পুণ্ড্রের
পাঁচালী -৯ ( সাংখ্য নিনাদ )
সাজেদুর
রহমান
জুঁই
বলল, আপা, আমার ভয় ভয় লাগছে।
দ্রিমার চোখে চশমা, কোলে মোটা একটা ইংরেজি বই
- The Discovery of India. দারুণ মজার বই। সে বইয়ের পাতা উল্টাল। জুঁইয়ের দিকে একবারও না
তাকিয়ে বলল, ভয় লাগার মত কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
গা জ্বলে
যাবার মত কথা। কি রকম হেড মিস্ট্রেস টাইপের ভাষা– ‘ভয় লাগার মত কন পরিস্থিতির
উদ্ভব হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না।‘ অথচ
পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ। তারা দুজন একা একা যাচ্ছে। দু’জন কখনো একা হয় না, সঙ্গে
পুরুষমানুষ কেউ নেই বলে জুইয়ের কাছে একা একা লাগছে। কপিলমুনি বাজারে বিকেলের মধ্যে
তাদের পৌঁছার কথা। এখন সন্ধ্যা, স্টিমার থেমে আছে। ডুব চরে আটকে গেছে। কপিলমুনি
যেতে তিন মোচর পার হতে হবে। যে ভাবে স্টিমার এগুচ্ছে, জুইয়ের ধারণা, পৌঁছতে পৌঁছতে
রাত – দুপুর হয়ে যাবে। তখন তারা কি করবে? ঘাটে বসে ভোর হবার জন্য অপেক্ষা করবে?
মেয়েদের বসার কোন জায়গা আছে কি? যদি না থাকে তারা কোথায় বসবে?
জুই বলল, আপা, তুমি বইটা বন্ধ কর তো।
দ্রিমার বই বন্ধ করল। চোখ থেকে চশমা খুলে
ফেলল। দ্রিমার বয়স একুশ। তার গায়ে সাধারণ একটা সূতির শাড়ি। কোন সাজসজ্জা নেই অথচ
কি সুন্দর তাকে লাগছে। জুই কিছুক্ষণের জন্য ভয় পাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে বলল, আপা
তোমাকে সেই রকম সুন্দর লাগছে।
‘সুন্দর মানুষকে সুন্দর লাগবে এটাই সাভাবিক।
তোকে তেমন সুন্দর লাগছে না। ভয়ে চোখমুখ বসে গেছে। এত কিসের ভয়?
‘ঘাট থেকে আমরা যাব কি ভাবে?
‘অনন্যারা যে ভাবে যায়। রিকশা পাওয়া গেলে
রিকশায়, সিএনজি পাওয়া গেলে সিএনজিতে। মটর সাইকেলে যাবার ব্যাবস্থা থাকলে মটর
সাইকেলে। জানিসতো এখানে ভাড়ায় মটর সাইকেল পাওয়া যায়। কিছু না পেলে জার্নি বাই ফুট।
‘হেঁটে এত রাস্তা যেতে পারবে?’
‘এত রাস্তা তুই কোথায় পেলি? মাত্র পাঁচ মাইল।
পাঁচ হচ্ছে ম্যাজিকাল সংখ্যা। কপিলের মতে বিশ্বজগতে সব
পঞ্চ তন্ত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। পঞ্চ
তন্মাত্র হল: শব্দ, র্স্পশ, রূপ,
রস ও গন্ধ। একাদশ ইন্দ্রিয় হল: পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয়; পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং অন্তরিন্দ্রিয়। এবং স্থূল ভূত হল: ক্ষিতি,
জল, তেজ, মরুৎ এবং আকাশ।
জুইরা যেখানে বসেছে সেখানে লোকজন বেশি নেই।
তাদের বেঞ্চটা পুরো খালি। একজন বসেছিল, কিছুক্ষণ পর সেও সামনের বেঞ্চে চলে গেছে।
জুই এই ব্যাপারগুলি লক্ষ্য করছে- কতক্ষণ পর পর ফেরিওয়ালা আসছে, কজন ফেরিওয়ালা কি
বিক্রি করছে। সামনের বেঞ্চে এখন সাতজন মানুষ বসে আছে। সবাই পুরুষ। কোন মেয়ে এখন
পর্যন্ত তাদের চোখে পরেনি। যারা আছে তারা সবাই বয়স্ক বুড়ো ধরনের গ্রামের মানুষ।
শুধু একটা অল্প বয়স্ক ছেলে। ছেলেটা বোধহয়য় অসুস্থ। তার গা হাত পা অস্বাভাবিক মোটা।
ছেলেটার পাসে বসা যে বুড়ো তার হাতে নিম গাছের ডাল। সে নিমের ডালটা কিছুক্ষণ পর পর
ছেলেটার গায়ে বাতাস করছে।
স্টিমার
চলতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আকাশ মেঘ করেছে বলে দিনের আলো নেই। এখন
ষ্টীমারের ভেতরটা পুরপুরি অন্ধকার। জুঁইয়ের ব্যাগে একটা চারজার টর্চ আছে। টর্চ বের
করবে কি-না বুঝতে পারছে না। জুঁই বলল, ষ্টীমারে লাইট জ্বলছে না কেন আপা?
দ্রিমা কিছু বলার আগেই সামনের বেঞ্চ থেকে
একজন বলল, এই লাইনের ষ্টীমারে রাতে বাতি জ্বলে না।
জুঁই বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
‘নৌপুলিশের হুকুম। করার কিছু নাই।‘
‘জুঁই বলল, নৌপুলিশ শুধু শুধু বাতি বন্ধ করে
রাখবে কেন?
দ্রিমা
মনে মনে হাসল। জুঁই কথা বলার মানুষ পেয়েছে। এখন বক বক করে কথা বলে যাবে। এক
মুহূর্তের জন্যেও থামবে না। দ্রিমা জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিয়েছে। বাতাসে তার
শাড়ির আঁচল উড়ছে। ষ্টীমারের ভেতোরটা অন্ধকার, বাইরে কপোতাক্ষ নদী ঢেউয়ে ঢেউয়ে
দিনের – শেষ আলোক বিন্দু দুলছে। তার অদ্ভুত লাগছে। যে মারিণে সে যাচ্ছে তা ভাবতে
ভালো লাগছে। সাংখ্যকার মহৰ্ষি কপিলের স্মৃতি বিজড়িত ঝিকরগাছার
কপিলমুনিতে ‘কপিলেশ্বরীর পুরাতন মন্দির’ ও তার কাছে তিনটি ঢিপি আছে। এই ঢিপিগুলি
নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ গবেষণা করে নি।অনেকে অনুমান করেন যে এইগুলি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ। কি
বিস্ময় তার জন্য অপেক্ষা করছে?
‘আপনার দুইজন কোথায় যাবেন?’
‘আমরা যাচ্ছি কপিলমুনি। ওখানে কপিলেশ্বরীর কালী
মন্দির আছে না? ঝিকরগাছা ঘাট কখন পৌঁছব বলতা পারেন। অখান থেকে কপিলমুনি কিসে যাওয়া
যায় বলতে পারেন। অবশ্য কিছু না পাওয়া গেলে হনটন মানে হেঁটে যাব।
‘এক-দুই ঘনটা লাগতে পারে। তবে আমরাও কপিলমুনি
যাচ্ছি। কালী মন্দিরে পুজা দিলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। আমি যাচ্ছি আমার ছেলেকে নিয়ে।
ওর যে কি হইছে ডাক্তার কবিরাজ ধরতে পারছে না।‘
‘অখানে মেলে বসে কোন সময়?
‘প্রতি বৎসর বারুণী উপলক্ষে ১৩ দিন ব্যাপী মেলা
হয়। কপিলের তপস্যাগুণে
বারুণীর দিন এই স্থানে কপোতাক্ষী নদীতে গঙ্গা প্রবাহিত হয়।
দ্রিমা কৌতূহল চেপে
রাখতে না পেরে লোকটিকে জিগ্যেস করল, আচ্ছে কপিলমুনির
আগ্রী গ্রামে তিনটি অতি ঢিপি বা স্তূপ আছে, আপনি কি দেখেছেন।
‘জি
দেখেছি। একটা ঢিপি খুড়ে পুরাতন ইটের দালান (ইষ্টক নিৰ্ম্মিত বাট পাওয়া) গিয়াছে।
এই রকম আরও ঢিপি দক্ষিণে চাদখালি ও উত্তরে
টাল পর্যন্ত মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায়। একটি ঢিপিকে কপিলমুনি গ্রামে জাফর আলি
নামে একজন মুসলমান সাধুর সমাধি আছে।
কপিলমুনিতে মুনির আস্তানা
ষ্টীমারে
গতি বাড়ছে। দ্রিমার চুল বাঁধা। তার ইচ্ছে করছে চুল ছেড়ে দিতে। ষ্টীমারের জানালায়
মাথা বের ক্রা থাকবে, বাতাসে চুল উড়তে থাকবে পতাকার মত। দুনিয়াতে সুন্দর দৃশ্য
গুলির মধ্যে মেয়েদের মাথার উড়ন্ত চুল অন্যতম। দ্রিমা কি চুলের বাঁধন খুলে দেবে?
জুঁই ডাকল, আপা!
দ্রিমা মুখ না ফিরিয়েই বলল, কি?
‘এই
লাইনে ষ্টীমারে প্রায়ই ডাকাতি হয়।‘
‘কে
বলল? ওই বুড়ো?’
‘হু।
এই জন্য আলো নেভানো থাকে। যাতে দূর থেকে শব্দ শুনে বোঝা যায় এটা পুলিশ না যাত্রী
বাহি ...।
‘যখন ডাকাত আসবে তখন দেখা যাবে। আগেই
দুশ্চিন্তা করে লাভ নাই। কারণ আমাদের হাতে কোন সমাধান নাই। তার চাইতে শোন আমাদের
এই বাংলার গর্ব কপিলমুনি কথা। যিনি পৃথিবীতে প্রথম মানবিক দর্শন চর্চা করেছিলেন।
জুঁই
নিতান্ত অনিচ্ছায় চেপে গিয়ে দ্রিমার দিকে তাকাল। তার কাছে দার্শনিক কপিলমুনিকে
মোটেই আকর্ষণীয় লাগছে না, বরং ভয় আরও বেশি লাগছে। ঘন কালো আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
দমকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসের ঝাপটা চোখে – মুখে লাগছে। জুঁই ফিস ফিস করে বলল,
ডাকতরা মেয়েদের পেলে কি করে জান আপা?
দ্রিমা
যা করে করুক। ডাকতরা তো ভয়ঙ্কর। ভয় জাগানোই তাদের ধর্ম। যার যা ধর্ম তারা তাই করবে।
আগুন-পানির ধর্ম নিয়ে প্রথম কপিলমুনি ভেবেছে। এই যে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, দমকা
বাতাস বইছে এসবের যে প্রকাণ্ড শক্তি সেটা নিয়েও তিনি ভেবেছেন। গল্পটা শোন মজা
পাবি।
মহাভারতের সেই আদিযুগের কথা। ইক্ষাকু বংশীয়
সগর রাজা একশ’তম অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন। তো যজ্ঞের আগের
রাতে অশ্ব চুরি হয়ে যায়। ঘোড়াটিকে চুরি করে ইন্দ্রদেব এবং কপিল মুনির আশ্রমে আটকে
রাখলেন। সগরের ষাট হাজার ছেলেরা খুঁজতে খুজতে পাতালে কপিল মুনির আশ্রমে যায়। সেখানে
ঘোড়াটিকে দেখে। ছেলেরা কপিল মুনি অপমান করে।
অপমানে কপিল প্রতিশোধ হিসেবে ছেলেদের ভস্ম ক’রে দিলেন। এরপর সগর রাজার পৌত্র
অংশুমান কপিল মুনিকে তুষ্ট করলে তিনি বিধান দিলেন যে, তপস্যা ক’রে স্বর্গের নদী গঙ্গাকে আনতে পারলে
একমাত্র তাঁর স্পর্শেই তারা সবাই প্রাণ ফিরে পাবে। অবশেষে সগর রাজার বংশধর ভগীরথ
তপস্যা ক’রে
এই কর্মটি সাধন করেন।
স্বর্গের
নদী গঙ্গার মর্তে অবতরণের এই উপাখ্যান বা কিংবদন্তীর দারুণ একটা ব্যাখ্যা আছে। পুরাণের
কিছু নির্দিষ্ট তারিখ নির্দেশ করেছেন, সেসব অনুসরণ করলে এবং ভুতত্বের ইতিহাস অনুসরণ
করলে এ ঘটনার বিশ্লেষণে জানতে পারি আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের এই বাংলা তথা
পুণ্ড্রবর্ধন এক অতি সমৃদ্ধ জাতির বসবাস ছিল। বানিজ্যে কৃষিতে সংস্কৃতিতে জ্ঞান
বিজ্ঞান চর্চায় এরা বাকি ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। তখন অযোধ্যার রাজা ছিলেন
সগর।
সগর
রাজার যে ষাট হাজার পুত্রের কথা বলা হয়েছিল, তা ঠিক তা নয়। সগর রাজার ছয়টি পুত্র ছিল বলে মনে
করা যায়। স্নেহে ওরকম বহুবচন চলত তখন। সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়াতে সগর রাজা এক
অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। এভাবেই তিনি রাজ্যজয় করতে পারবেন, এই আশা করে ঐ ছয়পুত্র অশ্বে চেপে রওনা হলেন। ক্রমে
সেই ছয়পুত্র এসে পৌঁছল বাংলার উত্তর অংশে।
আমাদের
এই অঞ্চলকে তখন উত্তর ভারতের মানুষের দুর্গম নিম্নাঞ্চল অসুরদের নিবাস। তো মহা
প্লাবনময়ী নদী আর সাগরের মোহনায় অসুর রাজ্যে তখন মহামুনি কপিল আশ্রম ছিল। যাঁর
সাংখ্য দর্শনের খ্যাতি ছড়ীয়ে পড়েছে। সেই সাথে তার নদী বিজ্ঞান, আগুন-পানির
অন্তনিহিত শক্তি ব্যাবহার দেখে সগর রাজার পুত্ররা অভিভুত হয়ে পড়লেন।
রাতারাতি
চারিদিকে গুজব রটে গেলো মহামুনি কপিল সগরপুত্রদের বন্দী করেছেন পাতালে। মানে মোহনা
সংলগ্ন কপিলাশ্রমে। আর সেই অগ্নিসম প্রাকৃতিক শক্তি তাদের ভস্মীভূত করেছে। অর্থাৎ
তারা সেই শক্তির মহিমায় আকৃষ্ট হয়েছেন।
এদিকে
সগর রাজার পুত্রদের হইহুল্লর ও তাদের ঘড়াগুলির হ্রেষাধ্বনি শুনে মুনির খানিকটা
বিরক্ত হলেন। তাবে সৌম্যকান্তি রাজ পুত্রদের আশ্রয় দিলেন। রাজ পুত্ররা ততক্ষণে
বুঝে গেছে এই মুনি যেমন জ্ঞানী তেমনি বলশালী যোদ্ধাও। তার সঙ্কোচে শক্তিশালী
যাদুকরের মতো বিজ্ঞানীর চরণে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
পুণ্ড্রবর্ধনে
সগর রাজার পুত্র ও তার সৈন্যরা কিছুকাল থেকে অশ্বসহ ফিরে গেলেন অযোধ্যায়। এই কদিনে
তার জেনে গেছে ঋষি কপিলমুনির বিষয়ে। এই নদী বিজ্ঞানী এই প্লাবন উপত্যকায় মানুষের
দুর্ভাগ্যের সঙ্গে সৌভাগ্যও যে কতটা জড়িয়ে ছিল তাই নিয়ে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল
ছিলেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আদতে যে নতুন পলির প্রলেপে প্রকৃতি শস্যশ্যামলা
হয়ে উঠছেন এবং মানুষের খাদ্য ও আশ্রয়ের
পুনর্নির্মাণ ঘটছে এই কথাটি তিনি ভালোই উপলব্ধি করেছিলেন।
কপিলের মতে প্রকৃতিই সবলা। তাঁর ইচ্ছাতেই মানুষ এগিয়ে চলে। তাই প্রকৃতিকে ক্ষুব্ধ
করা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ। সেসময় গঙ্গা কোনও একটি স্রোত ছিলনা। সমস্ত বদ্বীপ করতোয়ার
ব্যাপ্তি ছিল।
করতোয়ার অসংখ্য স্রোত ছিল। কপিল ব্যাস্ত ছিলেন
জলবিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণায়। বিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়ে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার
কথা ভাবছেন। তিনি চিন্তা আরও এক প্রচণ্ড প্রাকৃতিক শক্তির কথা চিন্তা করেছেন। এ
শক্তি আগুনের জন্ম দিতে পারে।
এ এক সর্বগ্রাসী আগুন। ঠিক যেমন চরাচর
ভাসিয়ে দেওয়া জল। সে জলকে প্রতিরোধ করার শক্তি মানুষের থাকেনা। শুধু সেই স্রোতের
সঙ্গে চলা ছাড়া। সেইরকম আগুন। এসব জেনে সগর রাজার পুত্রর আহ্বান জানালেন অযোধ্যায়।
অপরদিকে
রাজা খবর পেলেন সাগরের মোহনায় মহামুনি কী এক অসীম প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করছেন
যার প্রকাশে দিগন্তব্যাপী আগুন জ্বলে উঠবে।
জুঁই
ডাকাতের ভুলে দ্রিমার কাছে আগ্রহ ভরে জিগ্যেস করল, ‘মহামুনি কপিল কি সত্যি পুণ্ড্রের
অধিবাসী ছিলেন? তুমি কি নিশ্চিত?’
‘বৌধায়ন গ্রন্থে বলছেন, কপিল বলে এক অসুর
ছিলেন, তিনি
দেবতাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতেও এই আসুরীর কথা বলা
হয়েছে। কবি আল মাহমুদ এর সোনালি কাবিন কাব্যে কপিল-এর মুক্ত স্বাধীন
মানসিকতার উল্লেখ রয়েছে-
আমার তো কপিলে বিশ্বাস
প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ।
আমার তো কপিলে বিশ্বাস
প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ।
‘উনার বাবা-মা...। বাসস্থান যদি পুণ্ড্রবর্ধন
হয় তবে ঝিকরগাছায় কেন এলেন?’
‘সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা
কপিল- এর জন্ম ৭০০ খ্রিস্টপূর্ব। তাঁর বাবা পুন্ড্রনগরের রাজা বাসুদেব, মা-নারাচি।
তার বড় ভাইয়ের নামও ছিল বসুদেব। বসুদেব ও নরকের সহায়তায় জরাসন্ধ ৮৬ জন রাজাকে
করাগাওে নিক্ষেপ করেন। ১০১ জন রাজার রক্তে নরকওে তিনি পৃথিবীর অধিশ্বও হ্ওয়ার
স্বপ্ন দেখেন। জরাসন্ধের এহেন কু-কর্মে সহোযোগিতা করায় কপিল তাঁর ভ্রাতা বাসুদেবের
বিরোধিতা করেন।
বড়
ভাই পৌণ্ডকের ধৰ্ম্মবিগর্হিত আচরণে ক্ষুব্ধ হইয়া তিনি পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্য
(বৰ্ত্তমান উত্তরবঙ্গ) ত্যাগ করে সুদূর দক্ষিণে কপোতাক্ষের তীরে বসতি স্থাপন করেন
এবং স্বীয় নামে সেখানে এক কালীমূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
‘আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে সাংখ্য দর্শন
আসলে কি ধরনের দর্শন?
‘সাংখ্যদর্শন বাংলার সবচে
প্রাচীন ভাবদর্শন। এই দর্শন ২৭০০ বছরের পুরনো। সাংখ্যদর্শন নিয়ে ব্যাপক গবেষনা করেছেন অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে। অধ্যাপক গার্বে কপিলের দর্শন একুশ শতকের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব
অনুযায়ী কতদূর সত্য সেটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, "In Kapila’s
doctrine, for the first time in the history of the world, the complete
independence and freedom of the human mind, its full confidence in its own
powers were exhibited." (দেখুন: পন্ডিত
জওহরলাল নেহেরুর লেখা The Discovery of India.(P.184) তথ্যটি
শিহরিত করে! কাজেই, আয়োনিয়ার থালেস নন - বরং বিশ্বের প্রথম মানবতাবদী দার্শনিকটির নাম কপিল।
শিষ্য মাঝে মহর্ষি কপিল
কপিল সংসারে মানুষকে দুঃখ
ভোগ করতে দেখেছেন। একই সঙ্গে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় ভেবেছেন। কপিল লক্ষ্য
করেছেন যে- মানুষ সংসারে ত্রিবিধ দুঃখ ভোগ করে। (এক) আধ্যাত্মিক (দুই) আধিভৌতিক
এবং (তিন) আধিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ হল: কাম, ক্রোধ, লোভ -এসব রিপুতে তাড়িত হলে যে দুঃখ সেটি। মানব, পশু,
পাখি, সরীসৃপ এবং জড়বস্তু থেকে যে দুঃখ পায় কপিল
তাকে আধিভৌতিক দুঃখ বলেছেন। এবং আধিদৈবিক দুঃখ হল ভূকম্পন, বন্যা
বা অপ্রাকৃত শক্তি ইত্যাদি। মহৎ অর্থ চেতনা। অহঙ্কার
হল: ‘আমি জ্ঞান’। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ- প্রকৃতির তিনটি গুণের কারণেই বিভিন্ন ধরনের পদার্থ সৃষ্টি
সম্ভব হয়েছে। কপিল মনে করেন: মহা বিশ্ব হল প্রকৃতির তিনটি গুণের পরিণাম বা বিকার।
বিশ্বজগতের উদ্ভব কী ভাবে হল কপিল তার নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কপিলের মতে বিশ্বজগতে সব মিলিয়ে
জাগতিক পদার্থ রয়েছে পঁচিশটি। ১. প্রকৃতি। ২. পুরুষ।
৩. মহৎ ৪. অহঙ্কর ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ পঞ্চ তন্মাত্র ১০ থেকে ২০ একাদশ ইন্দ্রিয় ২১ থেকে ২৫ স্থ’ল ভূত।
৩. মহৎ ৪. অহঙ্কর ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ পঞ্চ তন্মাত্র ১০ থেকে ২০ একাদশ ইন্দ্রিয় ২১ থেকে ২৫ স্থ’ল ভূত।
এবার আবার দুঃখের প্রসঙ্গে
ফিরে যাই। কপিল বলছেন যে, ‘প্রকৃতির
সহিত সংযোগই পুরুষের দুঃখের কারণ। এবং এই সংযোগের উচ্চেদেই দুঃখ নিবারণের উপায়।
সুতরাং তাহাই পুরুষার্থ। প্রকৃতি-পুরুষের সংযোগের উচ্ছেদই দুঃখ মুক্তি। কিন্তু,
কী ভাবে? কপিল ‘প্রকৃতি
ও পুরুষ’ কে জগতের দুটি নিত্য পদার্থ বলেছেন। অথচ পরবর্তী
সময়ে বাংলার ভাবজগতে প্রকৃতি নারী হিসেবে
এবং পুরুষ পুরুষ হিসেবে
উপস্থিত।
‘পুরুষ উদাসীন, অপ্রধান এবং বহু। সাংখ্যের প্রচলিত
ব্যাখ্যা অনুসারে পুরুষ বলতে চেতন আত্মা বোঝায়। কিন্তু সাংখ্যের আদি অকৃত্রিম
রূপটিতেও তাইই বুঝিয়েছিল কিনা- এ বিষয়ে নানা সমস্যা আছে। অতএব সাংখ্য দর্শনে ‘পুরুষ’-তত্ত্বের তাৎপর্য প্রসঙ্গে সুদীর্ঘ
বিচার প্রয়োজন হবে।‘
‘হুম।...রক্তে নাচন উঠে...নিষাদ সূত্রে
আত্মপরিচয়ের...উন্মাদনায়;...জ্ঞানে আলোড়ন ওঠে কপিলের সন্ধানে! মজার কথা কি জানিস বৈদিক
সংস্কৃতিতে সকল শাস্ত্রের বাংলা তথা পুণ্ড্র জাতিকে চরম অপমান করেছে। এখানকার
পণ্ডিতদের উপেক্ষা করেছে। ব্যাতিক্রম ছিলনা কপিলের খেত্রেও। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়
সাংখ্য দর্শনের বিরোধিতা করতে গিয়ে সাংখ্য দর্শনের মূল কথাটাই কিন্তু এখানে বলে
দিয়েছে। ভাগবতে কপিল মুনিকে চব্বিশজন অবতারের একজন বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বলা
হয়েছে তাঁর পিতার নাম কর্দম ঋষি এবং মাতার নাম দেবহুতি।
মহাভারতের শান্তিপর্বে আচারজ্ঞ পিতামহ
ভীষ্মের জবানিতে সাংখ্যমত সম্পর্কিত দীর্ঘ উদ্ধৃতি রয়েছে। আর্যাবর্তর প্রাচীন মনুস্মৃতি
বা মনুসংহিতায়, ‘চরক-সংহিতা’র, ষষ্ঠিতন্ত্রের কাহিনী ও প্রবাদসমূহ কৌটিল্য
প্রণীত ‘অর্থশাস্ত্র’-এ সাংখ্যদর্শনের
প্রশস্তি দেখা যায়।
ঝিকরগাছা
ঘাট আসতে দেরি নেই। ঘাটের বাতি দেখা যাচ্ছে। ষ্টীমারের গতি এখনো কমতে শুরু করেনি।
দ্রিমা হাত ঘড়ি দেখার চেষ্টা করলো। রেডিয়াম ডায়েল থাকা সত্ত্বেও ঘড়ির লেখা পড়া
যাচ্ছে না। তবে রাত নয়টার মত বাজে। পাঁচ ঘণ্টা লেট। রাত ন’টা ঢাকা শহরে এমন কিছু রাত
না – কিন্তু ঢাকার বাইরে গভীর রাত। দ্রিমা চিন্তিত বোধ করছে। এতক্ষণ সে সাহসী
তরুণীর ভূমিকায় অভিনয় করেছে- ষ্টীমার থেকে নামার পর সত্যিকার অর্থেই সাহসী তরুণী
হতে হবে। কপিলমুনিতে যাবার ব্যাবস্থা করতে হিবে। প্রমাণ করতে হবে – দু’টি মেয়ে
ইচ্ছে করলে নিজেরা নিজেরা ঘুরে বেড়াতে পারে। বডিগার্ডের মত একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে
না থাকলেও হয়।
বি.দ্রঃ ঝিকরগাছা, কপিলমুনির এক তরুণকে বলেছিলাম কপিলমুনি’ নামের কারণ কি? তরুণটি হাসতে বলল, জানিনা। তাকে কপিলমুনি বিষয়ে জানালাম। উত্তরে সে বলল, ‘ভাই আদ্দিকালের কথা মনে করে কি হবে। তার দর্শনের সূত্র বর্তমানে কি কাজে লাগে? সাংখ্য নিনাদ ... হা হা হা...
# বুদ্ধের
জন্মস্থান কপিলাবস্তুর নামকরণ হয়েছিলো।
#
কপিল মুনিরও নাকি মৃত্যু হয়েছিল যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াই ক’রেই।
# মহর্ষি কপিল হচ্ছেন এই দর্শনের
সূত্রকার। তাঁর শিষ্য
আসুরি এবং আসুরির শিষ্য ছিলেন পঞ্চশিখ। এরপর
পঞ্চশিখ-এর দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র নানাভাবে বহু শিষ্যের মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
পঞ্চশিখ-এর কাছ থেকে শিষ্য পরম্পরাক্রমে ঈশ্বরকৃষ্ণ আর্য্যা ছন্দে ‘সাংখ্যকারিকা’
নামে যে গ্রন্থ রচনা করেন, তা-ই এখন পর্যন্ত
সাংখ্য সম্প্রদায়ের প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
#
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
#
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
Comments