পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৪ (বাঙালির বীরত্ব গাঁথা- দ্বিতীয় পর্ব )
পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৪ (বাঙালির বীরত্ব গাঁথা- দ্বিতীয় পর্ব )
সাজেদুর রহমান
এক বিস্মৃত বীর মহাপদ্মনন্দন
আলেকজান্ডার বিপাশা নদীর মহনায় এসে থমকে দাঁড়ালেন। কী
আশ্চর্য, তিনি দেখলেন তাঁর চেয়ে কম্পক্ষে দশ বছরের এক তরুণ ঘোড়ার পিঠে বুক চেতিয়ে
বসে আছে। তার পেছনে হাজার হাজার যোদ্ধা হস্তী। সেনানায়ক তরুণটিকে ঘিরে তীরন্দাজরা
চক্রাকার ঘুরছে আর তীর ছুঁড়ছে।
প্রতিপক্ষের ছোড়া ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসা তীর ঠেকান দুঃসাধ্য
হয়েপরছে। তীরের ছুঁচাল ফলা সৈন্যদের বর্ম ভেদ করে আহত করছে। আঘাত মারাত্নক নাহলেও
অপর পক্ষের মহড়া মহাবীরের বাহিনীর মনে এমন ভয়ের সঞ্চার করল যে, আলেকজান্ডার সামনে
এগুতে সাহস পেলেন না। মহাবীরের জীবনে এটাই ছিল একমাত্র এবং অন্তিম পিছুটান।
গ্রীক
বীর আলেকজান্ডারের আক্রমণ প্রতিহত করেছেন যিনি সেই বীর সেনানায়কের নাম মহাপদ্মনন্দন। পুণ্ড্রের অধিপতি। নন্দ বংশের স্থপতি।
এক বিস্মৃত বীর মহাপদ্মনন্দন, তবে সতত উচ্চারিত আরেক বীর বৃত্তাসুর যিনি নিজস্ব সংস্কৃত রক্ষায় আত্ম বলি
দেন। খ্রিষ্ট পূর্ব এক হাজার থেকে খ্রিষ্টীয় এক হাজার এক হাজার সময়কালে এমন চার জন
লড়াকু বাঙালির পরিচয় তুলে ধরব বাঙালির বীরত্ব গাঁথা- দ্বিতীয় পর্বে।
‘বিস্তৃত যত নীরব কাহিনী
স্তম্ভিত হয়ে বও
হে অনাদি অতীত
কথা কও কথা কও’
স্তম্ভিত হয়ে বও
হে অনাদি অতীত
কথা কও কথা কও’
হায় কি সেলুকাস বিচিত্র পৃথিবীঃ
গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের
আজ থেকে দুই হাজার তিনশত তিপ্পান্ন বছর আগে কথা। প্রচণ্ড
বেগে পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করেছেন গ্রীক বীর
আলেকজান্ডার। ইউরোপ আর এশিয়া মহাদেশের
একের পর এক রাজ্য জয় করে ভারতের পাঞ্জাবে পৌছে যায়। তারপর আলেকজান্ডার সিন্ধুনদ পেড়িয়ে পুরু রাজ্য আক্রমণ করেন। তিনি গান্ধার, তক্ষশিলা
ও কন্বৌজসহ বিভিন্ন রাজ্য ও গোত্রের শাসনকর্তাগণকে আত্মসমর্পণের জন্য বার্তা
প্রেরণ করেন। তাদের অনেকে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানান।
মেসিডোনিয়
বাহিনী ভয়ঙ্কর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য তক্ষশীলার রাজা অম্ভি বশ্যতা স্বীকারের প্রতিশ্রুতিসহ প্রচুর
পরিমাণে উপঢৌকন পাঠান। ড. রমেশ মজুমদার এই আত্মসমর্পণকে ‘উপমহাদেশের ইহাইই হলো
দেশদ্রহিতার সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত’ বলেছে।
দিগ্বিজয়ি গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের তার যুদ্ধে
ইতি টানতে চেয়েছিলেন বিপুল ঐশ্বর্যের আধার গাঙ্গিয় রাজ্য জয়ের মধ্য দিয়ে।
সেই উদ্দেশে তিনি বিপাশা নদীর মহনায় এক (৩৫০ খ্রীস্টপূর্ব-২৯০ খ্রীস্টপূর্ব) শীতের সকালে বিপুলসংখ্যক
সৈনিক নিয়ে উপস্থিত হন। তেজদিপ্ত সম্রাটের চোখে সারা পৃথিবী জয়ের
স্বপ্ন পূরণের দ্বার প্রান্তে।
বিজিত
স্থানীয় ছোট ছোট ভূস্বামীরা আলেকজান্ডারকে জানাল অপর পাড়ের দেশটির অপরাজেয়
সৈন্যবাহিনীর কথা। তারা বলল, ‘ভারতের
সমূদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডাই সর্বশ্রেষ্ঠ’। এর পর তার নিজস্ব দূত থেকে যা জানলেন তাতে শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সম্রাট। তার কল্পনাতেও
ছিলনা ভারতে এত বড় শক্তিশালী সম্রাজ্য আছে।
সম্রাট আলেকজান্ডারের সেনাপতির সেলুকাস জানালেন, গঙ্গারিডাই
রাজ্যের ৭০০ হস্তির বিশাল হস্তী-বাহিনী আছে। এদের
১০০০ অশ্বারোহী এবং ৬০০০০ পদাতিক সৈন্য নিয়ে সজ্জিত হয়েআছে। তিনি জানালেন, এই বাহিনীর
জন্যই এ রাজ্য কখনই বিদেশী রাজ্যের কাছে পরাজিত হয় নাই। যার কারনে অন্যান্য রাজ্য আতংকগ্রস্ত থাকে।
এসব আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে জেনে গেছে। দীর্ঘ জুদ্ধ যাত্রায় তারা একদিকে যেমন ক্লান্ত-অবসন্ন; তারউপর মগধ
ও গঙ্গাঋদ্ধির সমরশক্তি ও যুদ্ধপ্রস্তুতির বিবরণ জেনে তারা রীতিমত আতঙ্কিত। তারা বলাবলি করছে, সামনে এগিয়ে যাওয়া মানে নিশ্চিতভাবে সমূলে
ধ্বংস হওয়া।
এমন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়াও দ্বিগ্গিজয়ী বীরের
জন্য অপমানজনক। করণীয় আলোচনার জন্য নিজের সেনাবাহিনীর সাথে পরামর্শে বসলেন। আলেকজান্ডার নিজে সৈন্যদের বোঝাতে বললেন, বিপাশা পার হয়ে আর পূর্ব দিকে অগ্রসর হবনে। বেবিলন হয়ে ফিরে
যাবো। কে শণে কার কথা। বিচক্ষণ সেনাপতি সৈন্যদের পক্ষ হয়ে জানাল
সৈন্যরা কেউ বিপাশা পার হয়ে নিজের জীবন দিয়ে আসতে রাজী নয়। জানা যায়
হিপাসিস
(বিয়াস) নদীর তীরে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং পূর্ব দিকে আর কোন রাজ্য আক্রমণে
অস্বীকার করে। ফলশ্রুতিতে,
এ নদী আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ের সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দেয়।
ঐতিহাসিক
নীহারঞ্জন বলেছেন-'আজ এ-তথ্য সুবিদিত যে, ঔগ্রসৈন্যের সমবেত প্রাচ্য-গঙ্গারাষ্ট্রের
সুবৃহৎ সৈন্য এবং তাহার প্রভূত ধনরত্ন পরিপূর্ন রাজকোষের সংবাদ আলেকজান্দারের
শিবিরে পৌছিয়াছিল এবং তিনি যে বিপাশা পার হইয়া পূর্বদিকে আর অগ্রসর না হইয়া
ব্যাবিলনে ফিরিয়া যাইবার সিদ্ধান্ত করিলেন, তাহার মূলে
অন্যান্য কারণের সঙ্গে এই সংবাদগত কারণটিও অগ্রাহ্য করিবার মত নয়।'
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহারঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব)
গ্রন্থে লিখেছেন- ‘গঙ্গারিডাই-রা যে গাঙ্গেয় প্রদেশের লোক এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই, কারণ গ্রিক লাতিন লেখকরা এ সম্বন্ধে একমত। দিয়োদারাস-কার্টিয়াস-প্লুতার্ক-সলিনাস-প্লিনি-টলেমি-স্ট্ট্যাবো প্রভৃতি লেখকদের প্রাসঙ্গিক মতামতের তুলানামূলক বিস্তৃত আলোচনা
করিয়া হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয় দেখাইয়াছেন যে গঙ্গারিডাই বা গঙ্গারাষ্ট্র গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বতীরে অবস্থিত ও বিস্তৃত ছিল’।
চন্দ্রকেতু
গড়, দ্বিগঙ্গা ও উয়ারি-বটেশ্বর প্রত্নপীঠসমূহ থেকে সম্প্রতি আবিষ্কৃত
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে প্রমাণিত হয় এগুলো তদানীন্তনকালে গঙ্গাঋদ্ধির সমৃদ্ধ
বাণিজ্য নগরী ছিল। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তার ইন্ডিকা গ্রন্থে বলা হচ্ছে, ‘গঙ্গারিডাই রাজ্য
৩০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ভারতীয় উপমাহাদেশের বাঙলা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। ধ্রুপদী
গ্রিক এবং ল্যাটিন ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুযায়ী আলেকজান্ডার দি গ্রেট বাংলায় অবস্থিত
এ সম্রাজ্যের কাউন্টার এটাকের আশংকায় ভারতে তার বাহিনী উইথড্র করতে বাধ্য হন।
মহাবীর আলেকজান্ডারকে প্রতিহত করা সেই অসীম সাহসী বাঙ্গা
বীর মহাপদ্মনন্দন ছিলেন নন্দ বংশের স্থপতি। গ্রিক ও ল্যাটিন বর্ণনায় তার
নাম আগ্রাম্মেস। বৌদ্ধ শাস্ত্র
মাহাবোধিবংশে উগ্রসেন। আর হিন্দু শাস্ত্রে বলা
হয়েছে-শূদ্রোগর্ভোদ্ভব।
অবশ্য হিন্দু পুরাণ ও জৈন গন্থে উল্লখিত পদ্মানন্দের
এই সংগ্রামের ইতিহাস বেস মজার। তখন তার বয়স মাত্র
পঁচিশ। তিনি ছিলেন নাপিতের সন্তান। নিম্ন
বর্ণের মানুষ হওয়ায় তাকে প্রথমে কেউ মেনে নিতে পারছিল না। এতে তিনি দমে না গিয়ে পদ্মানন্দ
ও তার দল গোপনে সারা দেশ থেকে তার সমকক্ষ জাতের তরুণ-যুবক
দের নিয়ে স্বাধীণতার
যোদ্ধা সংগ্রহ করে। হাজার হাজার অকুতোভয় যুবক এক কথায়ই দলে যোগ
দিয়েছে। তার সতীর্থরাও কামার, জেলে বা কৃষকের ঘরের। অশ্ব চালনা, মল্লযুদ্ধ থেকে
শুরু করে মহামত্যের রাজশক্তির সাথে লড়াই, সব কিছুতেই সে দেশের মানুষের কাছে সাহসিকতা এবং
অপরাজেয় মনভাবের কারনে-পরাধীন দেশ মাতার দাসত্বের শৃংখল
ভাংগার লক্ষ্যে-পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালি সেনাবাহিনী।
পদ্মানন্দের শাসনামলে তিনি কাশী, মিথিলা, বীতিহোত্ৰ,
ইক্ষবাকু, কুরু, পঞ্চাল, হৈহয় ও কলিঙ্গদের পরাভূত করিয়াছিলেন
তাহার পক্ষে গঙ্গারাষ্ট্র স্বীয় প্রাচ্য রাজ্যের অন্তর্গত করা কিছু অসম্ভব নয়। এই নন্দ বংশের ধননন্দ
সম্বন্ধে সিংহলী মহাবংশ-গ্রন্থে বলা হইয়াছে, এই রাজা প্রভূত ধন সংগ্ৰহ
করিয়াছিলেন নানা ন্যায় ও অন্যায় উপায়ে; ধনের পরিমাণ
দেওয়া হইয়াছে আশি কোটি; বোধ হয়।
বিখ্যাত ইরান সম্রাট দারায়ুস থেকে শুরু করে উত্তর পশ্চিম
ভারতের পারক্রমশালি রাজা পুরু পর্যন্ত কেউ আলেক্সান্ডারের
বাহিনীর সামনে দাড়াতে পারে নাই।
অথচ কি আজব ব্যাপার এতুটুকু এক ছেলের কাছে হার মানতে হচ্ছে।
আলেক্সান্ডারের হতবিহব্বল হয়ে সেনাপতি সেলুকাসকে গ্রীক ভাষায় দুর্বোধ্য কি যেন বললেন। দিজেন্দ্রলাল
রায় তার একটি লেখায় আলেকজান্ডারের বিচিত্র সেই ভাব-ভাষা
সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এই
দেশ’...
যেমন আমরা বলি ‘হায়! কি বিচিত্র এই দেশ’।
বীর বৃত্তাসুর যিনি নিজস্ব সংস্কৃত রক্ষায় আত্ম বলি
দেন
কালের মহানায়ক বৃত্তাসুরঃ
সেই সাহসী মানুষগুলো করতোয়া নদীর তীরে এই মহাস্থানগড় বা
পুণ্ড্রনগরে তারা গড়ে তুলেছিল বাংলার প্রাচীন এক রাজধানী। আর্যরা মহাস্থানের কথা
জানতেন। মহাভারতের সভাপর্বে পুন্ড্রদেরকে সুজাতি, শ্রেণীমন্ত ও শ্রেষ্ঠ জাতি এবং কর্ণপবে তাদেরকে শাশ্বত ধর্মজ্ঞ বলা হয়েছে।
রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের মতে
ঐতিহাসিকও স্বীকার করেছেন, পুণ্ড্রনগর তথা ‘স্বর্গ রাজ্যে’ প্রাধান্য
প্রতিষ্ঠা নিয়ে দেবতা (আর্যরাজগণ) ও অসুরদের (অনার্যরাজদের) মধ্যে দীর্ঘকাল
দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংগ্রাম চলেছে। সেই সংঘর্ষের অসংখ্য কাহিনী ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ
প্রভৃতি আর্য সাহিত্যে
ছড়িযে আছে বিচিত্র রূপে-আঙ্গিকে। সেগুলো
আসলে
আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিরোধ
ও
মুক্তি সংগ্রামেরই কাহিনী।
আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে
ধর্ম তথা সংস্কৃতিকে
আশ্রয় করে জেগে
ওঠা এই এলাকার
সেমিটিক ঐতিহ্যের অধিকারী
জনগণের সংক্ষোভের তোড়ে
উত্তরাপথের পূর্বপ্রান্তবর্তী প্রদেশগুলোর
আর্য রাজত্ব ভেসে
গিয়েছিল। ৭ম শতকে আর্যরা বঙ্গসহ উপমহাদেশের
পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। পর্যায়ক্রমে
অত্যাচারি আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক। দ্রাবিড়দের নগরগুলো ধ্বংস সাধনের সময় আর্যরা
যে গণহত্যার আশ্রয় নেয় তা, ঐসব নগর সমুহের গণকবর বা বৈধ্যভূমি আবিস্কারের মাধ্যমে
প্রমানিত হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
নদী-মাতৃক
বাংলাদেশের বিশেষ ভূ-প্রকৃতি
এ দেশের মানুষের
চরিত্র ও জীবন-দর্শনকে
প্রভাবিত করেছে। বিশেষ প্রাকৃতিক
পরিবেশ এ এলাকার
মানুষকে কষ্ট-সহিষ্ণু,
সাহসী ও সংগ্রামী
করেছে। সংগ্রামশীল
এই সাহসী মানুষেরা
বেড়ে উঠেছে স্বাধীনতার
দুর্জয় প্রেরণা নিয়ে।
খ্রিস্টীয়
তৃতীয় শতকের শেষান্তে অথবা চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পত্তন হয়।
ধারণা করা হয় যে,
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের অব্দে অথবা চতুর্থ শতকের প্রারম্ভে গুপ্ত
বংশীয় আদিপুরুষ শ্রীগুপ্ত মগধে রাজত্ব করতেন। আবার কারো কারো মতে গুপ্তগণ বাঙালি
ছিলেন এবং প্রথমে বাংলাদেশেই রাজত্ব করতেন। চৈনিক
পরিব্রাজক ইৎসিং-এর বিবরণের উপর নির্ভর করে ইতিহাসবিদ ডি. সি. গাঙ্গুলি অনুমান
করেছেন যে,
গুপ্তবংশীয় রাজাদের আদি বাসস্থান বাংলাদেশেই ছিলো। সেটা বাংলার
উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে থাকতে পারে অনুমান করা হয় (বাংলাদেশের ইতিহাস, গ্রন্থকার: ফোর ডক্টরস)। তবে এ দুই অভিমতের পক্ষে কোনো জোড়ালো যুক্তি
বা তাথ্যিক প্রমাণ পাওয়া যায় নি (মজুমদার, প্রাগুক্ত,
পৃঃ ৩৩-৩৪)।
কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর
‘এর সোশ্যাল হিস্ট্রি
অব বেঙ্গল’ বইয়ে
দেখিয়েছেনঃ তিন স্তরে
বিভক্ত আর্য সমাজের
ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা
প্রথমে বাংলায় আসেনি। এদেশে
প্রথমে এসেছে ব্রহ্মণেরা। তারা
এসেছে বেদান্ত দর্শন
প্রচারের নামে। বাংলা
ও বিহারের জনগণ
আর্য-অধিকারের বিরুদ্ধে
যে আন্দোলন পরিচালনা
করেন, তাও ছিল
ধর্মভিত্তিক তথা সাংস্কৃতিক।
গুপ্ত আমলে বাংলাদেশে
আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দোর্দন্ড
প্রতাপ শুরু হয়। আর্য
ভাষা ও সংস্কৃতির
স্রোত প্রবল আছড়ে
পড়ে এখানে। এর
মোকাবিলায় জনগণের প্রতিরোধ
সংগ্রাম পরিচালিত হয়
জৈন ও বৌদ্ধ
ধর্মকে আশ্রয় করে। জৈন
ও বৌদ্ধ ধর্ম
ও সংস্কৃতি বাংলা
ও বিহারের জনগণের
আত্মরক্ষার সংগ্রামে এ
সময় প্রধান ভূমিকা
পালন করে। আর
জনগণের আর্য-আগ্রাসনবিরোধী
প্রতিরোধ শক্তিকে অবলম্বন
করেই বৌদ্ধ ধর্ম
ও সংস্কৃতি দীর্ঘদিন
এ এলাকার প্রধান
ধর্ম ও সংস্কৃতিরূপে
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে
সক্ষম হয়।
এই আন্দোলনের যিনি নেতৃত্ব
দেন তার নাম 'বৃত্তাসুর’। ঐতিহাসিকদের মতে, আর্য ধর্মের বিরুদ্ধে
দেশব্যাপী আন্দোলন তাদের ধর্ম
শাস্ত্রে বৃত্তাসুরকে প্রধান
শত্রু বলে বর্ণিত হয়েছে। ঋগবেদের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র দেবতা ইন্দ্র আর
ইন্দ্রের প্রধান শত্রু ‘বৃত্তাসুর’।
দেবতাদের উদ্দ্যেশ্যে লিখিত ঋগবেদ আর্যজাতির সবচেয়ে প্রাচীন
গ্রন্থ। ঋগবেদ বলা হচ্ছে, বৃত্তাসুর বলে
এক অসুর ছিল,
সে শিবঠাকুরের থেকে এক বর আদায় করল যে দেব, দানব,
মানবের তৈরি প্রচলিত কোন অস্ত্রে তাঁর মৃত্যু হবে না। শিব
ঠাকুর তার আনুগত্তে তুষ্ট হয়ে বর দিয়ন। এদিকে বর পেয়ে বৃত্তাসুর আরও অত্যাচারী হয়ে
উঠলো, ক্রমে সে দেবলোক অবধি অধিকার করে নিলো। তখন দেবতারা বিচারের আশায় ভগবান
বিষ্ণুর কাছে গেলেন,
সব শুনে ভগবান বিষ্ণু বললেন– তোমরা নৈমিষারণ্যে ঋষি দধীচির কাছে যাও, তাঁর অস্থি দিয়ে
প্রস্তুত এক নতুন অস্ত্র বজ্র দ্বারাই বৃত্তাসুরের নিধন সম্ভব। দেবরাজ ইন্দ্র ঋষি
দধীচির কাছে ছুটলেন,
দয়ালু ঋষি দধীচি সব শুনে তৎক্ষণাৎ যোগবলে দেহত্যাগ করলেন।
এদিকে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা সেই অস্থি দিয়ে বজ্র তৈরি করলেন, যা দিয়ে অধর্মী,
অত্যাচারী বৃত্তাসুরের বধ সম্ভব হল, আর দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর স্বর্গের সিংহাসন ফিরে পেলেন।
উত্তর-পূর্ববাংলায় ষষ্ঠ
শতকের গোড়াতেই ব্রাহ্মণ্য
সমাজ গড়ে ওঠে। পঞ্চম
ও অষ্টম শতকের
মধ্যে ব্যক্তি ও
জায়াগার সংস্কৃতি নাম
পাওয়া যায়। তা
থেকে ড. নীহাররঞ্জন
রায় অনুমান করেন
যে,
তখন বাংলার আর্যয়করণ
দ্রুত এগিয়ে চলছিল। বাঙালি
সমাজ উত্তর ভারতীয়
আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ-ব্যবস্থার
অন্তর্ভূক্ত হচ্ছিল। অযোধ্যাবাসী
ভিণ প্রদেশী বাহ্মণ,
শর্মা বা স্বামী,
বন্দ্য, চট্ট, ভট্ট,
গাঙি নামে ব্রাহ্মণেরা
জেঁকে বসেছিল, “বাংলাদেশের
নানা জায়গায় ব্রাহ্মণেরা
এসে স্থায়ী বাসিন্দা
হতে লাগলেন, এরা
কেই ঋগ্বেদীয়, কেই
বাজসনেয়ী, কেউ শাখাব্যয়ী,
যাজুর্বেদীয়, কেই বা
সামবেদীয়, কারও গোত্র
কান্ব বা ভার্গব,
বা কাশ্বপ, কারও
ভরদ্বাজ বা অগস্ত্য
বা বাৎসা বা
কৌন্ডিন্য।
এমনি করে ষষ্ঠ
শতকে আর্যদের বৈদিক
ধর্ম ও সংস্কৃতির
ঢেউ বাংলার পূর্বতম
প্রান্তে গিয়ে পৌঁছল”।(বাঙালির ইতিহাস,
আদি পর্ব, পৃষ্ঠা
১৩২)
সাত শতকের একেবারে
শুরুতে গুপ্ত রাজাদের
মহাসামন্ত ব্রাহ্মণ্য-শৈবধর্মের
অনুসারী শশাংক রাঢ়ের
রাজা হয়ে পুন্ড্রবর্ধন জয় করেছিলেন।
‘দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্য
হিমাচল যমুনা গঙ্গা
উচ্ছল জলধি তরঙ্গ’
বাংলার ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন রাজাঃ
বাংলার ইতিহাসের প্রথম স্বাধীন নরপতি শশাংক
সপ্তম শতকে বাংলার ইতিহাসে গৌড়াধিপ শশাংক আকস্মিক উল্কাপিন্ডের
মত উদিত হয়ে আলো ছড়িয়ে দেন। গৌড়াধিপ শশাংকই সর্বপ্রথম ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেন। তিনই বাংলার ইতিহাসের প্রথম স্বাধীন নরপতি
হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ড. মজুমদারের মতে, রাজা হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগে মহাসামন্ত শশাঙ্ক
ইতিহাসে ছিলেন প্রায় অপরিচিত। শক্তিমত্তা, সাহস, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক মেধার ওপর ভর করে তিনি
গুপ্ত রাজাদের দুর্বল সময়ে প্রবল আঘাত হেনে গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। শশাংক তাঁর পাল রাজারা এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। জোরে ভারত ইতিহাসের পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাঁড়ান।
বঙ্গদেশের ইতিহাসে শশাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে
আছেন। তিনিই প্রথম রাজা
যাঁর সীমা বঙ্গদেশের বাইরেও বিস্তার লাভ করেছিলেন। শশাংক মোটামুটিভাবে ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন
বলে ধারণ করা হয়। সম্ভবত ৬০৬ খ্রিঃ
শশাংক রাজা সিংহাসনে বসেন। গৌড়ের সিংহাসনে বসারপর উত্তর ও পশ্চিম বাংলার কিছু অংশ তিনি
গৌড়ের অন্তভূক্ত করেন। গৌড়ে তাঁর অধিকার স্থাপন করে প্রতিবেশী অঞ্চলে রাজ্যবিস্তার
শুরু করেন। তিনি দন্ডভুক্তি (মেদিনীভুক্ত) রাজ্য, উড়িষ্যার রাজ্য এবং বিহারের মগধ রাজ্য
জয় করে তার রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন। পশ্চিমে তার রাজ্য বারণসী পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। সামন্তমহারাজ সোমদত্ত এবং মহাপ্রতিহার শুভকীর্তির মেদিনীপুর
লেখতে শশাংককে ‘অধিরাজ’ বলা হয়েছে। অন্য সুত্র মতে, রাজ্য বিস্তারের প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে প্রাকৃতিক সীমা তথা
উত্তরে-হিমালয়, পশ্চিমে শোন-গণ্ডক এসব প্রাকৃতিক সীমা লাভের চেষ্টা করেন। সম্ভবত মগধ প্রথম থেকেই তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
শশাংকে গৌড়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তাঁ রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ
বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে ছয় মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত রাঙামাটির নিকট
কানসোনা। হিউয়েন সাং এর ভাষার
শশাংকের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ নগরে রক্তমৃত্তিকা বিহারে বিহারে অবস্থিত ছিল।
যদিও শশাংকের রাজসভায় কোন সাহিত্যিক ছিলেন না। তবুও বিরোধী পক্ষের রচনা থেকে শশাংক সম্পর্কে জানা যায়। হর্ষের সভাকবি বানভট্ট এর হর্ষচরিত গ্রন্থে এবং চীনা পর্যটক
হিউয়েন সাং এর রচনা থেকে শশাংক সম্পর্কে জানা যায়। ড. আর ডি ব্যানার্জির মতে. শশাংক ছিলেন পূর্ববর্তী গুপ্ত বংশের
সন্তান। আবার ধারণা করা হত
তিনি মহায়েস পুপ্তের পুত্র বা ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন বলে মনে করা হয় কিন্তু নির্ভরযোগ্য
প্রমাণের অভাবে অভাবে এমতামতটি ও অস্পষ্ট।
শশাংকের বংশপরিচয়, তাঁর উত্থান ও জীবনের কাহিনী আজও পরিষ্কারভাবে
পাওয়া যায় নি। যশোহরে প্রাপ্ত কিছু
মুদ্রা থেকে জানা যায় ‘নরেন্দ্রগুপ্ত পাঠান্তরে ‘নরেন্দ্রাদিত্য’ খোদাই আছে। যেহেতু গুপ্ত সম্রাটরা ‘আদিত্য’ কথাটি ব্যবহার করত সেহেতু ধারণা
করা হয় শশাংক গুপ্ত বংশীয় ছিল। তবে এ তথ্যের কোন প্রত্যক্য প্রমাণ ছিলনা বলে ড. রায় চৌধুরী
এ মতকে অগ্রাহ্য করেন।
শশাংকের উপাধি গ্রহণ থেকে জানা যায়, তিনি স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব
সূচক পরমদৈতক, পরমভট্টারক, মহারাজাধিরাজ, পরমমাহেশ্বর উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। সোমদত্তের
পরিবর্তে শ্রীশশাঙ্গ দেব উৎকীর্ণ করিয়েছিলেনশশাংকের।
শশাংক শশাঙ্ক শুধুমাত্র দুঃসাহসিক অভিযানকারী ছিলেন না। মেদিনীপুরের দাঁতন বা দন্ডভুক্তি অঞ্চলে দিঘী জলসেচ ব্যবস্থা
জণ্যে তা প্রচেষ্টার সাক্ষ্য দেন। শশাঙ্কের তাম্রশাসনে গুপ্তধারার প্রতিফলন থাকলেও আর্থসামাজিক
চিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন চোখে পড়ে। বিশেষ করে তাঁর আমলে বাংলার সমাজ ও প্রশাসন অধিকতর সামন্তনির্ভর
হয়ে পড়েছিল।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ গুলিতে শশাংকের বৌদ্ধ বিদ্বেষের উল্লেখ পাওয়া
যায়। বানের রচনার শশাংকে
গৌড়াধর্ম গৌড়ভুজঙ্গ বলা হয়েছে। শশাংক গয়ায় বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন। তিনি আদেশ জারি করেনঃ “সেতুবন্ধ
হইতে হিমালয় পর্যন্ত যেখানে যত বৌদ্ধ আছে, তাহাদের বুদ্ধ হইতে বালক পর্যন্ত যে না হত্যা
করিবে, সে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইবে”। (রামাই পণ্ডিতের শূন্য পুরাণ, পৃষ্ঠা ১২৪)
ড. বি. সি সেন খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে অষ্টম শতাব্দী
মধ্যভাগ পর্যন্ত সময় সীমাকে বঙ্গদেশের ইতিহাসে “ব্যর্থও যুগ” বলে অভিহিত করেন। এই ব্যর্থতার মধ্যে একমাত্র সার্থক ব্যক্তি ছিলেন গৌড়রাজ শশাংক।
শশাংককে নিঃসন্দেহে সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ
নৃপতি বলা যায়। বালার ইতিহাসে তিনিই
প্রথম শাসক যিনি সাম্রারাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। তিনি যে সাম্রারাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন, তারই উপর পাল যুগের
রাজারা সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। ড. মজুমদার বলেছেন যে, শশাংকের যদি জীবনীকার থাকত। তাহলে হয়ত হর্ষবর্ধনের মতো উজ্জ্বল মনে হত।
‘হে মহামানব একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরীর ভিড়ে’।
ইতিহাসের বিরল গণনায়ক গোপালঃ
এটি ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বিশেষকরে ঘটনার আকস্মিকতায়
অভুতপূর্ব গণউত্থান। আমাদের ইতিহাসের প্রথম গণনির্বাচন। মাৎস্যন্যায়ের সময়
বাংলার বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য বাংলার মানুষ তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখিয়ে নির্বাচনের আয়োজন
করেছে।
লামাতারনাথের মতে গোপাল পুন্ড্রবর্ধন নিবাসী এক ক্ষত্রীয়
পরিবারে জন্মগ্রহন করেন এবং পুন্ড্রবর্ধনেই তার শক্তির প্রাথমিক উত্থান, বিকাশ এবং পরিণতি লাভ ঘটেছে। গোপালের বংশ পরিচয় সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায়
না। শুধু এটুকুই জানা যায় যে, তাঁর পিতা ছিলেন বপ্যট
(যাকে শত্রু ধ্বংসকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে) এবং পিতামহ ছিলেন দয়িতবিষ্ণু (যাকে
বলা হয়েছে সর্ববিদ্যা-বিশুদ্ধ)। পাল রাজাদের বংশ পরিচয় সম্পর্কিত সমস্যার মতোই
যে আদি রাজ্যকে ভিত্তি করে তাদের উদ্ভব সে সম্পর্কেও নিশ্চয় করে কিছু বলা দুরূহ।
রামচরিতম্ গ্রন্থে বরেন্দ্র (উত্তরবঙ্গ) পাল রাজাদের জনকভূ (পিতৃভূমি) বলে
উল্লিখিত হয়েছে। এতে মনে হয় উত্তরবঙ্গেই পাল রাজগণ তাদের আদি রাজ্য স্থাপন
করেছিলেন।
গোপালই হলেন পাল
বংশের প্রতিষ্ঠাতা। যে বংশ পরবর্তীতে চার’শ বছর শাসন করে। পাল
বংশের সবচেয়ে শক্তিশালী
দুই রাজা ছিলেন গোপালের পুত্র ধর্মপাল (রাজত্বকাল
৭৭৫-৮১০
খ্রীষ্টাব্দ) এবং দেবপাল
(রাজত্বকাল ৮১০-৮৫০
খ্রিষ্টাব্দ)।
দেবপালের রাজত্বকালে উপমহাদেশের
এক বিশাল অংশ
বাঙালীদের করতলগত হয়।
ধর্মপালের রাজত্বের ৩৪তম বর্ষে রচিত খালিমপুর তাম্রলিপি
থেকে জানা যায়,
গোপাল ছিলেন বপ্যট নামে এক যোদ্ধার পুত্র এবং দয়িতবিষ্ণু
নামে এক ‘সর্ববিদ্যাশুদ্ধ’ পণ্ডিতের পৌত্র’। তারানাথের মতে, গোপাল ছিলেন গোঁড়া বৌদ্ধ এবং ওদন্তপুরী মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা। পাল সভাকবি
সন্ধ্যাকর নন্দী ‘রামচরিত’ কাব্যে পাল রাজাদের ‘সমুদ্রকুলোদ্ভূত’ বলেছেন। আবুল ফজল
পাল রাজাদের কায়স্থ বলে বর্ণনা করেন। রামচরিতে বরেন্দ্রভূমি অর্থাৎ উত্তরবঙ্গকে পাল
রাজাদের পিতৃভূমি (জনকভূ) বলা হয়েছে।
পাল রাজাদের নামের শেষে ‘পাল’ শব্দাংশটির অর্থ ‘রক্ষাকর্তা’।
তাঁদের সঠিক জাতি-পরিচয় জানা যায় নি।
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এর সুত্র মতে, সেই গঙ্গাহৃদয়
(গঙ্গারিডাই) থেকে আজকের বাংলাদেশ আর সমস্ত ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম
গণতন্ত্র চর্চা হয়েছিলো এই বাংলাদেশেই। জাতি হিসেবে এ যে আমাদের কতবড় গর্ব ও
গৌরবের বিষয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
ফলে একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে গোপালকে কেন্দ্র করে প্রথম
গণতন্ত্রের চর্চা মূলত: বাংলাদেশের বরেন্দ্রভূমি ভিত্তিক সংঘটিত হয়েছিল। দশম
শতাব্দিতে রচিত বাংলার ইতিহাসের একমাত্র প্রামান্য পুঁথি সন্ধ্যাকর নন্দীর
রামচরিতেও একই বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যাকর নন্দীর বর্ণনা অনুযায়ী বরেন্দ্রই
হচ্ছে পাল রাজাদের পিতৃভূমি।
“জাগিল স্মৃতিতে পূর্ব গরিমা
কালিমা মোছাতে হবেই হবে
বীর প্রসবিনী জননী মোদের, বীরের জাতি, আমরা বীর”
সবশেষে
বলা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল ভারত জুড়ে এবং
বহির্বিশ্বেও নানা দেশে। এ দেশের ঐশ্বর্যের কথা জানতো অনেকেই। এ আকর্ষণে ভিনদেশিরা
বারবার ছুটে এসেছে। কখনও এসেছে বাণিজ্যিক উদ্দেশে, কখনও ধর্ম প্রচার করতে,
আবার কখনও এসেছে গোটা দেশটিই দখল করে নিতে। আর এই দখলদারের
বীরুধে রুখে দাঁড়িয়েছে এখানকার সাহসী সন্তানেরা।
দুর্যোগে, সংগ্রামে তারা দুর্বার
হয়ে ওঠে শত্রুর বিরুদ্ধে। এই সামান্য হাতিয়ার নিয়ে বাঙালিরা মৌর্য সৈন্যদের
বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়। সেই অভিযান আলেকজাণ্ডারের
কাল থেকে, গঙ্গারিডিবাসীর সে পরাক্রম গ্রীককাব্যে কীর্তিত। রাজনৈতিক
মহানায়কত্ব অর্জনের দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া পরম্পরা।
চিরকালের
বিদ্রোহী, পোষ-না-মানা রোখ তার। আমাদের রক্তে বীরের
রক্ত, আমাদের চেতনায় স্বাধীনতা রাঙা সূর্য।
মুক্তির মন্দিরে সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান,
লেখা আছে অশ্রুজলে।
কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা,
বন্দিশালার ঐ শিকলভাঙা
... যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে।
-
মোহিনী চৌধুরী।
###সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
Comments