পিশাচী সাজেদুর রহমান


পিশাচী
সাজেদুর রহমান
 ত্রিভুবন মোহিনী উপদেবী কর্ণপিশাচী। রূপক ছবি। নেট থেকে সংগৃহিত। 

রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর।
হার হিম করা রাত। পুরোনো বাড়ির একটা সুন্দর কক্ষে তান্ত্রিক সারশূন্য নিঃশঙ্কচিত্ত।  
পিশাচ সাধনা-বিষয়ক একটি গ্রম্থ তার হাতে এসেছে। তিনি জয়েন উদ্দিনের সিদ্ধান্ত নির্ণয় করতে বসলেন। জন্মস্থান-লগ্ন ও কুষ্ঠী হিসেব করে অত্যন্ত নির্ভুল থিকুজীর হিসেব করলেন। পানি তত্ত্বের জাতককে অপরাধ প্রবণতাকে কী কল্যাণ কর পথে আনার যন্ত্রের খসড়া আঁকতে পেরে তিনি মুগ্ধ। তাঁর ইচ্ছা করছে এখনই মোক্ষম যন্ত্র আঁকলে কেমন হয় তা দেখতে।
নিঃশঙ্ক চিত্ত গঞ্জিকা হাতে জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসলেন। কল্কিতে লম্বা টান দিলেন। রাতের শেষ প্রহরে চতুর্দশীর চাঁদের ফিকে আলো। বাড়ির ভেতর থেকে একটা বিড়ালের বাচ্চা মানুষের বাচ্চার মত করে কাঁদছে! নিঃশঙ্ক চিত্ত হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তার গা ছমছম করছে। যেন অশুভ কিছু তার জন্যে অপেক্ষা করছে। ভয়ঙ্কর কিছু। এমন সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
নিঃশঙ্ক চিত্তেকে চমকে দিয়ে কে একজন মিষ্টি গলায়, তান্ত্রিক নিঃশঙ্ক চিত্ত...ও।
নিঃশঙ্ক চিত্ত চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ভয়ে সে অস্থির হয়ে গেল। ফুলের গন্ধে চারদিক ম-ম করছে। কোত্থেকে আসছে এত মিষ্টি সুবাস?
কে, কে? কে কথা বলে?
মিষ্টি গলা আবার শোনা গেলএ-ওমা, ভয়ে আপনি দেখি আমরা। যে দিন-রাত ডাকিনী-সাধনা, পিশাচ-সাধনার কথা বলে তার এমন ভয় পেলে চলে?
আপনে কে?
আমি পিশাচী। কর্ণপিশাচী।
নিঃশঙ্ক চিত্ত হতভম্ব গলায় বলল, কর্ণপিশাচী বলে কিছু নাই।
ওমা, আজ দেখি উল্টা কথা।
উল্টা না, এইটা সত্য।
এইটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমার কথা কিভাবে শুনছিস?
নিঃশঙ্ক চিত্ত বিড়বিড় করে বললেন, যে বিস্ময়কর ঘটনা এই মুহুর্তে ঘটছে সেটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
ভাল করে তাকা। তাকিয়ে দেখ তো কি ব্যাপার। বিনা আগুনে গাজা টানছিস যে। 
নিঃশঙ্ক চিত্ত প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তিনি হতভম্ব। আরে তাই তো, পিশাচী খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দেখতে কিশোরী মেয়েদের মত। শুধু চোখ দুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। মেয়েটাকে দেখা মাত্রই কলজেটা ধক করে বুকের পাজরে সজোরে ধাক্কা খেল। ভয়ে নয় মেয়েটার অসহ্য রুপের কারনে। ফুলের গন্ধ আসছে পিশাচী মেয়েটার গা থেকে। তার তাকিয়ে মিটিমিট হাসতে হাসতে বলল, দেখলেন?
নিঃশঙ্ক চিত্ত কিছু বলল না। বলবে কি? সে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছে।
কি, মুখে দেখি বাক্য নেই।
নিঃশঙ্ক চিত্ত মনে মনে রাম নাম জপ করতে লাগলেন। প্রশ্নের জবাব দিলেন না। প্রেতিযোনির প্রশ্নের জবাব দিতে নেই। জবাব দিলে তারা পেয়ে বসে। পিশাচী বলল, বিড়বিড় করে কি পড়ছিস? মন্ত্র?
পিশাচী খিলখিল করে হেসে উঠল। নিঃশঙ্ক চিত্ত আসলেই শরীর বন্ধন মন্ত্র পরছিলেন।
গৌরবর্ণা কর্ণপিশাচীদেবী। নেট থেকে সংগৃহিত

দোহাই দোহাই
তিন পীর।/ কিরপিন সবে নীর।।
লক্ষ্মী ও মনসা।/ মা কালী ভরসা।
দিলাম দেহ বন্ধন/ রক্ত বর্ণ চন্দন।।
ফুলের নাম জবা।/ পশ্চিমে রয় কাবা।
কাবার ঘরে ছয় কুঠুরী
তান্ত্রিকের মন্ত্রে গণ্ডগোল হয়ে গেল। দেহ বন্ধন মন্ত্র দীর্ঘ মন্ত্র। যা একবার আটকে গেলেই মৃত্যু নিশ্চিত। নিঃশঙ্ক চিত্ত তান্ত্রিকের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। লুটিয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। কিন্তু থেমে নেই তার মুখ। বির বির করতে করতে একবার তাকাল পিশাচীর দিকে। 
নিঃশঙ্ক চিত্ত? কি মন্ত্র? দেহ বন্ধন?  
পিশাচীর সঙ্গে কথাবার্তায় জড়াতে নেইএই সত্য জেনেও নিঃশঙ্ক চিত্ত কথাবার্তা শুরু করেছেন। তিনি ধমলের সঙ্গে বললেন, এই চুপ।
আমাকে ধমকাবি না। আমি কর্ণপিশাচীদেবী।
নিঃশঙ্ক চিত্তবাবু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন এবং তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বিকট একটা হাসি শুনলাম। ঘড় কাঁপিয়ে গাছপালা কাঁপিয়ে হো-হো করে কে যেন হেসে উঠল। তিনি দেখলেন, তন্ত্র শাস্ত্রের বর্ণনার অবিকল- দেবীর দেহ কৃষ্ণবর্ণ, লোচনত্রয় রক্তাভ, আকার খর্ব্ব, উদর বৃহৎ এবং জিহ্বা বন্ধুকপুষ্পের ন্যায় অরুণবর্ণ। দেবীর চারি হস্ত, এক হস্তে বরমুদ্রা, দ্বিতীয় হস্তে অভয়মুদ্রা এবং অপর হস্তদ্বয়ে একটি নরকপাল আছে। শরীর হইতে ধুম্রবর্ণ জ্বালা বহির্গত হইতেছে।
তান্ত্রিক নিঃশঙ্ক চিত্তের মনে খটকা লাগল। কর্ণপিশাচীদেবী হাতে দুটি নরকপাল থাকার কথা। কর্ণপিশাচী শীতল গলায় বলল, এখন বল আমার পুজার বলির কুমারী কি করলি? আমার আরেকটি নরকপাল লাগবে।
আমি জানি না।
কেন জানিস না?
তান্ত্রিক নিঃশঙ্ক চিত্ত বিছানায় শুয়ে পড়লেন। শীত শীত লাগছে। পায়ের কাছে রাখা চাঁদর বুক পর্যন্ত টেনে দিলেন। একটা হাত রাখলেন কোলবালিশের উপর। তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। মাথার ভেতরে সমুদ্র গর্জনের মতো শব্দ হচ্ছে। এ রকম শব্দ কেন হচ্ছে কে জানে? প্রচণ্ড ভয় পাবার পরে কি মানুষের শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড খানিকটা এলোমেলো হয়ে যায়?
তাঁর ঘুম ভাঙল অনেক সূর্য ওঠার আগেই। গত রাতে মোটামুটি ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই, তবু সন্দেহটা যাচ্ছে না। নিঃশঙ্ক চিত্ত বসে স্তব্ধ হয়ে আছেন। তিনি বিছানা থেকে নামলেন। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। পূর্বমুখী হয়ে বললেন, ওঁ প্রিয়দত্তায়ৈ ভূম্যৈ নম:
'নিগুম বিচারে সত্য'  সর্ট ফ্লিম থেকে সংগৃহীত। (#NigumBichareSotyo #TaranathTantrik #HoichoiOriginals Nigum Bichare Sotyo



সূর্য এখনো পুরোপুরি ওঠে নি।
পূর্বআকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘন রক্তিম মেঘের যে বিচিত্র সৌন্দর্য আছে তা নিঃশঙ্ক চিত্ত আগে লক্ষ করেন নি। তাঁর দৃষ্টি পশ্চিমের দিগন্তরেখায়। সকালের প্রথম আলোয় নদী দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল নদীটি পাচিল ঘেরা বাড়ির সঙ্গে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওই বাড়িটার সঙ্গে নদীর কোনো যোগ নেই। নদী দেখতে ভালো লাগছে না।
পশ্চিম আকাশের মেঘ পরিষ্কার হচ্ছে না, বরং গাঢ় হচ্ছে। নিঃশঙ্ক চিত্ত নিচে নেমে আসলেন। ভেতরের উঠোনে একটা বেদীর উপর সরেন চন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে পেতলের একটি বিষ্ণুমূর্তি। সে নিঃশঙ্ক চিত্তকে দেখতে পায় নি। নিঃশঙ্ক চিত্ত ডাকলেন, এই সরেন বাবু! সরেনবাবু ভয়াবহভাবে চমকে উঠল। হাত থেকে বিষ্ণুমূর্তি বেদীতে পড়ে ঝন ঝন শব্দ হল। এতটা চমকানোর কোনো কারণ নেই। নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, কী করছ?
সূর্যপ্ৰণাম করি। রাম নামে পূজা করছি।
নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, গেট খুলে দাও নদীতে স্নান করতে যাব। এত কাছে নদী, স্নান করে সূর্যপ্ৰণাম দিয়ে দিন শুরু করতে চাই।
সরেন চন্দ্র আমতা আমতা করে বলল, ঠাকুর আমার কাছে গেটের চাবি নাই। হুজুরের কাছে আছে। আমি আপনার জন্যে পূজার ফুল নিয়ে এসেছি।
নিঃশঙ্ক চিত্ত তাকালেন। সরেন সামনে শালপাতা লবঙ্গ, ধুপ, দীপ, ফুল সুগন্ধি ইত্যাদি পুজোর সরঞ্জাম। লোকটি জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ হাসি হাসি। সেই হাসির আড়ালে গোপন একটা অহংকারও আছে। কিসের অহংকার, কে জানে।
সরেনবাবু!
জি।
আপনার সামনে ভয়াবহ বিপদের আলামত দেখতে পাচ্ছি।
পুরোহিত মসায় নিজেকে সামলাতে কিছু সময় নিলেন। পুরোপুরি সামলাতে পারলেন নাকাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আপনি কী আমাকে ভবিতব্য বললেন?
আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দুই হাতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, আপনার সামনে একটা ভয়াবহ দুর্যোগ। পারিবারিক সমস্যা। অসম বিবাহঘটিত সমস্যা।
গুরুদেব আমায় কৃপা করুন। কেন বললেন জানতে পারি?
অবশ্যই জানতে পারেন। আপনার হাতের বিষ্ণুমূর্তিটির এক চোখ নীলকান্তমণির। সেই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এই বিষ্ণুমূর্তি অশ্রু বর্ষণ ভয়াবহ বিপদের আলামত।
পুরোহিত মসায় আমার দিকে তাকালেন। পুরোহিত মসায়ের চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে, এই তো হয়েছে। আমার দিকে তাকানোর অর্থ হচ্ছে, আমাকে ইশারায় বলাজি, আপনার কাছে আশ্রয় খুঁজছি। আমাকে উদ্ধার করুন। 
আমি বললাম, দুর্যোগ হঠাৎ উপস্থিত হয়েছে।
পুরোহিত মসায় বললেন, হঠাৎ মানে কবে?
ধরুন এক মাস। তবে দুর্যোগ আপনি সামলাতে পারছেন না। আরো জটিল করে ফেলছেন।
পুরোহিত মসায় আবারো আমার দিকের তাকালেন। চোখের ইশারায় আবারো বললেন, কি আশ্চর্য? লোকটা কিছু বলবে বোধহয়ভঙ্গিটা সে রকম। সে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। বির বির করলেন। আমি ভাবলাম, এটা কি বিশেষ কোনো মন্ত্র নাকি?
বিষ্ণুমূর্তি বিষয়ে রহস্যময় কথা জানি বলেই জানালাম।
পুরোহিত মসায় বললেন, এই সমস্যাটা কখন মিটাবে?
মিটবে না।
তিনি হাহাকার করে উঠলেন, কী বলছেন আপনি! মিটবে না মানে?
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম, এই সমস্যা মেটার নয়। সমস্যা বাড়তে বাড়তে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে আসবে। এই সমস্যায় একটি বাচ্চা মেয়ে জড়িত। মেয়েটির মৃত্যুযোগ আছে। সে মারা গেলে হয়তোবা সমস্যা মিটে যাবে।

সরেনবাবু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাকে এখন আর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। বোধশক্তিহীন জম্বিরমতো দেখাচ্ছে।
রোদ উঠেছে। বাংলো প্যার্টের্নের বাড়ির ডানদিকে প্রাচীন কয়েকটা কাঁঠালগাছ। কাঁঠালগাছের পাতায় আলো-আঁধারের খেলা। একটু দূরে দুটো আতাফল গাছ। সোনালি রঙের আতাফলে পুরো গাছ সোনালি হয়ে আছে। পাকা আতার লোভে ভিড় করেছে। রাজ্যের পাখি। তাদের সঙ্গে ঝগড়া বেধে গেছে কাকদের। কান পাতা দায়। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, যাই।
লোকে অপযশ গায়,
জারজাত কংসরায়,
লেখা গেল দেবতাসভায়।
অষ্ট মাতৃকার মধ্যে দেবী চামুণ্ডা হলেন প্রেতরূঢ়া মানেরদেবীর বাহন এই প্রেতও ভীষণ শক্তিশালী ভূত। তন্ত্রে এই ভূতটির নাম কবন্ধঅর্থাৎ দেহ থেকে মস্তক আলাদা এমন কোন ভূতছবিটায় একটু ভুল আছে আসলে চিত্রকার (অভিষেক দাস/২০২০) এত কিছু বুঝে ছবিটি অংকন করেনি 

আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম। 
প্রাচীন বড় বাড়িগুলি সাধারণত যে-রকম হয়, সে-রকম একটা পুরনো ধরনের বাড়ি। এইসব বাড়িগুলি এমনিতেই খানিকটা বিষগ্ন প্রকৃতির হয়। এই বাড়ি দেখে মনে হল বিরাট একটা শোকের বাড়ি। খা-খী করছে চারদিক। লোকজন নেই।
ভেতরের উঠোনে বকুল গাছ থেকে একটা দুটা করে ফুল পড়ছে। ফুলগুলি দূর থেকে যত সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছেহাতে নেওয়ার পর তত সৌরভ দিচ্ছে লাগছে না। কিছু সৌন্দৰ্য দূর থেকে দেখতে হয়, কাছ থেকে দেখতে হয় না।
এমন একটা রহস্যময় পরিবেশে পেয়ারা গাছের নিচে ইসাহাক মীর কে দেখা যাচ্ছে।
বাড়ির সামনেই পুকুর। পুকুরের পানি কত পরিষ্কার হতে পারে সেটা এই পুকুর স্বচক্ষে না দেখলে জানাই হতো না। কাক চক্ষুজলের ভেতর উকি মারছে নীল আকাশ।   
ইসাহাক মীর বলল, ঠাকুর কী করছেন? ইসাহাকের গলায় চাপা কৌতূহল।
নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, কিছু করছি না। হাঁটছি, বাড়ি পরিদর্শন বলতে পার।

ম্যানেজার ইসাহাকের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। তান্ত্রিক মসায় গতকাল তাকে আপনি করে বলছিলেন, এখন তুমি বলছেন। শুরু থেকে তুমি করে বললে অস্বস্তি লাগত না। প্রথম কিছুক্ষণ আপনি বলায় লাগছে।
বিষ্ণুমূর্তি অশ্রু বর্ষণ বিষয়টা কী বলেন তো?
বিষয় কিছু না।
বিষয় কিছু না বললে তো হবে না। এ পৃথিবীতে কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না।
আমি হাসিমুখে বললাম, এই পুকুরের পানি কাঁচের মতো ঝকঝক করছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে শীত-বর্ষা, শরৎ-হেমন্ত সব সময় এই পুকুরের পানি এমনই ঝকঝক করে।
আসো নেমে পরি। তোমার সঙ্গে কাক চক্ষুজলে সাঁতার কাটব।
আমি সাতাঁর জানি না।
জানি না বললে তো হবে না। জলের দেশের মানুষ সাঁতার না জানাটা অপরাধ।
আসলে গুরুদেব এই পুকুরে দোষ আছে। প্রতিবছর একজন করে মানুষ খায়। সাঁতার জানা মানুষও সাঁতার ভুলে যায়। গতবছর রহিম মণ্ডলরে খাইছে। রহিম মণ্ডল সেরকম সাঁতার জানা মানুষ।    
গুরুদেব অপরাধ নেবেন না।
রহিম মণ্ডলরে কাহিনীটা বল।
আমি গুছিয়ে বলতে পারবো না। হুজুর ভালো করে বলতে পারবে।
আমি তোমার আগছাল বর্ণনাই শুনব। গোছানর থেকে আগছাল ব্যাপার আমার ভালো লাগে।
ছবি-দীপক গুহ ১৯৭৭। ছবির মধ্যমনি কোলকাতার হাতিবাগানের তান্ত্রিকাচার্য মনসারাম ভট্টাচার্য্য জ্যোতিঃশাস্ত্রী। মহাশক্তি-মহাকালী তারাপীঠের তারামায়ের দর্শনও নাকি তিনি পেয়েছিলেন। 
      
ম্যানেজার ইসাহাকের আগছাল কথা-
রহিম মণ্ডল ভাইয়ের পুকুর বাজারে অপেক্ষা করছেন। গভির রাত। তাঁর চাতালের বেবসা। মকামতলা থাকে ট্রাক করে ধান আসবে। ট্রাক আসবে ভোররাতে। কার্তিক মাসের শেষাশেষি। শীত যেমনতেমন কুসায় অস্থির। মাছা হাটির শেডের নিচে বসে সময় কাটানোর জন্যে ঢুকতে যাবেন হঠাৎ তার পা জমে গেল। বুক ধকধক করতে লাগল। মনে হল শেডের ভেতর অশুভ কিছু আছে। ভয়ঙ্কর কিছু। যে ভয়ঙ্করের কোনো ব্যাখ্যা নেই। লৌকিক কিছু না, অলৌকিক কিছু। তার উচিত কিছুতেই শেডের না ঢোকা। একবার ঢুকলে আর বের হতে পারবেন না।
ভয় ভাঙার দুর্বার সাহস করলেন। তিনি ভয়কে জয় করা বহুল প্রচলিত পথ ধরে শেডের ভেতর ঢুকলেন। শেডে যেখানে আড়ৎদারেরা বসে সেখানে একজন বৃদ্ধ লাল চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। বৃদ্ধের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে। রহিম মণ্ডল কাছে গেলেন। গলায় খাঁকারি দিলেন। বৃদ্ধ চোখ মেলল না, তবে তার ঠোঁটের কোনায় সামান্য হাসি দেখা গেল। শরীর জমিয়ে দেওয়া তীব্র ভয় রহিম মণ্ডলকে আবারো আচ্ছান্ন করল। তিনি প্ৰায় ছিটকে বের হয়ে এলেন।
বাকি রাতটা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি বাজারের ভেতর দিয়ে জাওয়া সিএনবি সড়কে পায়চারি করছেন। রহিম মণ্ডল সামনে গিয়ে পেছনে ফেরার আগে আরেকবার বৃদ্ধকে দেখলেন। বৃদ্ধ সিএনবি সড়কের ধারে বন্ধ টং-দোকানে বেঞ্চে ঠিক আগের শুয়ে আছে। মাথা নিচু এবং চোখ বন্ধ করে আগের মতোই সিগারেট টানছে। ঠোটের কোনায় আগের মতোই অস্পষ্ট হাসি।

চারদিক গাঢ় অন্ধকার।
বাতাস শীতল। কোনো শব্দ নেই। ঝিঝি পোকাও ডাকছে না। শুধু দূরে রাস্তা দিয়ে ট্রাক ছুটে চলার শব্দ হচ্ছে। রহিম মণ্ডল হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করল। তার মনেই রইল না, সে এখন দৌড়ে চলা মতো বয়সের না। তার পা খালি। জুতা-স্যান্ডল কিছুই নেই। এখন তার একটাই চিন্তাকত তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছানো যায়। সে বৃদ্ধ থেকে দূরে যেতে চায় যেখানে তার নিরাপত্তা থাকবে।  
যোগিনী সাধনার উপাচার 

অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়েছে। নক্ষত্রের আলোয় সব কিছুই আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। ভাইয়েরপুকুর বাজার থেকে রহিম মণ্ডলর বাড়িতে যাবার দুটা রাস্তা আছে। একটা মড়াদীঘির পাড় দিয়ে, অন্যটা সিএনবি সড়ক দিয়ে। দ্রুত আসা যাবে মড়াদীঘির পাশ দিয়েই। আজিজ মিয়া সেই পথ ধরল। যদিও এই পথে এখন লোক চলাচল করে না। ভয় পায়। রহিম মণ্ডল এখন যাবতীয় ভয়ের উর্ধে। তাকে যে ভয় তাড়া করছে সে ভয়ের কাছে আর সব ভয় তুচ্ছ।
মড়াদীঘির পাড়ে রহিম মণ্ডল থমকে দাঁড়াল। সড়কের ঠিক মাঝখানে কে যেন বসে আছে। বৃদ্ধ লকটি না? হ্যাঁ বৃদ্ধলকটি তোইয়াকুব মোল্লা। সে তো ঘুমাচ্ছিল। তার যে বয়স হয়েছে। সে এত দ্রুত এখানে রাস্তার মাঝখানে বসে আছে। কেন? রহিম মণ্ডল চিৎকার করে বলল, কে কে? কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হলো না।
রহিম মণ্ডল পেছনে ফিরল। পেছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। কে সে? নক্ষত্রের অস্পষ্ট আলোয় কিছুই পরিষ্কার দেখা যায় না। কিন্তু পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে সেও যে বৃদ্ধলকটি তা বুঝা যাচ্ছে। বৃদ্ধলকটির হাতে লম্বা ছুরি। কোরবানির সময় অনেককেই এরকম একটা ছুরি নিয়েই গরু জবাই করতে বের হয়ন। 
রহিম মণ্ডলর শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে রাস্তার মাঝখানেই সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। এটা করা যাবে না। তাকে পালাতে হবে। চিৎকার করে লাভ নেই, গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। তাকে পালাতে হবে। কোন দিকে সে পালাবে?
রহিম মণ্ডল রাস্তা থেকে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে শুরু করল। বৃদ্ধলকটিও ছুরি হাতে তার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। রহিম মণ্ডল ঠিকমতো দৌড়াতে পারছে না। রহিম মণ্ডল দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে দেখল। বৃদ্ধলকটি ঠোটের কোনায় পৈশাচিক হাসি মুখে এগিয়ে আসছেন।
এখন বৃদ্ধলকটি হেঁটে আসছেন না। বাতাসে ভেসে আছেন। শুধু পাইয়ের বুড় আঙ্গুল মাটিতে লেগে আছে। সে আঙ্গুল কাকের নখের মতো লম্বা-কালো। রহিম মণ্ডল আবার দৌড়াতে শুরু করল। সে কোন দিকে যাচ্ছে নিজেও জানে না। একবার মনে হলো সে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে, একবার মনে হচ্ছে সে আসলে দৌড়াচ্ছে না, বাতাসে উড়ছে। সামনে এটা কী? পুকুর না? রহিম মণ্ডল ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে পড়ল। পুকুরের পানি বরফের মতো ঠাণ্ডা। হাপা জমে যাচ্ছে। রহিম মণ্ডল খুব ভালো সাঁতার জানে। কিন্তু সে সাঁতার দিতে পারছে না। পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। পুকুর পাড়ে বৃদ্ধলকটি দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরের পানিতে তাদের ছায়া পড়েছে। ছায়া পড়ার কথা না। নক্ষত্রের আলোয় কোনো কিছুরই ছায়া পড়ে না। রহিম মণ্ডল ক্ষীণ স্বরে ডাকিল, ও জয়েন ভাই। ও জয়েন ভাই।


ষষ্ঠ মহাবিদ্যা দেবী ছিন্নমস্তা নিজের মস্তক ছেদন করে সেই রক্ত নিজেই পান করছেন। সাধকদের বিশ্বাস, একা ছিন্নমস্তার সাধনাতেই সমস্ত সাধনার ফল লাভ করা যায়।

রহিম মণ্ডলের এই ঘটনা কিভাবে জানলে?
হুজুর দেখেছেন। তার সামনেই রহিম মণ্ডল পুকুরে ঝাঁপ দেয়। তবে তিনি বুঝতে পারেন নি। অবশ্য বুঝতে পারলেও কিছু হতো না। পুকুর জাঁকা টেনে নেবে তাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।     
তান্ত্রিক নিঃশঙ্ক চিত্ত রসিকতার ঢঙ্গে বললেন, মনে হচ্ছে কেউ নিজেকে অদৃশ্য রেখে পুরা ঘটনা দেখেছে। তারপর আয়েস করে গল্প করে জানিয়েছে।
মানে?
মানে-ফানে কিছু না। তোমাকে অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র বলি।
বলেন।
আলি বা তা ছা-/ইয়া ফা ওয়া হা;
ক্বাফ আলিফের হরফন-/জ্বীন সূরার বাদশা।
দোহাই কামাখ্যা মা;/কেউ যেনো না দেখে মোরে-
দেখলে মা পদ্মা হবে"/রাবণের মহা স্বচ্ছর.!
ডানে থাক ইসরাফিল-/বামে থাক মনাইসা মা"
শরীর এক্ষণি গায়েব হয়ে যা!/বাক্যের দাপটে বাক্য লড়ে;
বাক্য যদি লড়ে চড়ে-/দোহায় মা পদ্মার মাথা জটা;
কার্তিকের পায়ে পড়ে।

মন্ত্রটা অদ্ভুত না?
হা, দারুণ ব্যাপার। হিন্দু মুসলিমের দ্বৈত রসায়নে তৈরি। আশ্চর্য! 
তুমি কি জানো আরবিতে কুমারীকে আনিসা বলে। আসি বেদেও তাই। 
ম্যানেজার ইসাহাক অভিভুত চোখে নিঃশঙ্ক চিত্তকে দেখছে।
আমি আনিসা সন্ধানে বের হবো। তার আগে জয়েন সাহেবের সাথা দেখা করব। তুমি বেবস্থা করো। 

চন্দন পালংকে শুয়ে।
জয়েন উদ্দিন সাধারণত দখিণা ঘরেই সময় কাটান। আজ তিনি শুয়ে আছেন। নিজের ঘরের পালংকে। সেখানে বাইরের লোকজনের প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু নিঃশঙ্ক চিত্তকে সরাসরি সেখানেই নিয়ে যাওয়া হলো।
ঘরে বিশাল এক রেলিং দেয়া খাট। খাটে তিনটা বালিশ পেতে আধশোয়া হয়ে জয়েন উদ্দিন এলিয়ে পড়ে আছেন। তার গায়ে কাশ্মীরি পশমি হলুদ রঙের চাদর। চাদরের নিচে একটু পরে পরেই তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন। খাটের রেলিং ধরে দাসী চিন্তিত এবং ভীত চোখে দাঁড়িয়ে আছে। জয়েন উদ্দিনের চোখ লাল তবে তিনি নেশাগ্ৰস্ত না। ঘরে এলকোহলের গন্ধ নেই। কর্পূরের গন্ধ আছে।
নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, আপনার কি শরীর খারাপ করেছে?
জয়েন উদ্দিন বললেন, শরীর ভালো না খারাপ সেই আলাপ পরে হবে। আপনি ঐ চেয়ারটায় বসেন।
দাসী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, উনার শরীর খুবই খারাপ।
জয়েন উদ্দিন ধমক দিয়ে বললেন, তোমারে কে কথা বলতে বলছে? আমার শরীর ভালো না মন্দ সেইটা আমি বুঝব। সামনে থেকে যাও।
দাসী চোখ মুখ শক্ত করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েই রইল। জয়েন উদ্দিন প্ৰচণ্ড ধমক দিলেনকঠিন গলায় বললেন, যাও ঘর থেকে। দাসী বের হয়ে গেল। জয়েন উদ্দিন বললেন, তান্রিক এখন আপনি আমারে জন্য যা করার করেন।
নিঃশঙ্ক চিত্ত কাছে গেলেন।
জয়েন উদ্দিন বললেন, কি দেখলেন?
নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, আপনার নাড়ি দ্রুত চলছে। আপনি কোনো একটা বিষয় নিয়ে খুব উত্তেজিত।
বিষয়টা কি আপনি অনুমান করতে পারেন?
জ্বি না। আমার অনুমান শক্তি ভালো না।
জয়েন উদ্দিন বিছানায় উঠে বসলেন। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তান্ত্রিক শোনেন, আমি সব সময় নানান উত্তেজনার মধ্যে থাকি। উত্তেজনায় থাকা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এতে আমার শরীর খারাপ করে না। ঘটনা ভিন্ন। আপনি আমার ঘটনোটা আগে শোনআজ পিশাচীকে দেখলাম। পিশাচী একেক দিন একেক ভাবে আসে। আজ এসেছে সম্পূর্ণ নগ্ন। গলায় নরমুণ্ডের মালা।
নিঃশঙ্ক চিত্ত কিছু বললেন, নরমুণ্ডের মালার তা‌ন্ত্রিক নাম মহাশঙ্খ।
জয়েন উদ্দিন বললেন, পিশাচীর ঘটনাটা বলার আগে আপনার কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। এই যে রহিম মণ্ডল পানিতে ডুবে মারা গেছেএই বিষয়ে আপনার অনুমান কী? কেন মরল?
নিঃশঙ্ক চিত্ত কিছু বললেন না। তিনি লক্ষ করলেন জয়েন উদ্দিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখছে। সে কি কিছু বলার চেষ্টা করছে? প্রশ্নের ভেতরেও লুকানো প্রশ্ন থাকে। লোকটির এই প্রশ্নের ভেতর লুকানো কোনো প্রশ্ন কি আছে?
নিঃশঙ্ক চিত্ত জয়েন উদ্দিন তীক্ষ্ণ চোখে চোখ রেখে বললেন, কয়েক দিন আগে আনন্দ বাজারে একটা অদ্ভুত খবর দেখলাম।
কলকাতার সবচেয়ে বেশি প্রচারিত সংবাদ পত্র আনন্দ বাজার। খবরটা কি?
বীরভূমের সদাইপুরে সাবিত্রী নামের এক অষ্টাদশী নারীর বিরুদ্ধে পিশাচ সাধনার নামে তার স্বামীর রক্তপান করত। এমনকী, সাবিত্রীকে প্রতিবেশীরা নগ্ন অবস্থায় বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে গভীর রাতে। ভয়ে, অন্ধবিশ্বাসে স্থানীয়রা খুব একটা ওই অভিশপ্ত বাড়ির ছায়া মাড়াতেন না।
রহস্যে ঘেরা কামরুপ কামাক্ষাবলা হয়, এখানে অনেক কালো জাদু সাধক ও যোগিনী রয়েছে যারা সেখানকার বিখ্যাত কামাক্ষা মন্দিরে এসবের চর্চা করে থাকেমূলত এই কামাক্ষা মন্দিরকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে এখানকার যাবতীয় রহস্য...

সম্প্রতি সাবিত্রীর স্বামী অভিজিৎ অসুস্থ হয়ে বর্ধমান হাসপাতালে ভর্তি হন। দুই দিনের মাথায় অভিজিৎ মারা যায়। অভিজিৎ-এর মা ছবি বাগদির পুলিশের কাছে অভিযোগে বলেন, পুত্রবধূর তন্ত্রসাধনার জেরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন অভিজিৎ। নিয়মিত তার রক্তপান করত অভিযুক্ত সাবিত্রী। পুলিশ অভিযুক্ত সাবিত্রীকে গ্রেফতার করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অভিজিতের মৃতদেহ গ্রামে এসে পৌঁছালেও শোকপ্রকাশ করতে দেখা যায়নি তার স্ত্রীকে। বরং সেই সময় নাকি ঘরের ভিতর থেকে মড়ার খুলি, কাটা আঙুল নিয়ে এসেও কিছু মন্ত্র পড়তে শুরু করে মৃতের সহধর্মিণী।
জয়েন উদ্দিন কঠিন গলায় বলল, আমি পিশাচ সাধনা করি না। আমি জানি না কিভাবে করতে হয়। এটা আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। আমাকে এই গল্প কেন বললেন?
জয়েন উদ্দিন কঠিন গলায় বলল, সাবিত্রীর ও তার মাত্রিকুল কাপালিক। তারা বংশপরম্পরা প্রেতযোনি সাধনা করে আসছে। তারা এর আগেও মানুষ খুন করেছে। খুনগুলি করেছে অতি কাছেরজনদের। নিজের ভাইঝি, প্রতিবেশী, আত্মিয়সজন। তাদের সঙ্গে আমার কি মিল পেলেন?  
নিঃশঙ্ক চিত্ত শান্ত গলায় বললেন, আমার ধারণা সাবিত্রীরদের মতো সাধকদের ব্যাপারটা আপনার মাথায় ঢুকে গেছে। আপনি তাদের মতো করে জীবন যাপন করতে চাচ্ছেন। আপনা বাড়িতে চাঁপা, পদ্ম, মালতিফুল, বেলপাতা, তুলসীর গাছ আছে, কোন  উগ্রগন্ধ অথবা একেবারেই গন্ধ নেই এরকম ফুলের গাছ নেই কারণ পিশাচ সাধকরা তাই করেন।
জবা তো গন্ধ নাই। আমার বাড়িতে সাত ধরনের জবা ফুলের গাছ আছে।
নারায়ণের পুজোয় জবা ফুলে করা হয় না। জবা ফুল লাগে শক্তিপুজোয়। এর কারণটা কি জানেন?   

জয়েন উদ্দিন উত্তর দিলেন না। তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছেন। তার হাতের মুঠি বন্ধ। প্রতিটি লক্ষণ বলে দিচ্ছে তিনি রেগে গেছেন। রাগ সামলাতে পারছে না। নিঃশঙ্ক চিত্ত জয়েন উদ্দিনর রাগটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হল না। যেন তিনি ধরেই নিয়েছেন জয়েন উদ্দিন রাগবেন। নিঃশঙ্ক চিত্ত চেয়ারে পা তুলে বসলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, জয়েন উদ্দিন সাহেব, আমি নিশ্চিত নারায়ণের পুজোয় জবা না দেবার কারণ আপনি জানেন। দেবী চামুণ্ডা বিষাক্ত কীট হয়ে জবার ভেতরে লুকিয়ে ছিল। তার পর সেই ফুল নিয়ে নীলাম্বর শিবপুজা করতে গেলে, ফুলের মধ্যা থাকা কীট শিবকে দংশন করলে, কীটের কামড়ে শিউরে উঠল শিব।       
দাসী আবার এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে। জয়েন উদ্দিন প্ৰচণ্ড ধমক দিলেনআবার কেন আসছ?
ধমকে দাসী কেঁপে উঠল, কিন্তু খাটের রেলিং ধরেই থাকল। নিঃশঙ্ক চিত্ত সহজ গলা বললেন, হীরামন তুমি এখন যাও।  
হীরামন দাসী চলে গেল। তবে তার চোখ ভর্তি পানি। অস্বাভাবিক একটা দৃশ্য।
কথিত এখানে যারা আসেন তারা ফেরে যেতে পারে নাকদাচিৎ কেউ ফেরে তাহলে শক্তিশালী তান্ত্রিক হয়ে ফেরান

জয়েন উদ্দিন নিচু করে বললেন, আপনার কি ধারণা আমিও মানুষ বিসর্জন দিচ্ছি? গ্ৰাম থেকে মানুষ ধরে এনে গোপনে বিসর্জন দিয়ে বাড়ির পেছনের পুকুরে ফেলে দিচ্ছি? এসব কে বলেছে? 
নিঃশঙ্ক চিত্ত গম্ভির গলায় বললেন, আমাকে কেউ বলে নি। আমি অনুমান করছি। এই অনুমানের পেছনে ভিত্তি আছে। তোমার সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে আমি লাইব্রেরিতে সাজানো বইগুলির উপর চোখ বুলিয়েছি। চামড়ায় বাঁধানো, সোনার জলে নাম লেখা বেশ কিছু পুরোনো বই দেখলাম। তন্ত্র সাধনা নিয়ে লেখা দুটা বই চোখে পড়েছে। একটার নাম বাচস্পতি মিশ্রের কুলরাম। একটা প্রাচীন পঞ্জিকা আছে বরেন্দ্রকুলপঞ্জিকা। এখন আপনি বলেন এই বইগুলি তন্ত্র সাধনার?
জয়েন উদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, না ব্যাপারটা সে রকম না।
অনেকেই মনে করে কাজটা আমি করায়েছি। ভয় দেখায়ে তারে পানিতে নিয়া ফেলছিঘটনা সত্য না। আমি মানুষরে শাস্তি দেই। আমি খুনি না। আমার অবস্থায় থাকলে এইগুলা করতে হয়। বুঝতে পারছেন?
পারছি। আপনার পুকুরের পানির মতো পরিস্কার। 
জয়েন উদ্দিন আহত গলায় বললেন, গল্পে আছে এক মহিলার এক ছেলের জন্ম দিয়েছে, গায়ের রঙ কালো। ধাত্রী তার বাড়ি ফিরে গল্প করল, অমুক মহিলার এক ছেলে হয়েছে। গায়ের রঙ কাকের মতো কালো। লোকমুখে গল্প ছড়াতে লাগল। শেষ অংশ হচ্ছেএক মহিলা একটা কাকের জন্ম দিয়েছে। কাকটা কা কা করছে তবে ফাঁকে ফাঁকে মাডাকছে। কা কা মা। মা কা কা।
আমি দুষ্ট লোক এইটা সত্য, তবে যতটা বলি ততটা না। আমার কথা কি আপনি মন দিয়া শুনছেন?
জ্বি শুনছি।
জয়েন উদ্দিন অসহিষ্ণু গলায় বললেন, আপনি কিন্তু তান্ত্রিক মসায় আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি।
প্রশ্নটা যেন কী?
প্রশ্নটা হলএই যে রহিম মণ্ডল পানিতে ডুবে মারা গেছেএই বিষয়ে আপনার অনুমান কী? কেন মরল?
আপনাকে আগেই বলেছিআমার অনুমান শক্তি প্রখর। যাকে বলে অচিরকালে সর্বজ্ঞতা।
জয়েন উদ্দিন বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন পরিষ্কার করে বলুন। 
নিঃশঙ্ক চিত্ত সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, মানুষের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা অত্যন্ত বিচিত্র। মানুষ সুন্দর যেমন পছন্দ করে, অসুন্দরও করে।
জয়েন উদ্দিন বললেন, প্রশ্নটি কার কাছে?
নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, To whome it may concern?
জয়েন উদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, তান্ত্রিকবাবু আপনি তো দেখি সত্যি সত্যি আমাকে পিশাচ সাধিকদের দিলে ফেলে দিয়েছেন। ঠিক করে বলুন তো আপনি আমার সম্পর্কে কী ভাবছেন?
ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, গত রাতে কর্ণপিশাচী আমাকে দেখা দিয়েছেন। তন্ত্রশাস্ত্রে কর্ণপিশাচী হল উপদেবতা। দেবতার স্তরে নয় এরা তবে তাদের মতো অনেক শক্তিই ধারণ করে। অপদেবতা নয়। ভূত প্রেত পিশাচকে বলে অপদেবতা। এই দেবীর সাধনায় আপেক্ষিক সর্বজ্ঞতা লাভ হয়। যাক সে কথা আপনার পিশাচীর কথা শুনি।

জয়েন উদ্দিন গলার স্বর গম্ভীর করে মাথা সামনের দিকে খানিকটা কুঁকিয়ে বললেন,      
কাল রাতে তারাতারি ঘুমোতে গেলাম। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখভর্তি ঘুম। এমন ইচ্ছে ঘুম হবার কোনো কারণ ছিল না। কারণ ছাড়াই এই পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। ঘুম ভাঙল স্বপ্ন দেখে। হঠাৎ একটা প্রখর গন্ধ পেলাম! গন্ধটা খুব মিষ্টি। কাঁঠালি চাঁপার মত। মুহূর্তেই গন্ধে ঘড় ভরে গেল পুরা ঘড়। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগে দরজাটা খুলে গেল। লাল সিল্কের শাড়ী পরা একটা মেয়েটা রুমে ঢুকলো।
মেয়েটার গায়ের গন্ধ অতি মিষ্টি। এমন মিষ্টি গন্ধ আমি এর আগে কোনো মেয়েকে গা থেকে পাই নি। মেয়েটার আরো একটি ব্যাপারে আমি মুগ্ধ। সেটা হলো মেয়েটার গলার স্বর। অবিকল ‘কিং কুৎসিতো নরঃ, কৰ্ম্মধা’ শলকের কিন্নর কণ্ঠ। মানুষের গলায়ে নানা রকম স্বর শুনি। কিন্নর কণ্ঠ যে থাকে। এটা আমি কল্পনাও করে নি। হীরামনের গায়ের কণ্ঠ কোকিলা। খারাপ না। কোকিলা কণ্ঠও ভালো লাগে। তবে কিন্নর কণ্ঠ অন্য জিনিস।

মেয়েটার গায়ে লাল সিল্কের শাড়ী-ঠোঁটে কড়া করে লাল লিপস্টিক দেয়া। আমি কখনো মেয়েটার ঠোঁটে লিপস্টিক দেখেনি। মেয়েটার বলল, তারপর ঠিক করলাম তোমার সঙ্গে যখন দেখা হবে তোমাকে বলব আমার শরীরটাই তো তোমার দরকার। বেশতো শরীরটা কিছুক্ষণের জন্য তোমাকে দেব। তার বদলে আমার মনোবাঞ্ছা কুমারী নরমুণ্ড তুমি আমাকে দাও।
আমি চোখ কপালেরও উপরে তুলে তাকিয়ে আছি। মেয়েটা বলল, কথা বলছ না কেন? তুমি চাইলে আমি সব কাপড় খুলে ফেলতে পারি। ঘরেও কেউ নেই, তবুও তোমার কাছে যদি মনে হয় ঘর বেশী আলো তাহলে আমি জানালা বন্ধ করে দিতে পারি। আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা উঠে জানালা বন্ধ করে দিল। ঘর আবছা অন্ধকার হলো। মেয়েটা বলল, অন্যদিকে তাকাও জয়েন উদ্দিন। নগ্ন হয়ে প্রেমিকের সামনে আসা কঠিন নয়। কিন্তু পূজারীর সামনে নগ্ন হওয়া বেশ কঠিন।

যখন ভোর বেলা, তখন পিশাচী শাড়ি খুলে নগ্ন হল। হঠাৎ করে মেঘের কলে বিদ্যুৎ চমকে গেলো। সে এক অপুরুপ দৃশ্য।
পিশাচী অতি সুরেলা গলায় বলল, তুই কি বিস্মিত হচ্ছিস?
সামান্য হচ্ছি। আপনি নগ্ন হলেন কেন?
এই বোকা ছেলে! বিস্মিত হবার কিছু নেই। আমি ব্যাখ্যা করলেই বুঝবি তোর কাছে নগ্ন হওয়াটা খুবই যুক্তিযুক্ত। তুই বিছানায় আরাম করে বস, আমি ব্যাখ্যা করছি।

দেবী কালিকা বা কালীর উপাসনায় অন্ধকার থেকে আলোকের পথে পৌঁছানো যায়। তাই দীপান্বিতা অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে আলো দিয়ে সাজানো হয় ঘর। দেবী পাপ হরণ করেন। 

আমি নাগাদেবী, সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি বলেই নগ্ন।
আপনি তো লজ্জাও বিসর্জন দিয়েছেন। লজ্জা বিসর্জনের জিনিস না।
তোর কাছে না, আমার কাছে লজ্জাও বিসর্জনের।
আপনি গোপন অঙ্গে শূল বিদ্ধ করেছেন কেন?
সবাইকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যেই শূলবিদ্ধ।
আপনি তো সবই বিসর্জন দিয়েছেন। গোপন অঙ্গও বিসর্জন দিন। এর তো আপনার প্রয়োজন নেই।
আমাকে নিয়ে তুই মাথা ঘামাচ্ছিস কী জন্যে? তুই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে অচিরকালে সর্বজ্ঞতা লাভ করতে চাস, পিশাচী সাধনা কর। কৃপা চাইলে আমার সেবা কর।
পিশাচী সাধনাটা কি?
এই বোকা ছেলে! নরবলি ছাড়া পিশাচী সাধনা হয়? তুই এক কাজ করা, আগামী অমাবস্যার নরবলি দে।
এইটা পারব না। মা। আমি মহাপাতক হব।
পাপ-পুণ্যের তুই বুঝিস কী?
তোকে যা করতে বললাম কর। নয়তো মহাবিপদে পড়বি।
আমি স্বপ্নের মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে বললাম, এই কাজটা পারব না মা। নরবলি ছাড়া তুমি যা করতে বলবে তাই করব। দেবী তখন বললেন, তুই যখন পারবি না। তখন আমার ব্যবস্থা আমিই করব। তখন তোর দুঃখের সীমা থাকবে না।
এই পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দুশ্চিন্তায় কেমন বুক ধরফর করছে। খুবই ভয় হচ্ছে। আগামী অমাবস্যার না জানি কী হয়!
নিঃশঙ্ক চিত্তর ভুরু কুঞ্চিত হল। স্বপ্নের একটি অংশ কি সত্যি? মানুষ যেমন মিথ্যা কথা বলার সময় মিথ্যার সঙ্গে কিছু সত্য মিশিয়ে দেয়, স্বপ্নেও কি সে রকম কিছু ঘটেঃ মস্তিষ্ক স্বপ্নের সঙ্গে সামান্য বাস্তব মিশায়। নিঃশঙ্ক চিত্ত চেয়ারের হাতলে নখ দিয়ে দাগ কাটতে লাগলেন। জয়েন উদ্দিন তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে সে অপেক্ষা করছে নিঃশঙ্ক চিত্ত কী বলেন তা শোনার জন্যে। নিঃশঙ্ক চিত্ত সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
জয়েন উদ্দিনকে দেখে মনে হল নিঃশঙ্ক চিত্তের এই কথায় সে একটা বুকের উপর থেকে পাহাড় সরে গেছে। ভারমুক্তির আনন্দে তিনি হেসে ফেললেন।

হাসিতে খুব সহজেই মানুষকে চেনা যায়। সব মানুষ একই ভঙ্গিতে কাঁদে কিন্তু হাসার সময় একেক জন একেক রকম করে হাসে।
নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ দিয়ে যাচ্ছি। নিয়মকানুন বিধিসহ মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র লিখে দিয়েছি। প্রতিদিন কয়েকঘণ্টা জপহোমাদি করে কবচ ধোয়া পানি পান করতে হবে। মনে রাখবেন, কবচের পুরশ্চরণ করতে কমপক্ষে সময় লাগে ২ থেকে ৩ দিন। যখন মনে হবে তখন জপ করতে হবে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র-
ওম ঐয়মবকম যজামহে সুগন্ধিমপুষ্টিবর্ধনম
উর্বারুকমিব বন্ধনান মৃতোর্মোক্ষিয়মামৃতাত...
...পিশাচের সাধনা বড়-ই কঠিন! তান্ত্রিক যোগিনীকে পিশাচের সর্বশক্তি দিতে য়েছিলো, আর পিশাচ চেয়েছিলো নারীবল...

নিঃশঙ্ক চিত্ত চলে যাচ্ছেন। 
ম্যানেজার ইসাহাক আর সরেন চন্দ্র শ্রদ্ধাভক্তির চূড়ান্ত করেছে। এখন তারা নিঃশঙ্ক চিত্তকে এগি দিতে যাচ্ছে। আমার ঝুলি নিয়ে সমস্যা দেখা গেলো। সরেন আগে ঝুলি কাঁধে ঝুলিয়রছে। ম্যানেজার ইসাহাক রাজ্জের বিরক্তি নিয়ে বলল, ঝোলাটা এত আগে নিয়েছেন কেন। কনকিছু ছাড়া পড়ল কিনা দেখেছেন।
জি।
খাবার দেবার কথা ছিল...
কোন কিছু বাদ নাই।        
ম্যানেজার ইসাহাকের রাগ সপ্তমে উঠে গেল। উচ্চস্বরে বলল, মুখে মুখে কথা বলছ কেন?
নিঃশঙ্ক চিত্ত ভাবলেন, ম্যানেজারের রাগ আর চরতে দেওয়া ঠিক হবে না। জাত্রকালে ঝগড়াঝাঁটি অশুভ। তিনি ইসাহাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, চল বেড়িয়ে পরি।        
ইসাহাক মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। তারপর জোর করেই কিছু টাকা ঝুলিতে গুঁজে দিয়ে বলল, গুরুদেব এটা আপনি পথে খরচা করবেন
নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, আমি কিন্তু ভাউচার দিতে পারবো না। তুমি হিসেব মেলাতে ঝামেলায় পড়বে। কথাটা বলেই ইসাহাককে নিয়ে বাহির দূরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তখন দারওয়ান আর জালু এসে প্রণাম করল। নিঃশঙ্ক চিত্ত অবাক হলেন। দেখলেন সিঁড়ির মুখেই দেখেন হীরামন যেন তাদের অপেক্ষায়।
হীরামন কাছে এসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলব্যাপারাটা নিঃশঙ্ক চিত্তবাবুর কাছে সম্পূর্ন অপ্রত্যাশিত। নিঃশঙ্ক চিত্ত হীরামনের মাথায় হাত রেখে বললেন, বেটি, আশীর্বাদ করার ক্ষমতা আমার নেইভগবানের কাছে শুধু প্রার্থনা করি, তিনি যেন তোমাকে সুখে রেখে, আনন্দে রেখে       
কথাটার মধ্যে হাসির কিছু ছুল না। তবু মেয়েতা খিল খিল করে হেসে উঠল।
কথাটার মধ্যে হাসির ব্যাপারা কিছু ছিলনা বলেই মনে হয়। তবু মেয়েটা মোহকারা হাসি না থামিয়ে কোকিল কণ্ঠে বলল, গুরুদেব, আপনার সাথে ম্যানেজার সাহেবও কি যাচ্ছেন? ভাবে তো মনে হচ্ছে।   
ইসাহাক আমতা আমতা করতে লাগলো। নিঃশঙ্ক চিত্তবাবু বললেন, ভালো কথা, আজকে তোমার হাসির যোগ সুতরাং তুমি হাসবে এটাই স্বাভাবিক। আর সে তোমার মন কাড়া এমন হাসিতে মূহুর্মূহ পল্লবিত হবে গাছগাছালি পশুপাখি।

হীরামন হাসছে। লাজুক হাসি। নিঃশঙ্ক চিত্তবাবুর দেখতে বড় ভালো লাগছে। তিনি ভাবছেন, হাসির ক্ষমতা ভগবান এই মেয়েটাকে দিয়ে রেখেছে উদার হাতে। সেই সঙ্গে মেয়েটি রূপবতী। শুধু রূপবতী নয়, চোখে পড়ার মতো রূপবতী। হালকাপাতলা শরীর। ধবধবে ফরসা গায়ের রঙ। লম্বাটে স্নিগ্ধ মুখ। বয়সও খুব কম মনে হচ্ছে। আরো একটি লক্ষ করার মতো ব্যাপার হল-মেয়েটি সাজগোজ করেছে। চুল বেঁধেছে, চোখে কাজল দিয়েছে-কপালেলাল রঙের টিপ। গ্রামের মেয়েরা কপালে টিপ দেয় বলেও জানতাম ন।

হীরামন খেয়াল করল তার আশে-পাশের সবাই হাসছে। এমনকি জয়েন উদ্দিন সাহেবও হাসছেন। তিনি যে কখন নেমে এসেছে হীরামন খেয়াল করে নি?
হাসি সৎক্রামক রোগ। বাড়ির মধ্যে সবাই হাসছে। হীরামনের মনে হল, শুধু মানুষগুলি না। কুকুর কাকরাও হাসছে। উঠানের বকুল গাছটা বিনা বাতাসে যেভাবে দুলে উঠল তাতে হীরামন পুরপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তবে কি গাছ হাসে!!!


সামনেই আনন্দ দৃশ্য। 
ম্যানেজার ইসাহাক মীর এগিয়ে দতে নদীর পাড় পর্যন্ত এলো। নদীর পাড় ঘেঁসে ঘেঁসে যাচ্ছেন। তার অদ্ভুত লাগছে। মধুর বাতাস। পশ্চিম আকাশের মেঘ এখন ভেলার মতো পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা তালগাছ বাঁকা হয়ে নদীর দিকে ঝুঁকে আছে। একদল শিশু তালগাছে উঠে সাবধানে মাথা পর্যন্ত যাচ্ছে, সেখান থেকে ঝাপ দিয়ে নদীতে পড়ছে। তাদের কী আনন্দ! নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, দেখো ইসাহাক। ওদের কী আনন্দ!
ইসাহাক কিছু বলল না। নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, ধনির পুত্র-কন্যারা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। ইসাহাক বলল, তাঁদের জন্য অন্য আনন্দ। মহান স্রষ্টা ঠিক করে রেখেছেন কে কী আনন্দ পাবে। নিঃশঙ্ক চিত্ত বললেন, তুমি চলে যাও, আর এসো না।
ইসাহাক বেস খানিকটা সময় চুপ থেকে নিঃশঙ্ক চিত্তকে বিস্মিত করে বলল, আরেকতু যাই। কোনো আনন্দদৃশ্য হয়তো সামনেই আছে।
নিঃশঙ্ক চিত্ত গেয়ে উঠলেন-
আনন্দময়ীর আগমনে
আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে
হেরো ওই ধনীর দুয়ারে
দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে।

####

সাজেদুর রহমান 
গণমাধ্যম কর্মী 
sajedurrahmanvp@gmail.com
01912078593

কৃতজ্ঞতা
প্রচণ্ড সাহসী মানুষ তান্ত্রিক সারশূন্য নিঃশঙ্ক চিত্ত। তিনি ভয়ঙ্কর সুন্দরী কর্ণপিশাচীর সাধক। দুর্ভাগ্য বসত তাঁর উপর দায়িত্ব পড়েছে বলীর জন্য কুমারী জোগাড় করার। এই বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প-‘পিশাচী’। 
গল্পের দুর্বলতা ঢাকার জন্য ছবি ও বাস্তব তথ্য জুড়ে দিয়েছি। কৃতজ্ঞতা
জানাচ্ছি সপ্তডিঙা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারম্যান এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ তমাল দাশগুপ্ত স্যারকে। এছাড়াও বাংলাদেশের সৃজনশীল ব্লগ-চর্চা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ রণদীপম বসু, বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট দীপক গুহ এবং সাংবাদিক-লেখক শ্যামল ঘোষ-এর সমাজ এবং লোকাচার ভিত্তিক লেখাগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে

#NigumBichareSotyo #TaranathTantrik #HoichoiOriginals
Nigum Bichare Sotyo (নিগুম বিচারে সত্য)| Taranath Tantrik | Lalon Fakir | Hoichoi | SVF Music

তথ্যসুত্র

১) শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস
২) নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট   
৩) https://bengali.oneindia.com/astrology/some-unknown-facts-about-tantra-011266.html 
৪) https://www.jstor.org/stable/29756386                   


Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )