পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৩ (মঙ্গোলকোটের দেবী মনসা)


পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৩ (মঙ্গোলকোটের দেবী মনসা) 
সাজেদুর রহমান 
দেবী মনসা

আদি-দরজায় চৌদ্দ-পনের বছরের অপরূপ রূপবতী একটি কিশোরীর মুখ দেখা গেল। মেয়েটির নাম ঘৃতাচী, সে কিরাত কন্যা-সাপের বিশ ঝাড়ার ক্ষমতার আয়ত্ত করেছে। ঘৃতাচী বড়ই অবাক হয়েছে। তার জীবনে এমন বিস্ময়কর ঘটনা কিভাবে ঘটে গেল। তাই শুনে রাতদুপুরে সাধু সাধু চেহারার লকগুল এসে পুঁজ দিতে চাচ্ছে। আগামিকাল সখীদের গল্পটা কিভাবে বলবে, তা ভেবেই তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। গল্পটা অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না। সন্ন্যাসী ধরনের লোকগুলোর নাম জানতে পারলে ভালো হতো।          
  ঘৃতাচী ফিসফিস করে তার মাকে বলল, মা, এই পূজার অর্ঘ কি আমি গ্রহণ করব?
  ঘৃতাচীর মা নিচু গলায় বলল, জানিনা। দেখি তোর দিদিমা কী বলেন।
  ঋষি মতো এসব লোকজন কে মা?
  জানি না।
ঋষি মতো লোকগুলোর মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ একজন দিদিমার দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, দেবতার বরপ্রাপ্ত মেয়েটি কি আপনার গোত্রের? বড়ই দিব্য লক্ষণা। সে সাপের বিষ নাশের ক্ষমতা পেয়েছে।       

অথর্ববেদে প্রথমাব ঘৃতাচী নামক কিরাত কন্যার সর্পবিশ নাশের ক্ষমতার বর্ণনায়া এমনটি জানতে পারি অপেক্ষাকৃত নবীন পুরান ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান ও দেবীভাগবত পুরাণে মনসার উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগের সাহিত্যকর্ম মনসামঙ্গল কাব্যে মনসার মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত হয়েছে নানা গাথা কাহিনী। এছাড়াও খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভারতে আসা সঙ্গীদের বর্ণনায় ভারতবর্ষে সর্পপূজার জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কোনো এক স্থানে অন্যান্য পশুর সঙ্গে বৃহদাকৃতির সাপকে গুহার মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পান।

মহাস্থানের চালু ইতিহাস আর প্রচল কিংবদন্তির আড়ালে ঢেকে রেখে দেয় এইসব অতি প্রাকৃতিক ঘটনা প্রবাহ থেকে জানতে পারি-উত্তরবঙ্গ থেকেই মনসা দেবীর উৎপত্তি। এর অকাট্য প্রমাণ মেলে মহাস্থানের মঙ্গলকোট পাওয়া মনসা দেবীর আদিতম প্রতিমা। যেটি রেডিও কার্বন দ্বারা পরিক্ষিত।   

ধ্রুপদী শিল্পচর্চার উচ্চমার্গীয় ইতিহাসঃ  
মঙ্গলকোট মহাস্থানগড়ের (বগুড়াশিবগঞ্জ উপজেলায নামুজা ইউনিয়নে) প্রায় ১ কিলোমিটার পশ্চিমে চিংগাসপুর গ্রামে অবস্থিত। আলেকজান্ডার কানিংহাম মধ্যযুগের খুবই ছোট আকৃতির একটি মন্দির স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেন ১৮৭৯ সালে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখানে খনন করে (১৯৮১-৮৩) এক হাজারেরও বেশি প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কার করে। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর কুষাণ যুগের পোড়ামাটির ভাস্কর্য। বাংলাদেশের অন্যকোন প্রত্নক্ষেত্রে এ ধরনের বৃহদাকৃতির পোড়ামাটির ভাস্কর্য পাওয়া যায়নি।
সর্পদেবী মনসার মূর্তি

পোড়ামাটির ভাস্কর্য সর্বাপেক্ষা কৌতূহলোদ্দীপক দিকটি- অধিকাংশই নারী মূর্তি। এগুলি মাথায় সাপের ফণাসহ সুদৃশ্য মস্তকাবরণী ও অলংকারে শোভিত। এখানে মূর্তিগুলি স্তূপাকারে পাওয়া যায়, যার উপর পরবর্তীকালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। স্থানটি এখনও পুরোপুরি খনন করা হয়নি।

মঙ্গলকোট ঢিবিটি ছিলো পলিবাড়ি মৌজার ২০৭ নং প্লটে এবং উত্তর দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য ছিলো ৮৭.৮৭ মিটার, প্রস্থ ১২.১২ মিটার থেকে ২১.২১ মিটার ও উচ্চতা ২.১২ মিটার। ভুমির মালিক বা মালিকদের অনধিকার প্রবেশের কারণে ঢিবিটির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। ১৯৭৪ সালে স্থানীয় কয়েকজন লোক গুপ্তধনের সন্ধানে বেআইনিভাবে খুড়ে কয়েকটি অতি মুল্যবান ও অতি উচ্চমানের পোড়ামাটির চিত্রফলক আবিষ্কার করেন এবং সেই সংগে ঢিবিটিটির যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করেন

এখানে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ভাস্কর্যগুলো গুপ্ত কালে পুন্ড্রবর্ধনভূক্তিতে ধ্রুপদী শিল্পচর্চার উচ্চমার্গীয় ইতিহাসকে সামনে এনেছে। বাংলা অঞ্চলে পাথরের কোন উল্লেখযোগ্য উৎস ছিলো না। তাই শিল্পী পাথরের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছিলো পোড়ামাটির মাধ্যমকে, আর অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতায় তৈরি করেছিলো কালোত্তীর্ণ সব ভাস্কর্য। অনেক ক্ষেত্রেই তা অতিক্রম করেছিল প্রস্তর ভাস্কর্যের শিল্প সুষমাকে। আর এ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা পরবর্তী সময়ে লক্ষ করা যায় উত্তরবঙ্গে পাল যুগের এবং দেব, চন্দ্র আমলে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের পোড়ামাটির ফলকচিত্রে এবং খানিকটা ভিন্ন রুপে সুলতানি আমলের বাংলায়।
ভাস্কর্যগুলোর গড় উচ্চতা ০.০৬১ মিটার। এগুলি সর্পদেবী মনসার মূর্তি। তবে কয়েকটি প্রতিমা সর্পফণাবিহীন। সুঠামদেহী ও স্বাস্থ্যবতী নারী ভাস্কর্য প্রতিমাগুলোর যে মোহনীয় রূপ শিল্পি ফুটিয়ে তুলেছেন তা তুলনাহীন।

মনসার আদিতম প্রতিমাঃ
অধিকাংশ ভাস্কর্য ভাঙ্গা অবস্থায় পাওয়া গেলেও সৌভাগ্যজনকভাবে বেশ কয়েকটি ভাল অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। মঙ্গলকোটে পাওয়া মনসা দেবীর প্রতিমা সর্ব প্রাচীন বলে জানা গেছে। এখানকার দুহাত বিশিষ্ট প্রতিমাগুলির ডান হাত ফলাঞ্জলিহস্ত ও ডান হাতে কোলে আস্তিককে ধরে আছে। কোনটিতে আস্তিকের সঙ্গে ঘটের উপস্থিতি চোখে পড়ে। মাথায় সর্পফণা বিশিষ্ট মুকুট রয়েছে। গুপ্তযুগের এ প্রতিমাগুলির সময় ৫/৬ শতক। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে আটচল্লিশটিরও বেশি মনসা প্রতিমা আবিষ্কৃত হয়েছে।

এ ভাস্কর্যগুলির নির্মাণ রীতির বিশ্লেষণ এগুলোর শিল্পরীতি বুঝতে সাহায্য করে। ভাস্কর্যের কমনীয় মুখাবয়বে ধনুক বক্র ভ্রু, আনত দৃষ্টি, টিকালো নাসিকা, হাসির রেখা ফুটে উঠা ওষ্ঠ, তীক্ষ্ণ চিবুক প্রভৃতির মধ্যে গুপ্ত শিল্পকলার সব বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। গুপ্ত শিল্পি সফলভাবে একটি দেবী মুখাবয়বের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ভক্তবৃন্দের মনের আকুতি বুঝতে পারার মতো অসাধারণ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন। যার সাথে মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত গুপ্ত যুগের একটি পোড়ামাটির ভাস্কর্যের মুখভঙ্গির তুলনা করা যেতে পারে।



মঙ্গলকোট ভাস্কর্যগুলো গুপ্ত পাথরের ভাস্কর্যগুলোর মতোই শিল্পশৈলী প্রকাশে শতভাগ সফল। ধ্রুপদী গুপ্ত শিল্পকলার এক উৎকৃষ্ট  উদাহরণ একটি তরুণী প্রতিমা যার গলায় বিনুনির ন্যায় পাকানো (সামান্য মোটা) হার, কানে কুন্ডল, মাথায় পেছন থেকে সম্মুখভাগ দিয়ে বেষ্টিত বিনুনি সদৃশ কেশসজ্জা, দেহের শক্ত গাঁথুনী এবং অবাক দৃষ্টিতে তাকানোর ভঙ্গিমা ইত্যাদি মিলিয়ে শিল্পি ফুটিয়ে তুলেছেন যেন সদ্য কৈশোরে পা দেয়া কোন কিশোরী পৃথিবীকে নতুন করে অবাক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করছে। তার আয়তাকার মুখাবয়ব, পুরু নিম্নোষ্ঠ, টিকালো নাসিকা, চিবুক সরু কটিদেশ ইত্যাদি সবকিছুই গুপ্ত কবি কালিদাসের কুমারসম্ভবে পার্বতীর সৌন্দর্য বর্ণনায় ব্যবহূত উপমার বাস্তব প্রয়োগ। এযেন কালিদাসের মেঘদূতেনারী সৌন্দর্যের বর্ণনার বাস্তব প্রয়োগ।

পোড়ামাটির ভাস্কর্যের প্রকৃত ইতিহাসঃ
মঙ্গলকোটে প্রাপ্ত ভাস্কর্য শুধুমাত্র তরুণ প্রজন্মকেই উপস্থাপন করেনি পূর্ণ বয়স্কদেরও উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ধরনের দুটি ভাস্কর্যের একটি পুরুষ এবং অন্যটি নারী ভাস্কর্য। পুরুষ ভাস্কর্যটির আয়তাকার ভারী মুখমন্ডল ও নাকের গড়নের মধ্যে দিয়ে একজন মধ্য বয়সী পুরুষকে উপস্থাপন করা হয়েছে। তেমনিভাবে সামান্য মাংসল মুখমন্ডলের একজন পূর্ণ বয়স্ক নারীকে সফলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ অঞ্চলের শিল্পিরা কেবল মানুষের ভাস্কর্যেই দক্ষ ছিল না তাদের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় প্রাণী চিত্র পরিস্ফুটনে। একটি পোড়ামাটির ফলকে রাজহাঁসের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হাঁসটির অলংকৃত পালক ঠোঁট দিয়ে পরিষ্কার করার অসাধারণ ভঙ্গীমার সাথে অন্য কিছুর তুলনা চলে না।

আমাদের সভ্যতার মৌলিক ও প্রধান উৎস মৃত্তিকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। মাটি বাংলাদেশের প্রাণ। বহু যুগ থেকে মাটিই আমাদের জীয়নকাঠি ও সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি। নদীমাতৃক বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ। প্রখর সূর্যতাপের কারণে এই দেশের পলিমাটি হলো রোদে-শুকোনো ইট, তারপরে আগুনে-পোড়ানো ইট এবং পোড়ামাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোশন, তৈজসসমূহ।


প্রাগৈতিহাসিক কালে এখানে এ মৃত্তিকা সভ্যতার গ্রামে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বসবাস খ্রি.পূ. দশ হাজার থেকে সাত হাজার অব্দের মধ্যে। মাটির মানুষের মাটির ঘরবাড়ি, মাটির তৈজসপত্র, মাটির পুতুল এবং শেষমেশ মাটির সমাধি কিংবা মাটির ছাই। মৌর্য-পূর্ব যুগের বাংলায় সীমিতভাবে পোড়ামাটির শিল্পচর্চা হয়েছে পোড়ামাটির ভাস্কর্যের প্রকৃত ইতিহাসের শুরু মৌর্য যুগ থেকে। মৌর্য-পূর্ব যুগের মৃৎশিল্পে বিষয়ের বৈচিত্র্য ছিল না। সেখানে সমুদয় মনোযোগ রাখা হয়েছে মাতৃমূর্তি নির্মাণে। মৌর্য যুগে সত্যিকার অর্থে মৃৎশিল্প বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রূপে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রত্নস্থলে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। এসব ভাস্কর্যের কেশ বিন্যাস, মুখভঙ্গি, মস্তকাভরণ, পোশাক এবং অলংকার ব্যবহারে মার্জিত রুচির পরিচয় ছিল। এ যুগে সাধারণ ভাস্কর্যগুলোর মুখাবয়ব ছাঁচে তৈরি করা হতো। পরে তা যুক্ত করা হতো হাতেগড়া দেহের সঙ্গে।

সাধারণ ভাবে এই কয়েকটি কথা মনে রাখিয়া প্ৰাচীন বাঙলার তক্ষণ-শিল্পালোচনা আরম্ভ করা যাইতে পারে। এই উষ্ণ, জলীয়, বৃষ্টিস্নাত, নদীবিধৌত বাঙলাদেশে সুপ্রাচীন নিদর্শন যে পাওয়া যাইতেছে না, তাহা কিছু অস্বাভাবিক নয়; অন্যান্য কারণের ইঙ্গিত আগেই দিয়াছি। খ্রীষ্টোত্তর ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের আগেকার নিদর্শন যাহা পাওয়া গিয়াছে, সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন, এ-ক্ষেত্রেও তাহা স্বল্পই। স্বল্পতার প্রধান কারণ, দেশের মাটি ও জলবায়ু, পাথরের অপ্রাচুর্য, যথাযথ খননবিষ্কারের অভাব, কিন্তু সর্বোপরি যে-কারণ ছিল সক্রিয় তাহা ঐতিহাসিক। প্রাচীন বাঙলাদেশে আর্য-সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ স্পৰ্শ খ্রীষ্টোত্তর পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের আগে ভালো করিয়া লাগেই নাই এবং সেই সংস্কৃতির কেন্দ্ৰস্থল। মধ্যদেশের সঙ্গে যোগাযোগও খুব ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠে নাই। তাহার আগে আদিম কোম-সন্নিবিষ্ট রাঢ়-পূণ্ড-সুহ্ম-বঙ্গ প্রভৃতি জনপদ নিজেদের সমাজ-সংস্থা, নিজেদের শিল্প ও সংস্কৃতি, নিজেদের জীবনযাত্রা লইয়া ভারতবর্ষের এক ধারে পড়িয়াছিল আৰ্য্যমনের অবজ্ঞা ও অজ্ঞতায়।
পোড়ামাটির ভাস্কর্য, ফলক নির্মাণ বাংলা তথা ভারতবর্ষে বহু প্রাচীন কাল থেকেই চর্চিত হয়ে আসছে। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয় এ সম্পর্কিত করণ-কৌশল, পদ্ধতি নিয়ে বেদ বা বেদপূর্ব শাস্ত্রকারগণ বিস্তারিত কিছু লিখে রেখে যাযাননি। ফলক নির্মাণপদ্ধতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো গ্রন্থ আজ অবধি বাংলা ভাষাতেও পাওয়া যায়নি। তবে কিছ পুরাণ, ইতিহাসাশ্রয়ী গ্রন্থ ও চিকিৎসাশাস্ত্রীয় সংকলন পোড়ামাটির মূর্তি নির্মাণ বিষয়ক পদ্ধতি ও কৌশল যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

খ্রিস্টপূর্ব দুই শতক থেকে খ্রিস্টীয় তিন শতক পর্যন্ত বিশেষ করে শুঙ্গ ও কুশান শাসনযুগে সমগ্র গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা ও মধ্য ভারতজুড়ে পোড়ামাটির এক ধরনের শিল্পশৈলী প্রচলিত ছিল উল্লিখিত মৃৎশিল্প বা ফলকগুলো পর্যবেক্ষণের আগেই বাৎস্যায়নের কামসূত্র গ্রন্থটি আবিষ্কৃত হয়েছিল এই গ্রন্থে নগর জীবনের আভাস ছিল অনুমান করা হয় শুঙ্গ-কুশান যুগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব দুই শতক থেকে খ্রিস্টীয় তিন শতক পর্যন্ত সময়কালের ভেতর বাঙালির কৌম সমাজে সূক্ষ্ম ভাঙন ধরে তারই প্রকাশ ঘটেছে পোড়ামাটির ফলকে প্রস্ফুটিত ভাস্কর্যগুলোয় বিশেষ করে নারী মূর্তিগুলো তৈরি হয়েছে বিশেষ মনোযোগে
এই দেশ যখন বহুকাল অবধি স্বাধীন ছিল তখনই কেবল দেশ ও মাটিভিত্তিক শিল্পকর্মের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। গুপ্তযুগে ও পাল আমলে ধীমান ও বীতপালের সময়ে এবং সুলতানি আমলে বা সেন আমলের স্বাধীন সময়ে এই শিল্পচর্চার ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। পরবর্তী সময়ে মোগল আমলে এই চর্চায় ছেদ পড়ে। তারা পোড়ামাটি ব্যবহার না করে বালি-সুরকির আস্তরণ দেওয়া শুরু করল।

পালপর্বের আগে প্রস্তর-ভাস্কর্যের নিদর্শন যে বাঙলাদেশে খুব বেশি নাই, তাহার প্রধান কারণ সুলভ মৃৎশিল্পের প্রসার। নমনীয় মাটির নিজস্ব একটা গুণ ও প্রকৃতি তো আছেই; সহজ দ্রুত অঙ্গুলি ও করতালু চালনার ফলে নানা বিচিত্র দ্রুত ভঙ্গ ও ভঙ্গি সহজেই রূপ গ্রহণ করে, ডোলের মার্জনা সহজ নয়। এই মাধ্যমে কাজ করার ফলে বাঙলার লোকায়ত শিল্পের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আপনি ধরা দিয়াছিল।
বাংলাদেশে ভাস্কর্য বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পাল আমলকে কেউ কেউ চিহ্নিত করেনপ্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং মানুষের ধ্বংসলীলায় প্রাচীন বাংলার এসব ভাস্কর্য নিদর্শন পুরাকীর্তি চিরতরে হারিয়ে গেছে

পরম্পরাগত শিল্পচর্চার ছন্দপতনঃ
প্রাচীন বাংলার ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য শিল্পীরা মনগড়া কোনো সিদ্ধান্ত আমলে নেয়া হয়নি। শিল্পসামগ্রী তৈরির পূর্বে শিল্পীগণকে রীতিমতো শিল্পশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে হয়েছে অথবা যে কোনোভাবেই সেই শিল্পশাস্ত্রের জ্ঞান আয়ত্ত করতে হয়েছে। ভারতবর্ষের শিল্পীদের জন্য শুক্রনীতি (শিল্প আইন) ও শিল্প সম্পর্কিত সমস্ত বই-পুস্তকে কলাশিল্প নিয়ন্ত্রণের যে সব সূত্র ও কঠোর নিয়ম আছে তার বাইরে শিল্পীর স্বেচ্ছাচারিতার বিন্দুমাত্র সুযোগ ছিল না। তবে দেবতামূর্তি বা দেবতাচিত্র ব্যতীত অন্যান্য শিল্পকর্মের ব্যাপারে এই নিয়ম শিথিলযোগ্য ছিল। দেবতাদের ভাস্কর্য বা মূর্তি তৈরিতে ভাস্করদের স্বেচ্ছাচারিতা কোনো ভাবেই বরদাস্ত করা হতো না। আর ভাস্করগণও সে নিয়মকে অবজ্ঞা করতেন না। কাজেই ভাস্কর্য বিদ্যা অনুশীলন করার পূর্বেই ‘শিল্পীকে শাস্ত্রীয় বিধান, মূতির্র ধ্যান, রূপতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার পর তক্ষণ বিদ্যার কলাকৌশল এবং যন্ত্র পরিচালনা আয় করতে হতো’। সে জন্য শিল্পীকে শিল্পকর্মের ছন্দ, ভারসাম্য, অস্থিবিদ্যা, ঘনত্ব বা ওজন, অনুপাত ইত্যাদি মূলনীতিসমূহ মেনে কাজ করতে হয়। শিল্পগ্রন্থ ‘অগ্নিপুরাণে’ উল্লিখিত হয়েছে যে ভাস্কর তার ধারণাকৃত মূর্তির লক্ষণ ও ভাব ব্যঞ্জনা ভাস্কর্য নির্মাণে প্রস্তুত হওয়ার পূর্বেই শুদ্ধচিত্তে ধ্যানস্থ হয়ে অনুধাবন করবে। সে কারনেই শিল্পগ্রন্থে ভাস্কর্য নির্মাণকে অন্যতম যোগাচার বলা হতো।

ভাস্কর্য শিল্প আদিতে যে উদ্দেশে তৈরি করা হতো সে মোটিফ পরবর্তীতে আর স্থির থাকেনি, সেই সাথে প্রাচীন বাংলায় শিল্পকর্ম করা একটি পেশা হিসেবে মর্যাদায় ছিল সেটিও ধরে রাখা যায় নি। অর্থাৎ স্বতন্ত্রভাবে মূর্তিতত্ত্বের চর্চা বাংলায় আর টিকে থাকেনি। এর কারণ দুর্বোধী নয়। তার কৃষিনির্ভর জীবনের অর্থসম্বল ছিল পরিমিত, চিত্তসমৃদ্ধি ছিল ক্ষীণায়ত, গ্রাম্য কৃষিনির্ভর জীবনে সে-সুযোগও ছিল স্বল্পই।    
প্রাচীন বাঙলার স্থাপত্যের সুসংবদ্ধ ইতিহাস রচনা করার মতো উপাদান স্বল্পই। ধ্বংসস্তূপে পরিণত বা অর্ধভগ্ন যে দুই চারটি বিহার-মন্দির ইতস্তত বিক্ষিপ্ত রূপ পাই তাতে প্রাচীন বাঙলায় ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বৃহৎ কর্মশক্তি বা গভীর গঠন-নৈপুণ্যের পরিচয় খুব বেশি নাই। কাজেই শিল্পেও সে পরিচয় নাই।

মঙ্গলকোটের ইতিহাসের সুলকসন্ধানঃ    
প্রতিটি প্রাচীন জনগোষ্ঠীর গাথা-কাহিনীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে রয়েছে সর্প-সংশ্লেষ। প্রাচীন মেসোপটমিয়া, মিশর, গ্রিস, ক্রিট, ফিনিশিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া প্রভৃতি দেশে সর্পপূজার প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-৩০০০ অব্দের সুমেরিয় শিল্পকলার নিদর্শনে দুটি পেচানো সাপের প্রতীকী উপস্থাপনা দেখা যায়। মিশরের ফারাওদের প্রতীক ছিল সাপ এবং ঈগল। এছাড়া তাদের ভূদেবতার মাথা ছিল সর্পাকৃতির এবং তিনি ছিলেন সকল সাপের অধিষ্ঠাতা দেবতা। হরপ্পা সভ্যতার সিলে সর্প-মানবের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এভাবে দেখলে মঙ্গলকোটের ইতিহাসের পুরোটা জানা দরকার।  

মঙ্গলকোট প্রত্নক্ষেত্রে পরবর্তী (ষষ্ঠ স্তর) স্তরের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রত্নস্থলটি শনাক্তীকরণের কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। অথচ এ স্থানে উৎখনন করে পাওয়া বিপুল মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী প্রমাণ করে যে, মৌর্য আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে এ প্রত্নস্থলটি সম্ভবত একটি পরিপূর্ণ নগরকেন্দ্র হিসেবে বিকাশ লাভ করেছিল। মঙ্গলকোটের রহস্য উন্মচন বা বিষয়টি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করে উদ্যগ নিয়ে আরও গবেষণা জরুরী।

বিষয়টি গুরুত্ব সবাই বঝেন। এমনকি দেশের বাইরে থেকে যারা আসে, পর্যটন, প্রশাসন বা গবেষণার কাজে, তারাও কী এক অজ্ঞাত কারণে বেমালুম চেপে যায় সবকিছু। মনে হয় কখনো কিছুই ঘটেনি, আর আমরাও দেখিনি কিছুই। আমাদের প্রাচীন শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি আছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেগুলো চর্চার পরিধি অত্যন্ত সীমিত। বছর দশেক আগেও আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘বাংলাদেশ অধ্যয়ন’ বিষয়ে কোনো পাঠদান করানো হতো না। ইদানীং পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে ‘বাংলাদেশ অধ্যয়ন’ নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়, যদিও মাত্র তিন ক্রেডিটের কোর্স দিয়ে হাজার বছরের ঐতিহ্য জানা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

সোজাকথায় একটি জাতির শক্তিমত্তা কত প্রচ-, তার ধারণক্ষমতা কত গভীর, তার বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ কত উন্নত তা জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে ওই জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। জানতে হবে তার সাংস্কৃতিক অর্জন ও সাংস্কৃতিক অর্জনের প্রয়াসটিকে। সংস্কৃতি জীবন নয়, জীবনের সৌষ্ঠব। সংস্কৃতি সমাজ নয়, সমাজজীবনের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলা। সংস্কৃতি যতটুকু ব্যক্তিগত, এর চেয়ে বেশি সামাজিক। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার সহজাত প্রবণতা থেকেই সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। তাই এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে সমাজে।

কয়েকটি সাধারণ মন্তব্যঃ  
মহাস্থান জাদুঘরের ৪ নং শোকেসে প্রদর্শিত দেব মস্তকদ্বয়ের একটির দৃষ্টিতে নির্মল সারল্যের প্রকাশ পাপ পঙ্কিলতা মুক্ত দেবচরিত্রের এবং অপর প্রতিমার তীক্ষ দৃষ্টি ও গম্ভীর মুখাবয়বে জ্ঞানের গভীরতা ও জাগতিক অনুভূতির উর্ধ্বে দেবত্বের অহমিকার প্রকাশ ঘটেছে। মঙ্গলকোটের শিল্পিরা বংশ পরম্পরায় কাজের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা অর্জন করেছে ভাস্কর্য সৃষ্টিতে।  

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যেই দিয়েই সজীব থাকে। আমাদের লোকশিল্পের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন মেলে মৃৎশিল্পে। এই শিল্পের প্রাচীনতম ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া গেছে সিন্ধু সভ্যতার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে। আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার ওই পোড়ামাটির পুতুলে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে বাংলাদেশের পাহাড়পুর ও ময়নামতি বৌদ্ধবিহারে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলক ও পুতুলের সঙ্গে। তারা ওই সাদৃশ্যের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, পোড়ামাটির শিল্পের কাল উত্তীর্ণ যে ধারাটির সূত্রপাত ঘটেছিল সিন্ধু অঞ্চলে তা আমাদের এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চল পর্যন্ত পরবর্তীকালে ছড়িয়ে পড়েছিল। পোড়ামাটির শিল্প তৈরির উপকরণগুলো এবং এ প্রযুক্তি বিশ্লেষণ করলে সব অনুসন্ধ্যিৎসু ব্যক্তির কাছেই বিষয়টি অবশ্য পরিষ্কার হবে।   

মহাস্থানের ইতিহাস অনেককেই শুনিয়েছি। যারা এই ঐতিহাসিক স্থানে যায় নি (এই প্রজন্মের শ্রোতাদের কথা বলছি) তারা শোনার পর বলেছে- পুণ্ড্রনগরের অনেক ঘটনাই তাদের কাছে কাল্পনিক বলে মনে হয়েছে, এতোসব কি সম্ভব?
তাদের কাছে আমার একটাই কথা- সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগৎ। সবই বাস্তব, আবার সবই অবাস্তব। আমি সেই অনন্য গৌরবজ্বল সুরিয়েলিসটীক সময় খুঁজে আনতে চেয়েছি। তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য।                   
### 

সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী 
০১৯১২০৭৮৫৯৩

 sajedurrahmanvp@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান