পুণ্ড্রের পাঁচালী -২ (নামকরণের সাতকাহন)


পুণ্ড্রের পাঁচালী -২ (নামকরণের সাতকাহন)


ঋষি দীর্ঘতমা ও বলি রাজা

‘তুই দীর্ঘতামাসে প্রবিষ্ট হ...’ অর্থাৎ তুই অন্ধ হয়ে জন্মা। কামে অন্ধ দেবতা বৃহস্পতি জোরপূর্বক সঙ্গমে ব্যার্থ হয়ে এই অভিশাপ যাকে দিলেন তিনি তখনো মাতৃগর্ভে। তাই জন্মের পরে শিশুটি নাম রাখা হয় দীর্ঘতমা
     
জন্মান্ধ দীর্ঘতমা ছিল শৌর্যেবীর্যে অতুলনীয়। গর্ভাবস্থায় থাক মাতা মমতার স্লাতিহিনতা বিষ্যটি দীর্ঘতমার জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। সে বেদশাস্ত্রে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়ে ঋষি উপাধি পেয়ে যায় অল্প বয়সে।

অপর দিকে যথেচ্ছাচার যৌন সঙ্গম করে সমালাচিত হতে থাকে। এর কারণ দীর্ঘতমা অন্ধ থাকায় রাতদিনের পার্থক্য বুঝতে না। অথবা জন্মপূর্বক অভিজ্ঞতা তাকে এমন সভাবের করে তুলেছিল। ব্যাপারটা যখন মানবি পর্যায়ে থেকে ষাঁড়ের সাথে ঘটতে থাকল, তখন সমাজপতিরা তাকা হাতপা বেঁধে গঙ্গায় ভাষীয়ে দিলো। ঋষি হওয়ার কারনে প্রাণে মারল না।

এদিকে ভারতবর্ষের দক্ষিণপূর্বের দেশ কিসিন্ধিকার দাপুটে রাজা বলি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি বংস রক্ষার উপাই খুঝছিলেন। এমন সময় গঙ্গায় গোসল করতে গিয়ে ভাসতে থাকা ঋষি দীর্ঘতমাকে পেলেন। দীর্ঘক্ষণ পানিতে হাবুডুবু খেয়ও বেঁচে থায় ঋষির প্রাণশক্তি দেখে বিস্মিত হন।

আরও বিস্মিত হন যখন জানতে পারেন তার অসম্ভব যৌন ক্ষমতার কথা। বলি রাজা প্রাসাদে আনলেন এবং স্ত্রী সুদেষ্ণাকে অনুরধ করলেন ঋষির সেবা করতে। সুদেষ্ণা একেবারেই রাজি হন না। কিন্তি স্বামীর সম্মানের কথা ভেবে রাজি হন।

ঋষি দীর্ঘতমার ওইরসে এবং সুদেষ্ণার গর্ভে একে একে জন্ম নিল পাঁচ পুত্র সন্তান। অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম। এই পাঁচ সন্তান পৃথক রাজ্য তথা জাতীগোষ্ঠী তৈরি করে। এই হল পুণ্ড্রসহ আমাদের দেশের নামের উৎপত্তির বৈদিক ব্যাখ্যা।

অন্যান্য বৈদিক সাহিত্যে আর ডজন খানিক ব্যাখ্যা আছে। এছাড়াও ইসলামিক, গ্রিক, চৈনিক উৎস ছাড়াও নৃতাত্ত্বিক, লোকশ্রুত, ঐতিহাসিক প্রত্নসাক্ষ্য মিলিয়ে পুণ্ড্র জাতীর নামকরণের ইতিহাসের বহু মতাদর্শ পাই।

মতাদর্শ গুলর মদ্ধে সবথেকে গ্রহণ যোগ্য ব্যাখ্যাটি পাই রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত থেকে। তিনি ঐতিহাসিক প্রত্নসাক্ষ্য দিয়ে বলেন,পুন্ড্র একটি প্রাচীন জাতিমূলক নামএখনকার ভূমি পুত্ররা ‘পুণ্ড্র’ নামের এক জাতীয় আখের চাষ করে তা থেকে গুর তৈরি করে সমগ্র ভারতবর্ষে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল প্রাচিন কালে। এ থেক এই জাতীর নামকরণ। ১ম খ্রিস্টাব্দের মহাভারতও এই তথ্যটি সমর্থন করে।

ভিন্নমতে বলা হচ্ছে, অতি প্রাচীনকালে এদেশে যারা রেশম কীট পালন রেশম উৎপাদন করত, তাঁহারা পলিয়া নামে অখ্যাত ছিল। "পলু" অর্থ রেশম। ধারনা করা যায় "পলু" শব্দ থেকে পুণ্ড্র-এর উৎপত্তি। কারন "পলিয়া" জাতি পুণ্ড্র জাতি অভিন্ন। এখনও পলিয়া শব্দের প্রচলন এই দেশে দেখা যায়

পুণ্ড্র জাতির আদি পুরুষের জন্ম কাহিনী বলতে ড, অতুল সুর ‘পুণ্ড্রদেবের’ বংশ ধরদের মনে করেন। যাদেরকে আদিতে ‘পোদ’ জাতি বলা হয়। পোদ > পুঁড়া > পণ্ডরও > পুণ্ড্র।

পুণ্ড্রনগর ইতিবৃত্ত নিয়ে রচিত 'পুণ্ড্র' গবেষণা গ্রন্থে অধ্যাপক মোস্তফা আলী এবং 'ইতিকথা-পৌণ্ড্রবর্ধন' গ্রন্থে অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান উল্লেখ করেছেন, ‘পুঁড়া’>‘পোদ’ জাতীকে পুণ্ড্রবর্ধনের আদিবাশিন্দা(‘পোদ’ ‘পুন্দাবি’ ‘পুঁড়া’)

হিন্দু শাস্ত্রের পৌরাণিক মনুসংহিতা ও বিষ্ণু পুরানে পুণ্ড্র দেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। পুণ্ড্রনগরী একটি বণিক শাখার উল্লেখ জৈনদিগের গ্রন্থে রয়েছে। মনুসংহিতা, পদ্ম পুরাণ, বায়ুপুরানে উল্লেখ আছে, পাণ্ডু নামের একটি রোগ থেকে ‘পুণ্ড্র’ নামের উত্পত্তি। পুণ্ড্রকেস্ট্রার (পুণ্ড্রভূমি) অধিকাংশ ব্যক্তিই এ রোগে ভুগত।     
   
বিশ্বের প্রায় সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থেই ‘পুণ্ড্র’ নামটি পাই। আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের ইতিহাস গ্রন্থ মেগাস্থিনি, আরব্য রজনির সিন্দাবাদের বাণিজ্য যাত্রায় পুণ্ড্র জাতীর উল্লেখ পাই। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম-৮ম শতকের দিকে প্রাপ্ত বেদবাক্য অনুযায়ী পুণ্ড্র ছিল একটি অনার্য গোষ্ঠী যারা সাদানিরা নদীর পূর্বদিকে বাস করত। এর পরে মহাভারতে পুণ্ড্র জাতিকে অসুর এবং পুণ্ড্রের অধিপতি বাসুদেবের কথা জানতে পারি।

এই প্রথম আমরা পুণ্ড্র জাতীর কোন বেক্তিবিশেষের নাম পেলাম। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম শাস্ত্রে  সবথেকে শক্তিশালী প্রমাণ মেলে খ্রিস্টপূর্ব তিনশতাধিক বছর আগে অশকের শাসনের সময় কালের শিলালিপি আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই অকাট্য দলিলে উল্লিখিত পুদনগল’ (পূণ্ড্রনগর) তখন আঞ্চলিক রাজধানী।

পৌণ্ড্রবর্ধন নামটি ভুক্তি (প্রদেশ) ও রাজধানী উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কিন্তু সাধারণত রাজধানী বোঝাতে পৌণ্ড্রবর্ধনপুর (নগর) ও প্রদেশ বোঝাতে "পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি" শব্দের প্রয়োগই দৃষ্ট হয়। পৌণ্ড্রবর্ধনপুরের শাসন অন্তভুক্তির নামই "পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি" ছিল এছাড়াও খ্রিস্টের জন্মের চারশত বছর পূর্বে রচিত "কল্পসুত্র", কবি কহলন মিশ্রের রাজতটনীতে, কবি সন্ধাকর নন্দী' "রামচরিতম" কাব্যে, ও রাজতরঙ্গিনীতেসহ শতাধিক প্রাচীন উপাদানে পুণ্ড্র নামটি দেখতে পাই।


বছর তিনেক আগে এমনি এক পোদের সাথে দেখা হয়

চৈনিক প্রিব্রাজক হিউয়ান সাং ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে পুণ্ড্রে আসেন। তিনি পুন-ন-ত্ন-ফ-ন অর্থাৎ পুণ্ড্রবর্ধন সম্পর্কে বিষদ বর্ণনা দেন। এর আগে খালিমপুর লিপিসহ বহু লিপিতে দেখিতেছি পুন্ড্রবর্ধনার্ন্তগত বাঘ্রতটিমন্ডলের উল্লেখ পাই। 

পুণ্ড্র বা পোদ জাতী বাংলার ভূমিপুত্র। এই জাতি এখনও সাত্নত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে অদ্ভুত সমুজ্জ্বলতায় এখনও টিকে আছে। গতশতাব্দীর মধ্যভাগে জরীপ করেন বিখ্যাত গবেষক কানিংহাম। পাবান, রাজশাহী, পশ্চিমবঙ্গে দেড়হাজার পোদ জাতীর জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নিরূপণ করেন, যারা তাদের আদি পেসা মাছ ধরার কাজটি ধরে রেখেছে।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য বছর তিনেক আগে এমনি এক পোদের সাথে দেখা হয় যায়। সে জানায় এখনো দেশর উত্তরবঙ্গের খালেবিলে মাছ ধরে জীবনযাপন করে। পুণ্ড্রের পাঁচালি-২-এর নামকরণের সাতকাহনে নতুন কিছুকি দিতে পারলাম।  
###           



Comments

Popular posts from this blog

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পিশাচী সাজেদুর রহমান