পুণ্ড্রের পাঁচালী -৮
(পোতনগর-রহস্য )
সাজেদুর রহমান
ইতিহাসের সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা আসলে মস্তিষ্কে গেঁথে
যাওয়া কিছু তৈরি ধারণা ছাড়া কিছুই না। এই তৈরি ছবুগুলোর যখন আমরা অপলক চেয়ে থাকি।
সত্য তখন থেকে যায় এর সবমিছু থেকে দূরে, অন্য কোথাও, যার সন্ধান এখনো অজানা।
-ডাব্লিউ.জি.অষ্টারলিৎজ।
আসার কথা ছকে বাঁধা চিন্তাজগৎ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা
মানুষের মজ্জাগত ব্যাপার। আর তাই একদিন অজানাকে জানা হবেই। ধাপে ধাপে উন্মচিত হবে
সকল রহস্য। তবে মহাস্থানে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির মধ্যে একটা নিদর্শন আছে যাকে যত খনন করা
হচ্ছে, যত গবেষণা করা হচ্ছে, যত বিশ্লেষণ করছে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক আর
ইতিহাসবিদরা ততোই জট পাকাচ্ছে।
গোলোকধাঁদায় আটকে যাওয়া পুরাকৃত্তিটির পরিচিত নাম গোবিন্দ
ভিটা। আর এই নামটাই প্রথম রহস্যময় ব্যাপার।
কারণ এই ভিটায় কোনো গোবিন্দ তথা বিষ্ণুর (বৈষ্ণব ধর্মের) কোন আবাস বা পূজামণ্ডপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এছাড়াও এই
স্থাপনা ঘিরে আছে অনেকগুলো কুহক।
মহাস্থানগড়ের উৎখননের সূচনা কাল থেকে
হালজামানায় ফ্রান্স-বাংলাদেশ যৌথ খনন পর্যন্ত প্রায় সবখননেই গোবিন্দ
ভিটা ছিল আগ্রহের কেন্দ্রে। এখানে পাওয়া
নিদর্শন খ্রিষ্টপূর্ব তিনশ বছর থেকে সুলতানি আমল পর্যন্ত। এই ধরনের প্রাপ্তিতে
উৎখনন কারিরা নির্মাণসূচনা কাল
নির্ণয় করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছে।
বিশেষজ্ঞদের বিভ্রান্তি আরো বাড়ে যখন দেখে উঁচু, এই আপাত ইটের তৈরি বিচিত্র স্তুপের ওপর
দাঁড়িয়ে করতোয়া নদীর ক্ষীণধারার দিকে তাকিয়ে। কি ছিল আসলে এখানে? কেন তৈরি করা হয়েছিল এই বিচিত্র আকারের স্থাপনা? অতীতের প্রমত্তা করতোয়া নদীর একেবারে ধার ঘেঁষে তৈরি করা, নদীভাঙ্গনের শিকারের ঝুকি সত্ত্বেও ঠিক এখানেই কেন এই ভবন তৈরি করা
হয়েছিল? অসংখ্য প্রশ্নবোধক চিহ্ন হাজার বছর ধরে দৃঢ়
ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এখানে।
মহাস্থানগড়ের দূর্গ
প্রাসাদ এলাকার বাইরে উত্তর দিকে অবস্থিত একটি অসমতল ঢিবিতে কে.এন দীক্ষিত ১৯২৮-২৯ সালে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ চালান। এর পরে ১৯৬০
সালে ড. নাজিম উদ্দিন আহমদ এখানে একটি
গভীর খাদ খনন করেন। এ দুজন এই ভিটের আকার, স্থাপত্যিক বিন্যাস, প্রত্ননিদর্শণ,
ইটের মাপ ব্যবহৃত মসল্লা ইত্যাদির
ভিত্তিতে অনুমান করেন, মন্দিরটি
খ্রীষ্ঠীয় আনুমানিক ষষ্ঠ শতকে
নির্মিত হয়েছিল। এই শতকের নির্মাণস্ত-এর মেঝেতে
তিনটি মাটির কলসি পাওয়া যায় যেগুলির অর্ধেক অংশ ভরা ছিল ঝিনুকের চুন দিয়ে। একটি
কলসির ভেতর মানুষের এক টুকরো অস্থি পাওয়া যায়।
গোবিন্দভিটায়
পাওয়া সেই মাটির কলসির অস্থি সম্পর্কিত একটি বৌদ্ধ শ্লোক পাওয়া যায়। যার অর্থ-
মহাকচ্চান স্থবির বুদ্ধের পূতাস্থি স্বর্ণপাত্রে ভরে পোতনগরে নিয়ে আসেন। তা থেকে
একখন্ড পূতাস্থি রাজকুমারকে প্রদান করেন এবং কুশল ইচ্ছুক রাজকুমার সেই উত্তম ধাতু
নিধান করেন এবং তার উপরে মহাস্তুপ নির্মাণ করে শ্রদ্ধার্ঘ্য দান করেন। এই শ্লোক
থেকে গোবিন্দভিটার আরেকটি নাম পাওয়া যায়, পোতনগর।
এটি
নদীবন্দর এবং প্রাথমিকভাবে বৌদ্ধকীর্তি সেটাও বোঝা যায়। গোবিন্দভিটার আদি নাম কোথাও গোবিন্দ দ্বীপ কোথায় বিষ্ণু
মন্দির, স্থানিয়রা রাজবাড়ি বললেও গোবিন্দভিটা নামের উৎপত্তির অজ্ঞাত রয়ে
যায়। শুধু তাই নয় স্বাধীনতা পূর্বে ও পরে বিভিন্ন সময়ে খনন কাজ চালিয়েও প্রচীন
এই স্থানটির ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক অনুক্রম সম্পর্কে জানতে না পাড়ায় খননকাজ শুরু করেও তা বন্ধ
করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। যার
কারনে ধাপে ধাপে এ প্রত্নস্থল ও অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস পুনর্গঠন এবং প্রাচীন
নগরটির গঠন ও ইতিহাস জানার কৌতূহল থেকে
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের যৌথ উদ্যোগে খনন চলে। এই খননে ১৭টি স্তর পাওয়া
যায়। এর প্রত্যেকটিই নাকি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এখানে ৬ষ্ঠ
শতকের একটি নির্মাণস্তর পাওয়া যায় যেখানে কিছু বিশেষ সামগ্রী বিস্মিত করে।
ঐতিহাসিকদের মতামত, প্রত্নতাত্ত্বিকদের
পর্যবেণ, গবেষকদের ব্যাপক অনুসন্ধানে রহস্য জড়ান গোবিন্দ ভিটার প্রকৃত পরিচয় নির্ণয়ে জটিল আরও বাড়ে। স্থানটিকে সমৃদ্ধ বিপননকেন্দ্র
বা বিদেশজাত সৌখিন দ্রব্যাদির বাজার, সেকেন্দার
শাহ দ্বিতীয় টাকশাল, উপ-সামদ্রিক নৌবন্দর হিসেবে বলা হয়েছে। এছাড়াও গোবিন্দ
ভিটার সংলগ্ন ঘাট বিশেষ
পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। আজও
প্রতিবৎসর পৌষসংক্রাস্তির দিনে উত্তরবঙ্গের বহু স্থান থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বিরা মহাস্থানের গোবিন্দদ্বীপের ঘাটে করতোয়ায়
স্নান করে থাকে।
দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপক অনুসন্ধান ও খননের ফলে মৌর্য, গুপ্ত, পাল
ও মুসলিম যুগের কাঁচাপাকা ঘরবাড়ি, রাস্তা, নর্দমা, কূপ, মন্দির, মসজিদ, তোরণ, বুরুজসহ
উল্লেখযোগ্য নিদর্শন উন্মোচিত হয়েছে। মৌর্যযুগের ছাপাংকিত ও ঢালাই করা রৌপ্য মুদ্রা এবং
উত্তরাঞ্চলীয় কালো চক্চকে মৃৎপাত্র, অর্ধ-ডজন শূঙ্গযুগের (খ্রি.পূ. ২য়-১ম অব্দ)
পোড়ামাটির ফলক, একটি খোদাইকৃত নীল পাথরের চাকতি আকৃতির প্রসাধনী ট্রে (খ্রি.
১ম-২য় শতক), একটি কাদা মাটির তৈরী সীলমোহর ও পোড়ামাটির মস্তক (৪র্থ শতাব্দী),
তিনটি বৃহৎ মাটির পাত্র বা ভাট (খ্রিস্টীয় ৬-৭ শতক) যাতে শঙ্খখোসা ও চুন এবং
নরকংকাল ছিল। এখানে প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন
আকৃতির ও ধরনের পোড়ামাটির দ্রব্য, স্বল্পমূল্যের পাথরের তৈরী গুটিকা ও বোতাম,
কানবালা ও কুন্তল, নাকফুল ইত্যাদি। এ ছাড়া, পোড়ামাটির মূর্তি ও খেলনা এবং তামা ও
ব্রোঞ্জের তৈরী বলয় এবং সুরমা দন্ডও পাওয়া গিয়েছে। (সুত্র-বাংলাপিডিয়া)
#
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
Comments