পুণ্ড্রের পাঁচালী -৪ (কীচক কাহিনি )


পুণ্ড্রের পাঁচালী -৪ (কীচক কাহিনি )
সাজেদুর রহমান
 সেই সময়ের সমাজ চিত্র 
গল্পটা পাঁচ হাজার বছর আগের। পুণ্ড্র নগরের উত্তরপূর্বে নিভৃত অরণ্য বেষ্টিত মৎস্য নামে একটা দেশ ছিল। সেই দেশের রাজা বিরাটের অগাধ ধনসম্পদ ছিল। সম্পদের মধ্যা ৬০ হাজার গাভীর বিসাল খামার ছিল।

বিশাল এই গোসম্পদ রক্ষায় বড় হুমকি ছিল দস্যুদের হামালা। ডাকাত দোল যখনতখন গোধন লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। রাজা জানতে পারালেন সুশরমার রাজা ত্রিগর্তরাজ ঝামেলাটা করছে। তিনি শ্যালক কীচককে সাথে নিয়ে ত্রিগর্তরাজকে আক্রমণ করলেন। কীচকের দুঃসাহসিকতায় সহজেই পরাজিত করেন। ত্রিগর্তরাজা পালিয়ে দুর্যোধনের কাছে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচায়।

রাজা বিরাট কীচককে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। কীচকের দস্যুদমনের সেই শৌর্য শক্তি দিন দিন বাড়তে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় রাজা ইদানিং কীচকের কোন ব্যাপারে কিছু বলে না।

  সেই করতোয়া এই করতোয়া 


এদিকে পঞ্চপাণ্ডব ১২ বছরের বনবাস যাপন এবং এক বছর অজ্ঞাত বাসের সময়কালে বিরাট রাজার দরবারে নিল। এক্ষেত্রে পাঁচ সদর নিজেদের নাম পরিচয় গোপন করেছিলেন। যুধিষ্ঠি কঙ্ক নামে সভাসদ, ভীম বল্লভ নামে পাচক, অর্জুন বৃহন্নলা নামে রাজ কন্যা উত্তরার সঙ্গীতশিক্ষক, নকুল তন্তিপাল নামে গোশালার অধ্যক্ষ আর সহদেব গ্রন্থিক নামে অশ্বশালার অধ্যক্ষের কাজ নিলেন

পাণ্ডবরা সবাই নিজ নিজ কাজে ভালো করছিলেন। রাজা তাই তাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। এপর্যন্ত ঠিকঠাক চলছিলো, গোল বাঁধল যখন দ্রৌপদীও কাজের খোঁজে এই দেশী এসে হাজির হলেন।

গৌর গায়ের রং। দেখতে সুন্দর। কথা বলে ভদ্র ভাষায়। সমস্যা হল কেউই তাকে কাজ দিতে চাচ্ছিল না। সবার এক কথা, না বাপু তোমাকে দেখে কাজের মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। রানী সুদেষ্ণা তখন প্রাসাদের ছাদ রোদ পোহাচ্ছিলেন। তিনি ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলেন। মেয়েটাকে ডেকে পাঠালেন।
কীচক ইউনিয়ন পরিষদ 

কাজ খুঁজতে আশা মেয়েটা বলল,আমার স্বামী পাঁচজন গন্ধৰ্ব। কোনো কারণে তাদের এখন চরম সঙ্কটে পড়েছে। আর আমি সৈরিন্ধীর কাজ করে দিন কাটাচ্ছি। এর আগে আমি সত্যভামা আর দ্রৌপদীর ঘড়ে করেছি। এখন আপনার কাছে এসেছি। দয়া করে আশ্রয় দিলে খুব উপকার হয়।

সুদেষ্ণা আশ্রয় দিলেন। দ্রৌপদী সৈরিন্ধীর কাজ দিলেন। দ্রৌপদী রানির সেবা করে ভালই চলছিল। রানিও তাকে অত্তাধিক মায়া করত।

এর মধ্যা একদিন রানী সুদেষ্ণার কাছে তার ভাই কীচক দেখা করতে এলো। আর তখন রানী ভাইকে খাবার দেওয়ার জন্য সৌরন্ধ্রীকে আদেস করে। কীচক রূপবতী সৌরন্ধ্রীকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে। অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে, যতক্ষণ না সৌরন্ধ্রী দৃষ্টির আড়াল হয়। ভাইয়ের এই দৃষ্টি বোনের নজর এড়ায় না।

কীচক কোনোপ্রকার রাখঢাক না করেই সৌরন্ধ্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সৌরন্ধ্রীকে রূপী দ্রৌপদী বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে। প্রেমে বাধা পেলে দ্বিগুণ হয়। কীচকের ক্ষেত্রে তা হোল চার গুণ।

ভাইয়ের বারবার অনুরধে বোন সুদেষ্ণা উপাই বের করলেন। এক রাত্র স্নেহের ভাইর জন্য রানি অন্তপুরিতে রাতের খাবারের বিশেষ কয়েকটা পদ রান্না করার হুকুম দিলেন। রান্না হলে সুদেষ্ণা সৌরন্ধ্রীকে ডেকে বলল, পুঁই পাতায় কইমাছের ডিমের ভুনা, শিং মাছের ডিমের পাতুরি, বেসনে ডুবিয়ে বকফুল ভাজি আর ঝিঙ্গা দিয়ে রাঁধা লাবড়া। কীচকের প্রিয় খাবার। তরকারি গুল বাটিতে নাও আর সবুজ কলাপাতায় ধবধবে সাদা ধোঁয়া উঠা গরম ভাত সাজিয়ে ঘরে গিয়ে দিয়ে এসো

খাবার দিতে যাওয়াটা দ্রৌপদী জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর। কীচক তাকে সামনে পেলেই গায়ে হাত দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু রাণীর আদেস ফেলতে পাড়ল না। সে কীচকের ঘরে প্রবেশ করল এমন ভাবে যাতে কোনমতে রেখেই চলে আসতে পারে। যাতে কীচক কিছু করার সুযোগ না পায়।

নিভৃতে সৌরন্ধ্রীকে পাওয়ার এই সুযোগ তো কীচকেরই বুদ্ধিতে, সেটা দ্রৌপদী বুঝতে পারেনি। সে ঘড়ে ঢুকতেই কীচক দ্রৌপদী ধরে ফেলল। দ্রৌপদী মিনতি করে বলল, আমার সাথে এমন করবেন না। আমার পক্ষে আপনাকে গ্রহণ করা সম্ভব না।

কথাটা শুনে কীচকের যেন ক্রোধ বেড়ে গেলো। সে দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে ছুড়ে মাড়ল। দ্রৌপদী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, আমার গন্ধৰ্ব স্বামীরা যদিও দুঃখে পড়েছে, তবুও তারা আমাকে সবসময় সর্বদা রক্ষা করেন। কেউ আমার অপমান করলে, তারা তাকে মেরে ফেলেন। এই কথা শুনে কীচক অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল। খানিকটা বেপরোয়া ভঙ্গিতে সৌরন্ধ্রীকে ছেরে দুহাত প্রসারিত করে বলল, ডাক তোর স্বামীদের, আমার কিছুই করতে পারবে না।

এই সুযোগে দ্রৌপদী কীচককে সজরে ধাক্কা দিয়ে ঘড় থেক বেড়িয়ে দৌরে রাজার কাছে বিচার দিল। মুহূর্ত খানেক পরে সেখানে কীচকও রাজ দরবারে ঢুকে পড়ল। দরবারে তখন যুধিষ্ঠি আর ভীম উপস্থিত ছিল। কীচক রাজাকে তয়াক্কা না করে সেখানেই দ্রৌপদীকে উন্মাদের মতো শারীরিক লাঞ্চিত করতে লাগলো।

কীচকের এই অন্যায় দেখেও রাজ বিরাট কিছু বললেননা। চোখের সামনে দ্রৌপদীর এমন নির্যাতন ভীম পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। যুধিষ্ঠি লক্ষ করল ভীম রাগে কাঁপছে আর একটু পরপরই একটা গাছের দিকে তাকাচ্ছে। ভীম কি ওই গাছ উপড়ে তুলে সভার সবাইকে পিটিয়ে তখতা বানানর কথা ভাবছে? যুধিষ্ঠি ভাবল এটা হলে মহাসমস্যা হবে।

ভীমকে থামাতে হবে। সে বলল, কি হে পাচক ঠাকুর, কাঠের জন্য গাছের দিকে তাকাচ্ছ? কাঠের গাছ বাইরে গিয়া খোঁজ। এই কথা বলার ফাকে ভীমকে ইঙ্গিতে শান্ত থাকাতে বলল।
    
এর পড়ের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে লাগলো। পাণ্ডবেরা সিদ্ধান্ত নিল কীচককে শেষ করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন দ্রৌপদী ঠোটে বাঁকা হাসি দিয়ে কীচককে রাতে তার ঘরে আসার ইঙ্গিত করল। বেপরোয়া কীচক সন্ধ্যা না পেরোতেই দ্রৌপদীর ঘড়ে ঢুকে পড়ল।

পাণ্ডবরা ভেবেছিল রাতে আসবে। তখন সবাই ঘুমিয়ে থাকবে। সেই সুজগে কাজ সারবে। কিন্তু কীচক ঢুকল যখন প্রাসাদে তখন সবাই জেগে আছে। কি আর করা। ভীম যখন হত্যালিলা চালাছিল তখন কীচকের আর্ত চিৎকার ঢেকে দিতে মৃদঙ্গ বাজাতে লাগল।

এই কাহিনীটা বীরটা রাজা পর্বের। মহাঋষি বেদব্যাস রচয়িতা। আর কাসিনাথ বাংলায় মহাভারতে সংসকৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন। মহাভারতে বলা হচ্ছে, কীচক পুণ্ড্র নগরীতে বাস করতেন। তার নামানুসারে করতোয়ার তিরে নৌবন্দরটির নামকরণ হয়।

বৈদিক সাহিত্যে উল্লখিত কীচক এখনও আছে। পুণ্ড্র তথা মহাস্তনা থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরপূর্বে কীচক ইউনিয়ন। এখান থেকে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় যাওয়া যায়। এই গোবিন্দগঞ্জে আজ থেকে খ্রি.পূ. নবম থেকে অষ্টম শতকে গভীর অরন্নের মাঝে কীচকের দুলাভাই-এর মৎস্যদেশের রাজধানি ছিল।

পার্বতীপুর শহর থেক ৪ কি.মি. পূর্বে রংপুরগামী রেললাইনের দক্ষিনে গড়ের পাড় নামে ঢিবি আছে। লোকে তাকে কিচিক রাজোর গড় বলে। ঢিবিটি দখল হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। তবে এই ঢিবিটি সত্তিকারের কীচকের কিনা তা প্রমাণ হয়নি।

মহাভারতের সুত্রে জানতে পারি, ভীম এতটাই রেগে ছিল যে, কীচকের হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙ্গে ভর্তা বানিয়েছিল। কিচকের বেস কয়েক জন ভাই ছিল ভীম তাদেরকেও হত্যা করে।

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান