পুণ্ড্রের পাঁচালী -৩ (বাংলার পিরামিড)
পুণ্ড্রের
পাঁচালী -৩ (বাংলার পিরামিড)
সাজেদুর রহমান
ভূমি থেকে প্রায় ৫০ ফুট উচু ১৭২টি ভরাট করা কক্ষসহ
অনেকটা কচ্ছপের পিটের মত এই ইমারত
‘এটাকে
বাংলার পিরামিড বলতে পারেন!’
কথাটা
অভিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো ভঙ্গিতে বলল মেয়েটা। কালো ছিপছিপে গড়নের বয়কাট চুল।
মেয়েটাকে দেখে মনে হোল সদ্য স্কুল পেরোনো কিশোরী। এই বয়সী ছেলেমেয়েদের সভাব বড়দের
মতো কথা বলে বুঝিয়ে দেয়, আমরা আর ছোট নই।
ছোট
মুখে বড় কথা। পাত্তা না দিলেই হয়। আমি পাত্তা দিলাম না। বেহুলার বাসর ঘর খ্যাত গোকূল
মেধটাকে দেখতে লাগলাম। পোড়ামাটির ইটে বানান এই পুরাকীর্তির কাছে যতবার এসেছি
ততবারই ঘন্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থেকেছি। অদ্ভুত ব্যাপার এই কাঠামোর সামনে দাঁড়ালেই গুপ্ত-পাল-সেন-সুলতানি আমলের ছবি ভেসে ওঠে।
এখানকার
কুঠরিতে বসে কতশত বৌদ্ধ মুনি ধ্যান করেছে। ষড়রিপু দমন করছেন, যেন অহংকার বা মোহ দ্বারা আক্রান্ত না
হয়।
তবে
আমি আক্রান্ত হলাম। কারণ মেয়েটা আমার পাসেই দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা বিরক্ত নিয়ে
মেয়েটার দিকে না তাকিয়ে বললাম, গোকূল মেধকে কোন অর্থে এটা পিরামিড বলা যায়?
ঃ এই
স্ট্রাকচারটা অনেকটা সাউথ আমেরিকার ইনকা পিরামিডের মত। প্রথমে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে সেটা
ক্রমান্বয়ে উঁচু করা হয়েছে, আর চারপাশ থেকে টেরাসের মত কুঠুরিগুলো
বানানো হয়েছে, পরে আগুনে পোড়া ইট দিয়ে দেয়াল গাঁথা হয়েছে।
এটার গড়ন অনেকটা পেরুর কারাল পিরামিডের মত, যেটা কিনা প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে
তৈরি ‘নোর্ত চিকো’ সভ্যতার নিদর্শন।
ঃ কিন্তু
এ জিনিস তো দেড় হাজার বছর আগের, আমি বললাম।
ঃ তা
ঠিক, তবে
একই ধরণের স্থাপনা প্রাচীন দুনিয়ার অনেক জায়গায় পাওয়া গেছে। এ থেকে বোঝা যায়
পরিব্রাজকরা সে যুগেও ছিল আর প্রযুক্তির গ্লোবালাইজেশনও ঘটেছিল। দূরপ্রাচ্যে এমন
অনেক স্থাপনা আছে।
ঃ পাহাড়পুরের
বিহারটা আরেকটু পরে বানানো হলেও ওটার স্থাপত্যরীতিও একই রকম বলেই জানি।
ঃ হ্যাঁ। এগুলো
সবই পাল আমলের বৌদ্ধবিহার বলে ধরা হয় তবে গুপ্ত আর পাল দুই আমলের ট্রাঞ্জিশন
পিরিয়ডের সময় সম্ভবত, কেননা এসব জায়গায় গুপ্তযুগের কিছু
নিদর্শনও মিলেছে।
মেয়েটা
আমার মনোযোগ কেরে নিতে পেরেছে। এটা বুঝতে পেরে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিতি
হাসছে। আমি বললাম, আমি কি তোমার পরিচয় জানতে পারি?
ঃ আমি
দ্রিমা। এবছর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে অনার্স
পাস করেছি। এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ইন্টার্নি করছি।
দ্রিমার
কথায় খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম। মেয়েটার সাথে শুরুতে অবজ্ঞা দেখানর জন্য খারাপ লাগলো।
তাকে তুমি করে ডেকেছি বলে সরি বললাম। দ্রিমা হেসে বলল, আমি আপনাকে আমি চিনি। আপনি
ইতিহাস নিয়ে পত্রিকায় লেখেন।
লক্ষ্য
করলাম দ্রিমা হাসলে তার চোখের তারাটা ঝিকমিক করে। তখন তাকে আর খুদ্র মনে হয় না।
আমি বললাম, লেখার চেষ্টা করি। তা আপনি এখানে এই সময় যে?
ভাসুবিহারে
খনন কাজ চলছে। সেখানে কাজ শিখছি। সেখানেই শুনলাম আপনি এসেছেন। জানলাম আপনি দুপুরের
দিকে ভাসুবিহারে যাবেন। দুপুরের পরে তো খননের কাজ হয় না। তাই ভাবলাম আপনার সাথে
পরিচয় হওয়া যায় কি না। আমাদের কাজের সাথে মিডিয়াও একটা পার্ট।
ঃ ভালো
করেছেন। নবিন প্রত্নতাত্ত্বিকের চোখে পুরাক্রিত্তির নতুন ব্যাখ্যা পেলাম।
কথা
বলতে বলতে আমরা স্তুপের প্রায় শীর্ষে পৌঁছে গেলাম। ইটের দেয়ালগুলো ভেঙ্গে সিঁড়ির
মত আকার নিয়েছে বিভিন্ন স্থানে, তাই ওঠা তেমন মুশকিল না।
ঃ বিস্ময়কর
এক পুরাক্রিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছি আমারা। অশোকের আমলে এটি পুন্ড্রবর্ধনের পাহারার
কাজে পর্যবেক্ষণমঞ্চ হিসেবেও ব্যবহার হতো। এখন করতোয়া অনেক দূরে সরে গেলেও প্রাচীন
কালে এখান থেকে করতোয়া নদীর অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেতো।
ঃ তার
মানে গুপ্ত যুগের তৈরি?
ঃ হ্যাঁ।
এখানে সে আমলের প্রত্নসাক্ষ্য মিলেছে। সেই সাথে এটা পাল, সেন দু’যুগেই ধর্মকর্মের যায়গা ছিল, পাল যুগে বিহার আর সেন যুগে শিবমন্দির। স্তূপটির স্থাপত্যরীতির ভাবুন। মেধটা নিচ থেকে
ওপরের দিকে ক্রমশঃ সরু হয়ে উঠেছে। কোন ধাতব রিইনফোর্সমেন্টের ব্যাবহার না
করে পাথর আর পোড়ামাটির চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়ে যথেষ্ট মজবুত স্থাপনা বানিয়েছে সেই মধ্য
প্রাচীন কালে, যা এত শতাব্দী পেরিয়েও এগুলো অটুট আছে।
ঃ সিভিল
ইঞ্জিনিয়ারিং ও আর্কিটেকচারে সে সময় বিরাট উন্নতি সাধন হয়েছিল।
ঃ এখানে
ফ্রান্স বাংলাদেশ যৌথ খনন কাজ করেছে। সেই প্রত্ন খননে যতটুকু রহস্যউদঘাটন করা
হয়েছে তাতে বোঝা যায়...।
ঃ তাতে রহস্যের সামান্যই উদঘাটন করা গেছে। এই স্তুপকে ঘিরে কত শত রহস্য রয়ে গেছে,
আমরা আজোও
অনেকটাই জানতে পারিনি।
উপরে
একেবারে কেন্দ্রে ছোট ইঁদারা টাইপের একটা গর্ত, সেন যুগে এটায় শিবলিঙ্গ স্থাপন করা হত বলে
ধারণা করা হয়, তারও আগে হয়ত বৌদ্ধদের পদ্মস্তম্ভচক্র
বসানো ছিল। জায়গাটা একটু নিচু, দ্রিমা লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। ইটের খাঁজে কলম দিয়ে একটু ঘষা দিয়ে মনোযোগ
দিয়ে কি যেন দেখলেন। আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, ‘এখানকার প্রতিটা বস্তু কণা, ইটের প্রতিটা টুকরো হাজার হাজার বছরের
শত শত অজানা রহস্যের সাক্ষী। কিন্তু আফসোস, সে রহস্য খোঁজার জন্য যারা নিযুক্ত তাদের
পেসাদারিত্তের বালাই নাই।
ঃ আপনারা
নতুন পজন্ম আসছেন। আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়য় তো খুব ভাল কাজ করছে।
আমারা
যখন পিরামিডের চুড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেলের একফালি রোদ
দ্রিমার মুখে এসে পড়েছে। সেই ঝলমল আলতে দ্রিমার রূপ পাল্টে দিয়েছে। তাকে দ্রাবিড়
কন্যার মতো লাগছে। আমি আচ্ছন্ন হয়ে দেখছি।
দ্রিমা
ইঁদারার ইট দেখতে দেখতে আমুদে ঢঙে বললেন, এখানে কারণে অকারণে বহুবার এসেছি, তাও
খুব দেখতে ইচ্ছে করে, এই স্তুপকে ঘিরে কত শত ইতিহাস রচিত হয়েছে। শক্তিশালী
মৌর্য সম্রাট অশোকের কল্যাণে এ এলাকাতেও বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল, কেননা এখানকার মানুষের খুব পছন্দ
হয়েছিল অহিংসবাদ... আমরা আজো অনেকটাই জানতে পারিনি, জানার চেষ্টাও সেভাবে করিনি।
ঃ এ
আমাদের জাতীয় দৈন্য।
ঃ কৌতূহলী
ভঙ্গিমায় দ্রিমা বললেন, শুনেছি বৌদ্ধ শাওলিন সন্ন্যাসীদের ছত্রিশ চেম্বারের রহস্য
নাকি আজো অজানা, ওদের
অনেকেই নাকি উড়তে পর্যন্ত পারে।
ঃ ইন্টারেস্টিং!
তা এখানে কোন কিছু আঁচ করতে পারছেন?
হাসতে হাসতে দ্রিমা
বললে, এখনও
না। বেশ দুর্বোধ্য আর……হয়ত বা মিথও হতে পারে…আপনিও চেষ্টা করতে পারেন। আপনি রহস্য খোঁজার কাজটা করতে পারেন।
আমিও
দ্রিমার কথায় হাসলাম। বললাম, ঐ রহস্য সম্ভবত এখানেই চাপা পড়ে আছে হাজার বছর ধরে! তবে
এখানে যেদিন প্রথম এসেছি তখন রূপকথার নগরগুলোর মত মনে হয়েছে। সত্যই এটাকে বেহুলা
লখিন্দরের বাসর ঘরের মতো লেগেছে।
ঃ গকুল
মেধকে বেহুলার বাসর ঘড় বলেই বেশি পরিচিত।
ঃ এখনও
পরিষ্কার মনে আছে, তখন আমি ক্লাস ফোর পড়ি। আম্মা নিয়ে এসেছিলেন। সাথে আমাদর ছোট
বোন ছিল। আম্মা এই স্তুপের সামনে দাঁড়িয়েই বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের কাহিনী বলেছিলেন।
ঃ গল্পটা
নিছক লোককথা ধরা হলেও যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং, হয়ত আসলেই কোন সত্য ঘটনা থেকে বিবর্তিত। আমার ধারণা, দুনিয়ার সব মিথ সত্যের ছায়ায় রচিত।
রোদ
পরে আসছে। গোকূল মেধের একেবারে শীর্ষে আমরা। শেষবারেব মতো চারপাশটা দেখতে দেখতে নেমে আসলাম। সত্যমিথ্যার পাঠ আপাত চুকিয়ে আমরা বিদায় নিলাম।সন্ধ্যার
আগেই বগুড়া শহরে যেতে চাই। গোকুল মেড় পুন্ডুনগরের দূর্গ থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার
দক্ষিনে গোকুল গ্রামে অবস্থিত। ভ্যানে চড়ে মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড যেতে ২০/৩০ মিনিট
লাগে।
Comments