পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )


পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )
সাজেদুর রহমান
 বলির খড়গ 

আমি ঘুরে-ফিরে একটা স্বপ্নই দেখি – মীর বোরহান এবং তার সদ্যোজাত পুত্র সন্তানকে পাশাপাশি বসিয়ে রাখা হয়েছে। বোরহান মিনতি করে বলছে, হুজুর আমাকে শাস্তি দিন। আমার পুত্র সন্তানকে বাঁচতে দিন। তাকে বলি দেবেন না। বোরহানের শিশুসন্তান চিৎকার করছে – বাবা আমাকে বাঁচাও, বাব...বাবা...। কিন্তু রাজা পরশুরাম কিছুই শুনছে না – সে ঠাকুরকে বলল, প্রথমে বোরহানের দুটি হাত কেটে ফেলো।

পুণ্ড্রের কালীমন্দিরে লোক জমে যাচ্ছে। একজন পুরহিত শিশুটিকে কালীর সামনে রাখা হাড়িকাঠরে উপর শুয়ে দিলো... কাপালিক বলির মন্ত্র পড়ছে..., হ্রিং, ফট... স্বপ্নের এই যায়গায় আমি জেগে উঠি। আমার বুক ধক ধক করতে থাকে। পানির পিপাসা হয়। নিজেকে ধাতস্থ করতে অনেক সময় লাগে। বিছানায় চুপচাপ বসে হাঁপাতে থাকি। এই সময় মনেপরে পুণ্ড্রের নিষ্ঠুর শাসক পরশুরামের কথা।

এক সময় পরশুরাম পুণ্ড্র তথা মহাস্থানের শাসন করতেন। তার প্রাসাদ এখনো টিকে আছে। কাজী মেছের আলীর ‘বগুড়ার ইতিকাহিনী’তে পরশুরামের নরবলির কাহিনীটি পাই। তাতে বলা হচ্ছে, “১০৪৩ সালে মহাস্থানগড়ের পাশে মথুরা নামক গ্রামে মীর বোরহান নামের এক মুসলমান বাস করতেন। বোরহানের কোন সন্তান না থাকায় তিনি মানত করেন, আল্লাহ যদি তাকে একটি সন্তান দান করেন তাহলে তিনি একটি গরু কোরবানি করবেন। এরপর তার এক পুত্র সন্তান জন্মলাভ করলে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বোরহান একটি গরু কোরবানি করেন। একটি চিল এক টুকরা গরুর মাংস নিয়ে পরশুরামের প্রাসাদ চত্বরে ফেলে। রাজা পরশুরাম এতে ক্ষিপ্ত হন এবং বোরহানের দুহাত কেটে নেওয়া হয় এবং তার শিশুপুত্রকে মা কালীর মন্দিরে নরবলি দেওয়া হয়। মনের দুঃখে বোরহান বিবাগী হয়ে যান, পথিমধ্যে তার সাথে দেখা হয় শাহ সুলতানের; বোরহানের সব কথা শুনে শাহ সুলতান পরশুরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং পরশুরামকে পরাজিত ও হত্যা করেন।

নরবলির প্রথা আমাদের কাছে এখন নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত বলে মনে হলেও হিন্দু ধর্মে এক সময় তা মনে হয়নি। প্রাচীন সমাজে প্রথাসিদ্ধ ছিল। নরবলি দেওয়া হতো ক্রুদ্ধ দেবতাকে সন্তুষ্ট কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের সাধারণ লাভ-ক্ষতির কথা বিবেচনা করে।

আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে আদি পুণ্ড্রের কৃষিভিত্তিক সমাজে নরবলির ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেসমাজে নরবলির রক্ত ছড়িয়ে দিত ফসলের ক্ষেতে। ভাবত ফসলের দেবী তুষ্ট হবেন। ক্ষেতে ভরে উথবে ফসলে। তাছাড়াও সেই রক্ত দিয়ে উপাসনা স্থান পরিষ্কার করার রীতিও প্রচলিত ছিল। কখনো কখনো গণনরবলিও সংঘটিত হতো; যেমন দ্রাবিড়দের কৃষিভিত্তিক নগর সভ্যতার প্রাককালে।
 বলি দিচ্ছে 
ড. আর এম দেবনাথ (সিন্ধু থেকে হিন্দু), শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার (লাইফ ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া) সহ অনেক ইতিহাসবিদ মনেকরেন দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী প্রাচীন বাংলায় এসেছিল। তাদের ধর্মীয় ক্রিত্তে নরবলির প্রথা ছিল। বাঙালী সনাতন ধর্মাবল্মবী হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মে দ্রাবিড়ের রয়েছে গভীর প্রভাব।

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতেহিমালয় পার হয়ে মহাস্থানের পথে যেতে যেতে অযোধ্যার রাজা অম্বরীষ অশ্বমেধ যজ্ঞের পশু হরণ করেন অম্বীষের পুরোহিত বলেনরাজার দোষে পশু অপহৃত হওয়াতে রাজাকে নরবলি দ্বারা প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে রামায়ণে নরবলির প্রথম উদাহরণ পাই মহর্ষি ঋচিকের মাধ্যম পুত্র শুনঃশেফক। কালিকা-পুরাণে নরবলির লোমহর্ষণ ব্যাপার পড়লে আমাদের হৃৎকম্প হয়। কিন্তু দেবীকে প্রসন্ন করবার নিমিত্ত নরবলি শ্রেষ্ঠবলি গণ্য হইত। মহাভারতের আদিপর্বে দ্বিসপ্ততিতম অধ্যায়ে নরবলির তথ্য পাই।      

কালিকা-পুরাণে নরবলির জন্য শত্রুরাজ্যের রাজপুত্র উত্তম বলছে। ব্রাহ্মণ ব্যতীত অপর উচ্চজাতির যুবককে কয়েকদিন ভালোমতো খাওয়ানো হতো। তার পরে তাকে দেবীর প্রীত্যর্থে বলি দেওয়া হত। পূর্ববঙ্গে দুর্গাপূজায় নবমীর দিনে নির্দিষ্ট যুবককে মানকচুর পাতায় মুড়ে হাড়িকাঠে চাপিয়ে বলি দেওয়া হয়। পুণ্ড্রের আদি ইতিহাসে লক্ষ্মীমূর্তি সামনে কুমারীকে বলি দেওয়া হত। তার পরে সেই কুমারীর সদ্যছিন্ন রক্তমাখা হৃদপিণ্ডটি রচনার পাতালে রেখে পুরহিত ছড়ামাম্মাকে প্রশ্ন করতেন- মা, তুমি তুস্ত হয়ে রইলে তো?                      
হিন্দু ধর্মাবলিম্বদের মধ্যে তান্ত্রিকদের একটা বিশেষ দল ছিল, যাদের বলা হতো কাপালিককাপালিকরা নরবলি দিত। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় (বাঙালির ইতিহাস; দ্বিতীয় খণ্ডে) লিখেছেন, তান্ত্রিকরা অনেক বীভৎস আচরণ করতো। বলি প্রদত্ত মানুষের বুকের ওপর বসে করত ধ্যান। তারা ভাবতেন এভাবে লাভ করতে পারবে মহাশক্তি। এমনকি অমরতা। কখনো কখনো তান্ত্রিকরা বলির মৃতের মাথার খুলিতে উলঙ্গ নারীপুরুষ সুরা পান করত     

নীহাররঞ্জন রায় উল্লেখ করেছেন এক সময় বাংলাদেশে (পুণ্ড্রবর্ধনসহ) অনেক কাপালিক ছিল। ছিল আরও বিভিন্ন প্রকারের তান্ত্রিক সাধক। শারদীয় পূজার নবমী তিথীতে অথবা জয়ন্তিয়া রাজকুমারদের জন্মাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে নরবলি দেয়া হতো। চরগণ অন্যান্য রাজ্য থেকে বলির জন্য মনুষ্য সংগ্রহ করত। নরবলির জন্য মনুষ্য সংগ্রহকারীদের নাম খোজকর বলা হতো।                

‘খোজার ভিটা’ নামে একটা স্থান আছে মহাস্থানে তথা পুণ্ড্র এলাকায় যা এখন শিবগঞ্জ উপজেলায়। এছাড়াও নরবলির সাথে সম্পৃক্ততার ইতিহাস পাই বিষমর্দন ঢিবি, ডাকিনির ধাপ, কালীতলা হাট, কালীতলা হাট, মানকালীর কুন্ডধাপ , কালীদহ সাগর।

কালীদহ সাগর শিবগঞ্জের আমতলীতে কালী সদনে এক সময় নরবলির প্রচলন ছিল।
‘এখানে বিশেষ গণনা না করিয়া একেবারে দলে দলে বলি প্রদান করা হয়’ এমনটাই জানালেন এখানকার এক পুরহিত। এখন এখানে মাঘের অমাবস্যায় কালীপূজার রাতে শত শত পাঁঠা বলি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। সেই দিনে মেলা বসে। স্থানিয়রা এই পূজাকে ও মেলেকে পাঁঠাবলির মেলা বলে।

পাঁঠাবলির মেলা দেখতে গিয়েছিলাম ২০১৫ সালে। সেবার চার শতাধিক পাঁঠা বলি হয়েছিল। বলির কাজ শুরু হয় বিকেলে। প্রথমে পাঁচটা পাঁঠা বলি হয়। সেই পাঁঠা গুলকে উপস্থিত পূজারিদের মধ্যে বিচিত্র কায়দায় দিয়ে দেওয়া হয়। তার পর থেকে থেকে বলি চলতে থাকে। সারা রাত ধরে চলে। এখানে কথা হয় এক কাপালিকের সাথে             

কাপালিক আফসোস করে বলেন, নরবলির প্রথা আর নেই, বিধাতাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বছরে ২/১ শত নরবলি দিলেও বিধাতা খুশী থাকতো, যুগে যুগে বিধাতাকে বঞ্চিত করায়, একা ১৯৬৯ সালে বিধাতা লাখের বেশী মানুষকে নিয়ে যায়; বুঝা যাচ্ছে, নরবলি নেয়ার বিধাতা কোথায়ও যায়নি; আছে, চুপ করে আছে; মানুষ যদি নরবলি না দেয়, বিধাতা নিজ হাতেই কাজ সারবে!

ষাটোর্ধ কাপালিকের কাছে নরবলি নিয়ম জানতে চাইলে বেস আগ্রহ ভরে সে সব বলল। এখন যেখানটাকে ‘কালীতলা হাট’ বলা হয় সেখানে এবং মাঝিড়া গ্রামে উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে নরবলির প্রচলন ছিল। এই দুই গ্রামের কালী মুক্তির প্রতিষ্ঠা ও পূজা পণ্ডিতসা কর্তৃক প্রবত্তিত হয়েছিল। সেখানে তাঁর পিতা নরবলি দিতেন।           
    
হিন্দু শাস্ত্র মতে একটি নরবলিতে দেবী সহস্র বৎসর তৃপ্তি লাভ করেন, আর তিনটি নরবলিতে লক্ষ বছর তৃপ্তি লাভ করেন। মনুষ্য মাংস দ্বারা কামাখ্যা দেবী এবং আমার রূপধারী ভৈরব তিন হাজার বৎসর তৃপ্তি লাভ করেন। বলে জানালেন সেই কাপালিক। 

বলির পদ্ধতি তিনি জানালেন সবিস্তারে। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায়, চন্দ্রহাস বা কর্ত্রী দ্বারা বলিচ্ছেদ করাই উত্তম। বলি দেয়ার আগে হে খরগ তোমার নাম অসি, বিশসন, তীক্ষ্ণধার, দুরাসন, শ্রীগরভ, বিজয় এবং ধর্ম পাল, তোমাকে নমস্কার করি“ উচ্চারণ করে , হ্রিং, ফট এইমন্ত্র দ্বারা খরগকে পূজা করিয়া সেই বিমল খরগ গ্রহণ করিয়া বলিচ্ছেদকরতে হয়।

বলির বর্ণনা দেওয়ার সময় কাপালিকের চোখ দুটি চক চক করছিল। সে বলেই চলল, তারপরে ছিন্ন বলির রুধির জল, সৈন্ধব, সুস্বাদু ফল, মধু, গন্ধ ও পুষ্পের দ্বারা সুবাসিত করিয়া ওঁ, ঐঁ, হ্রীঁ, শ্রীঁ কৌশিকি এই রুধির দ্বারা প্রীতিলাভ কর, এই মন্ত্র উচ্চারণ করে যথাস্থানে রুধির নিক্ষেপ করিয়া ছিন্ন মস্তকের উপর প্রদীপ জ্বালাইয়ারাখতে হত এবং, ‘এইরূপে সাধক বলির পূর্ণ ফল প্রাপ্তহত।...বলি দ্বারা মুক্তি সাধিত হয়, বলি দ্বারা স্বর্গ সাধিত হয় এবং বলিদান দ্বারা নৃপতি গণ শত্রু নৃপতি গণকে পরাজয় করিয়া থাকেন।    

নরবলির প্রথা পুণ্ড্রবর্ধনের বিভিন্ন অঞ্চলে ছিল। ঠাকুরগাঁ-এর বিষহরী মন্দিরে, দিনাজপুরে মোসান কালীর মন্দিরে, রাজশাহীর দেও রাজার দরবারে নরবলির কথা জানতে পারি। বাংলা একাডেমীতে রক্ষিত একমনি এক কাহিনীর কথা জানতে পারি। এই কাহিনী মহাস্থানের শাহ সুলতান, বোরহান ও পরশুরামের সাথে মিল আছে।

গল্পটা এমন- দেও রাজার মহাকাল মন্দিরে নরবলির নিয়ম ছিল। তো সেই নরবলি রেওয়াজে একজন নাপিতের দুই ছেলেকে বলি দেওয়া হয়। নাপিতের তৃতীয় এবং শেষ পুরত্র সন্তানকেও বলি দেওয়ার কথা জানিয়ে দেয় অত্যাচারী তান্ত্রিক দেও রাজা।            

পুত্রের জীবন বাঁচাতে সেই নাপিত এক মুসলিম সাধকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। সাধক তাদের অভয় দিয়ে বললেন, তোমরা নিশ্চিন্তে বাড়ী চলে যাও, তোমার ছেলেকে কেউ বলী দিতে পারবে না, আর খুব শীঘ্রই এই দেও রাজার পতন হবে, নরবলি প্রথাও থাকবে না।              

পরের দিন সকাল। দেও রাজার মহাকাল মন্দিরে পূজার আয়জন চলছে। দেওরাজ মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে নরবলির যোগাড় যন্তর কাজ তদারকি করছেন। মন্দিরের পুরোহিতদের একজন বললেন, হুজুর আপনার দুই ভাই আসলেই নরবলির প্রক্রিয়া শুরু করা যায়। এদিকে মন্ত্রপূত জল দিয়ে যূপকাষ্ঠটি ধোয়া হচ্ছে। ধোয়ার কাজে নিয়োজিতদের উদ্দেশ্যে পুরোহিত হাঁক ছাড়লেন, কই! বলীর নর কে আনা হলো?        

বলীর জন্য যাকে রাখা নাপিত ও তার ছেলেকে স্নান করিয়ে পুরোহিতের সামনে আনা হয়েছে। পুরোহিত পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন সেই ছেলের। তারপর নাপিতের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন, “তিনটা ছেলেকেই মহাকাল দেবতার কাছে সমর্পণ করলি, তুই তো পুণ্যে আমাদেরকেও ছাড়িয়ে যাবি রে!

নাপিত কাঁপতে কাঁপতে সেখানে বসে পড়লো। গাম্ভীর্যের সাথে পুরোহিত ইশারা করলেন ছেলেকে যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। দেওরাজকে বুলেন, বলী কাজটা দ্রুত শেষ করতে হবে, যোগ সময় আর খুব বেশি হাতে নাই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকঢোল বেজে উঠল। দেওরাজা হিসেবে পরিচিত এই দুই ভাই প্রকৃতপক্ষে মন্দিরের বিগ্রহের সামনে যজ্ঞ শুরুর জন্যে দাঁড়িয়ে গেলেন। পেছনে অন্য পুরোহিত গন, আর একজন যূপকাষ্ঠের বলী তদারকি করছেন। যোগ সময় শুরু হতেই বলীর জন্য হাত ইশারা করলেন রাজাদ্বয়।

বলীর দায়িত্বে থাকা পুরোহিত কাপালিককে আদেশ দিলেন বলী শুরু করতে। কাপালিক নাপিতের ছেলের গর্দানে কোপ বসালেন। কাপালিক পর পর তিন বার কোপ বসালেন। বিস্ময়ের ব্যাপার বলি হলো না। কাপালিক একটু অবাক হয়ে গেলো। পুরোহিত বিব্রত। তাড়া দিলেন, আবার করো! আবার কোপ বসালেন। কাপালিক এবার ভয়ে দুই পা পিছিয়ে আসলো, হাত জোড় করে দাঁড়ালো পুরোহিতের সামনে।
এদিকে দেওরাজ সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন, অন্য পুরোহিতরা অনেকেই পেছন ফিরে দেখার চেষ্টা করছেন কি সমস্যা হলো। বলীর পুরোহিত তো রাগে অগ্নিশর্মা!!
অকর্মার দল! গজগজ করতে করতে নিজেই ক্রমাগত বলী দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন।

হঠাৎ করে ঢাকঢোল বন্ধ হয়ে গেলো, মন্দিরের ভেতর থেকে ভেসে আসলো চিৎকারের শব্দ। হুড়োহুড়ি করে বের হয়ে আসছেন পুরোহিতরা। যূপকাষ্ঠ ফেলে বলীর পুরোহিত মন্দিরের ভেতর উঁকি দিলেন। তাকিয়ে দেখলেন প্রচন্ডভাবে দুলতে শুরু করেছে বড় বিগ্রহ, যেকোনো মুহূর্তে আছড়ে পড়বে দেয়ালে। দেওরাজ তখনো ভেতরে, তারা মন্দির থেকে বের হননি।

এক মুহূর্ত সেই বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে আবার যূপকাষ্ঠের দিকে তাকালো সেই পুরোহিত। সেটা তখনো দুলছে, কাছে গিয়ে যূপকাষ্ঠ থেকে ছেলেটিকে আলাদা করে ফেললো। ধীরে ধীরে থেমে গেলো বিগ্রহের দুলুনি।

সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর করনীয় ঠিক করতে পুরোহিতরা সবাই ঢুকে পড়লেন মন্দিরের ভেতর। বাইরে রুদ্ধশ্বাস হয়ে ঘটনাটা দেখছে নাপিত পিতা। মন্দিরের ভেতর গুঞ্জন শুরু হলো, কিছুক্ষণ পরেই একজন পুরোহিত বের হয়ে এসে ঘোষণা করলেন, “এই নরের দোষ আছে! এই নরের বলী হবে না!

আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো নাপিত পিতা। তার দেহে যেন নড়ার শক্তিটিও অবশিষ্ট নাই আর। দেখলেন তার সন্তানের বাঁধন খুলে দেয়া হচ্ছে, তবু নিজের চোখকে যেনো বিশ্বাস করতে পারছ না সে। ছেলেটি অবাক দৃষ্টিতে দেখছে নিজের শরীরের বাধন খোলার দৃশ্য। এ যেন যমের বাড়ীতে উঁকি মেরে ফেরত আসা, নতুন জীবন ফিরে পাওয়া।

মহাকাল গড় রাজ্যে যখন এই নাপিত পরিবারের কাহিনী নিয়ে চলছে তুমুল কানাঘুষা, ঠিক সেই সময় অতি গোপনে সৈন্য সামন্ত সংগ্রহ করছেন সেই মুসলমান সাধক যার নাম শাহ মখদুম আক্রমণ করে এবং দেও রাজার সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়।

সম্ভবত সেই থেকে নরবলির প্রচলন বন্ধ হয়। নরবলি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন –
"যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে
ভাঙো ভাঙো আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে
  ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।"
#

সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী 
০১৯১২০৭৮৫৯৩
 sajedurrahmanvp@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পিশাচী সাজেদুর রহমান