পুণ্ড্রের পাঁচালী -১০ (নিশি-কুটুম্ব)


পুণ্ড্রের পাঁচালী -১০ (নিশি-কুটুম্ব)
সাজেদুর রহমান 


সেবারে আমরা মহাস্থানগড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। অরূপ রূপের প্রাচীন একটি জাদুবাস্তব শহর পুন্ড্রবর্ধন। বগুড়া শহর থেকে তের চোদ্দ মাইল দূরে শিবগঞ্জ উপজেলার বেতগাড়ী গ্রামে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি। বিশাল বাড়ি। বাড়িটা ফাঁকা, পরিবারে সদস্যরা থাকে শহরে  
   
আমাদের এক বন্ধু হান্না ঐ বাড়ির মালিক। সে স্থানীয় কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক। সে আমাদের অনেকদিন ধরে বলছে, শীতের সময় এদিকে বেড়াতে চলে এসো না! অবাক-করা এক শহর! খুব ভালো শীতের সবজি পাওয়া যায়। আর শিবগঞ্জের আলু তো বিখ্যাত। আলু আর বেগুনের ভর্তা অসম্ভব মজাদার। অবশ্য শীতকালে হাঁসগুলোও বেশ মোটাসোটা। আর থাকার জায়গারও কোনো অসুবিধে নেই। এক একজন দুতিন খানা করে ঘরে নিয়ে শুতে পারে।

ছেলে-মেয়েদের স্কুল ছুটি পেয়েই আমি, মোবারক আর তুহিন আর তার বউ জুঁই আর ওদের ছেলেমেয়ে তানভির আর তানিসা রওনা হয়ে পড়লাম। আমরা আগে কেউ মহাস্থান যাইনি, দেখেই আসা যাক্ মাটির নিচে ঘুমন্ত ইতিহাস

মহাস্থান বাসস্ট্যান্ডে নেমেই আমরা একটা ভাড়ায় মাইক্র পেয়ে গেলাম। মোটরগাড়ি যখন প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল, মাইক্রটা বোধ হয় সেই সময়কার। তার হর্ণ বাজে না। কিন্তু সারা গাড়িতেই এমন ঝকার ঝক্ হুড়ুম হাড়াম শব্দ হয় যে হর্ণের কোনো দরকার নেই। মাইক্রটা দেখলেই রাস্তার লোক দৌড়ে মাঠে নেমে যায় আর অন্য গাড়িগুলো অনেক দূরে থেমে পড়ে। মনে হয়, এখানে মাইক্রটা বেশ বিখ্যাত।
আমাদের অবশ্য বেশ ভালো লাগছিল। মাইক্রটিতে বসে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছি। এক সঙ্গে মাইক্র চড়া আর ঘোড়ায় চড়া হয়ে যাচ্ছে।

তখন বিকেলবেলা। গাড়িটা শহর ছাড়াবার পরেই রাস্তার দুপাশের দৃশ্য বেশ সুন্দর। রাস্তার এক পাসে অনেক দূর পর্যন্ত দুর্গ নগরীর ঢেউ খেলানো প্রাচীর। প্রাচীরটা ঠিক পাহাড় নয়, তবে অনেকটা পাহাড় পাহাড় ভাব। লাল রঙের পাথরের ঢিবি, আর মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট গাছ। আর আকাশটাকে বেশ জমকালো করে সূর্য ডুবছে। ঠিক যেন একটা ছবি। অর্থাৎ চুলকাটার সেলুনের ক্যালেন্ডারে যে-রকম ছবি থাকে, ঠিক সেইরকম।


আমরা মুগ্ধ হয়ে সেই ছবি দেখছিলাম, ইতিমধ্যে মাইক্রওয়ালা আমাদের ভুল রাস্তায় নিয়ে যাচ্ছিল। সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল গকুলমেধে। এখানে নাকি সবাই বেহুলার বাসর ঘড় নামে পরিচিত গকুলমেধ দেখতে আসে। আমরা কলেজে যাবো শুনে সে তো খুব অবাক। ছুটির সময় আবার কেউ কলেজে যায় নাকি?

যাই হোক, কোনো রকমে তো পৌঁছোনো গেল। কলেজেরর গেটেই দাঁড়িয়েছিল হান্না। হাতে একটা বিরাট লম্বা লাউ, ঠিক একটা গদার মতন। আমাদের দেখে এক গাল হেসে বললো, তোরা আসবি বলে এক্ষুনি এই লাউ কিনলাম।
মোবারক অমনি ধমক দিয়ে বললো, মোটেই আমরা লাউ কিংবা আলু-বেগুনের ভর্তা খেতে এখানে আসিনি। বেগুন খেলে আমার গা চুলকায়।
হান্না বললো, দুকেজি বড় বড় শিংমাছও কিনেছি অবশ্য।
মোবারক বললো, আলু ভর্তা শিংমাছের ঝোল জিনিসটা অবশ্য মন্দ নয়। কিন্তু মোটা মোটা হাঁসগুলো কোথায়?

জুঁই বললো, একি, এসেই তোমরা খাওয়ার কথা শুরু করলে যে!

তানভির আর তানিসা ডন বৈঠক দিতে শুরু করেছে। মাইক্রর ঝাঁকুনিতে ওদের গায়ে ব্যাথা হয়ে গেছে। তারপরই ওরা এক ছুটে চলে গেল বাগানে।
জিনিসপত্র নিয়ে আমরা চলে এলাম হান্নার বাড়িতে। বাড়িটার সামনে ইটের দালান আর ভেতরের কয়েকটা ঘর মাটির। সব মিলে বারোখানা ঘর। মাটির ঘড়ের প্রকাণ্ড জানালা, শহরের গ্রীলদেয়া জানালা না, খোলামেলা জানালা। এত প্রকাণ্ড জানালা যে মনে হয় আকাশটা জানালা গলে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। ঘন সাঁঝের রক্তিমাভ আকাশ, যেন গাদাখানিক কমলা-লাল রঙ আকাশে লাগানো হয়েছে। রঙ এখনও শুকয়নি। টাটকা রঙের গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে।       

বাড়ির ভেতরে বিরাট বড় আঙিনা। আঙিনায় অনেক রকম গাছপালাও রয়েছে। তানভির আর তানিসা বেশ খানিকক্ষণ সেখানে হুটোপুটি করার পর ঝগড়া করতে করতে ফিরে এলো। তানভির আর তানিসা বয়েস তেরো আর এগারো, কিন্তু ওরা মাঝেমাঝেই বড় ঝগড়া করে।
বাসে আসবার সময় তানভির একটা বাঁশের বাঁশী কিনেছিল। এখানে খেলতে খেলতে সেটা একবার একটা গাছতলায় রেখেছিল। আর খুঁজে পাচ্ছে না। সে বলছে, তানিসা সেটা নিয়েছে।
আর তানিসা বলছে, মোটেই আমি নিইনি। ঐ পচা একটা বাঁশী নিতে আমার বয়ে গেছে!
সে দুহাত তুলে দেখালো, কোথায় বাঁশী? আমার কাছে আছে!
তানভির বললো, তুই নিশ্চয়ই লুকিয়ে রেখেছিস কোথাও!
আমরা ওদের ঝগড়া থামালাম। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আমি বললাম, কাল সকালে আমিই খুঁজে দেবো বাঁশীটা। বাগানেই নিশ্চয়ই কোথাও পড়ে আছে।
রাতের খাওয়া দাওয়া বেশ ভালোই হলো। বেলিরমা নামে একজন মহিলা ভালোই রাঁধে। শুধু ডাল রাঁধতে জানে না। ডালের বাটিতে নেমে অনায়াসে সাঁতার কাটা যায়।

খাওয়ার আগে ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমরা তার মানে বুঝতে পারিনি। সন্ধের পর আমরা চা খাচ্ছিলাম। মোবারক ওর চায়ের কাপটা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। আমরা ঘরের মধ্যে। চমৎকার ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। ছাতিম ফুলের গন্ধ। মোবারক গান গাইছিল আপন মনে। একটু বাদে ঘরের মধ্যে ফিরে এলো। চায়ের কাপটা বারান্দাতেই রেখে এসেছে। সেটা মনে পড়তেই বারান্দায় ফিরে গিয়ে দেখলো, কাপটা নেই।
মোবারক চেঁচিয়ে বললো, আরে, আমার চায়ের কাপ কোথায় গেল?
আমরাও বারান্দায় গিয়ে খুঁজলাম। চায়ের কাপটা পাওয়াই গেল না।

জুঁইঃ নিশ্চয়ই আপনি কাপটা ভুল করে অন্য কোথাও ফেলে এসেছেন।

মোবারকঃ না, এই তো বারান্দার রেলিং-এর ওপর রেখেছিলাম।
রেলিং-এর ওপর কেউ কাপ রাখে? নিশ্চয়ই নিচে পড়ে গেছে। আমরা সবাই মিলে বকলাম মোবারককে। মোবারক আঙিনায় গিয়েও দেখে এলো। সেখানে ভাঙা কাঁচের টুকরোও পড়ে নেই। তাহলে চায়ের কাপ কোথায় যাবে? অর্ধেক চা ভর্তি কাপ তো আর হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে না। মোবারকের যা ভুলো মন। নিশ্চয়ই অন্য কোথাও রেখেছে কখন।

হান্না তখন হাটে গিয়েছিল কয়েকটা জিনিসপত্র কিনতে। সুতরাং কাপের ব্যাপারটা আমরা একটুবাদে ভুলে গেলাম।

এখানে চাপকলের পানি নেই। পাশে বেশ বড় একটা বালতিতে পানি তোলা আছে। কলতলা উঁচু করে পার বাঁধানো। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, মুখ ধোওয়ার জন্য কেউ বাইরে যেতে চায় না। কলে পানি তোলা হোল। তোলা পানি বেস গরম। বালতি ভরে ভরে জল আনা হতে লাগলো ভেতরে। আমিই চেপে চেপে পানি তুলছিলাম। পরিশ্রম করলে শীত কেটে যায়।

পানি তোলা শেষ হলে বলতি টালতি নিয়ে ভেতরে আসবার পর খেয়াল হলো স্যান্ডেলটা ফেলে এসেছি। ফিরে এসে দেখি স্যান্ডেল জোড়া অদৃশ্য হয়ে গেছে।
আমি বুঝে গেলাম, এটা মোবারকের কাণ্ড। খানিকটা আগে চায়ের কাপের জন্য ওকে বকেছি বলে ও আমার স্যান্ডেলটি লুকিয়েছে। ফিরে গিয়ে আমি কাউকে কিছু না বলে মোবারকের স্যান্ডেলটি নিজের পায়ে পরে নিলাম।
মোবারক একটু পরেই বললো, এই, তুই আমার স্যান্ডেলটি পরেছিস কেন?

আমিঃ তুই আমার স্যান্ডেলটি কোথায় লুকিয়েছিস, দে!

মোবারকঃ আমি তো তোর স্যান্ডেল নিই নি।

আমিঃ কলের পাড় থেকে তুই যে আমার স্যান্ডেলটি পরে চলে এলি?

মোবারকঃ না সত্যিই না।
তখন টর্চ নিয়ে আমরা দুজনে আবার গেলাম কলের ধারে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও স্যান্ডেলটি পাওয়া গেল না।
মোবারক তখন চোখ গোলগোল করে বললো, একি ভুতুড়ে ব্যাপার নাকি? আমার কি রকম সন্দেহ হচ্ছে!
চাঁদ ওঠেন, তাই ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারদিক নির্জন। এর মধ্যে ভূতের নাম করা মোটেই উচিত নয়।
আমি তবু সাহস সঞ্চয় করে বললাম, যাঃ ভূতে স্যান্ডেলটি নিয়ে কি করবে?
তাহলে স্যান্ডেলটি জোড়া গেল কোথায়? এই মাত্র ছিল এখানে।
কিন্তু ভূতে কখনো জুতো নেয়, তা শুনিনি! ভূতেরা তো জামা কাপড়ই পরে না। জামা কাপড় না পরে শুধু স্যান্ডেলটি কেউ পায় দেয়?
স্যান্ডেলটি পরা একটা ভূতের কথা চিন্তা করতেই আমার হাসি পেল। আমি বললাম, নিশ্চয়ই কুকুর-টুকুর এসে...

মোবারকঃ আমার চায়ের কাপটাও কি কুকুরে নিয়েছে?
এমন সময় একটা হালকা বাঁশীর আওয়াজ শোনা গেল বাড়ির বাইরে থেকে। কেউ যেন নতুন বাঁশী শিখছে।
মোবারক ভয় পেয়ে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো, শুনতে পাচ্ছিস? তানভির যে বাঁশীটা হারিয়ে গিয়েছিল...
এবার আমারও একটু সন্দেহ হলো। কিন্তু মোবারকের কাছে সাহস দেখানো দরকার। তাই বললাম, চল্, বাড়ির বাইরে খুঁজে দেখে আসি।
মোবারক কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, হান্নাকে ডাকি তাহলে?

আমি বললাম, ওকে ডাকতে হবে কেন? আমরা দুজনে তো আছি, সঙ্গে টর্চ রয়েছে।
দুজনে খুব ঘেঁষাঘেঁষি করে বাড়ির বাইরে ঘুরে আসলাম। কোথাও কেউ নেই। বাঁশীর শব্দটাও থেমে গেছে। টর্চের আলোয় এক সময় দেখতে পেলাম, সানবাঁধা পুকুর পাড়ে তানভিরের বাঁশীটা পড়ে আছে। মাঝখান থেকে ফাটা, সেটা থেকে শব্দ বেরুবার কথা নয়।


দুজনে ছুটতে ছুটতে ফিরে এলাম ঘরে। মোবারক সোজা হান্নার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, এখানে ভূত আছে, আমাদের বলিস নি কেন?

হান্না অবাক হয়ে বললো, ভূত! ভূত আবার কি?
আলবত্‌ এখানে ভূত আছে।

তোদের মাথা খারাপ। এই পাড়ায় আটচল্লিশ ঘরে প্রায় শ’তিনেক লোকের বাস। এত ঘন বসতির মাঝে ভূত তো দূরের কথা ব্রহ্মদৈত্যও আসতে সাহস করবে না। আজকালকার ছেলেছোকরাদের তো চিনিস না!

মোবারক তবু বললো, তাহলে ছোটনের স্যান্ডেল, আমার চায়ের কাপ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কি করে?

তানভির আর তানিসা ভূতের কথা শুনেই চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। আর হান্না হো-হো করে হাসছে। এরকম সময় হাসি কারুর ভালো লাগে?
এক সময় হাসি থামিয়ে হান্না বললো, সত্যি, ধলুর কথাটা তোমাদের আগেই বলে দেওয়া উচিত ছিল।

আমরা তিন চারজন মিলে একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ধলু? ধলু আবার কে?
হান্না বললো, সে একটা সাঙ্ঘাতিক চোর। তার জ্বালায় এখানকার সব লোক অস্থির।
চোরের কথা শুনে সকলের ভূতের ভয় কমে গেল। তানভির বললো, চোরটাকে পুলিশে ধরতে পারে না?

হান্না বললো, ধরবে কি করে, তাকে দেখতেই পাওয়া যায় না! সে যে কখন আসে আর কখন যায়, কেউ টের পায় না। তবে, সে খুব বড় কিছু কিংবা দামী কোনো জিনিস এখনো চুরি করেনি। তাই সব সময় লোকে পুলিশে খবরও দেয় না!
বলতে বলতেই হান্না ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো। ব্যস্ত হয়ে বললো, কলের পাড়ে বালতি ফেলে আসোনি তো? তাহলে এতক্ষণ গেছে।

সবাই মিলে কলের পাড়ে ছুটলাম। অন্য বালতিগুলো ভেতরে আনা হয়েছিল। কিন্তু যে-বালতিতে আগে থেকে পানি ধরা ছিল সেটা পানি ভরে রাখা হয়েছিল। গিয়ে দেখি সেটা হাওয়া হয়ে গেছে!

রাতে আমরা জানলা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পরলাম। সকালে উঠে দেখা গেল আর কিছু চুরি যায়নি।

চা-টা খেয়ে আমরা বেড়াতে বেরহলাম। কাছেই একটা ছোট নদী আছে। গাংনই নাম। বেশ টলটলে জল। একটু দূরে দূরে গ্রামও রয়েছে কয়েকটা। সেরকম একটা গ্রাম রামকান্দি। গ্রাম পেরুলেই কীচক। মহাভারতে বলা হয়েছে পুণ্ড্র নগরীর উপকণ্ঠে করতোয়া নদীর তীরে কীচক নামে এক সেনাপতি বাস করতেন। দ্রোপদিকে অপমানিত করার কারণে মহাবীর ভীম কীচককে হত্যা করেন। একসময় এই কীচকের নামে নৌবন্দর ছিল। কালের গর্তে হারিয়ে গেছে। এখন রামকান্দি আর কিচকে পানের বরজ নার্সারি ফলজ বাগান। তানভির আর তানিসা ছুটে ছুটে একবার রামকান্দি একবার কীচকে আসা যাওয়া করতে লাগলো। তাই দেখে মোবারক বললো, একেই বলে পৌরনিক রাজ্য দৌড় প্রতিযোগিতা!

হান্না জানালো, কাছেই একটা গ্রাম আছে। নাম বারামদেউল। প্রাচীন কালে এখানে বেতের নৌকা তৈরি হত। সেই নৌকায় করে চাল দূর দূরান্তে রফতানি হত। বেতের নৌকার সেই চালকে বালাম চাল বলা হত। ধারণা করা হয়, আমাদের গ্রাম বেতগাড়ীতে বেতঝার ছিল।

মহাস্থানগড় জুড়েই যেন এক বিচিত্র পরিবেশ প্রাচীনত্ব আর আধুনিকতার এমন সন্মেলন খুব বেশি জায়গায় চোখে পড়বে নাএখনো মহাস্থানগড়ের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে প্রাচীন আমলের অসংখ্য ভবনের ভগ্নাংশ এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা কাদামাটির সঙ্গে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই পোড়ামাটির ইটগুলো দিয়ে তাদের বাড়িঘর তৈরি করেন তারা যে কতো অমূল্য সম্পদকে নষ্ট করে ফেলছে তা নিজেরাই জানেন না এখানে প্রায়ই খনন কাজের সময় মাটির নিচ থেকে উঠে আসে ইটের টুকরা বা পোড়ামাটির আসবাবের ভগ্নাংশ কখনো কখনো পাওয়া যায় ছোটখাট মূর্তি বা মুদ্রা…

আমরা গেলাম লহনার ধাপে গেলাম। স্থানীয়রা বলে লহনার ঢিবি। জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত যা মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে সেকেন্দ্রাবাদ মৌজায় অবস্থিতএটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনালহনার ঢিবির পূর্বে দৈর্ঘ্য ছিলো ৭২ মিটার, প্রস্থ ৪২ মিটার ও উচ্চতা ৬ মিটার বর্তমানে এটির দৈর্ঘ্য ৬০ মিটার, প্রস্থ ৫৪ মিটার ও উচ্চতায় ৩ মিটার

হান্নাঃ এই ঢিবির প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যাবে ইমারতের উৎখনন করলে এই ঢিবি লহনা নামে আকর্ষনীয় এক নারীর চরিত্রের আস্তিত্ব বহন করে শিবগঞ্জ উপজেলার অন্যান্য ১০টি ঢিবির মতোই এই ঢিবিটিতেও ইট চোরের কারণে বিপর্যয়ের চিহ্ন বিদ্যমান
ইতিহাসবিদ সাথে থাকলে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা দেখার মজাই আলাদা।

দিন ফুরিয়ে যাওয়ায় ফিরে এলাম।  

ফিরে এসে শুনলাম, আমাদের জন্য যে দুটি হাঁস কিনে রাখা হয়েছিল, সে দুটোই চুরি হয়ে গেছে। রান্না ঘরের বারান্দায় একটুক্ষণের জন্য হাঁস দুটোকে রেখে বেলিরমা ভেতরে গিয়েছিল একটা গামলা আনতে, সেই ফাঁকেই ধলু এসে সে দুটো নিয়ে গেছে।
সেই দুপুরে বাধ্য হয়ে আমাদের ভর্তা ভাজি খেতে হলো বলে আমরা ধলুর ওপর সত্যিই খুব রেগে গেলাম।

রাতের খেয়ে দেয়ে ওঠার পর ধলুর আর এক কীর্তি টের পাওয়া গেল। জুঁই বাইরের দড়িতে ছেলেমেয়েদের জামা প্যান্ট আর নিজের একটা শাড়ী কেচে শুকোতে দিয়েছিল। সে সব তো গেছেই, এমনকি দড়িটা পর্যন্ত নেই!

তুহিন এবার রেগে গিয়ে হান্নাকে বললো, এ কোন জায়গায় নিয়ে এলি আমাদের? চোরের রাজত্ব একটা!

হান্নাঃ  বললো, নারে দোস্ত এখানে আর কোনো চোর নেই, শুধু ধলুর উৎপাতেই নতুন লোকেরা জব্দ হয়ে যায়।

তুহিনঃ কেন, ধলু কি পুরোনো লোকদের জিনিস চুরি করে না?
না, তা নয়। আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আমরা কোনো কিছুই বাইরে রাখি না। ধলুর কিন্তু একটা গুণ আছে। সে কক্ষণো ঘরে ঢুকে কিছু চুরি করে না। তুমি ঘরের দরজা খুলে রাখো, ভেতরে যতই দামী জিনিস থাক সে হাত দিতে সাহস করবে না।
মোবারক ধমক দিয়ে বললো, থাম, চোরের আবার গুণ! এখানকার পুলিশ কি এতই অপদার্থ যে একটা চোরকেও ধরতে পারে না?

হান্নাঃ শুনেছি, অনেকদিন আগে ধরে পড়েছে দুএকবার। কিন্তু ছিচকে চুরি তো, দু মাস তিন মাস জেল খেটে বেরিয়ে আসে, আবার চুরি করে। লোকটার দেখা পাওয়াই খুব শক্ত। ডাবোর গ্রামে ওর বাড়িও আছে, সেখানে গিয়েও ওকে ধরা যায় না। একবার আমাদের গ্রামের লোকজন ওকে রাত্তিরবেলা প্রায় ধরে ফেলেছিল। তাও হাত ফসকে পালালো। দৌড়ে গিয়ে একটা পুকুরে লাফিয়ে পড়লো, তারপর আর দেখাই গেল না।
ওকে কিরকম দেখতে? জানতে চাইলে হান্না জানাল, রোগা, ছোট্টখাট্টো চেহারা, কাঁধে একটা ঝোলা।

তুহিন ভ্রু কুচকে বলল, এই চোর দেখছি পেশাদার চোর

মোবারকঃ চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা     

হান্নাঃ মজার কথা কি জানো এই চোর কিন্তু আমাদের এই বঙ্গ দেশে বহু প্রাচীন এক চরিত্রপ্রাচীন বাংলার গ্রামে এই চোরদের কথা শোনা যায় প্রচলিত আছে কত শত কিংবদন্তী ‘চোরচক্রবর্তী’ নামে এক প্রাচীন গ্রন্থে বলা আছে-চোর-শাস্ত্র জানলে মানুষের বুদ্ধি বাড়ে, মানুষ চতুর হয়। ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে একজন চোরকে কেমন হতে হয় তার মজার বিবরণ আছে। সেখানে চোরের সংলাপেই চোর বলছে, “আমি বিড়ালের ন্যায় নিঃশব্দে গমন করিতে পারি মৃগের ন্যায় দ্রুতবেগে দৌড়াইতে পারি শ্যেন পক্ষীর ন্যায় সহসা গ্রাহ্য বস্তু ধরিতে ও খণ্ড খণ্ড করিতে পারি কুক্কুরের ন্যায় নিদ্রিত ও জাগরিত ব্যক্তির বল পরীক্ষা করিতে পারি সর্পের ন্যায় বক্ষোপরেও গমন করিতে পারি এবং আমি নানাবিধ রূপ ধারণে ও বিবিধ বেশ বিন্যাসে ঐন্দ্রজালিকের সদৃশ, সর্বদেশীয় ভাষার উচ্চারণে দক্ষ, এবং স্থলপথে ঘোটকের ও জলপথে নৌকার তুল্য

চুরিবিদ্যা বিষয়ে প্রাচীন গ্রন্থের পৃষ্ঠা উল্টে জানা যায়, প্রাচীন বঙ্গদেশে চোরদের বিভিন্ন পশু ও পাখির ভাষাও নাকি আয়ত্ত করতে হতো চুরি করার জন্য চোরদের কাজ অন্ধকারে তাই তখন একজন চোরের চোখ ও কান এই দুই ইন্দ্রীয়কে হতে হতো ভীষণ প্রখর গ্রামে এক সময়ে চোররা বাড়িতে সিঁধ কেটে চুরি করতো চোরদের কাছে সিঁধকাঠি ছিলো ভীষণ পবিত্র এক বস্তু জানা যায় এই সিঁধ ছিলো ছয় ধরণেরঃ পদ্মব্যাকোষ অর্থাৎ ফুটন্ত পদ্মফুলের মতো সিঁধ, ভাস্কর সিঁধ হচ্ছে সূর্যের মতো গোলাকার, বালচন্দ্র কাস্তের আকৃতি, বাপী নামের সিঁধ হচ্ছে পুকুরের মতো চারকোনা অর্থাৎ চওড়া

এছাড়াও ছিলো স্বস্তিকা চিহ্নের মতো দেখতে সিঁধ আর পূর্ণকুম্ভের মতো সিঁধ চোরদের আইনশাস্ত্রে নিষেধ ছিলো, রোগীর বাড়িতে প্রবেশ না করতে অসুস্থ মানুষ জেগে থাকে অনেক রাত অবধি নিষেধ ছিলো বেশ্যা নারী অথবা লম্পট পুরুষের বাড়িতে চুরি না করতে কারণ এই দুই প্রজাতির বাড়িতেই মানুষের চলাচল বেশী থাকে এরা নিজেরা্ও ঘন ঘন বাড়ি থেকে বের হয়

মোবারকঃ আচ্ছা, এই চোর শব্দটার উৎপত্তি কোথায়?

আমিঃ অভিধানে চুরি (চৌরকার্য, হরণ, আত্মসাৎ) যে করে সে চোর সংস্কৃত ভাষায় বলা হয়, চৌর, তস্কর চৌর্যবৃত্তি যার পেশা সে পেশাদার চোরসমাজের চোখে চুরি অপরাধ এবং চোর অপরাধী

হান্নাঃ প্রাচীন বঙ্গ সমাজে এক সময়ে অপরাধ বা ক্রাইম বলতে ছিলো শুধু চুরি বৈদিক শব্দ ‘তায়ু’ মানে চোর এই শব্দের সংশ্লিষ্ট তিনটি শব্দ হচ্ছে স্তেন অর্থ চোর ও চুরি, স্তেয় শব্দের অর্থও চুরি অস্তেয় শব্দের অর্থ চুরি না করাক্রমে ক্রমে চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো অনেক নাম যেমন ধুতালিয়া শব্দটি প্রাচীন বাংলা ভাষায় পাওয়া যায় এর অর্থ প্রবঞ্চক, ঠগ আবার সিন্ধালিয়ার অর্থ সিঁধেল চোর এমনি ভাবে ফাঁসুড়েকে বলা হতো গলসীচর্যাপদে আছে ‘‘যো সো চৌর সোই দুষাধী, যে সে চোর যেই চোর-ধরা’’ ‘দুষাধী’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, যে দুঃসাধ্য কর্ম করে অর্থাৎ দক্ষ ব্যক্তি, গোয়েন্দা

মোবারকঃ এই চর্যাপদের রচয়িতা লুইপাদ না ভুসুকুপাদ। যতদূর জানি এরা বাঙালি ছিলেন এবং পুণ্ড্রবর্ধনের নাগরিক।

হান্নাঃ হতে পারে। তবে গোটা মানব সমাজে ছড়িয়ে আছে এমন চোরদের গল্প। বাংলার পাল আমলের শাস্ত্র নির্দেশিত ১০টি অপরাধের দণ্ডের মধ্যা চোরের শাস্তি জরিমানার কথা জানা যায়। অপরাধের জরিমানা থেকে রাজকোষে বড় অংকের কর আসত সেটা বলাই বাহুল্য। ইতিহাসে তার কোন বিবরণ আমরা পাই না। তবে এসব ক্ষেত্রে সমসাময়িক কালে পাল রাজারা বড়ই উদার ছিলেন। কারণ দণ্ড কেবল জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ অষ্টাদশ শতকে খোদ ইংল্যান্ডেও সামান্য রুমাল চুরির অপরাথে নাবালকেরও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত।

তুহিনঃ একজন মানুষ কেনো চোর হয়, কেনো সে এই পেশা বেছে নেয় কেনো? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট তবে শুধু এই সংকট থেকেই মানুষ তস্কর হয়ে যায় না লোভ নামের রিপু তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় তবে চিকিৎসা ও মনোবিজ্ঞান বলে ‘ক্লিপটোম্যানিয়া’ নামে বিশেষ মানসিক অবস্থার কথা এই অবস্থায় মানুষ নিজের মনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে চুরিতে অভ্যস্ত হয়ে যায় এটি এক ধরণের মানসিক রোগ

আমিঃ এই ‘ক্লিপটোম্যানিয়ার’ মতো মানুষের মনের আরেকটি বিকার ‘প্লেজিয়্যারিজম’ল্যাটিন শব্দ ‘প্লেজিয়্যারিয়াস’-এর অর্থ হচ্ছে সাহিত্য ভাবনার চুরি বা অপহরণ। বুদ্ধিবৃত্তির চুরির নানা দিক আছে। আমাদের দেশে যে প্রত্নবস্তু চুরি হয় সেটাকেও এই ক্যাটাগরির চুরি বলা যায়।

হান্নাঃ মহাস্থানের কত কত প্রত্নবস্তু চুরি হয়েছে হচ্ছে তার হিসেব করতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।      

বর্তমান পুন্ড্রবর্ধন নগরে এখন ইলেট্রিক লাইট জ্বলে নানা রকম দোকানপাট আর আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এখানে এখানেই নিয়মিত বসে বৃহত্তম হাট ও বাজার কৃষিজ ও অন্যান্য পণ্য পরিবহনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে এখানে প্রচুর কর্মচাঞ্চল্য
  
এর পরের দু’দিনে আমাদের দুজোড়া স্যান্ডেল, তিনটে গেঞ্জি, তানিসার চুলের ব্যান্ড, তানভিরের ক্রিকেট ব্যাট, জুঁইয়ের চিরুনিচুরি হয়ে গেল। কোনো জিনিস ভুল করে একটুও বাইরে ফেলে রাখার উপায় নেই। টুক করে জিনিসটা নিয়েই অদৃশ্য হয়ে যায়।
তানভির আর তানিসা তো দারুণ ক্ষেপে উঠলো। তারা ঠিক করলো, চোরটাকে ধরবেই! তানভির কখনো চোর দেখেনি, তার ধলুকে দেখার দারুণ উৎসাহ। অনেক সময় ওরা ইচ্ছে করে বাগানে কোনো জিনিস ফেলে এসে আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে। তখন কিন্তু ধলু আসে না। সেও কম চালাক নয়।

রাস্তায় ঘাটে কোনো রোগা আর ছোট্টখাট্টো চেহারার লোক দেখলেই আমাদের সন্দেহ হয়। সেরকম কোনো লোককে যখন আমরা সন্দেহ করেছি, তখনই হয়তো ধলু অন্যদিক থেকে এসে আমাদের আর একটা জিনিস চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
দিন সাতেকের মধ্যে হুপা সত্যিই আমাদের জব্দ করে দিল। কিছুতেই আমরা তাকে একবার দেখতেও পেলাম না, অথচ সে সমানে আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে পালাচ্ছে। অন্ধকার হলেই মনে হয়, যে-কোনো গাছের আড়ালেই বোধহয় থলে ঘাড়ে করে ধলু ঘাপটি মেরে বসে আছে। কোনো জিনিসে তার অরুচি নেই। কয়লাভাঙা হাতুড়িটাও সে বাদ দেয় না।

দুদিন বাদে আমাদের ফিরতে হবে। তানভিরের বেশী আফশোস, সে ধলুকে একবার, অন্তত একবার দেখতেও পেলে না। এত কাছে এসেও একটা চোর দেখা গেল না।
সেদিন সকালে আমরা গাংনুই নদীর তীর ধরে বেড়াতে গেছি। হান্না বললো, এই যায়গাকে নামাপলি বলে। ডাবুর গ্রাম এটি। এখানেই ধলুর বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই বললাম, দেখতে যাবো! হান্না বললো, তাকে কিছুতেই বাড়িতে পাবে না। আমরা বললাম, তা হোক্।

একটা পুকুর ধারে একটা বাঁশের চ্যাচাড়ির তৈরি বাড়ি। তাও ভাঙাচোরা। বাড়ির পাশের লাউমাচার কাছে খুব ছেঁড়া কাপড় পরা একজন মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে। হান্না বললো, ঐ ধলুর বৌ। ধুলোয় বসে দুটো ছেলেমেয়ে বিচ্ছিরি গলায় কাঁদছে। ওরা ধলুর ছেলেমেয়ে। তাহলে ধলু নামে সত্যিই একজন কেউ আছে। চোর দেখা হলো না বটে, কিন্তু চোরের বাড়িটা দেখা হয়ে গেল।
তানভির জিজ্ঞেস করলো, ছেলেমেয়ে দুটো কাঁদছে কেন?
আমরা কেউ কোনো উত্তর দিলাম না। তানভির বললো, চোরটা কি পাজী, আমরা খেলনাগুলো চুরি করে এনেছে, তাও নিজের ছেলেমেয়েদের খেলতে দেয়নি। তা হলে চুরি করে কেন ও?

ফেরার সময় দেখলাম, আলিয়ারহাটের ভেতর দিয়ে আসছিলাম। হান্না বলছিল, এই আলিয়ারহাটের উপর দিয়ে ভীমের জাঙ্গাল নামের সবুজ উঁচু ভূমির অস্তিত্ব ছিল। সেই জাঙ্গালের অস্তিত্ব দিনে দিনে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, যা ছিল ইতিহাসের পাতার নানান ঘটনার সাক্ষী, তাতে ভূমিগ্রাসীদের চোখ পড়েছে। এসব প্রত্ন মাউন্ট দখল করা হয়েছে।    

ভীমের জাঙ্গাল ছাড়াও মহাস্থানগড়ের দশ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে উঁচুভূমি আছে ৩৬টি। যেগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক ভাষায় ‘মাউন্ট এই  ঢিবিগুলোর (মাউন্ট)বেশিরভাগই বেআইনী দখল করে সমতল করা হয়েছে। শিবগঞ্জে আর গোকুল এলাকায় অন্তত দশটি মাউন্ট কেটে সমতল ভূমি করে দখল করা হয়েছে। সেখানে কোথাও আবাদ করা হয়েছে। কোথাও অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে, যা খালি চোখে দেখা যায়। টিলা গুলোর মধ্যে বনপতির ধাপ, খুলনার ধাপ, ওঝা ধনতলি ভিটা, ছোট ট্যাংরা, বড় ট্যাংরা, রাজা গোপীনাথের ধাপ, সওদাগর ভিটা, চিরিঞ্জির ধাপ, দোল মঞ্চ, রস মঞ্চ, ডাকিনির ধাপ...।  
হান্নার কথায় ছেদ পরলরাস্তা দিয়ে একজন মোটা মতন লোক মাইকে গান বাজাতে বাজাতে কি যেন বলছে। মন দিয়ে শুনলাম, আসছে সুক্রবার হাটের পাসে মাঠে হাডু-ডু খেলা অনুষ্ঠিত হবে, সেই কথা জানাচ্ছে। এখানকার গ্রামের লোকেরা কাবাডিকে হাডু-ডু বলে।

মোবারক হঠাৎ বললো, আচ্ছা ধলুকে আমাদের বাড়িতে একবার নেমন্তন্ন করলে হয় না? আমরা ওকে কিছু বলবো না, পুলিশেও ধরাবো না। শুধু দেখবো। চোরটা কিন্তু সত্যিই মজার!

তানভির আর তানিসা লাফিয়ে উঠলো, হুররে, আমরা দেখবো, আমরা দেখবো।
হান্না বললো, কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে কোথায়? ওর বাড়িতে কিছু বলে লাভ নেই। দুদিন তিনদিন হয়তো বাড়িই ফেরে না!

মোবারক বললো, আমি সে ব্যবস্থা করছি। মোবারক সেই মাইকে ঘোষককে ডেকে কিছু বলে এলো। টাকাও দিলো শখানেক। তারপর থেকে সেই মাইকে ঘোষণা হতে লাগলো, আজ রাতে হাজীপাড়ার বিশিষ্ট বেক্তি প্রফেসর হান্নানের বাড়িতে ধলুর দাওয়াত, ঢাকা থেকে আগত মেহমানরা তাকে খাওয়াবেন। তার কোনো ভয় নেই। সে পেট ভরে খাবে। গোপনিয়তা রক্ষা করা হবে! মেহমানরা পোলাও মাছ মাংস আর এক খিলি পান খাওয়াবেন।

সেদিন সন্ধ্যের পর থেকেই ধলুর দাওয়াতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হতে লাগলো। তানভির আর তানিসা বিকেলেই কয়েকটা বড় বড় কাগজে লিখেছে, ধলু, আজ তোমার দাওয়াত, তোমাকে মারা হবে না, বকা হবে না, জিনিস ফেরত চাওয়া হবে না। এসো কিন্তু! তারপর সেই কাগজগুলো আটকে দিয়েছে কয়েকটা গাছে।

চোর একটু বেশী রাত্রেই আসবে ভেবে আমরা নিজেদের খাওয়া দাওয়া আগে সেরে নিলাম। তারপর থালা-বাটিতে ধলুর খাবার সাজিয়ে রেখে দিলাম পুকুরপাড়ের উঁচু বেদিতে। ধলু ঘরের মধ্যে ঢোকে না বলে বাইরে তার খাবার রাখতে হলো। আমরা সবাই মিলে বসে রইলাম ঘরের চৌকাঠে।

রাত বাড়তে লাগলো, ধলু আর আসে না। আলিয়ারহাট বাদেও আশেপাশের গ্রামে মাইকে জানানো হয়েছে, ধলু খবর পেয়েছে নিশ্চয়ই। সে কি আমাদের বিশ্বাস করতে পারবে না?

তানভির আর তানিসা ছড়া বানিয়ে সুর করে বলতে লাগলো, আয়, আয়, ধলু আয়! ভাত দেবো, মাছ দেবো, পিঁড়ি পেতে বসতে দেবো, গেলাস ভরে জল দেবো, বাটি ভরে মাংস দেবো, ছাঁচি পান দেবো, আয় আয় ধলু আয়!
ধলু আর আসে না। দশটা, এগারোটা, এমনকি বারোটা পর্যন্ত বেজে গেল, তবু ধলু এলো না। চোরটা তো আচ্ছা নেমকহারাম! তুহিন, জুঁই আর হান্না রাগ করে শুতে চলে গেল। তানভির আর তানিসা জেদ করে বসে থাকলেও আর বেশীক্ষণ জাগতে পারলো না। ঘুমিয়ে পড়লো সেখানেই। আমি আর মোবারক বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। একসময় সব গল্পও ফুরিয়ে গেল।

কখন দুজনেই যে ঝিমিয়ে পড়ে ছিলাম তা খেয়াল নেই। হঠাৎ জেগে উঠেই চমকে উঠলাম। থালা বাটিগুলো সব খালি। কাছে গিয়ে দেখলাম সব কিছু চেটে পুটে কে যেন খেয়ে গেছে। মানুষই নিশ্চয়ই, নইলে ঐরকমভাবে থালা বাটি পরিষ্কার হয় না। কতটুকু সময় মাত্র আমরা ঝিমিয়েছিলাম, তারই মধ্যে ধলু এসে খেয়ে গেছে!
থালা বাটি গুলোও যে সে নিয়ে যায়নি, সেটাই অবাক কাণ্ড। তাতেই বুঝলাম, আজ সে চুরি করতে আসেনি, দাওয়াত খেতেই এসেছিল। দাওয়াত খেয়ে কেউ থালাবাটি সঙ্গে নিয়ে যায় না, সেইটুকু জ্ঞান আছে। তবে বোধহয় বড্ড লাজুক, আমাদের চোখের সামনে খেতে চায়নি।

তারপর যে আমরা আর একটা দিন ছিলাম ওখানে, সেদিন আর আমাদের কোনো কিছুই চুরি যায়নি! তখন আমরা সবাই ঠিক করলাম, এরপর কোথাও বেড়াতে গেলে প্রথমেই চোরকে দাওয়াত খাওয়াতে হবে। চোররাও ভদ্রতা জানে! এই জন্যই কথায় বলে নিশি-কুটুম্ব
  
## # #

# বি.দ্রঃ  
এ লেখা পড়ে যাতে কারুর চোর হওয়ার বাসনা না থাকে সেজন্য আমরা শেষ করব গ্রাম বাংলায় একসময় প্রচলিত দুটো চোর-তাড়ানি শ্লোক দিয়ে
# প্রথমটি এরকম:
“চোর-চোরানি বাঁশের পাতা/চোর এলে তার কাটব মাথা/হুটুরপুটুর লোটা কান/চৌকিদারি ঘর উঠান।/নয়া লাঙ্গল পুরানো ইশ/বন্দিলাম দশ দিশ,/বন্দিলাম ছিরাম-লখণে/ঘুরে বেরাক চোর উঠানে
 
# দ্বিতীয়টি এইরকম:
কপ্‌পোল কপ্‌পোল,
যদ্দুর যায় কপ্‌পোলের বায়,
চোর-চোট্টা না বাড়ায় পায়!
বাঁধলাম ঘর, বাঁধলাম বাড়ি,
কোন্‌ চোরা করবে চুরি!”
#

সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী 
০১৯১২০৭৮৫৯৩

 sajedurrahmanvp@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান