পুণ্ড্রের পাঁচালী - ৫ (এক অনিঃশেষ পুরাকীর্তির কথা )


পুণ্ড্রের পাঁচালী - ৫ (এক অনিঃশেষ পুরাকীর্তির কথা )
সাজেদুর রহমান
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর এলাকার 
ঐতিহ্যবাহী ভীমের জাঙ্গাল’ কেটে নেওয়া স্থান।

কারণ সামান্যই। সামান্য কারণেই শ্যামপুর গ্রামে একটা বিপর্যয় ঘটে গেলো। এই গ্রামের মাটি বিক্রেতা মোতালেব হোসেন শব্দগ্রামের মাটি ব্যাবসায়ি ইন্দাস আলী যোগসাজশে করে মহাস্থানের অন্যতম পুরাক্রিত্তি ভীমের জাঙ্গাল কেটেকুটে পাঁচটি ইটভাটায় মাটির জোগান দিচ্ছে। প্রতি ট্রাক মাত্র ১৫০ টাকায়।

নিরিবিলি এলাকায় খুব ভোরে শুরু করে ৬০/৭০ জন শ্রমিক লাগিয়ে দিয়ে জাঙ্গালের মাটি কাটার কাজটি সকাল ৯/১০ টার মধ্যে শেষ করে ফেলে। এতে গ্রামের লোকেদের নজরে কম আসত। ইটভাটা গুলি ছিল জনবসতির খুব কাছে। সেগুলি যখন চালু হোল তখন তার ধোঁয়ায় এলাকার লোকেরা চরম দুর্ভগে পড়ল। বিশেষ করে ভাটার কাছাকাছি থাকা চারটি স্কুল ও একটি কলেজের শিক্ষার্থীদের অসুবিধা হতে লাগলো খুব বেশি।                 

হাজার বছরের পুরাক্রিত্তিটি মহাস্থান গড় থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে দিনের পর দিন এমন ঘটনা ঘটে চললেও প্রশাসন নাকি টেরই পায়নি। এলাকার মানুষের নাকের ডগায় ঐতিহাসিক জাঙ্গালের মাটি ও গাছ কাটছে এবং সেই মাটি-গাছ পুরিয়ে পরিবেশ দূষণ করছে ... যেন দেখার কেউ নেই।

এভাবে দিনের পর দিন ইটভাটায় পুড়তে ভীমের জাঙ্গাল নিয়ে স্থানিয়দের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলেও ভূমীদস্যুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে সাহস পাছিল না। প্রশাসনের প্রশ্রয়ে কাজটা হচ্ছে বলে সবার ধারণা ছিল। প্রথমে গোলবাধায়  কয়লাদিয়ার গ্রামের এক কিনটাগারতেন স্কুলের খুদে শিশুরা। তারা স্থানীয় এক সাংবাদিককে কাঁদতে কাঁদতে বলে, চাচ্চু, ভাটার ধোঁয়ায় ক্লাস করতে পারছি না। আপনি মুন্নী ভাটার মালিক সাজাহান চউধুরি চাচ্চুকে বলবেন, সকালের ধোঁয়া না করতে।

সাংবাদিক খোঁজ নিলেন, জাঙ্গালের কেটে নেওয়া অংসের ছবি তুলে প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিলেন। তার পত্রিকা ইটভাটায় পুড়ছে ভীমের জাঙ্গালশিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে টনক নরে স্থানীয় প্রশাসনের। তার সেই দেনেই মাইকিং করে, ভীমের জাঙ্গাল জাতে আর কেউ না কাটে। এতদিনের জমে থাকে বিসবাস্প ফেটে বেরোয়। আশেপাশের ছাত্র জনসাধারণ তিনকিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন করে। তাতে তিব্র ভাষায় স্লোগান ছিল। ভাটা হটাও শিক্ষা বাঁচাও, ইতিহাস পোরান বন্ধ করো। পরিবেশ বাঁচাও ... ইত্যাদি।

এই ভীমের জাঙ্গাল রক্ষার আন্দোলনটি ২০১১ সালের ডিসেম্বরে হয়েছিল। ঘটনার সাত বছর পরে ২০১৮তে এসে দেখা গেল জাঙ্গালটি কোদাল দিয়ে ঐভাবে কাটা না হলেও আবাদি জমির গ্রাসে চলে যাচ্ছে ধিরে ধিরে। এলাকার লোকেরা মনে করে মাতির ঢিবী দিয়ে কি হবে। তার চেয়ে খেত করে ফসল ফলালে বেশি লাভ।

ভীমের জাঙ্গাল সরকারি জমি। আমি নথিপত্র যতটুকু দেখেছি মহাস্তনের অধিনে তথা বগুড়ার হাজার হাজার এক্র ভূমী প্রত্ন অধিদপ্তরের আওতায়। হতাশার কথা বিষয়টি স্থানী প্রশাসন জানেনা। এই সুযোগে ভীমের জাঙ্গাল-এর অনেক এলাকা স্থানিয় অধিবাসীরা দখলে নেয়েছে।                        

মানববন্ধনের একাংশ  

ইতিহাসবিদ প্রয়াত কাজী মোহাম্মদ মিছেরের লেখা রাজশাহীর ইতিহাস গ্রন্থে বলা হয়েছে, আড়াই হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছে পুণ্ড্রনগর, আজকের মহাস্থানগড়। আরও পরে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে এর পাশ দিয়ে গড়ে ওঠে একটি সড়ক ভীমের জাঙ্গাল’, যা এ উপমহাদেশের প্রাচীন স্থাপনার একটি। সড়কটি সিরাজগঞ্জের সীমানা থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে বগুড়া শহরের মধ্য দিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা হয়ে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট অবধি চলে গেছে। সমতল থেকে সড়কটির উচ্চতা ছিল ৩০-৩২ ফুট। প্রস্থে স্থানবিশেষে ৬০-৭০ ফুট।


স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, ভীমের জাঙ্গাল নির্মাণ করেন ভীম নামে এক রাজা যাঁর পরিচয় অজ্ঞাত। তবে অনেকের মতে, তিনি দ্বিতীয় পান্ডব ভীম কিংবা ভগীরথ রাজবংশের অনঙ্গভীম, গজভীম ও রণভীম, এঁদের কোন একজনের সঙ্গে অভিন্ন হতে পারেন। আবার অন্যদের মতে, তিনি ছিলেন বারো শতকের রাজা ভীম, যাঁর পিতৃব্য কৈবর্ত-প্রধান দিব্য পাল রাজবংশের দ্বিতীয় মহীপাল এর কাছ থেকে বরেন্দ্র জয় করেছিলেন। দিব্যের (দিব্যোক) পর সিংহাসনে বসেন তাঁর ভাই রুদক এবং রুদকের পর রাজা হন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ভীম। তিনি পালবংশীয় রাজা রামপাল কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হন। এরূপ বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, সম্ভাব্য পাল আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যূহ হিসেবে এই ভীমই জাঙ্গালটি নির্মাণ করেন। তবে এই জনশ্রুতি স্বীকৃত তথ্য দ্বারা প্রমাণ সাপেক্ষ। (বাংলা পিডিইয়া)  

যাইহোক ভীমের জাঙ্গালটি বাস্তবে টিকে থাকা দুরহ হয়ে পরেছে। তবে একেবারে বিলীন হয়ে যাবে না। বাস্তব অস্তিত্ব ধুঁকতে থাকলেও মানুষের মুখে মুখে টিকে থাকবে। আর থাকবে কাগজপত্রে... এ যে এক অনিঃশেষ ক্রিত্তি।  
#

সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী 
০১৯১২০৭৮৫৯৩
 sajedurrahmanvp@gmail.com       




Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান