পুণ্ড্রের পাঁচালী-১১ (কেউ কথা রাখেনি)
পুণ্ড্রের পাঁচালী-১১ (কেউ কথা রাখেনি)
সাজেদুর রহমান
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা…
(কেউ কথা রাখেনি; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বোষ্টুমী কথা না রাখলেও মহাস্থানের বোষ্টুমীরা
ঠিকয় কথা রাখে। তারা প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমীতে শীলা দেবী ঘাটে ঐতিহ্যবাহী স্নানউৎসবে
হাজির হয়। শুধু তাই নয়, ১২ বছর পরপর পৌষ-নারায়ণী স্নানের উদ্দেশ্যে এই স্থানে যোগ দিয়ে
থাকেন। কথা দিয়েও কথা রাখেনা ঘাট সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব শিলরা। সংস্কারের অভাবে কিংবদন্তির শীলা দেবী ঘাটের এখন নাজুক দশা।
মহাতীর্থ শীলা দেবী ঘাট স্থানীয় হিন্দু ধর্মালম্বীরা কাছে ভারতের
গঙ্গাস্নানের মতোই পবিত্র। যার কারণে আশেপাশের এলাকা ছাড়াও দেশে এবং দেশের বাইরের
পুণ্যার্থীরা এই স্নানউৎসবে যোগ দেয়। স্নানের দিনে বিশাল মেলা
বসে।
“বিসাল মেলা বসে দাদা। লক্ষ লক্ষ মানুষ।“, কথাটা বললেন
সুরেন। তিনি ঘাটেই থাকেন। অনতি দূরে শ্মশানের পুরহিত। শরিফ বিড়ি ফুকতে ফুকতে বললেন, ঘাটটি টিকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা
করে জাচ্ছি। কিন্তু কি সমস্যা জানেন দাদা, আমাদের শ্মশানের বেশখানিক
জমি দখল হয়ে গেছে।
শ্মশানের জমি দখল নিয়ে মজার ঘটনা ঘতেছে।
স্থানীয় আওয়ামীলিগ নেতার জমি দখলের খবর ছড়িয়ে পরলে, হাইকোর্ট রুল জারি করে। অবস্থা
বেগতিক দেখে সেই নেতা প্ল্যাকার্ডে ক্ষমা চেয়ে মহাস্থানের রাস্তায় অবস্থান
কর্মসূচী পালন করেছে। সেই নেতার সাথে কথা হয় আমার। নেতা বলেন, শ্মশানের জায়গাটা
পরেই থাকে। সেখানে মার্কেট হলে কাজে লাগত। আমি
এলাকার উন্নতির কথা ভেবে কাজটা করতে গিয়েছি।
শ্মশানের জায়গাটা ভরাটের সাথে সাথে তো করতোয়া নদীও ভরাট করছিলন। কথাটা প্রায় বলতেই নেতা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ক্যান নদী খননের কাজটা
তো আমিই এনেছি। যাইয়া দেখেন শীলাদেবী ঘাটে।
গেলাম ঘাটে। দেখলাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাইনবোর্ড। যাতে
লেখা ৫৩ লাখ টাকা ব্যায়ে করতোয়া নদীর পুনঃ
খননের কাজ শেষ করেছে ৩৯ লাখ টাকায়।
বিস্ময়ের ব্যাপার। ঠিকাদার
বরাদ্দের ১৫ লাখ টাকা বাঁচিয়েছেন। শীর্ণকায় করতোয়ার তীরে শীলাদেবী ঘাটে কয়েকজন মহিলা ঘাস ধুচ্ছিল। তাদেরকে জিগ্যেস
করলাম, এ বারে ঘাট এলাকায় নদী খনন হইছে কেমন? কাজে ব্যাস্ত মহিলাদের একজন বলল,
ক্যা জানি? ক্যাংকা করে খুঁড়ল কবার পারিচ্ছি না।
খননের ঠিকাদার
এ.কে.এম বজলুর রহমানের ফোনে কথা হয়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে শুরুতেই ঠিকাদার তার
বগুড়ার সবুজ বাগের অফিসে চায়ের দাওয়াত দেয়। আমি কাজের বিবরণ জানতে চাইলে বলেন, করতোয়া নদীর ঘাট এলাকায় এক’শ
মিটার নদী খননে কাজ পেয়েছিলেন। তা তিনি যথাযথ ভাবে করেছে। আর তাকা টাকা বাঁচানর
পরসঙ্গটা কেন জানি এরিয়ে গেলেন।
শীলাদেবীঘাট নিয়ে দুটি কথা চালু আছে। সব থেকে চালু কাহিনী, শীলাদেবী ছিলেন মহাস্থানগড়ের শেষ হিন্দু
রাজা পরশুরামের কন্যা বা ভগ্নি। মুসলিম সাধক শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার কর্তৃক রাজা পরশুরাম পরাজিত হবার পর শীলাদেবী
করতোয়া নদীর এই স্থানে জলে ডুবে আত্মহুতি দেন। আর
দ্বিতীয়টি জনস্রুতি-স্থানটি এক সময় নৌপথে আমদানি করা পাথর খালাস ও স্তুপীকৃত
করে রাখার জন্যে ব্যবহৃত হতো বলে কালক্রমে এর নাম হয় “শিলা দ্বীপ”, এবং যার বিকৃতরূপ
সম্ভবত “শীলাদেবী” এবং “শীলাদেবীর ঘাট”।
শীলাদেবীর ঘাটের অবস্থান মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ২০০ মিটার
পূর্বে করতোয়া নদীতে অবস্থিত। এই ঘাটের মূল অবস্থান মহাস্থানগড়ের বৈরাগি ভিটার বিপরীত দিকে। মূল রাস্তা থেক ঘাটে যাওয়ার
পথে একটা তোরণ দেখালাম। তোরণটি নতুন। তবে প্রধান সড়ক থকে পর্যন্ত যাওয়ার পথ কাঁচা এবড়োথেবড়ো। মহাতীর্থ শীলাদেবী ঘাট ও মহাশ্মশান উন্নয়ন কমিটির সভাপতি প্রহল্লাদ
চন্দ্র সরকার বলেন, স্নানউৎসবে ঘাটে আসা মানুষদের রোদ-বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে
হয়। আট বছর আগে এ ঘাট এলাকায় রোদ-বৃষ্টির সময় মানুষের আশ্রয় নেওয়ার জন্য স্থানীয়ভাবে
একটি যাত্রীছাউনি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু কিছু দূর কাজ
এগোনোর পরই টাকার অভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়েও প্রয়োজনীয় টাকার সংস্থান করা যায়নি। অনেকেই কথা দিয়েছিল তারপর কত শুক্লা পক্ষ চলে গেলো, কিন্তু সেই অর্থ আর এলোনা…।
দাঁড়িয়ে দেখেছি ভিতরে…
পরাবাস্তবতার শহর মহাস্থান।
মহাস্থন দুর্গে দাঁড়িয়ে দেখছি ভেতরে অলৌকিক এক কূপ। এই কূপটি শীলাদেবীর কিংবদন্তীর সাথে জড়িত। স্থানিয়রা তাকে জিউৎকুন্ড বলে। কথিত আছে এই কূপের পানিতে মৃত মানুষকে
ফেলে দিলে জীবন ফিরে পায়।
কূপটির অলৌকিক
ক্ষমতা নষ্ট করেছে শাহ সুলতান বলখী (মাহীসওয়ার)। তিনি জাদু বলে এক চিল পাঠান। চিলটি জিয়ৎকুন্ডের
পানিতে গরুর মাংস ফেলে। আর
তাতেই কুহক কূপের কার্যকরীতা হারায়। সেই থেকে কূপটি মৃত।
পানি শূন্য কূপটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে এর জৌলুস হারিয়ে যেতে বসেছে। তার পরেও কথ্য কাহিনীর টানে কূপটি দেখতে প্রতিদিনই দর্শনার্থী ভীর করে। জিয়ৎকুন্ডটি উন্মুক্ত থাকায় দর্শনার্থী, পর্যটক ও স্থানীয় জনসাধারণদের
নিক্ষেপ করা ইট বালি-পাথর ও মাটিতে ভরে যেতে বসেছে কূপটি। এ অবস্থা চলতে থাকলে
আগামীতে কূপটি ভরাট হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে এক সময় দর্শনার্থীরাও এটি দর্শনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
একজন খুদে দর্শনার্থীরা গভীর আগ্রহ নিয়ে কুপের তলদেশ দেখার চেষ্টা করছে। খুদে দর্শনার্থীরা কূপের দেয়ালের
উপর এমন ভাবে ঝুকে দেখছে যে একটু এদিক-সেদিক হলেই পরে যাবে। পাশে
থাকে এক মধ্যবয়স্ক মানুষ ধমক দিলো। বলল, “উংকা করে দেখিস না।
পরবু।“
পাঁচ-ছয় বছরের খুদে দর্শনার্থীরা বলল, ও
দাদারও ভয় লাগিচ্ছে? হামাক নামায় দে...হামি দেকমু।
বাচ্চাটার সাহস আছে। তাই
তাদের সাথে আলাপ জমালাম। মধ্যবয়স্ক লোকটা জানাল, তার বাড়ি শিবগঞ্জ উপজেলার বেতগারী গ্রামে। নাম ওবাইদুল। ছোট
বেলায় সে তার বাবার সাথে এসেছিল। আজ সে নাতিকে নিয়ে এসেছে। তবে তার নাতির
মত করেনি। সে বলল, তখন কূপটি অনেক গভীর ছিল। নিচের দিকে তাকালে
ভয়ে গা শিউরে উঠত।
জিয়ৎকুন্ডটির ২০/২৫ ফুট গভীরতায় গ্রানাইট পাথরের একটি প্রস্তরখন্ড দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও কতকগুলো পাথর তাকে তকে সাজানো আছে। জীয়তকুন্ড কূপটি ১৮শ ১৯শ শতকে নির্মিত। খুব সম্ভবত পানি উত্তোলনের জন্য এটি নির্মিত। কূপ নির্মাণের প্রথম
পর্যায়ে এটিকে ব্যবহার করা হতো।
কুপের পূর্বে শীলাদেবীর ঘাটের দরজা আর পশ্চিমে পশুরাম গেইট। গেটের পাসে প্রত্ন অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড। এর পরেই পরশুরামের প্যালেস বা প্রাসাদ। তবে প্রাসাদ বলতে যে ছবি ভেসে ওঠে সেরকম
নয়।
প্রাসাদের অন্দর মহলে অবস্থিত ছোট একটি আঙ্গিনা। সেই আঙ্গিনার দিকে মুখ করে
পৃথক পৃথক ৪টি মহল। মোহলগুলোর
প্রবেশ পথসহ বেশ কিছু কক্ষের ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে। মুল প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দুইটি প্রহরী কক্ষের নিদর্শন
দেখা যায়।
এখনো সে যে-কোনো…
পরশুরাম প্রাসাদের গায়ে-গা লাগোয়া ঘর-বসতি। সেইসব বাড়ির বাশিন্দাদের কাছে পরশুরামের প্যালেসের ক্ষয়ে
যাওয়া দেয়াল কাপড় শুকান, গল্প গুজব বা শীতের দিনে গোসলের স্থান। ২০১৭ সালের (১৮ অক্টোবর) শীতের পরন্ত দুপুরে গিয়ে দেখি দুজন মেয়ে প্যালেসের উত্তর মহলের দেয়ালে
বসে রোদ পোহাচ্ছে।
রদের দিকে পিঠ দিয়ে তাপ থেকে মুখ বাঁচাতে দুজনই ওড়না দিয়ে মুখ
ঢেকে রেখেছে। আমি তাদের কাছে গিয়ে বললাম, আপনাদের কি সৌভাগ্য। রাজার প্রতিবেশী, প্যালেস বসেন। উত্তরে তারা বলল, আপনেগেরে কাছে দেখার
জিনিস, হামাগেরে কাছে বাড়ির আংনে (উঠান)।
সার্কের সংস্কৃতিক রাজধানি
ঘোষণা করায় মহাস্থানের প্রত্নস্থানগুলিকে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে বলে সরকার
প্রচার করে আসছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখলাম এখনো সে যে-কোনো সাধারণ স্থান। স্থানীয়রা আগের মতই আছে।
মহাস্থানগড়ের সীমানা প্রাচীর বেষ্টনীর ভিতরে যেসব প্রাচীন সভ্যতার
নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে পরশুরামের প্রাসাদ অন্যতম। ঐতিহাসিক স্থানটি ১৯০৭, ১৯৬১ ও ১৯৯৫ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন
করেছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তখন তিনটি নির্মাণ যুগের সন্ধান
পাওয়া যায়।
খননের নিম্নতর স্তরে পাল আমলের নানা ভবনের ধ্বংসাবশেষ, কিছু
পোড়ামাটির নকশি পাতলা ইট (ফলক) এবং এ স্থানের মধ্যস্থলে কিছু ভবনের অবশেষ ও এই ভবনের
বলে অনুমিত কিছু চমকদার মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রগুলি মুসলিম
শাসনামলের। অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণ কাল ১৫শ/১৬শ শতকের বা সুলতানী
আমলের বলে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ধারণা করেন। এছাড়া এখানে কোম্পানি আমলের (১৮৩৫-১৮৫৩) দুইটি মুদ্রা পাওয়া
গেছে।
কত রকম আমোদে হেসেছে…
পরশুরামের প্রাসাদ থেকে ১০ মিনিটের দূরত্ব হযরত শাহ সুলতান বলখী
(রঃ) এর মাজার। মাজারটি ছোটোখাটো পাহাড়ের মতো উচুতে অবস্থিত। মাঝারের আশেপাশে অনেকগুলি ফকীর-সন্ন্যাসীর
ঝুপড়ি টাইপের কুঠির। সেসব কুঠিরে দিনে-রাতে গাঁজা খাওয়াসহ কত রকম আমদ হচ্ছে- আর তা
থেকে একটু পর পরই জিকির ধ্বনিত হচ্ছে।
এই মাজেরে গাঁজা খাওয়ার বেস
চল ছিল। শোনা যায় বৈশাখের শেষ বৃহস্পতিবার ঐতিহ্যবাহী বাৎসরিক মেলায় বস্তায় বস্তায়
গাঁজা ক্রয়-বিক্রয়-সেবন চলত।
বিষয়টা এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলো যে মেলার আসল পরিচয় হাড়িয়ে গাঁজার মেলা নামে
পরিচিতি হল। সেই অবস্থা একন নেই। প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করলেও একটু আড়ালে আবডালে
রেওয়াজ টিকে আছে।
মাজারে প্রতিবছর বৈশাখের শেষ বৃহস্পতিবার মেলা কারণ, এই দিনে শাহ সুলতান বলখী (রঃ) পুণ্ড্রবর্ধনের
অত্যাচারী নরপতি পরশুরামকে পরাজিত করেন। সেই বিজয়কে আরো মহিমান্বিত করতে এই মেলার রেওয়াজ শুরু হয়। এই
বিখ্যাত মেলা এবং ওরসে আশপাশের দশ গ্রাম তো আছেই, এমনকি বহু দূরদূরান্ত থেকে আসে পির-বাবার
মুরিদ, ভক্ত, আশেকান উপস্থিত হয়।
এই মেলার আরেকটি অদ্ভুত
ব্যাপার হলো, মুরিদানদের মধ্যে যেমন আছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান,
সাঁওতাল, রাজবংশী, গারো, চাকমা ইত্যাদি নানা জাত, তেমনই আছে শেখ সৈয়দ খান পাঠান কলু
জোলা রাজিল ফাজিল ডোম চাঁড়াল ব্রাহ্মণ কায়স্থ কৈবর্ত নমঃশুদ্রসহ সব ধর্মের ধরমের মানুষ অংশ নেয়।
এই যে পিরের মহিমা ও মাজেজা এমনই যে, লোকান্তরে থেকেও তিনি এক
অদৃশ্য অঙুলিহেলনে জাতপাত ধর্মবর্ণ লিঙ্গ শ্রেণি পেশা নির্বিশেষে নানা রঙের, নানা মেজাজের
মানুষকে বসিয়ে ছাড়েন একই পঙক্তিতে। আর তাঁর ওরসের খিচুড়িও একাকার করে দেয় খাদ্যদ্রব্যের সমস্তরকম
জাতপাত শ্রেণিবিন্যাস। ভূমণ্ডলে এমন ঘটনা সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, ওরসের এই অদ্ভুত রেসিপির খিচুড়িটা প্রতিবছরই হয়ে থাকে অব্যর্থভাবে
অপূর্ব– কি রঙে, কি ঘ্রাণে, কি স্বাদে। এক অনাস্বাদিতপূর্ব দিব্য স্বাদগন্ধযুক্ত পরমান্ন।
তন্ন তন্নকরে খুঁজে এনেছি…
মাজারের ভেতরে মসজিদ, খানকাহ, মেলার স্থান, একটি প্রাচীন কূপ
ছাড়াও একটি বড়ই গাছ আছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই বড়ই গাছে কোন কাটা নেই। আমি নিজে খুজেও কোন কাটা বের করতে পারিনি একটা বড় সাইজের বড়ই গাছে। বড়ই গাছ টা ঠিক মাজার ও মসজিদের মাঝামাঝি। প্রতিদিন দূর দূরান্ত
থেকে অনেক মানুষ আসে হযরত শাহ সুলতান বলখী (রঃ) এর কবর জিয়ারতের জন্য।
মহাস্থান গড় বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীন পর্যটন কেন্দ্র। এখানে মাজার জিয়ারত করতে এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান হতে বহু
লোক সমাগম ঘটে। এখানকার দানবাক্সে সংরক্ষিত অর্থের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৭০ হাজার টাকা যা মাজার
মসজিদের কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য উন্নয়ন কাজে ব্যবহৃত হয়। মাজার শরীফ মহাস্থান বাস স্ট্যান্ড থেকে কিছুটা পশ্চিমে হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ
বলখী (র:) এর মাজার শরীফ অবস্থিত। কথিত আছে মাছের পিঠে আরোহন করে তিনি বরেন্দ্র ভূমিতে আসেন। তাই তাকে মাহী সওয়ার বলা হয়। কথিত আছে হযরত মীর বোরহান নামক একজন মুসলমান এখানে বাস করতেন। পুত্র মানত করে গরু কোরবানী দেয়ার অপরাধে রাজা পরশুরাম তার বলির আদেশ দেন এবং
তাকে সাহায্য করতেই মাহী সওয়ারেরর আগমন ঘটে।
বাবা এখন অন্ধ …
সংবাদ, ইতিহাস, রূপকথায়, মহাস্থানের চালু ইতিহাস আর প্রচল কিংবদন্তির
আড়ালে ঢেকে রাখা বেসি সত্য দেখতে না পারাটাও অন্ধত্তের সামিল। শাহ সুলতান ইব্রাহিম বিন আদম বলখী বিষয়ে কাজী মেছের আলী: বগুড়ার
ইতিকাহিনীতে বলেছেন, “মহাস্থানে পরশুরাম নামে এক নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন। তার শাসনকালে মহাস্থানগড়ের পাশে মথুরা নামক গ্রামে মীর বোরহান নামের এক মুসলমান
বাস করতেন। শাহ সুলতান পরশুরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং ১০৪৩ সালে
পরশুরামকে পরাজিত ও হত্যা করেন।”
আজিজুল হক: বগুড়া ও মহাস্থানগড়ের ইতিহাস গ্রন্থে বলেন, ‘মাছের
পিঠে চড়ে বা মাছের আকৃতির নৌকার পিঠে চড়ে তিনি নদী পাড় হয়েছিলেন, তাই তার নাম মাহীসওয়ার।” আর প্রভাষ চন্দ্র সেন: বগুড়ার ইতিহাস
বই থেকে জানতে পারি, শাহ সুলতান বলখীর গল্পটি সিলেটের হযরত শাহজালালের সাথে দারুণ মিলের
কথা। শুধু তা-ই নয়, শাহ সুলতান-এর বাংলায় আগমন সম্পর্কিত মিথটিও হুবুহু হযরত শাহজালালের
অনুরূপ। শাহজালালের মতোই শাহসুলতানের পীরও তাকে এক মুঠ লাল রঙের মাটি দিয়ে আদেশ করেন, যেখানে
এই রকম মাটির মিল পাবে, সেখানে ধর্মপ্রচার করবে।
লক্ষ্য করুন, এই একই গল্প প্রচলিত আছে, পরশুরামের গল্পটি খ্রিস্টীয়
একাদশ শতকের শুরুর দিকের। বাংলায় তখন পাল যুগ চলছে; গৌড়, বরেন্দ্র ও পুণ্ড্র অঞ্চলে দৌর্দণ্ড
প্রতাপেই রাজা ন্যায়পালের শাসন চলছিলো (১০৩৮-১০৫৪), তার পরবর্তী শাসক ছিলেন রাজা বিগ্রহপাল
(১০৫৪-১০৭০) ও রাম পাল। মহাস্থানগড়ের পাল বিহারগুলো ছাড়াও এই সময়ে বিশ্ববিখ্যাত সোমপুর
(পাহাড়পুর) বিহার নির্মিত হয়। এই বিহারকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ ধর্ম ও শাসন তখনো বাংলার ইতিহাসে
উজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্যও এটি উজ্জ্বলতর সময়। রামপালকে নিয়ে সন্ধ্যাকর
নন্দী-র রামচরিত এই সময়ের অন্যতম সাহিত্য নিদর্শন।
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, চর্যাগীতিকার অধিকাংশ পদ এই সময়েই রচিত
হয়। সুতরাং পাল শাসনের সমান্তরালে একই স্থানে একই সময়ে একজন হিন্দু নৃপতির মহাপ্রতাপশালী
হয়ে ওঠা সত্যিই কঠিন কল্পনা। শুধু তাই নয়, দশম-একাদশ শতকে কি বাংলা অঞ্চলে কোনো মুসলমান ছিল যার পক্ষে গরু কোরবানি
করা সম্ভব?
শাহ সুলতান মাহীসওয়ার-এর সময় নিয়ে অপর একটি ঝামেলা হলো, বলখ্-এ
তার শাসনকাল; ৮১২ খ্রীস্টাব্দে তিনি উত্তর আফগানিস্তানের বলখ্ প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন। এর প্রায় আড়াইশ’ বছর পরে ১০৪৩ খ্রীস্টাব্দে বাংলায় এসে কোনো হিন্দু শাসকের সাথে
যুদ্ধ করছেন, বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কাজেই শাহ সুলতান মাহীসওয়ার বলে আদৌ কেউ ছিলেন কিনা কিংবা যদি
থাকেনও তবে তিনি কি দশম-একাদশ শতকের সুফি নাকি সপ্তদশ শতকের? কেননা, দলিলে দেখা যাচ্ছে,
১৬৮৫ সালে স্থানীয় শাসক মুজাফফর জং একজন সুফির আস্তানার জন্য সেখানে জমি বরাদ্দ করছেন। এই সুফিই যদি শাহ সুলতান মাহীসওয়ার হয়ে থাকেন, তবে তিনি দশম-একাদশ শতকে পরশুরামের
সাথে লড়াইয়ে বিজয়ী নন।
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি
লাল কাপড়…
মহাস্থানসংলগ্ন সুফি সাধক শাহ সুলতান ইব্রাহিম বিন আদম বলখী
মাহীসওয়ার-এর
মাজারটি কোত্থেকে এলো? এই প্রশ্নের মীমাংসা চাওয়াটা দূরন্ত ষাঁড়ের
চোখে লাল কাপড় বাঁধার চাইতেও দুরহ।
আমরা এখন পর্যন্ত কোনো ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে
মাহীসওয়ারের মাজার বা কবরের বিবরণ পাওয়া যায় না। মাহীসওয়ার যে এখানেই
মৃত্যুবরণ করেছেন, তারও কোনো প্রমাণ নেই। শাহ সুলতান মাহীসওয়ার বলখী বলে একজন সুফি সন্দ্বীপে এসেছিলেন
বলে শোনা যায়।
প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা অধ্যাপক আব্দুল করীম, শাহ সুলতান মাহীসওয়ার
সম্পর্কে লিখেছেন, “The account about the arrival of Shah Sultan and his wars
with the kings Balaram and Parasuram have come down only through traditions. He
is popularly called Mahisawar (fish rider) perhaps because he came on a
fish-shaped boat.
সেই সময় যেহেতু আরব বণিকদের সাথে বাংলাদেশের নৌবাণিজ্য প্রচলিত
ছিল, সুতরাং মাহীসওয়ার বা মাছের মতো নৌকার সওয়ারী থাকতে পারে, এবং তাদের কারো নাম শাহ
সুলতান হলেও হতে পারে, সুতরাং সন্দ্বীপে তার আগমন অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু বগুড়ার মতো
সমুদ্র থেকে বহু দূরবর্তী একটি স্থানে তিনি কি করে আস্তানা গাঁড়েন? মুজাফফর জং যে সুফির
আস্তানার জন্য জমি বরাদ্দ করছেন, তিনিই যদি মাহীসওয়ার হন, তবে আফগানিস্তান থেকে মৎস্যনৌকা
নিয়ে তার বগুড়া আসা ভৌগোলিক কারণে প্রশ্নাতীত নয়। সবচেয়ে সম্ভাব্য উত্তর
হলো- মুজাফফর জং যে সুফির জন্য জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন, কালে কালে তার ওপরেই মাহীসওয়ার
এবং শাহ সুলতান বলখী পরিচয় আরোপিত হয়েছে।
দেখিস, একদিন, আমরাও…
মহাস্থানগড়ের
কাছে একটি কোনো এক সুফি সাধকের আস্তানা ছিল সপ্তদশ শতক থেকেই। তবে কবে কখন কিভাবে
সেখানে মাজার তৈরি হলো,
তা জানা যায় না। তবে দেখলাম,
একদিন, আমরাও মাজার পূজা নামে শুরু করলাম বাণিজ্য।
মাজারটি যেখানে অবস্থিত
সেখানে আনেকগুলি প্রত্নস্থাপনা ধ্বংস করে নির্মিত হয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা;
হয়েছে মাজারের সম্প্রসারণ, নির্মিত
হয়েছে মাজারসংলগ্ন চাতাল, মাজারের প্রবেশদ্বার ইত্যাদি।
অবৈধ জমিতে মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ করে চলছে বাণিজ্য।
শাহ সুলতান মাহীসওয়ার মাজার
ইসলামে মাজার পূজা হারাম হলেও বাংলাদেশের সরকার ও প্রশাসন মাজারের
জন্যই নিবেদিত। জাতিগতভাবে বৃহতের বা মহতের প্রতি নিজেকে নিবেদনের সংস্কৃতি
যেমন আছে, তার চেয়েও বড়ো হয়ে আছে বাণিজ্য। মাজারগুলো সত্যিই
অসামান্য বাণিজ্যের উৎস। বগুড়ার মাহীসওয়ারের যদিও তেমন কোনো বিশেষ কেরামতির কথা শোনা
যায় না, কিন্তু এই মাজারের ব্যবসাও ভালো, তার প্রধান কারণ কাছেই দর্শনীয় প্রত্নস্থান
ও জাদুঘরের অবস্থান।
জমজমাট এ ব্যবসার কারণেই সবসময় মাজার কমিটির প্রধান থাকেন ক্ষমতাসীন
দলের স্থানীয় কোনো নেতা। এই মাজার কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট দালালরা মহাস্থান জাদুঘর ও প্রত্নস্থানে
প্রবেশের রাস্তার দুই পাশে অজস্র দোকান করে প্রত্নস্থান ও জাদুঘরগামী মানুষদের এক কথায়
জিম্মি করে অর্থ আদায় করে। গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথেই একদল দালাল আপনাকে ছেঁকে ধরবে মাজারে
আগরবাতি-মোমবাতি ইত্যাদি দেয়ার জন্য। এই মাজার-ব্যবসায় কথা আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিষ্কার।
নাদের আলী, আমি আর কত বড়
হবো?
ইতিহাস ঐতিহ্য
বিষয়ে গুরুত্ব বাড়ছে। সরকার সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও বস্তু বিষয়ে
জনসাধারণের মধ্যে প্রচারণা চালাচ্ছে। বলছে একদিন আমাদেরও গৌরবোজ্জ্বল ছিল।
সম্প্রতি মহাস্থান সার্ক সংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পালন করেছে সরকার। এতে তরুণ
সমাজসহ সাধারণের মাঝে সাড়া জেগেছে। প্রশ্ন হোল এই সচেতন সমাজ আর কত জাগ্রত হলে
সরকার সঠিক পদক্ষেপ নেবে।
তিনটি বিষয় লক্ষ্য
করুণ। এক) কে
এন দীক্ষিত ১৯২৮-২৯
সালে প্রথম এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করেন। তার এই খননের পরপরই ১৯৩০
সালে সরকার মহাস্থানগড়কে প্রোটেক্টেড সাইট হিসেবে ঘোষণা করে এবং বগুড়ার জেলার
বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে অধিগ্রহণ করে। শুধু মহাস্থানগড় নয়, বগুড়া জেলা প্রশাসনে আমি
ব্যক্তিগতভাবে যেসব
দলিলাদি নাড়াচাড়া করতে পেরেছি, সেখানে দেখতে পেয়েছি, মহাস্থানগড় ও এর আশেপাশে তো বটেই,
পুরো বগুড়া জেলার হাজার হাজার একর জমি সরকারের অধিগ্রহণ করা
আছে। তবে এর অধিকাংশই এখন আর বগুড়া জেলা প্রশাসন কিংবা সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের
দখলে নেই।
দুই) বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ক্ষমতা
সীমিত, একথাটি একেবারেই সত্যি নয়। বাংলাদেশের গুটিকতক যেসব প্রতিষ্ঠানের
কর্তাব্যক্তিকে ইনডেমনিটি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
তার মধ্যে অন্যতম। তার গৃহীত কোনো পদক্ষেপ নিয়েই আদালতে মামলা বা প্রশ্ন করা যাবে
না; সুতরাং এমন অসীম ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতার দিক
থেকে দীন বলা চলে না।
তিন) প্রত্নকীর্তিকে সংরক্ষণ আইন, প্রত্ননিদর্শন আইন, প্রত্নবস্ত্ত
রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইনসহ ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপত্য নির্দশন সংরক্ষণ বিষয়ক
নীতিমাল জুগপজুগি করতে সকারের অস্বাভাবিক গড়িমসি আমাদের আশঙ্কিত করে তুলেছে।
কেউ কথা রাখেনা!
ইতিহাস সমাজের জিনিস। রাষ্ট্র পাহারাদার। ইতিহাস কিন্তু ভোলেনা আমরা তাকে নিয়ে কি খেলা
খেলি। কালের বিবর্তনে ঠিকই ইতিহাসের বুক চিরে সত্যিটা বেরিয়ে আসে। সমাজও অনেকটা
একই। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র এই ইতিহাস ও সমাজ নিয়ে যারা অবৈধ কারবার করেন তাদের অবাধ প্রশ্রয় দিয়ে চলে।
আপনারা হয়তো এও ভাবছেন, আমার লেখাটি শুরুর দিকে ছিল কবিতা দিয়ে
বেশ হালাকা ধাঁচের। কিন্তু ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে সিরিয়াসধর্মী। সত্যি বলতে-কি, সমগ্র সমাজ যেখানে আগাগোড়া উদাসীনতার মাদুরে
মোড়া, সেখানে লেখা যে বাস্তব সম্মত হবে এতে আর বিচিত্র কী! তা ছাড়া, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
কবিতার মত মন্ত্রণালয়- ইতিহাসবিদ-প্রত্নতাত্তিক-স্থানিয় প্রশাসন-গবেষক-কেউ কথা-না-রাখে
তার দায় কে নেবে? এ তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কারুরই কন্ট্রোল নাই তার ওপর। আছে কি?
Comments