পুণ্ড্রের পাঁচালী -১ ( প্রাচীন আর্যবতের ঈর্ষা )


পুণ্ড্রের পাঁচালী -১ বৈদিক সাহিত্য থেকে 



আর্যরা পুন্ড্র বাসিকে দেখে তো বিস্মিত। লকগুলো দেখতে খর্বাকায়। কালো। পাখির মতো কিচিরমিচির করে কথা বলে। অথচ কি সুন্দর তাদের কাপড় বোনার কৌশল। গাছ আঁশ (পাট, কার্পাস, শিমুল, শন, কিটের লালা) দিয়ে অদ্ভুত কায়াদায় মিহি মশ্রিন পোশাক বানাতে পারে। এমন ব্যাপার তাদের মাথায় আসেনি।


তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, এই মানুষেরা এত চমৎকার কাপড় বুনতে পারে, অথচ কেনজানি তারা নিজেরা কাপড় পড়েনা বললেই চলে। পুরুষেরা সামান্য নেংটি আর নাড়িরা কাছুলি মাত্র। দুঃসাহসী পুন্ড্রের মানুষেরা পাখির মতো গান গাইতে গাইতে বিশাল জলরাশি পেড়িয়ে দেশবিদেশে বাণিজ্য করছে।

আর্যরা হতভম্ব হয়ে দেখল, তুলনামূলক অনগ্রসর মানুষেরা চাষবাসে অসম্ভব দক্ষ। ইতিমদ্ধে তারা ধান, দুকুল আর ইক্ষু চাষ করে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। আরও অবাক কাণ্ড ছোটোখাটো মানুসেরা বিসালাকায় হাতিকে ধরে বসমানাতে পারে।
পুর ব্যাপারটায় আর্যরা বিস্মিত হলেও তা মুখে শিকার না করে ঈর্ষান্বিত হয়ে পরে। পুণ্ড্রজনদের সর্বপ্রাচীন উল্লেখ ঐতরেয়-ব্ৰাহ্মণে। এই আর্য শাস্ত্রীয় গ্রন্থে পুন্ড্রদের বিষয়ে বলছে, বঙ্গ, মগধ এবং চের দেশের অধিবাসীদের পাখির সাথে তুলনা করা হয়েছে যারা কিচির-মিচির ভাষায় কথা কয় বলে।

ঐতেরিয় ব্রাম্মণের শুনঃশেপ-আখ্যানে বলছে, অন্ধ্রা: পুন্ড্রা: শবরা: পুলিন্দা: মুতিবা ইত্যুদন্তা বহবো ভবন্তি। যে বিশ্বামিত্রা দস্যুনাং ভূমিষ্ঠা: (শুন:শেপ উপাখ্যান ৭/১৮)। ...পুণ্ড্রারা অন্ধ, শবর, পুলিন্দ ও মুতিব কোমদের সংলগ্ন এবং আত্মীয় কোম বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে সর্ব প্রথম ঐতেরিয় ব্রাম্মণে আরণ্যকে "বঙগাবগধাশ্চেরপাদা:" শব্দটি আছে। হেয় করা হয়েছে।

এবং তারপরে বোধায়ন-ধর্মসূত্রে পুন্ড্রদের উল্লেখ আছে। প্রথমোক্ত গ্রন্থের মতে এখানেও আর্যভূমির প্রাচ্য-প্রত্যন্তদেশের দস্যু কোমদের অন্যতম; দ্বিতীয় গ্রন্থের মতে ইহারা সংকীর্ণযোনী, অপবিত্র; বঙ্গ এবং কলিঙ্গাজনদের ইহারা প্রতিবেশী।

আর্য শাস্ত্রীয় গ্রন্থ মনুসংহিতায় শুদ্রত্ব প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। "পৌন্ড্র কাশ্চৌড্র দ্রবিড়া: কম্বোজা যবনা: শকা:।/ পারদা পহ্ণবাশ্চীনা: কিরাতা দরদা: খশা:।।
পৌন্ড্রক, উড্র, দ্রাবিড়, কম্বোজ, যবন, শক, পারদ, পহ্ণব, চীন, কিরাত, দরদ ও খশ কর্মদোষে শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।" [মনুসংহিতা: ১০/৪৪ মানবেন্দু বন্দোপাধ্যায়]

ঐতিহাসিক জৈনদের প্রাচীন গ্রন্থ "কল্প সূত্রে" জৈন তিনটি শাখার কথা বলা আছে। তাম্রলিপ্তি, কোটিবর্ষ শাখা এবং পুন্ড্রবর্ধন শাখা। কোটিবর্ষ পুন্ড্রবর্ধনের একটি নগর।
(বাঙ্গালীর ইতিহাস: নীহাররঞ্জন রায়। পুন্ড্র:)


রামায়ণ-মহাভারত মতে পুন্ড্র রাজ্য এবং রাজা যে বিখ্যাত ছিলেন তাতে নীচের পৌরাণিক বিবরণগুলিই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সুগ্রীবরাজ দক্ষিণদিকে এবং মৎস, কলিঙ্গ, পুন্ড্র, কেরল প্রভৃতি দেশে সীতার অন্বেষণেনীল, হনুমান, জাম্বুবান, গয়, গবাক্ষ প্রমুখকে নিযুক্ত করলেন (সর্গ:৪০-৪৬ সীতা অন্বেষণের উদ্যোগ: বাল্মীকি রামায়ণ
সারানুবাদ-রাজশেখর বসু।) 
              
বৈদিক শাস্ত্র দিব্যাবদান-অশোকাবাদানে স্পষ্টভাবে প্রথম 'পুন্ড্রবর্ধন' শব্দটি এসেছে। পুন্ড্রবর্ধনের আশ-পাশে বিবস্ত্র জৈনদের বসবাস ছিল। জৈনরা এমন ছবি এঁকেছিল যে শাক্যপুত্র গৌতম বুদ্ধকে তাদের সর্বশেষ তীর্থংকর মহাবীরের পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকা অবস্থায় উপস্থাপন করেছিল। মৌর্য সম্রাট অশোক (খ্রি:পূ: ২৬৯-২২৮) কথিত আছে যে ১৬০০০ দিগম্বর জৈনদের তিনি হত্যা করেছিলেন।

পবিত্র জৈন ধর্মগ্রন্থ ধর্মগুরু ও কল্পসূত্ত রচয়িতা ভদ্রবাহুর(১ম চন্দ্রগুপ্ত সময়কাল খ্রি: পূ:৩১৪-৩০০) অনুসারীদের বলা হতো পুন্ড্রবর্ধন্যা কেননা তিনি নিজেও পুন্ড্রবর্ধনের অধিবাসী ছিলেন। এছাড়া বরহুত বৌদ্ধ স্তুপে শিলালিপিতে (খ্রি:পূ: ১-১ শতাব্দ) পৌন্ড্রবর্ধনীয়া শব্দটি পাওয়া গেছে।[রাজশাহী এবং গাইবান্ধায় দিগম্বর জৈন মন্দির
এখনও বিদ্যমান।]

পৌরাণিক কাহিনীর তথ্যগুলো একসাথে গুছিয়ে দেখলে সসংকোচে বলাই যায়, প্রখ্যাত জনেরা যেভাবে ইতিহাস রচনা করেছেন তাতে, বাংলার গৌরব পুন্ড্রবর্ধনের অতীত মর্যাদাকে আড়াল করতে পারেনি। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারতের (সারানুবাদ-রাজশেখর বসু থেকে) পৌন্ড্রক বাসুদেব দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় উপস্থিতি এবং সম্মানিত অতিথি হিসেবে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞে উপস্থিতিই তাঁকে ক্ষত্রিয় রাজ হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়। (আদি পর্ব)

ভীম একে একে রাজ্য জয় করে পুন্ড্রদেশের রাজা মহাবল বাসুদেব এবং কৌশিকী নদীর তীরবাসী রাজাকে পরাস্ত করে বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কর্বট, সুম্ম এবং ব্রম্মপুত্র নদ ও পূর্বসাগরের তীরবর্তী ম্লেছ দেশ জয় করে বহু ধনরত্ন নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে এলেন।
(সভাপর্ব)...রাজসুয়িক যজ্ঞের আরম্ভ পর্বে দেখা যায় যে পৌন্ড্রক মহাবল বাসুদেব ইন্দ্রপ্রস্থে যজ্ঞ দেখতে এসেছেন।  
(আশ্বমেধিকপর্ব) মহাভারতের উপরোক্ত আলোচনা সমূহে স্পষ্ট হয় পান্ডবদের যজ্ঞের ঘোড়া মগধে এলে রাজা মেগসন্ধি (জরাসন্ধের পৌত্র) অর্জুনের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করে নেন, যজ্ঞে উপস্থিতির জন্য নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। অর্জুন অশ্বের অনুসরণে সমুদ্রতীর দিয়ে বঙ্গ, পুন্ড্র, কোশল প্রভৃতি দেশের ম্লেছগণকে পরাস্ত করলেন।
মহাভারতের কিছু অংশের সমকাল কোটিবর্ষ বিষয়ের (আঞ্চলিক বিভাগ) প্রশাসনিক কেন্দ্র। কোটিবর্ষ বিষয় ছিল পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির একটি অংশ; চন্দ্র, বর্মন ও সেনযুগে এই পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী ছিল মহাস্থানগড়। কোটিবর্ষের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বায়ুপুরাণ (২৩।২০৯) ও বৃহৎ সংহিতা-এ (১১।২)। প্রাচীন তাম্রশাসনে আছে,"পুন্ড্রবর্ধন ভুক্ত্যন্ত: পাতী-বঙেগ বিক্রমপুর ভাগে" এককালে গঙ্গার পূর্বভাগ বিক্রমপুর এবং চট্টগ্রাম সীমানা অবধি পুন্ড্রবর্ধনের অধীন ছিল।

"গুপ্ত আমলের ধাতব পাত্রে তাদের সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রান্তের পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির কথা উল্লেখ আছে, যেখানে ভুক্তি বলতে সাম্রাজ্যের একটি বিভাগের কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য পতনের মুখে পড়ে এবং তাদের অধিকৃত অঞ্চলসমূহ সম্ভবত ৫৬৭-৭৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিব্বতী রাজা সাম্বাতসনের অধিকারে চলে যায়। বাংলা পূর্বে সমতট ও পশ্চিমে গৌড় নামক দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।"[উইকিপিডিয়া]
 
পৌন্ড্র বাসুদেব সমন্ধে কৃষ্ণ বলেছেন, নিজেকে শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে পরিচয় দেয় এই দুরাচার। অজ্ঞানতা বশত: আমার শঙখ-চক্র-গদা ধারণ করেছে। সে বঙ্গ, পৌন্ড্র এবং কিরাত দেশের শাসক। [মহাভারত, বেদব্যাস: কালী প্রসন্ন সিংহ অনূদিত।]

হরিবংশ পুরাণে আছে যে, পৌণ্ড্রশাসক বাসুদেব(কৃষ্ণের অপর নাম বাসুদেব) নাম ধারণ করায় এবং কৃষ্ণের ন্যায় শঙখ-চক্র-গদা ধারণকারী হওয়ায় কৃষ্ণ যুদ্ধে পৌন্ড্র বাসুদেব কে পরাজিত করেন এবং পৌন্ড্র বাসুদেব মৃত্যু বরণ করেন।

এসবের সত্যাসত্য নিরূপণ নয়; বরং পুন্ড্র রাজ্যের গুরত্ব বোঝাতে এই অবতারণা।
মহাভারত এবং পুরাণ মতে মহারাজ বলির আশ্রিত দীর্ঘতমা ঋষির অনুরোধে/ঔরসে বলির স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে ৫ (পাঁচ)সন্তানের জন্ম হয়। এদের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুম্ম।
বিষ্ণু পুরাণে পুন্ড্রের পরিবর্তে বুম্ম আছে। স্পষ্টতই পুন্ড্র সন্তানদের ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষেত্রজ সন্তান(বলির ঔরসে নয়) বলে অভিহিত করা হয়েছে।

স্কন্দপুরাণে পৌন্ড্রদেশ করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। ব্রম্মাণ্ড, মার্কন্ডেয় পুরাণ, মৎস পুরাণ, বৃহৎ সংহিতা জ্যোতিষ গ্রন্থে পৌন্ড্রদেশ ভারতের পূর্বে বলে দেখতে
পাই। বিভিন্ন পুরাণে পুন্ড্রের উৎপত্তিগত ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে।

ঐতিহাসিক প্রভাবশালী সাহিত্য মতে পুন্ড্র একটি বিখ্যাত জাতি। মহারাজ বলির পুত্র পুন্ড্রের বংশধর পুন্ড্ররা বালেয় ক্ষত্রিয়। পুন্ড্ররা ক্ষত্রিয়ত্ব লোপ পেয়েছে বটে, শুদ্রত্বের কথা বলা হয়নি। হরি বংশ':৩১/৩৫; গরুড় পুরাণ: পূর্বখণ্ড: ১৪৩/৭১; বিষ্ণুপুরাণ: ৪র্থ খণ্ড, ১৮শ অধ্যায়, মৎস পুরাণ:৪৩/২৬; অগ্নিপুরাণ:২৬৭:১১
[গণমুক্তি: পৃ:২৭ এবং পৃ:৫২: পুন্ড্রদের ক্ষত্রিয়ত্বের আন্দোলন: ড: সনৎ কুমার নস্কর
]
কালিকা পুরাণ এবং স্কন্দ পুরাণে পরশুরামের ভয়ে ক্ষত্রিয়ের একাংশ লুকিয়ে শুদ্রত্ব পাপ্ত হয় বলে বলা হয়েছে। দীর্ঘদিন ব্রাম্মণের অভাবে শাস্ত্রীয় সংস্কারের অভাবে এমনটি ঘটে। পুন্ড্ররা তাদের মধ্যে অন্যতম।

ব্রম্মবৈবর্ত পুরাণ সর্বাধুনিক এবং এই বাংলায় রচিত হওয়া সত্ত্বেও পুণ্ড্রদের "অসৎ শুদ্র" হিসেবে হেয় করে সর্ব নিম্ন স্থান চামার, শুঁড়ি, কসাই ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছে।
মনুসংহিতায় শুদ্রত্ব পাপ্তির কারণ আগেই বর্ণিত আছে। সিংহলীদের পালিগ্রন্থ "মহাবংশ" এ পান্ডু বাসুদেব নিয়ে আখ্যানটি বেশ কৌতুহলুদ্দীপক। ভগবান বুদ্ধের আদেশে ইন্দ্র বাঙ্গালী বিজয়কে শ্রীলংকায় বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তারের সুবিধার্থে রক্ষা করেন এবং বিজয়ী করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বঙ্গদেশ থেকে ভ্রাতুষ্পুত্র পান্ডু বাসুদেব লঙ্কায় গিয়ে রাজা হন।(প্রাচীন ইতিহাস: রমেশ চন্দ্র মজুমদার।)
পৌরাণিক কারণ দিয়ে ঐতিহাসিক সত্য নিরূপণ করা কঠিন। তবে পুন্ড্র যে অতি প্রাচীন একটি রাজ্য যা দক্ষ, যোগ্য, মহাবলী এবং স্বনাম খ্যাত রাজাধিরাজ দ্বারা শাসিত সে ব্যাপারে কারও দ্বি মত নেই।

মহাভারত এবং কিছু পুরাণ দিয়ে পুন্ড্ররা আর্য নাকি অনার্য তা স্পষ্ট না হলেও বৈদিক সাহিত্য এবং ঐতিহাসিক ধারা বিবরণী অনুযায়ী পুন্ড্ররা যে অনার্য, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।]

ঐতিহাসিক শিলালিপি:
(বারুফকির নামে মহাস্থানের এক ব্যক্তি ১৯৩১ সালে সংগ্রহ করেন। বর্তমানে কলকাতা যাদুঘরে।) পুডনগল: পুন্ড্রনগর। দুর্ভিক্ষের কারণে কোষাগার থেকে ধান দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। মওশুম এলে ধান ও গন্ডা দিয়ে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা ছিল। খ্রি:পূ: তৃতীয়-দ্বিতীয় শতকে সম্রাট অশোক কর্তৃক জারীকৃত। স্পষ্টতই পুডনগল মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।

খ্রিঃপূঃ ৩,০০০ অব্দে লিখি বৈদিক সাহিত্য ও মহাভারতের বিবরণ চমকপ্রদ। বলা হচ্ছে, পুন্ড্রনামের এক জাতি পুন্ড্র জনপদ গড়ে তুলেছিল। মহাভারত অনুযায়ী রাজা বলির পাঁচ পুত্র অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সূম্ম ভারতের পূর্বাঞ্চলে পাঁচটি জনপদ প্রতিষ্ঠা করে। এদের মধ্যে পুন্ড্র একটি। পুণ্ড্রনগর ছিল এ জনপদের রাজধানী।

এই ধরনের একাধিক পুরাণেও আছে; সেখানে কিন্তু পুণ্ড্রারা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ এবং সুহ্মদের ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি। মানবধর্মশাস্ত্ৰে পুণ্ড্রদের বলা হয়েছে ব্রাত্য ক্ষত্রিয়, যদিও মহাভারতের সভাপর্বে বঙ্গ ও পুণ্ড্র উভয় কোমকেই শুদ্ধজাত ক্ষত্ৰিয় বলিয়া বর্ণনা করাহয়েছে। কৰ্ণ, কৃষ্ণ এবং ভীমের যুদ্ধ এবং দিগ্বিজয় প্রসঙ্গেও মহাভারতে পুণ্ড্রকৌমের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। কৰ্ণ সুহ্ম, বঙ্গ এবং পুণ্ড্রদের পরাজিত করিয়াছিলেন এবং বঙ্গ ও অঙ্গকে একটি শাসন-বিষয়ে পরিণত করিয়া নিজে তাহার অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।

যাই হক, উপরের আলচনায় বোঝা যাচ্ছে, পুণ্ড্রদের জনপদ অঙ্গ, বঙ্গ এবং সুহ্ম কোমদের জনপদের সংলগ্ন, এবং হয়তো এরা সবাই একই নিবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়ত, এই জনপদের অবস্থান মুদগগিরি বা মুঙ্গেরের পূর্বদিকে এবং কোশীতীর-সংলগ্ন। জৈনদের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ কল্পসূত্রে গোদাসগণ-নামীয় জৈন সন্ন্যাসীদের তিন-তিনটি শাখার উল্লেখ আছে; তাম্রলিপ্তি শাখা, কোটিবর্ষ শাখা, পুণ্ড্রবর্ধন শাখা। এই তিনটি শাখার নামই বাঙলার দুইটি জনপদ এবং একটি নগর হইতে উদ্ভূত। কোটিবর্ষ পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত প্রসিদ্ধ নগর। এই পুন্দনগলই বোধহয় ছিল তখন পুণ্ড্রের রাজধানী বর্তমান বগুড়া জেলার মহাস্থান, যাহার পুরাতন ধ্বংসাবশেষ ঘেষিয়া এখনও করতোয়ার ক্ষীণধারা বহমান। এই করতোয়ারই তীৰ্থমহিমা মহাভারতের বনপর্বের তীর্থযাত্রা অধ্যায়ে উল্লিখিত হইয়াছে। লঘুভারতের কথায় বৃহৎপরিসরা পুণ্যা করতোয়া মহানদী

এইসব প্রাচীন বৈদিক সাহিত্য মতে অনুমান করা যায়, আর্যরা খ্রিস্টের জন্মের কয়েকশ বছর পরে পুণ্ড্রে এসেছে। আসার কারণ তাদের ধনসম্পদের আকাল। নতুন সম্পদের খোঁজে। মজার ব্যাপার হোল তখনও আর্য শাসিত অঞ্চল ছাড়া অন্য অধিবাসীদের বিশ্বামিত্রের দস্যু পুত্র বলা হয়েছে বেদের ব্রাম্মণ খন্ডের পর বেদাঙ্গের অন্তর্গত কল্পসূত্র। বৌধায়নের কল্পসূত্রে বলা হয়েছে বঙ্গ, পুন্ড্র এবং কলিঙ্গ দেশে কেউ গেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

...সমসাময়িক শতপথ ব্রাম্মণে উল্লেখ আছে যে আর্যদের যজ্ঞের আগুন পূর্বদিক সদানীরা নদী/কুশি ভাগলপুরের নিকটস্থ কৌশিকী প্রবাহ পর্যন্ত এগিয়েছিল।   
আর্যরা পুন্ড্র বা বঙ্গে যে আসেননি তার যথার্থ প্রমাণ বৈদিক সাহিত্যে বিদ্যমান। তাঁরা গঙ্গা-যমুনার পূর্বে আসেননি।

আর্যরা সহজে পুণ্ড্রের আধিপত্ত স্থাপন করতে পারেনি। পুণ্ড্রের জনগণ কয়েকশত বছর প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। আর এই প্রতিরোধ এখানকার নারিরা অবিশ্বাস্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল।

আর্যদের ঘোড়ায় চড়ে দ্রুতগতিতে আক্রমণ করে সরে পারার কৌশলের কাছে শেষতক পরাজয়য় মেনেনিতে হয়। যদিও পুণ্ড্রের লোকেরা আগে থেকেই কুকুর, গরুসহ বৃহদাকার হাতিকে বাগে আনতে পেরেছিল। কিন্তু অশ্ব পালন জান্তনা।
      
আর্যদের বসতী বিস্তার কালে তারা পুণ্ড্রের লোকেদের আরেকটি অদ্ভুত কাণ্ড দেখল
এই অসভ্য মানুষেরা গরু পালন জানলেও দুধ খেতে জানে না।

Comments

Popular posts from this blog

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পিশাচী সাজেদুর রহমান