দলটি এসেছে তা এখনো প্রত্নতাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যাতিত। দ্রাবিড় দলটি আসার সমসাময়িক কালা মঙ্গলিয় নামে আরেকটি মানব গোষ্ঠী এসে থাকতে পারে। এরা চীনের তিব্বত থেকে ব্রহ্মপুত্র নদী পথে এসে পাহাড়ি এলাকায় বসতী গড়ে। এই দুই জাতী মিলনে কোন না কোন নদীর অববাহিকায় বসতি স্থাপন করে।       

বাংলা জুড়ে মানুষের পদচারনার ইতিহাস কুসাচ্ছাদিত। শুধু এটুকু বুঝি যুগ শতাব্দী সহস্রাব্দী জুড়ে বাঙলার ইতিহাস রচনা করেছে এখানকার নদনদী। ব্রহ্মপুত্র করতোয়াসহ হাজারো নদনদী বাঙলাকে গড়েছে, বাঙলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করেছে। যুগে যুগে, এখনও করছে। নদী এই জনপদের প্রাণ।         


এই নদীর তীরে প্রাচীন কালে পুণ্ড্র জাতীর বাস ছিল

বৈদিক সাহিত্য মতে করতোয়া নদীর তীরে প্রাচীন কালে পুণ্ড্র জাতীর বাস ছিল। তারাই করতোয়া নদীর উর্বর প্লাবন ভূমিতে কৃষি কাজের সূচনা করে। আর সেখান থেকেই এই জাতী উন্নত কৃষিসভ্যতা গড়ে তুলেতে সক্ষম হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বহিঃশত্রু থেকে রক্ষাও করত এই করতোয়া। শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, আর্যদের হোমাগ্নি সরস্বতী তীর হতে ভাগলপুরের সদানীরা (করতোয়া) নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত এসে নিভে গেছে। অর্থাৎ সদানীরার অপর পারে অবস্থিত বঙ্গদেশের মধ্যে তারা ঢুকতে পারেনি।  

এই নদীর ইতিহাস সুপ্রাচীন এবং ইহার তীর্থমহিমা বহুখ্যাত। সেই পুরাকালে দাপুটে আর্যদের চোখে পুণ্ড্র জাতি অসুর-পাখি-হিন-মেলচ্ছ হলেও করতোয়া ছিল পবিত্র। মহাভারতের বনপর্বের তীর্থযাত্রা অধ্যায়ে করতোয়া পুণ্যতোয়া অর্থাৎ পবিত্র পানি। বলা হয়েছে, ‘করতোয়া-তটে তিনরাত্রি যাপন করলে অশ্বমেধ ফলপ্রাপ্তি ঘটে।‘ [মহাভারত, বনপর্ব, ৮৫ অধ্যায়(৩)]

করতোয়া নদীর নামকরণ নিয়ে একটি পৌরাণিক কিংবদন্তি আছে। কর অর্থ হাত, আর তোয়া অর্থ জল। হিন্দু দেবতা শিব হিমালয় পর্বতকন্যা পার্বতীকে বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে শিবের হাতে (কর) যে জল (তোয়া) ঢালা হয় সেই পানি নিঃসৃত হয়ে করতোয়া নদীর সৃষ্টি।

লঘুভারতেবলা হয়েছে,বৃহৎ পরিসরা পুণ্য করতোয়া মহানদী। এছাড়াও যোগিনী-তন্ত্ৰ, স্কন্দ-পুরাণ, কুমারিকা-খণ্ড, বুরুঞ্জি-সহ প্রাচীন গ্রন্থে করতোয়াকে হিরক নদী বলে সম্বোধন করে বলছে, এই নদী তীরেই গড়ে উঠা বিখ্যাত জনপদ প্রাচীন পৌন্ড্রবর্ন্ধন নগর, ঘোড়াঘাট সরকার বা প্রদেশের প্রধান শহর, বোগদহ সভ্যতা, পঞ্চনগরীসহ অনেক সভ্যতা। এক সময় করতোয়া ছিল তিস্তা নদীর প্রধান ধারা। আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন বাংলার রাজধানী (অশকের সাসনামলে) বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় (পুন্দনগল) এই নদীর তীরেই অবস্থিত ছিল।

করতোয়া নিয়ে সম্ভবত সবচেয়া প্রাচিন পুঁথি করতোয়া-মাহাত্ম্য’। বারো শতকের এই পুঁথিতে করতোয়াকে মহানদী বলা হচ্ছে আর করতোয়া তীরবর্তী পুণ্য পৌণ্ড্রক্ষেত্র বা পুণ্ড্রনগর পৃথিবীর আদি ভবন (আদ্যম ভুবোভবনম) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। করতোয়া-মাহাত্ম্য সুত্রে জানি, এক সময় করতোয়া স্ব-স্বতন্ত্র নদী হিসাবে সাগরে  পড়ত, কিন্তু এই কথার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাইনা। (লোকস্মৃতি সাগর বলতে বোধহয় কোন বৃহৎ জলস্রোতকে বোঝান হতো।)

করতোয়া-মাহাত্ম্য-এর সমর্থন পাই সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে। পৈতৃক সুত্রে পুণ্ড্রের অধিবাসি নন্দী বলছেন, গঙ্গা ও করতোয়ার মধ্যবর্তী দেশ পুণ্ড্রবর্ধনক বরেন্দ্র ভূমির মুকুটমণি, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থান। আর কাশ্মীরের কবি কালহনের রাজতরঙ্গিনীতে’ লিখেছেন, প্রাচীন নদী কলতু (আজকের করতোয়া)-   
পৌন্ড্র বর্ধনং ক্ষেত্রং নৈব মুনচতি কেশব
ধারিত্রা নাভি কমলাং প্লুতং করজৈলম
করতোয়া সদানীরে সবিৎ সুশ্রিতে
পৌন্ড্রান প্লায়েসে নিত্যং পাপং করোদ্ভাবে
(অর্থ পুন্ড্রবর্ধনের জলকাদায় আরর লৌকিক উৎসব কিংবা ধর্মীয় বা প্রাত্যেহিক জীবনের জড়িয়ে আছে)
 নদী ও জীবন 

এইসব মহাকাব্য এবং লিপিমালা থেকে জানতে পারি, সপ্তম শতকে বরেন্দ্রীর পূর্বদিক ঘিরে, প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনের পূর্ব-সীমা দিয়ে, করতোয় প্রবাহিত হত। অন্তত, মধ্যযুগে করতোয়া পদ্মা-ধলেশ্বরীতে মলিত হচ্ছে। এ বিস্ময়ে নীহারঞ্জন রায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব গ্রন্থে বলেছেন উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রধান নদী করতোয়া উল্লেখ করেন-করতোয়া ভুটান সীমান্তের উত্তরে হিমালয় পর্বতের পাদদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে দার্জিলিং ও জলপাইকুড়ি জেলার মধ্যে দিয়ে পঞ্চগড় জেলার ভিতরগড় নামক স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দিনাজপুর জেলা হয়ে ঘোড়াঘাটের নিকট গাইবান্ধা জেলায় প্রবেশ করে গেবিন্দগঞ্জ থানা পশ্চিম দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বগুড়ার মহাস্থানগরের ভিতর দিয়ে পাবনা হয়ে যমুনায় পতিত হয়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থেও আমরা একই তথ্য পাই।

বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সপ্তম শতাব্দীতে কামরুপ ভ্রমণকালে পৌন্ড্রবর্ন্ধন (মহাস্থান) এর নিকট যে বিশাল কালুতু (কা-লু-তু) নদীর সম্মুখীন হয়েছিলেন, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজী তিববত অভিযানকালে বর্ন্ধনকোটের কাছে যে, গংগার চেয়ে তিনগুন বিশাল বেগবতী নদীর সম্মুখে উপস্থিত হয়েছিলেন সেই বেগবতী নদীই করতোয়া নদী।
জাও ডি ব্যারোস (১৫৫০) এবং কান্তেল্লি দা ভিনোলা (১৬৬৩) এই দুইব্রিটিশের নকশায় ‘কাওরা’ (Calor) অর্থাৎ করতোয়া এবং ফান ডেন ব্রোকের নকশায় (১৬৬০) আত্রাই ও করতোয়া অবস্থান দেখতে পাই। টেভারনিয়ার (১৬৬৬) Chativor; /Chativor করতোয়া প্রসস্ত নদী হিসেবেই উল্লেখ পাই।

১৭৮৭ সালের প্রবল বন্যায় করতোয়া তার পুরাতন গতিপথ পরিবর্তন করে। এর পরে উইলিয়াম হাণ্টার করতোয়াকে ব্ৰহ্মপুত্র বছেন। ১৮১০ খ্ৰীষ্টাব্দে জনৈক যুরোপীয় লেখক বলিতেছেন, করতোয়া “was a very considerable river, of the greatest celebrity in Hindu fable” ১৮৫২ সালে করতোয়ার সাবেক ধারাটি পুনুরুজ্জীবনের জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহন করে। করতোয়া খনন করা হয় এবং বাঁধ নির্মাণ করে এর প্রবাহ সাবেক পথে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। কি করতোয়ার গতি পরিবর্তনের উদ্যোগ ব্যর্থ হলে ১৮৬৫ সালে টোল আদায়ের আদেশ রহিত করা হয়।      
       
উনবিংস শতাব্দীতে রেনেল বাংলার বিস্তারিত নদী জরীপ চালান। এখানে করতোয়া গতিপথ পাই। শত বছর পরে সেই পথের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলার জনজাতীর প্রত্ন গবেষণায় পুণ্ড্র অঞ্চলে কাজ করতে সেই রেনেলের মানচিত্র গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে নদীর গতিধারা জানতে পারলে অতিতের কথা জানা সম্ভব হিবে।

ঠিক এই কথাই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ তার রাজপথের কথায়। এই কাহিনীর নায়ক
সময়ক। যে চলে নদীর স্রোতের মতো। সময়কে দিয়ে লেখক বলাচ্ছেন যেন, পুরাতন কথা যদি শুনিতে চাও তবে (নদীর) এইখানে (তীরে) বইস; মনোযোগ দিয়া জলকল্লোলে কান পাতিয়া থাকো, বহুদিনকার কত বিস্মৃত কথা শুনিতে পাইবে।

জীবনের গভীরতম বোধকে রবীন্দ্রনাথ অনুভব করতে পেরেছিলেন। সেই গভীরে যেতে চেয়েছি, কিন্তু তারা অন্তরের এতই নৈশব্দ, যে আমি তুলে আনতে পারি না। দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী জেগে আমি করতোয়ার তীরে অপেক্ষা করি। বার বার হাত ফসকে যায়। কোন দিন কি পারব সেই মহান বোধকে স্পর্শ করতে? নিজেকে বোঝাই প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে বলেই মানুষকে সোময়ের এক আশ্চর্য তরঙ্গে ভাষীয়ে নিয়ে চলছে। সারাজীবন প্রতিটি মানুষ সেই তরঙ্গের দোলায় দোলায়। আমি অপেক্ষা করি।
#

সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী 
০১৯১২০৭৮৫৯৩

 sajedurrahmanvp@gmail.com


Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান