পুণ্ড্রের পাঁচালী-১২ (বাঙালির বীরত্ব গাঁথা - প্রথম পর্ব )


পুণ্ড্রের পাঁচালী-১২ (বাঙালির বীরত্ব গাঁথা - প্রথম পর্ব ) 
সাজেদুর রহমান 
এসএম সুলতানের চিত্র 
  
বাংলার প্রাচীন কালের দিকে আমি প্রায়ই তাকায়। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলি। এই ইতিহাসে একজনও বীর বাঙ্গালির বর্ণনা নেই। অথচ আমি জানি এবং যারা ইতিহাস লিখেছে তারাও জানতেন, সমৃদ্ধ নগর সভ্যতা নির্মাণে বাংলার ভূমিপুত্ররা প্রতিকুল প্রকৃতির বিরুদ্ধে অসাধারণ লড়ায় দেখিয়েছে। অন্যসভ্যতার সাথে সংযোগ বা কোন শিক্ষা ছাড়াই তাঁরা কৃষি-দর্শন-শিল্পায়নে যা করেছেন তার তুলনা হবে না। অথচ এরা কেউ ইতিহাসের মহানায়কের তালিকায় স্থান পায়নি। কেন না?

এখনে নিতান্তই আর্য শাস্ত্রের লেখকদের হীনমন্যতা পরিচয় পাই। বাংলা জয় করতে আট’শ বছর লেগেছে। এই দীর্ঘদিনের ব্যর্থতার কারণে বাঙালি জাতি সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা জন্মেছে। তাই তাদের ধর্মগ্রন্থ বেদে অনার্যদের এমন হিন ভাবে দেখানো হয়েছে যা দুনিয়ার কোনো পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম গ্রন্থে দৃষ্টান্ত নেই।

আমার এই লেখাটির অসম্পূর্ণতার মধ্যে একটি হোল আমি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে রোমের মহাকবি ভার্জিল বাঙালি বীরদের গাঁথা রচনা করেছিলেন সেটা আনতে পারলাম না। বিষয়টি এতই দুষ্প্রাপ্য এবং এতই কষ্টকর যে কিছুতেই লেখতে পারলাম না। আশা করছি অন্যরা লিখবেন। তাদের কলমে এইসব অমিত তেজসম্পন্ন মানুষের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা উঠে আসবে।

আমাদের পূর্ব পুরুষদের গৌরবদীপ্ত সংগ্রামের কাহিনী খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর থেকে খ্রিস্টীয় উনবিংস শতাব্দী পর্যন্ত বলার চেষ্টা করব। এই তিন হাজার বছরের বীরদের কথা তিনটি পর্বে লেখব। তাই ইতিহাসের পাতা থেকে শীর্ষ ঘটনা গুলই কেবল যদি উল্লেখ করি, তাহলে দেখব আমাদের বিজয় এসেছে একেরপর এক, ধারাবাহিক ভাবে এবং দ্রুত থেকে ক্রমেই দ্রুত গতিতে। প্রথম পরবে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে শূন্য খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।       

আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিল অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং সাহসী। তার মহাস্থানগড় বা পুণ্ড্রনগরে তারা গড়ে তুলেছিল বাংলার প্রাচীন এক রাজধানী।    

১) হাতি পোশ মানানোর কৌশল আবিস্কারক পালকাপ্য মুনি  

‘হে মরুৎগণ, তোমরা বড়লোক, জ্ঞানবান;... তোমরা পাহাড়ে মত আপন বলে বলিয়ান। তোমরা হস্তী মৃগের মত বনগুলি খিয়াফেলে। অরুণবর্ণ দিকসমূহে তোমরা বল যোজন কর। (১/৬৭/৭ বেদ)। হাতি পোষমানানর বিষয়টি পুণ্ড্রবাসীর অন্যোন্য অর্জন। আর্যরা তাই বেদে এভাবা প্রশংসা করেছে। বেদে আরেকবার হাতির কথা উল্লেখ আছে।
হাতি ধরা, পালন ও চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক পালকাপ্য মুনিও ছিলেন একজন বাঙালি খ্রিস্টের জন্মের ৫/৬’শ বছর আগে হাতি পালনের চল ব্যাপক হারে ছরিয়ে পরে। সে সময়ে সবথেকে কার্যকর বাহন হাতিকে কাজে লাগানোর বীর বাঙ্গালীর গৌরবের ইতিহাস। সেসময় আমাদের বিরাট হস্তীবাহিনী ছিল।    
যোদ্ধা হাতীর দল 

২) বাঙ্গালি লঙ্কা জয়

সিংহর উপদ্রবে রাজ্যের মানুষ অতিষ্ঠ। প্রজারা রাজার কাছে নালিশ করে বলছে, আমাদের বাঁচান। সিংহের কারণে দিনের বেলাতেও বের হওয়া দুস্কর। জীবন বাঁচাবে নাকি কাজ করবে? কিছু একটা করতে না পারলে ঘোরে না খেয়েই মরতে হবে।
উপায়ন্ত না দেখে রাজা ঘোষণা দিলেন, যে এই বিপদ থেকে রক্ষা করবে তার সাথে কন্যা বিয়ে দেবেন এবং সেই হবে দেশের রাজা।
অদম্য সাহসী সিংহবাহু চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এক রাতে সিংহ নধনে নামলেন। রাজ্যের সবাই দুরু দুরু মনে অপেক্ষা করছে। তার পর সকাল হোল। দেখা গেল রাজপ্রাসাদের ফটকে বিসালাকায় এক সিংহ মরে পরে আছে। কিন্তু সিংহবাহুকে দেখা গেলো না। সবাই যখন আশা ছেড়ে দিয়েছে ঠিক তখন সিংহবাহু বীরের বেশে হেঁটে আসছে।
মহাভামসা (Mahavamsa) অনুযায়ী বাংলার রাজপুত্র বিজয় সিংহ খ্রীষ্টপূর্ব ৫৪৪ সালে লঙ্কা জয় করেন এবং তার নাম দেন সিংহল। এই নিয়ে চমৎকার কবিতা রয়েছে- আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়,
সিংহল নামে রেখে গেলো নিজ শৌর্যের পরিচয়                     

মহাভামসা ইতিহাস গ্রন্থ অনুযায়ী এই দেশের (বঙ্গদেশ) রাজপুত্র বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় ছাড়ামালয় দ্বীপপুঞ্জ ও শামদেশেও তাদের নিজস্ব উপনিবেশ স্থাপন করে।

বাঙালিদের সম্পর্কে প্রাচীন গ্রন্থ দ্বীপবংশে আরেকটি বীরত্ব গাঁথার উল্লেখ পাওয়া যায় সম্ভাব্য ঘটনাটি হতে পারে আজ থেকে ২৭০০/২৮০০ বছর আগে বাঙালি যুবরাজ বিজয়সিংহ কর্তৃক সিংহল বিজয় এবং রাজ্য স্থাপনের কাহিনী যদিও সেখানে বিজয়সিংহকে উপস্থাপন করা হয়েছে অনেকটা নিন্দনীয়ভাবে তবুও এটা স্পষ্ট বাঙালিরা লড়াকু, সাহসী এবং বীরের জাতি

৩) সমুদ্রজয়ী দুঃসাহসিক বাঙালীরা

ভারত উপমহাদেশে বাঙালীরাই প্রথম সমুদ্রভ্রমণকারী শক্তিশালী জাতি। পান্ডু রাজার ঢিবিতে স্টিটাইট (Steatite)পাথরের কতকগুলি চিহ্ন খোদিত একটি গোলাকার সীল পাওয়া গিয়েছে। মনে করা হয় যে সীলটির খোদিত চিহ্নসমূহ চিত্রাক্ষর(Pictpgraph) এবং সীলটি ভূমধ্যসাগরীয় ক্রিট দ্বীপের, প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে নির্মিত। এই সীল ও প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শন থেকে মনে করা হয় প্রাচীন সভ্যতার ক্রীট দ্বীপের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো।
প্রাচীন কালে বাংলায় নানা ধরনের নৌকা তৈরি হত। ছোট নৌকা থেকে বৃহৎ ময়ূরপংখী নৌকা তৈরি হত বিক্রমপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বাংলায় কিন্তু বড় জাহাজও ছিল।

৪) বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মতাদর্শ চার্বাক

প্রাকৃতিক কারণেই বহিরাগতদের দ্বারা বাংলা আক্রমন খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না স্থানীয় জনগণ যেহেতু প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে অভ্যস্থ ছিল, সুতরাং তারা ছিল প্রকৃত যোদ্ধা তা সত্ত্বেও ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বাংলায় প্রথম বহিরাগতদের উপস্থিতি জানতে পারি। মৌর্য সাম্রাজ্যে অধিনে বাংলা কি ভাবে গিয়েছিল তা জানা যায় না।  মগধকে প্রায়ই বগধ নামে প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ আছে, তাতে বোঝার উপাই নেই আপোষ নাকি যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলা পরাধীন হয়।

মৌর্য সাম্রাজ্যে অধিনে শত বছরের মাথায় আর্যদের শেনদৃষ্টি পরে বাংলার ধনভাণ্ডারে। যোদ্ধা জাতি আর্যরা সমগ্র ভারত বর্ষ সহজে জয় করলেও ভাগলপুরের সদানীরা (করতোয়া) নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত এসে থামতে বাধ্য হয়। (শতপথ ব্রাহ্মণ)।
তখন আর্যরা ঘোর পথে বঙ্গে আগ্রাসন চালাতে থাকে। স্থানীয়রা প্রবল প্রতিরধ গড়ে তলে। আর্যদের সাথে দ্রাবিড়দের সংঘাত চলতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এই দীর্ঘ প্রতিরোধের কারণ চার্বাক মতবাদিদের সক্রিয়তা। যুক্তিবাদি বস্তুবাদী দর্শন বাংলা মায়ের সন্তানদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করে রাখে। ভারত জনের ইতিহাসে বিনয় ঘোষ লিখেছেন- বেদের বিরুদ্ধে বিরাট আক্রমণ হয়েছিল এক দল লোকের দ্বারা। তাদের বলা হতো লোকায়ত বা চার্বাক।            
স্বাধীন মনোভাব ও নিজ কৃষ্টির গর্বে গর্বিত বঙ্গবাসীরা আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রায় আট’শ বছর প্রতিরোধ করতে পারলেও শেষপর্যন্ত রুখতে পারে না। আর্যরা বঙ্গ বীজয়ের প্রথম পর্যায়ে চার্বাক মতাদর্শের মতালম্বিদের নিধিন করে। সেই সাথে সেই দর্শনশাস্ত্র নিশ্চিহ্ন করে।            
স্বর্গ রাজ্যেপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে দীর্ঘকাল দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংগ্রামের যে অসংখ্য কাহিনী ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ প্রভৃতি আর্য সাহিত্যে ছড়িযে আছে, সেগুলো আসলে আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিরোধ ও মুক্তি সংগ্রামেরই কাহিনী।উইলিয়াম হান্টার তার এ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গলবইয়ে ও প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ সংস্কৃত সাহিত্যে বিবৃত প্রথম ঐতিহাসিক ঘটনা হলো আদিম অধিবাসীদের সাথে আর্যদের বিরোধএই বিরোধজনিত আবেগ সমানভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ঋষিদের স্তবগানে, ধর্মগুরুদের অনুশাসনে এবং মহাকবিদের কিংবদন্তীতে।

ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে এই চার্বাকেরাই যুক্তিবিদ্যা বা তর্কবিদ্যার প্রবর্তন করেছিলেনচার্বাকরা বেদ ও পরলোক উভয়ই অস্বীকার করে একেবারে নাস্তিক শিরোমণি আখ্যায় ভূষিত হয়েছে।

৫) ঐতিহাসিক কুরুক্ষেত্রে বাংলার বীরযোদ্ধা

মহাভারতে (৬।৯) অঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গ রাজ্য তিনটাকে ভারতবর্ষ বা প্রাচীন ভারতের নিকটবর্তী রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে১২ বছর তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে অর্জুন বঙ্গ ও কলিঙ্গের সকল পবিত্র স্থানে এসেছিলেন। মহাভারতের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, পান্ডব ও কৌরবদের যুদ্ধ কুরুক্ষেত্রে বঙ্গ-বাসীরা দুর্যোধনের পক্ষে (পান্ডবদের বিপক্ষে) অংশ নিয়েছিলো। Vangas sided with Duryodhana in the Kurukshetra War (8:17) along with the Kalingas. They are mentioned as part of the Kaurava army at (7:158). Many foremost of combatants skilled in elephant-fight, belonging to the Easternersবঙ্গ-এর হস্তিবাহিনী ছিলো দুর্ধর্ষ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দশ হাজার সৈন্যের এক পর্বতসম বাহিনী নিয়ে বঙ্গ বীরেরা দুর্যোধনের পিছনে অবস্থান নিয়েছিলো। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় বঙ্গের রাজা ছিলেন ভগদত্ত।

৬) আলেকজান্ডারের জয়রথ থেমেছে বাংলায়

দিগ্বিজয়ী গ্রিক বীর আলেকজান্ডার বাংলা জয় করতে পারেনি। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গঙ্গার মহনায় উপস্থিত হলে বিসাল হস্তীবাহিনীর দেখা পান। শুধু তাই নয়, ওই বাহিনীর হাতে সূচাল তিরের আক্রমণ রাজ্যপিপাসু আলেকজান্ডারের বাহিনীকে বেতিবেস্ত করে তলে। জানা যায়, সেই তীরের আঘাতে আলেকজান্ডার অসুস্থ হয়ে পরে। সেই অসুস্থতা আর সারেনি মহাবীর।

গ্রীক পরিব্রাজক মেগাস্থানিস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'ইন্ডিকা'-য় উল্লেখ করেছেন, এই জাতির নাম গঙ্গাঋদ্ধি (Gangaridae)যার অর্থ "Wealth of the Ganges"দিওদোরাস সিকুলাস (Diodorus Siculus) উল্লেখ করেছেন, ভারত উপমহাদেশের সবচাইতে শক্তিশালী জাতি ছিলো গঙ্গাঋদ্ধি জাতি, এর রাজা বিশ হাজার অশ্ব, চার হাজার হস্তি, দুই হাজার রথ ও দুই লক্ষ পদাতিক সৈন্যের এক শৌর্যপূর্ণ বাহিনী নিয়ে আলেকজান্ডারের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হন।

আলেকজান্ডার তখন তাঁর সহকারী কইনাস (Coenus) এর সাথে দেখা করার পরে ঠিক করেন ফিরে যাওয়াই ভাল। গ্রীক পলিম্যাথ টলেমী (৯০-১৬৮ খ্রীষ্টাব্দ) লিখেছেন গঙ্গারিডী জাতি গঙ্গা নদীর মোহনার পাঁচটি মুখের পুরোটাতেই রাজত্ব করতো। অর্থাৎ সেই রাজ্যের অবস্থান যেখানে ছিলো সেটাই আজকের বাংলা।           

৭) বঙ্গ নারীর সংগ্রামের গৌরব-গাঁথা

পুণ্ড্রবর্ধনের উর্বর মাটিতে কৃষি কাজের পত্তন হয় আর্যবত্তের আগে। কোন কোন সুত্র মতে ধান, আখ, তুলা চাষের সূচনা এই বদ্বীপেই। আর কৃষির সূত্রপাত নারীদের মাধ্যমে বলে ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত। তাই পুণ্ড্র জনপদের কৃষিভিত্তিক নগর সভ্যতার পেছনে অবদান এখানকার নারী সমাজ।
জগৎ বিখ্যাত মসলিন কাপড় বোনার প্রধান কারিগর নারী। রাত জেগে অতি সূক্ষ্ম বাস্ত্র বনের নিপুণ কারিগর এই নারি সমাজ প্রয়জনে সাহসী উঠতেও দেখতে পাই। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মারা যাওয়ার পর ভালো শাসক সম্রাট অশোক ক্ষমতায় এলেও তাঁর রাজকর্মচারী ও সৈন্যরা ছিল লুটের দল। বাংলার সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম-অত্যাচার করত গোপনে। একসময় সরল মানুষগুলো বিদ্রোহী হয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। মৌর্য সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ে। দুঃসাহসী বাঙালির হাতিয়ার বলতে তখন প্রধানত তির-ধনুক আর লাঠি। আর শুনে রাখো, বিরাট সেনাবাহিনীর সামনে বাঙালিদের মূল শক্তি ছিল নারী যোদ্ধা।

৮) ইতিহাসের মহানায়ক কপিল

আর্যরা বাঙ্গালীদের কোন কাজে কোন প্রকার স্বীকৃত না দেলেও কপিলেলের সাংখ্য দর্শনকে অস্বীকার করতে পারেনি। তাকে দেবতার আসনে আসীন করেছে। সম্বোধন করেছেন ঋষি, মহামুনি, মহর্ষি বলে।            
সেই প্রাচীন পৃথিবীতে বাঙালিরা যে কোন সুউচ্চ পর্যায়ে জ্ঞান চর্চা করত তা অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে গবেষণায় দেখিয়েছেন। তিনি জানান, ২৭০০ বছর আগে    করেনি সর্ব প্রাচীনতম দর্শন সাংখ্যদর্শন বা সাংখ্যশাস্ত্র

৯) বিস্ময়ের বিস্ময় বাংলার মসলিন ও বাঁকলের বস্ত্র  

ইতিহাসের প্রাচীন পণ্য বাজারে বাংলার বিস্ময় মসলিন। এর মসৃণতা সূক্ষ্ম কারুকাজের কারণে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা ছিল আকাশ ছোঁয়া। চিনেও মসলিন তৈরি হলেও বাংলার মসলিন ছিল সরবাধিক আকর্ষণীয়।
ঢাকাই মস্‌লিন ঘাসের উপর রেখে রাতের বেলায় তার উপর শিশির পড়লে, কাপড় দেখাই জেত না। একটি আংটির ভিতর দিয়এক থান মসলিন অনায়াসেই টেনে বের করে নেওয়া যেত। তাঁতীরা খুব ভোরে উঠে একটি বাখারির কাটে নিয়ে কাপাসের খেতে ঢুকত। চট করে যেমন একটি কাপাসের মুখ খুলয়া যেত, অমনি বাখারিতে জড়িয়ে তার মুখের তুলাটি সংগ্রহ করত। সেই তুলা হতে অতি সূক্ষ্ম সুতা পাকিয়ে, তাতেই মস্‌লিন তৈয়ার হত।
গাছের বাকল থেকে এক ধরণের বস্ত্রও ছিল দারুণ লোভনীয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থেপেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সি বইতে এবং বিভিন্ন আরব, চীন ও ইতালীর পর্যটক ও ব্যবসায়ীর বর্ণনাতে মসলিন ও বাঁকলের বস্ত্র ছাড়াও শণ, পাট, ধঞ্চে, এমন কি আন্তসী থেকে বস্ত্র উৎপাদন হত বাংলার দুকুল সুপ্রাচীন কালের গৌরব।

১০) মিষ্টি লবণ উৎপাদনের সূচনা পুণ্ড্রে

পুণ্ড্র অর্থ আখ। পুণ্ড্র জাতির হাতে চাষ শুরু হওয়া বিশেষ জাতের আখ থেকে গুড় ও চিনি তৈরি হতো। সেই চিনি আরব্য বণিকের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চালান হতো। ৭২২ খ্রিস্টপূর্বে আরব্য বণিকদের ভাষায় চিনি হচ্ছে মিষ্টি লবণ কৌটিল্যের বইতেও পুন্ড্র এলাকায় আখ চাষের গোরা পত্তানের উল্লেখ পাই।

খৃষ্ট-পূর্ব একাদশ শতাব্দীতে চীনে যে সব পণ্য-দ্রব্য লেনদেন হত, সেসব পণ্য-দ্রব্যের মধ্যে দ্রাবিড়-দেশীয় নামের উল্লেখ আছে। তখন দ্রাবিড়-রাজ্য হইতে সমুদ্র-পথে চীনে বাণিজ্য চলিতেছিল, প্রত্নতত্ত্বের অনুসন্ধানে তাহা বুঝতে পারি। দক্ষিণ ভারতের সুগন্ধ মশলা, মণি-মুক্ত প্ৰভৃতির ব্যবসায় এ সময়ে বিশেষভাবে চলিয়াছিলএছাড়াও সমুদ্রপথে আমাদের জাভা, সুমাত্রা, শ্যাম (থাইল্যান্ড), ইত্যাদি দেশের সাথে বাণিজ্য ও যোগাযোগ ছিলো।  

১১) শিক্ষা-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ জাতী

সাহিত্যে, ভাষাবিজ্ঞানে এবং ন্যায়শাস্ত্রে যে ব্যুৎপত্তি আর্জিত হয়েছিল তা এক কথায় অভাবনীয়কোনরূপ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কেবলমাত্র সামাজিকগণের অথবা ক্ষেত্রবিশেষে জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত শিক্ষকবৃন্দের স্বতঃপ্রণোদিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিলএক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বিক্রমশীলা, ময়নামতি, পাহাড়পুর, ভাসুবিহার অন্যতমবঙ্গীয় সভ্যতার এই মহাজনপদের পুণ্ড্রনগর জন্ম নেওয়া শিক্ষক-পণ্ডিত-মনীষিগণ এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য-পণ্ডিতের পদ অলঙ্কৃত করে জগৎমাতাকে জ্ঞানভূষণে ভূষিত করেছিল

পাণিনির ব্যাকরণের টীকার চান্দ্র-ব্যাকরণের উল্লেখ ছাড়া ভারতে ব্যাকরণশাস্ত্রের বিবর্তনের ইতিহাস লেখা যায় না। অল্প বয়েসে সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায়, কলাশাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। রাজশাহীতে জন্ম, সময়কাল নির্দিষ্ট না করা গেলেও ৪৫০ থেকে ৬৬০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই এঁর জীবন ও কাজকর্ম।

খ্রিষ্টপূর্বর দুইশ বছরে আগেই স্বতন্ত্র রীতি নাটকের জন্ম ভূমী এই বাংলা। এছাড়া চিত্র শিল্প, কুঠির শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলার উজ্জ্বল ইতিহাস আছে।             

'প্ৰেক্ষাগৃহ' বা 'পেকূখ্য ধরন্স' প্ৰাচীন বাংলায় প্রবৃত্তির অনুসারে নাটকের প্রবৃত্তি চার রকম ছিল। সেই চারিটি প্রবৃত্তির নাম- আবিস্তী, দাক্ষিণাত্যা, পাঞ্চালী ও গুড় মাগধী। গুড় মাগধী প্ৰবৃত্তি যে সব দেশে প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে বঙ্গদেশ প্রধান। কারণ, বঙ্গদেশ হতেই মলচ মন্ত্র বর্ষক ব্রহ্মোত্তর ভার্গব মার্গব প্ৰাগজ্যোতিষ পুলিন্দ বৈদেহ তাম্রলিপ্তি প্রভৃতি দেশ নাটকের প্রবৃত্তি গ্ৰহণ করত।      

১২) বৌদ্ধ-জৈনসহ আজীবক ধর্ম দর্শনের উৎসভূমী  

দার্শনিক শ্রেষ্ঠ মহর্ষি বৃহস্পতি ও তদীয় ছাত্র চার্বাক, মহামতি শ্রী চৈতন্যদেব প্রমূখ ছিলেন বাংলা তথা পুণ্ড্রবর্ধনের গর্বিত সন্তান আজীবক আরামে জীবনযাপনে পক্ষপাতী জৈনদর্শনের মূল কথা হলো, সাধারণ অভিজ্ঞতায় আমরা জগতকে যেভাবে জানি তাই সত্য ও যথার্থ ভারতের প্রাচীনতম অসনাতন নাস্তিক্য ধর্মদর্শনের অন্যতম হচ্ছে জৈনদর্শন ‘জিন শব্দ থেকে জৈন শব্দের উৎপত্তি ‘জিন অর্থ বিজয়ী যিনি ষড়রিপুকে জয় করেছেন, তিনিই জিন      
জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, আজীবক ধর্ম এবং যে সকল ধর্মকে বৌদ্ধের তৈর্থিক মত বলতে, যেসব ধর্মই বঙ্গ মগধ ও চের জাতির প্রাচীন ধর্ম প্রাচীন আচার, প্রাচীন ব্যবহার, প্রাচীন রীতি, প্রাচীন নীতির উপরই স্থাপিত আর্যজাতির উপর এর ততটা নির্ভর করে না এ কথা যদি সত্য হয়, তাহা হলে বঙ্গদেশের জন্য গৌরবের
এর পেছনে যুক্তি (এক) এ সব ধর্মের উৎপত্তি পূর্বভারতে বঙ্গ মগধ ও চের জাতির অধিকারের মধ্যে, যে সকল দেশের সাথে আর্যদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল সে সব দেশের বাহিরে এ সব ধর্ম বৈরাগ্যের ধর্ম (দুই) বৈদিক আৰ্যদের ধর্ম সম্পূর্ণরূপে গৃহস্থের ধর্মী ঋগ্বেদে বৈরাগের নাম গন্ধও নাই অন্যান্য বেদেও যাগযজ্ঞের কথাই বেশি, সেই সূত্রগুলিতে চার আশ্রম পালনের কথা আছে শেষ আশ্রমের নাম ভিক্ষুর আশ্রম ভিক্ষুর আশ্রমেও বিশেষ বৈরাগের কথা দেখা যায় না আমরা যে সব ধর্মের কথা বলিছি, তাহাদের সবই বলছে গৃহস্থ আশ্রম ত্যাগ করে গৃহস্থ আশ্রমে কেবল দুঃখ

সুত্তপিটকের অঙ্গুত্তর নিকায়ে বঙ্গান্তপুত্ত নামে এক খ্যাতনামা বৌদ্ধ আচার্যের উল্লেখ পাওয়া যায় অপরদিকে পিটকগ্রন্থ থেরগাথা ও সংযুক্ত নিকায়ে বঙ্গীশ নামে একজন প্রতিভাবান ভিক্ষুর উল্লেখ রয়েছে। তিনি ছিলেন স্বভাব কবি তাঁর কবিত্বের প্রতিভা ছিল অসাধারণ; তাৎক্ষণিক স্বরচিত কবিতাচ্ছন্দে তিনি বুদ্ধ ও বুদ্ধ-শিষ্যদের গুণগান রচনা করে সকলকে অভিভূত করে দিতেন ইতিহাসবিদদের ধারণা বঙ্গান্তপুত্ত ও বঙ্গীশ বঙ্গদেশের অধিবাসী ছিলেন বলেই এরূপ নামে অভিহিত হয়েছিলেন

১৩) দাপুটে রাজা-ধিরাজ

প্রাচীন বাংলায় গোষ্ঠীর নামে রাজ্যের নাম হত। যেমন বঙ্গ, পুন্ড্র ইত্যাদি। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বাংলার বেশিরভাগ এলাকাই শক্তিশালী রাজ্য মগধের অংশ ছিল মগধ শাসনামল শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ সালের দিকে, এবং শেষ হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭৯৯ সালে। সে হিসেবে বাংলার ইতিহাস প্রথম রাজা হিসেবে বৃহদ্রথতারপরেই সিংহাসনে বসেন জরাসন্ধ।
গৌতম বুদ্ধের (খ্রীষ্টপূর্ব ৫৬৩ থেকে ৪৮০ পর্যন্ত) সময়ে এটি ছিল ভারতের চারটি প্রধান রাজ্যের মধ্যে একটি মগধের ক্ষমতা বাড়ে বিম্বিসারের (রাজত্বকাল ৫৪৪-৪৯১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) এবং তার ছেলে অজাতশত্রুর (রাজত্বকাল ৪৯১-৪৬০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) আমলে।

রামায়ণ এবং মহাভারতে সব থেকে বেসি পাই বাসুদেব নাম। পুণ্ড্রের রাজা। একাধিক বাসুদেব কথা পাই। কখনো কপিল মুনির পিতা, কখনো কৃষ্ণ অবতার ভিন্ন নামে, আবার কথাও দ্রপদির সয়ম্বরায় উপস্থিত পুণ্ড্রবর্ধনের প্রতাপশালি রাজা জিনি ভীমের হাতে পরাজিত হয়ে রাজ্য হারান। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেও আংশ নিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় বঙ্গের রাজা ছিলেন ভগদত্ত।

সভ্যতার বিনির্মাণে সুপ্রাচীনকাল থেকে এই জনপদে শক্তিশালী রাজারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, যারা ছিল, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী যোদ্ধা মহান সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোক, মহারাজাধিরাজ বিক্রমাদিত্য তথা সমুদ্রগুপ্ত, লঙ্কাবিজয়ী বীর শাসক বিজয় সিংহসহ প্রত্যেকের জীবন দর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে প্রাক বৈদিক যুগ থেকে চর্চিত রাষ্ট্র দর্শন

১৪) কয়েকটি ব্যাতিক্রমি তথ্য

রহস্যময় আগমনঃ আমাদের পূর্বপুরুষেরা ‘দ্রাবিড়’। সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা। কিন্তু কিভাবে কখন উত্তর ও মধ্য ভারত টপকে জলে-জঙ্গলের দেশে আসে তার তথ্য উদ্ঘাটন হয়নি। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে মূলত আর্য-পূর্ব বাঙালি জনগোষ্ঠীর।

কুকুর লেলিয়েঃ সম্ভবত বঙ্গীয় অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজস্বতা সম্পর্কে সেই প্রাচীন কালে এতটাই সচেতন ছিল যে আজ থেকে ২৬০০ বছর আগে জৈন তীর্থাঙ্কর মহাবীর যখন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রবেশ করলেন, স্থানীয় জনগন তাকেও প্রত্যাখ্যান করেছিল কুকুর লেলিয়ে তাড়ানো হয়েছিল ফলে মহাবীর বাংলা থেকে চলে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এরা খুব অসভ্য, কুকুর লেলিয়ে দেয়

চীনদেশে ময়ূর রফতানিঃ চীনদেশের অধিবাসীরা ময়ুর দেখে নাই। তাই ১৪০ পুৰ্ব্ব-খৃষ্টাব্দের আগে থেকে চীনে ময়ুরসহ প্রবালের বাণিজ্য আরম্ভ হয়। এক বিবরণীতে জানা জায়, মাছরাঙ্গ পর্দী, দশটা গণ্ডারের শৃঙ্গ, পাঁচ শত বিভিন্ন বীর্ণের কৌড়ি, কতকগুলি কোসিয়া মূল, চল্লিশ জোড়া জীবন্ত মাছরাঙ্গা, দুই জোড়া ময়ূর, প্ৰবালাদি রত্ন ও হেনার বাণিজ্যের প্ৰধান পণ্য বলে গণ্য
  
প্রথম মুদ্রার প্রচলন বাংলাদেশের  এখন পর্যন্ত ইতিহাসের প্রাপ্ত তথ্য বলেপ্রাচীন ভারতে প্রথম মুদ্রার প্রচলন বাংলাদেশের নরসিংদীতে। সেখানের উয়ারী বটেশ্বরে পাওয়া প্রাচীন ধাতব ছাপাঙ্ক মুদ্রার অস্তিত্ব থেকে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো এই ইতিহাসের সন্ধান পান প্রত্নতত্ত্ববিদরা।

প্রাচীন বাংলার বাঙালিরা যে সরল, উদার, বীরত্বপূর্ণ ও সাম্যবাদী সমাজের মানুষ ছিল তার পরিচয় বাঙালি মানসের গহিনে আজও কম-বেশি বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে এই নীতিসমূহ চর্চার ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য, ভক্তি, সশ্রদ্ধভাব, অতিথিপরায়ণতা, আত্মত্যাগ, সর্বমানবপ্রেম এসকলই বাঙ্গালীর নিজস্বতা-স্বকীয়তা।

প্রত্নতাত্ত্বিকদের খুঁজে পাওয়া তাম্রলিপির খোদাই থেকে বোঝা গিয়েছিলো আমরা কত উন্নত ছিলাম। জানতে পারি আমাদের পূর্বপুরুষেরা কৃষিনির্ভর ও সরল জীবন যাপন করত তারা আদি জনতা পরিশ্রমী ছিল এবং তাদের শরীরে যেমন শক্তি ছিল-বুকে ছিল প্রবল সাহস!
### 

সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী 
০১৯১২০৭৮৫৯৩
 sajedurrahmanvp@gmail.com     

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান