পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৫ (বাঙালির বীরত্ব গাঁথা-তৃতীয় পর্ব )


পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৫ (বাঙালির বীরত্ব গাঁথা-তৃতীয় পর্ব ) 
সাজেদুর রহমান


মহারাজা ভগদত্ত আর জরাসন্ধ, দুই পরাক্রমশালী যোদ্ধা। বাংলা মূলকে ওরা; দুর্ধর্ষ, বেপরোয়া, সাহসী অথচ সহজ-সরল মানুষ। বিপজ্জনক সব কাজে বেস্ত। জরাসন্ধ গেছে মথুরায় মামার খুনি মহাবীর কৃষ্ণকে ধরতে। হাতে যথেষ্ট সময় না পেয়েও বিনা প্রস্তুতিতে ভগদত্ত অসাধারণ রণকৌশলে নাস্তানাবদু করে উত্তরের গভীর বনে তাড়িয়ে দিলেন পাণ্ডব শ্রেষ্ঠ অর্জুনকে। দুই বীর দুই কাজে ছুটছে দু’দিক। ওরা কি জানত দুজনকে কিসের মকাবেলে করতে হবে? জানত জীবনের সবচেয়ে জটিল ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে যাবে ওরা। এবার রক্ষা নেই।
একদিকে যুদ্ধবাজ পঞ্চপাণ্ড, আরেকদিকে ঠাণ্ডা মাথার রাজনীতিবিদ কৃষ্ণ আর যুধিষ্ঠি। শেষ পর্যন্ত ভগদত্ত আর জরাসন্ধ নিঃসংশয় ভাবে হত্যার শিকার হয়। সেই সাথে ভগদত্তের বংশজাত আরেক বীর নরকাসুর এবং জরাসন্ধর সেনাপতি শিশুপাল আর্যদের কূটকৌশলে জীবন দিতে হয়।                
উত্তরদেশের ভগদত্তসহ নরকাসুর-জরাসন্ধ-শিশুপালের পতন ঘটছে, তখন থেকেই আমাদের বাংলায় অনার্য্য রাজাদের হারিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করছে আর্য্যশক্তি, কামরূপের ভগদত্ত-নরকাসুর ও জরাসন্ধ-শিশুপাল বধের মাধ্যমে থাবা বাড়াচ্ছে  উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। বাঙালির বীরত্ব গাঁথা-তৃতীয় পর্বে এদের নিয়েই থাকছে শ্রুত-অশ্রুত কাহিনী।                 

অতিরথ সম্রাট ভগদত্ত

মহাবীর অর্জুন ভগদত্তকে দেখে আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। নিজ সৈন্যদের দিকে মুখ করে সেনাপতিদের ডাকলেন। সেনাপতিগণ, তাড়াতাড়ি আসো। মহাবীর ভগদত্তকে দেখো। যে পুরুহূতের (ইন্দ্রের) যোগ্য পুত্র।
ভগদত্ত বিশাল হাতির পিঠে বসেছিল। অর্জুন তার কাছে গেলেন, হড়বড় করে বললেন, হে মহামত্তবীর এবার রণে নিবর্ত হও। তোমার শক্তি সম্পর্কে ধারনা ছিল না। এতদিনে তোমার যোগ্যতা জেনে খুশি হচ্ছি। কিসের কারণে তুমি এই যুদ্ধ করছ! কি চাও দয়া করে আমায় বল।
ভগদত্ত খুব ভালো করেই জানে ভয়ঙ্কর দিন যাচ্ছে। যে-কোনো সময় যে-কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। তারপরেও তার মনে চাপা আনন্দ। অর্জুন (বিপদ সঙ্কুল) বর্ত্ম(পথ) পেরিয়ে ইতিমধ্যে কালকূট কুলিন্দ, শাকল সুদ্বীপ, প্রতিবিন্ধ্য রাজ্য আনআর্য রাজাকে জয় করেছেন। এর পরে তার প্রাগ্‌জ্যোতিষ রাজ্যে এসেছে। কিন্তু পেরে ওঠেনি।
ভুবন বিখ্যাত ভগদত্তের আনন্দের প্রধান কারণ হলো, টানা আটদিন যুদ্ধে বীর যোদ্ধা অর্জুন তার কাছে দয়া ভিক্ষা করেছে। অর্জুন বিনয়ের সাথে বলেন, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কুরুকুলের রাজা হলেন। তিনি রাজসূয় ক্রতু(যজ্ঞ) করতে চান। আপনি যদি আমার উপর প্রীত হন তবে দয়া করে কিছু করদান করুন। প্রাগ্‌জ্যোতিষের ভগদত্ত রাজা আনন্দ মনে বহু ধন দিয়ে অর্জুনের পূজা করলেন।
মহাভারতের কালে শ্রেষ্ঠত্ব অনুযায়ী যোদ্ধাদের তিন ভাগে ভাগ করা হতো, রথী, মহারথী এবং অতিরথ, অতিরথ হলেন বীরত্বের শেষ সংজ্ঞা। মহাভারতের যুদ্ধে মোটমাট পাঁচজন অতিরথ ছিলেন। উত্তরপশ্চিম ভারতের বীরশ্রেষ্ঠ বীরোত্তম চতুর্বীরাঃ, ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, অর্জুনপ্রাগজ্যোতিষপুর সম্রাট ভগদত্ত মহাবীর অর্জুন নিজেই স্বীকার করেছেন 'মহাবীর ভগদত্ত গজযান বিশারদ ও পুরন্দর সদৃশ। উনি এই ভূমণ্ডলে গজযোধীগণের প্রধান।  
ভগদত্ত ছিলেন পৌরাণিক কামরূপ রাজ্যের অধিপতির। ঐতিহাসিকগণ বিষ্ণুপুরাণের ভিত্তিতে বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ হাজার সাল থেকে ২৫০০ সাল পর্যন্ত বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত সমগ্র সিলেট অঞ্চল কিরাত রজ্যের অর্ন্তভূক্ত ছিলো। এই সময় শ্রীহট্টকে বলা হতো হরিকেল। এর পরপরই কিরাতীদের পরাজিত করে মহারাজ ভগদত্তের পূর্বপুরুষগণ কিরাত রাজ্য দখল করে কামরূপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য সূত্রে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের কোন এক সময় মহারাজা ভগদত্ত সিংহাসনে বসেন। কামরূপছিল একটি বিশাল রাজ্যের নাম। তার সময়কালে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অন্তভুক্ত ছিল।  এই অতিকায় কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের জেলাও। সিলেট বিভাগের লাউড় পরগণাধীন লাউড় নামক পাহাড়ে তার উপরাজধানি থাকার উল্লেখ্য শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তসহ বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়। তার অনেক উন্নয়নের কথা শোনা যায়।  
প্রাগজ্যোতিষপুর সম্রাট ভগদত্ত মহাভারতের হস্তিনাপুর রাজ্যের সাথে তার আত্মীয়তা ছিল। তিনি ছিলেন কৌরব রাজপুত্র দুর্যোধনের শ্বশুর। মহারাজা ভগদত্ত ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ একজন ক্ষত্রিয় নৃপতি। তিনি দেব দেবীর ঘোর বিরোধী ছিলেন।
তার শাসনামলে ঐতিহাসিক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মহারাজা ভগদত্ত এক অক্ষৌহিনী সৈন্যসহ কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। তিনি পাণ্ডব পক্ষীয় হেডম্ব রাজ্যাধিপতি ঘটোৎকচ-এর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। উল্লেখ্য যে, হেডম্ব ছিলো কামরূপেরই অধীন এক সামন্ত রাজ্য। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে প্রথমদিকে ঘটোৎকচ এর কাছে রাজা ভগদত্ত হেরে যান। কিছুকালের মধ্যেই ঘটোৎকচকে পরাজিত করে রাজা ভগদত্ত পূর্বের প্রতিশোধ নেন। ঘটোৎকচ মৃত্যুবরণ করেন। ভগদত্ত শেষ পর্যন্ত অর্জুনের হাতে নিহিত হন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে মহাভারতে মহারাজা ভগদত্তকে আর্যকুল মর্যাদা দিয়ে ক্ষত্রিয় রাজা হিসাবে গণ্য করা হয়। মহাবীর অর্জুন নিজেই স্বীকার করেছেন 'মহাবীর ভগদত্ত গজযান বিশারদ ও পুরন্দর সদৃশ। উনি এই ভূমণ্ডলে গজযোধীগণের প্রধান।
ইন্দ্রসখা বঙ্গ বীর ভগদ‌ত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দশ হাজার সৈন্যের এক পর্বতসম বাহিনী নিয়ে রা দুর্যোধনের পিছনে অবস্থান নিয়েছিলো। মহাভারতে উল্লিখিত তৎকালীন বাংলার রাজা কর্তৃক কৌরবদের পক্ষে অংশগ্রহণের কারণেই কী বাংলাকে পাণ্ডব বর্জিত অঞ্চল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে?
মহাভারতের প্রথম বাংলায় অনুবাদকারী মহাকবি সঞ্জয়র নিবাসও এই এলাকায়। মহাকবি সঞ্জয় তাঁর লেখায় বার বার রাজা ভগদত্তর কথা লিখেছেনএছাড়াও যোগিনীতন্ত্রে কিরাতের দেশকে ‘‘প্রাগজ্যোতিষপুর’’ বলে আখ্যাযিত করা হয়েছে।
নরকের পুত্র ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষে লড়াই করে নিহত হন বলে উল্লেখ আছে।
সেই কামরূপ রাজ্যের উত্থান-পতন ও ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস নানা ঘটনা ও দ্বন্দ্ব সংঘাতে জর্জরিত। কিন্তু সে ইতিহাসের অনেকটাই প্রামাণিক তথ্যসমৃদ্ধ নয়। কতটা জনশ্রুতি-নির্ভর আঞ্চলিক গল্পগাথা, রাজবংশাবলী অবলম্বনে রচিত। ফলে ঐতিহাসিকদের মধ্যেও মতভেদ ঘটেছে নানা মাত্রায়, নানা প্রসঙ্গ অবতারণায়। মহাভারত এবং রামায়ণে কামরূপকে প্রাগ্জ্যোতিষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাঙ্গালা ইতিহাসের ভগ্নাংশ কামরূপ-রঙ্গপুরপ্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় উল্লেখ করেছেনঃযথায় এখন কামরূপ তথায় অতি প্রাচীনকালে এক আর্য রাজ্য ছিল, তাহাকে প্রাগ্জ্যোতিষ বলিত। বোধহয়, এই রাজ্য পূর্বাঞ্চলের অনার্য ভুমিমধ্যে একা আর্যজাতির প্রভা বিস্তার করিত বলিয়া ইহার এই নাম। ইরিত্রিয় সাগরের পেরিপ্লাস (প্রথম শতাব্দী) এবং টলেমির জিওগ্রাফিতে (দ্বিতীয় শতাব্দী) কামরূপকে কিরহাদিয়া নামে অখ্যায়িত করা হয়েছে যা কিরহাদিয়া জনগণের নামে নামাঙ্করণ করা হয়েছে। কামরূপের প্রথম মহাকাব্যিক উল্লেখ পাওয়া যায় ৪র্থ শতাব্দীর সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদের অভিলিখন হতে, যা এক ঐতিহাসিক সময়কালের সূচনাপাতের নির্দেশক। চীনা পরিব্রাজক তাঙ-য়ু (Tang-shu) বলেন, কামরূপ ও পৌন্ড্রবর্ধনের মধ্যবর্তি নদী ক-লো-তু এবং কামরূপ পৌ-বর্ধনের ১২০০ লী উত্তর পূর্বে অবস্থিত। এক সময়ে এই কামরূপ রাজ্য (প্রাগ্জ্যোতিষপুর) অতি বিস্তৃত হইয়াছিল। পূর্বে করতোয়া ইহার সীমা ছিল; আধুনিক আসাম, মনিপুর, জয়ন্ত্যা, কাছাড়, মযমনসিংহ, শ্রীহট্ট, রঙ্গপুর, জলপাইগুড়ি ইহার অন্তর্গত ছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনিন্দ্র বসু যে গবেষণা করেছেন, লাউড় রাজ্য পৌরাণিক যুগের রাজ্য। এর স্থপতি রাজা ভগদত্ত। ভগদত্তের ১৯ জন বংশধর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে রাজ্য স্থাপন করে। ঐতিহাসিকদের মতেবর্তমানের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল লাউড় রাজ্য।
মহাভারত, রামায়ন, কালিকাপুরাণ, মহাভারতে ভগদত্তকে কিরাত, চীনা ও ম্লেচ্ছদের রাজা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। ভগদত্তের সেনা বাহিনীতে চৈনিক সৈন্যদের উপস্থিতি ঐ সন্মিলনীর বড় প্রমাণ। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, উপমহাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতরাজী, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর এবং পূর্বে মণিপুর, ত্রিপুরা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলময় পাহাড় পর্বত। তাই এ তিন দিক থেকে ভারতে কোন মানবগোষ্ঠির আগমণ তুলনামূলকভাবে কঠিন ছিল। পশ্চিম দিক ছিল সহজতর। তাই পশ্চিম থেকেই বেশীর ভাগ মানুষের এসেছে উপমহাদেশে। তবে প্রাচীনকালের কষ্টসহিসষ্ণু সংগ্রামী মানবজাতির জন্য উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা কোন দুর্ভেদ্য প্রাচীর ছ্লিনা। হিমালয়ের পাদদেশের বিশাল এলাকা জুড়ে বসবাসরত মঙ্গোলীয জনগোষ্ঠির প্রভার উপমহাদেশের জনতত্বতে কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। আর্যজাতির আগমণের পূর্ব থেকেই উত্তর-পূর্ব ভারত ছিল মঙ্গোলিয় জাতির আবাসস্থল। তাদের পরিচিতি ছিল কিরাত।
কিরাতদের নিয়ে কৃত্তিবাসী রামায়নে বলছে,      
কনক চাপার মত শরীরের বর্ণ।
ঊঠানখানার মত ধরে দুই কর্ণ।
থালাহেন মুখখান তাম্রবর্ণ কেশ।
এক পাশে চলে পথ বলেতে বিশেষ।

রামায়নে অপহৃত সীতার অন্বেষণে সেনাবাহিনীর প্রতি নির্দেশ মতে,
ব্রহ্মপুত্র তরি রঙ্গে করিহ প্রবেশ
 মন্দর পর্বতে যাইও কিরাতের দেশ।
 যাইবে কর্ণাট দেশ আর শাকদ্বীপে।
কিরাত জানিবা আছে অত্যদ্ভুত রূপে।

পন্ডিতবর রজনীকান্ত গুপ্ত তার ভারত ইতিহাস-এ লিখেছেন, রাজা ভগদত্তের শাসনামলে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলাধীন লাউড় পর্বতে তার একটি শাখা রাজধানী ছিল যার ভগ্নাবশেষ আজও অত্র অঞ্চলে বিদ্যমান। তিনি দিনারপুর থেকে লাউড়, সেখান থেকে গৌড় পর্যন্ত খেয়া নায়েও চলা-ফেরা করতেন। কারণ তার সময়ে প্রাচীন শ্রীহট্রের এই অঞ্চগোলুর নিম্নাংশ বেশীরভাগ সাগরগর্বে নিমজ্জিত ছিল।  
যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজনকে সার্থক করতে অর্জুন উত্তরে কিরাত দেশে রাজা ভগদত্তের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলে এই বন্য সৈনিকদের অসীম সাহস ও ধৈয্য দেখে চমকে উঠলেন। অগণিত সেনা-যারা কিরাত(ব্যাধ) কাননবাসী, তাদের হাতে ধনুক, গুঞ্জহারের(কুঁচফলের) মালায় সজ্জিত, উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা, শরীরে বৃক্ষলতা বেষ্টিত হয়ে পরম হরষে যুদ্ধ করতে লাগল। এভাবে উভয় পক্ষের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ হল।
কথিত আছে বৃহত্তর রঙ্গপুরের নামের সাথে ভগদত্তের স্মৃতি জড়িত। প্রাগজ্যোতিস্বর ভগদত্ত (খ্রীঃপূর্ব ১৫০০ অব্দ) কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কুরুপক্ষ অবলম্বন করে নিহত হবার পূর্বে অবসর যাপন, আনন্দ-উল্লাস ও চিত্ত বিনোদনের জন্য নিজ রাজ্যের এই প্রান্তে রঙ্গশালা বা প্রমোদপুরী তৈরী করে রাজ-আমাত্ব্যদের নিয়ে আনন্দ বিলাস করতেন। রঙ্গশালা স্থাপনের কারনে এলাকার নাম হয়ে যায় রঙ্গপুর। রঙ্গপুর পরে রংপুর নাম ধারন করে। বাংলার প্রাচীনতম ভূমির বরেন্দ্র অঞ্চলের রংপুর নামকরণের সাথে রাজা ভগদত্তের রঙ্গশালা সম্পর্কিত বিষয়টি সচেতন রংপুরবাসী সহজে মেনে নিতে চান না।   
এই কিরাত জাতীর মহানায়ক ভগদত্তকে নিয়ে আরেকটি তথ্য পাই। দেখি মহাভারত সময়কালে যখন নরকাসুর কামরূপ রাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, ঐ সময় প্রাচীন গুজরাটে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা নামে রাজ্য প্রতিষ্টিত করেন। তৎকালে কামরূপ রাজা নরকাসুরের মানবতা বিরুধী বিভিন্ন কার্যকলাপে শ্রীকৃষ্ণ অতিষ্ঠ হয়ে নরকাসুরকে হত্যা করেন এবং কামরূপের যুবরাজ ভগদত্তকে সিংহাসনে প্রতিষ্টিত করেন

নরকাসুর/ ভৈঁসাসুর এক দুর্দমনীয় কাল পুরুষ   

বুঝতে নরকাসুরের দেরি হলো না অর ওপর আক্রমণ আসতে যাচ্ছে। প্রস্তুতি পর্ব প্রায় শেষ পথে। সত্যভামা আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গরুড়ের (গরু+পাখি) পিঠে চরে সুদূর দ্বারকা থেকে শোনিতপুরে এসেছেন। শিশুপাল নিশ্চিত মৃত্যু বুঝে স্মিত হেসে তার মা ভূমিকে বললেন, মা আমার মৃত্যু দিবস যেন আনন্দ উৎসব করা হয়।   কথাটা শেষ হতে না হতেই শ্রীকৃষ্ণ দ্রুত সুদর্শন চক্র ছুড়ে মারলেন। সুদর্শন চক্রের ধারালো ফলার আঘাতে শিশুপালের মাথা ধর থেকে আলাদা হয়ে গেল।
অসুর রাজা শিশুপালের হাসিমুখে মৃত্যু বরণ কি আর্যদের তাচ্ছিল্য প্রকাশ? আর্যসাহিত্য মতে সর্ব অপরাধী শিশুপাল। সে সমগ্র পৃথিবী জয় করে সর্গ আক্রমণ করে বসেন। দেবতারা শিশুপালের আক্রমণ প্রতিহত করতে নাপেরে পালিয়ে যান। দেবতা বিষ্ণু অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে জান। বিষ্ণু কৃষ্ণের কাছে অভিযোগ করেন, দেবতাদের আবাস হুমকিতে পরেছে বলে। এখনি বেবস্থা না নিলে এক আধা জংলির কাছে দেবতাদের পরাজয় হবে। যা মেনে নেওয়া অসম্ভব।
দেবতাদের অপমান নিয়মিতই করে যাচ্ছিল বাংলার ভূমিজাত পুরুষ শিশুপাল। ইনি জাদুবলে ১৬ হাজার রাজকন্যা তুলে এনে তার প্রাসাদে দাসি করে রাখে। এমনকি একবার হাতির রূপ ধরে বিশ্বকর্মার কন্যাকে অপহরণ করে ধর্ষণ করেন। পরে ইনি গন্ধর্ব, মানুষ ও দেবকন্যা ও অপ্সরাদের অপহরণ করে প্রাগ্‌জ্যোতিষপুরে বন্দী করে রাখেন।
অভিযোগের তালিকা দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। (মহাভারতের বনপর্ব বা মার্কেন্ডেয় পুরান অনুশারে) যুদ্ধ, নরহত্যা, সম্পদ লুন্ঠন, নারীদের উপর যথেচ্ছ যৌন নির্যাতনসহ অদিতি দেবীর কুণ্ডলজোড়া চুরি করেন প্রাগ্‌জ্যোতিষপুরের একটি দুর্গে রেখে আসার কথা ওঠে।            
এ অবস্থায় ইন্দ্রসহ সকল দেবতা বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বলল, নরকাসুর দেবতাদের পরম শত্রু। সেই সাথে সত্যভামা কৃষ্ণকে নরকাসুরের বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য রাজি করান। কৃষ্ণ এবং সত্যভামাগরুড়ে উঠে নরকাসুরের রাজ্য আক্রমণ করেন। আর এই আক্রমণে অস্ত্র দিয়ে সয়াহতা করে বিষ্ণু। এই নরকাসুরবধ হতে বিষ্ণুপুরাণের মতে পারিজাত হরণের সূত্রপাত।
অথচ এই কৃষ্ণ নরকাসুরের পিতা। জন্মের সময় পিতা তার মা ভূদেবিকে বর হিসেবে নরক দীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। তাই মৃত্যু পরবরতি নরকাসুরের মায়ের মুখে শুনতে পারি, ‘তবু হেন নরকের মুখখানা আমাবও প্ৰাণে জল জ্বল করে জলছে। আশ্চৰ্য্য আকর্ষণ’      

রাজা নরকাসুরের চরিত্র সত্যি আকর্ষণয়। প্রাচীনকালের এই মহানায়ককে ঘিরে  রয়েছে বিচিত্র এক রহস্যের বাতাবরণ।
এই মানুষটির জন্ম বিসয়ে বিভিন্ন পুরাণে বলা হয়েছে, বিষ্ণু যখন বরাহ অবতার রূপ ধারণ করে জলমগ্ন পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন, তখন পৃথিবী ও বরাহের সংস্পর্শে নরকাসুরের জন্ম, এই সূত্রে পৃথিবী মানে Earth হলো নরকের মা। এখন বলেন, বাস্তবে এটা কি সম্ভব?
বাস্তবতা হলো, এখানকার ভূমি পুত্র, যিনি আদিম সমাজের রূপান্তর ঘটিয়ে কৃষিসভ্যতা নির্মাণ করছিলেন। আর এই ক্ষেত্রে সমগ্র অনার্যবরতকে এক দেশের অধিনে আনতে সক্ষম হয়েছিলে।
পুরাণে উল্লিখিত নরকাসুর ছিলেন মহারাজ ভগদত্তের পিতা। অতি প্রাচীনকালে মহীরাং দানব নামে কামরুপের একজন রাজা রাজত্ব করতেন। এই রাজাই অসুর বংশ রাজাদের আদিপুরুষ বলা যেতে পারে। কিরাত-বংশীয় এই বংশে রাজ ঘটককে পরাজিত কর নরকাসুর কামরুপের সিংহাসন লাভ করেন। নরকাসুর কামরূপের রাজধানী বর্তমান গৌহাটিতে স্থাপন করেছিলেন। পশ্চিমে করতোয়ার থেকে পূর্বে দিক্রঙ পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তৃত ছিল। সে সময়ে গৌহাটির নাম ছিল প্রাগৃজ্যোতিষপুর। নগরের চারিদিকে পরিখা ও প্রাচীর নির্মাণ করিয়া তিনি নগরকে সুরক্ষিত করিয়াছিলেন। গৌহাটির কাছে একটি ছোট পাহাড় এখনও নরকাসুরের পাহাড় নামে পরিচিত।
প্রাগজ্যোতিষপুর শব্দের মর্মার্থ পূর্বদেশীয় জ্যোতির্বিদ্যার নগরবলে ঐতিহাসিক পরমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন অসমের ইতিহাস, মহাভারত, পুরাণ ও তন্ত্রসমূহে  প্রাগজ্যোতিষপুর তথা কামরূপ নগরীর ত্রান্তিক রাজা নরকাসুর ও তার পুত্র ভগদত্ত বৈদিক রীতিনীতিতে পারদর্শী ছিলেন৷
মহাভারতের কাহিনি মতে নরকাসুর কামাখ্যা দেবীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। দেবি তাকে অসম্ভব এক সর্ত আরোপ করে। বলেন, যদি নরক নীলাচল পাহাড়ের তলা থেকে মন্দির পর্যন্ত এক রাতের মধ্যে অর্থাৎ মোরগ ডেকে ওঠার আগে সিঁড়ি নির্মাণ করতে পারেন তবে তিনি বিয়ে করতে রাজী হবেন। নরকাসুর সেইমত সিড়ি নির্মাণ করে রাত পেরোনোর আগে শেষ করার উপক্রম করলেন। কামাখ্যা দেবী তখন ভয় পেয়ে একটি মোরগকে চেপে ধরাতে সে ডাক দেয়। নরকও রাত পেরোলো বলে ভেবে কাজ অর্ধেক রাখলেন।   
কামাখ্যা দেবী চাতুরী বুঝতে পেরে রেগে ফেটে পরেন। নরক মোরগ বা কুক্কুটটিকে ক্রোধবশত ধাওয়া করে হত্যা করেন। এজন্য দরং জেলায় "কুকুরাকটা" নামে একটি স্থান আছে।       
নরক বিদর্ভের রাজকুমারী মায়াকে বিয়ে করেছিলেন। ভাগবত পুরাণে উল্লেখ আছে, বিদেহের (উত্তর বিহার) রাজা জনক তাঁকে বড়ো করেন। বাণাসুরের প্রভাবে তিনি অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন। হরিবংশে এর ভিন্নপ্রকারে কাহিনি দেখি। বিষ্ণুপুরাণ হরিবংশের তথ্য বিবেচনা করলে, নরক অসুর, এমন কি, ইন্দ্রের কাছ থেকে, ইন্দ্রের 'ইন্দ্রপদ', কেড়ে নিয়েছিলেন! তখন উপায়ান্তর না দেখে, ইন্দ্র, ভগবান বিষ্ণুর, শরণাপন্ন হয়েছিলেন! বিষ্ণু, চপেটাঘাতে, চপেটা আঘাতে, নরক অসুরকে হত্যা করেছিলেন! ভগবান বিষ্ণুর হাতে নিহত হওয়ার দরুণ, নরক অসুরের, স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটেছিল! সেই সুত্রে, প্রথম অবস্থায় ভালভাবে শাসন করা নরকাসুর শোণিতপুরের বাণাসুরের প্রভাবে পড়ে অত্যাচারী হয়ে ওঠে।  
অত্যাচারী, ধর্মদ্রোহী, নারী হরণকারী নরকাসুর। তিনি তার রাজত্বকালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মানবতা বিরোধী চরম অত্যাচার চালিয়ে মানব সমাজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলেন। তিনি এতটাই নারকীয় আসুরিক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত থাকতেন যে তাকে শুধু অসুরনা একেবারে সরাসরি নরকের অসুর নরকাসুরআখ্যা দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় প্রবল পরাক্রান্ত এমন কেউ ছিল না যে এমন ভয়ংকর নরপিশাচের হাত থেকে নারীদের তথা সমাজকে রক্ষা করে। সমস্ত তথ্য এক সাথে করলে কোন্‌টা ইতিহাস তা নির্ধারণ করার আগে কোন্‌টা ইতিহাস না তা ঠিক করা কঠিন ও জটিল কাজ।
একটা উদাহরণ দেই।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নরকাসুর দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধা হিসেবে দেখি। কুরুক্ষেত্র হরিয়ানায়। নরকাসুর থাকত প্রাগজ্যোতিষপুর হইল পরবর্তীকালের কামরূপ রাজ্য যার সীমানায় পড়ছে বর্তমান সময়ের আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। মহাভারতের হিসেবে ভগদত্ত কুরুযুদ্ধে অংশ নিছে এক অক্ষৌহিণী সৈনিক নিয়া। এক অক্ষৌহিণী মানে হইল ১ লক্ষ ৯ হাজার সাড়ে তিনশো পায়দল সৈনিকের সাথে ২১ হাজার ৮৭০টা কইরা রথ আর হাতি এবং ৬৫ হাজার ৬১০টা ঘোড়া।      
আসাম থেকে হরিয়ানা যেতে পায়ে হেটে গেলে মোট ১৩৪ দিন; মানে প্রায় ৮ ক্যালেন্ডার মাস লাগবে। তাও যদি সবগুলা নদী-উপনদীতে এর জন্য নৌকা রেডি থাকে তবে। কিন্তু হাতি কেমনে নদী পার করে? সাঁতার দিয়ে? সেইটা সম্ভব?   
প্রাচীনকালের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক পরিক্রমায় প্রতিটা মতেরই কোন অন্তর্গত ভিন্নতাকে সময়ের প্রেক্ষাপটে আদিরূপের সাপেক্ষে অস্বীকার করা যাবে না। তাই কেউ কেউ বলেন, প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরকের ছেলে; যারে বামুন ঘরানার সাহিত্যে নরক রাজ্য বলত। সেই নরক রাজ্য যখন চতুর্থ শতকে বর্মন রাজ বংশের শাসনামলে প্রাগজ্যোতিষপুর নাম পাল্টাইয়া হইল কামরূপ; তখন বর্মন রাজারা দেশের মাইনসেরে শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া আর বৈষ্ণব ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য মগধ সাম্রাজ্য থেকে কামরূপে আমদানি করছিল ব্যাপক ব্রাহ্মণ। বামুনরা কিন্তু সহজে কামরূপে আসতে চাইত না। তারা বাংলারে কইত পক্ষী জাতীয় মানুষের দেশ আর কামরূপরে কইত নরক।  
রামায়ণ এবং মহাভারতের প্রথম শতকের পর লেখা অংশগুলিতে নরকাসুর এবং তাঁর প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের উল্লেখ আছে। তাঁর পুত্র ভগদত্ত‌ মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবদের হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে মানা হয়। বরাহ প্রজাপতির কথা শতপথ ব্রাহ্মণে আছে যদিও আনুমানিক পঞ্চম শতকে রচিত "হরিবংশ"-এ ভূমির সংস্পর্শে পুত্র উপজার কথা উল্লেখ আছে। বিষ্ণু পুরাণে নরকের এই কাহিনী বেশি করে বলা হয়েছে এবং পরে রচিত ভাগবত পুরাণে এই কাহিনী পুনরায় বর্ণিত হয়েছে।
পুরাণের মনগড়া তথ্যগুলোর প্রতি খেয়াল রাখা শুরু করুন। মহাভারত ছাড়া, কৃষ্ণ সম্পর্কে যেসব গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সেগুলো হলো-বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবত পুরাণ এবং হরিবংশ।
আর একটা ঐতিহাসিক তথ্য এখানে জেনে রাখেন, কৃষ্ণের সময় নরকাসুরের রাজত্ব বলে যা বলা হয়, সেই প্রাগজ্যোতিষপুর বা বর্তমানের আসামের রাজা ছিলো ভগদত্ত নামের এক ব্যক্তি, যে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলো এবং অর্জুনের সাথে যুদ্ধ করে মারা যায়।
নরকাসুরের কিংবদন্তি অসমের ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ; কারণ কামরূপ শাসন করা কয়েকটি রাজবংশ নরকাসুরের থেকেই হয়েছে বলে মানা হয়। গুয়াহাটীর দক্ষিণে তাঁর নামে একটি পাহাড় আছে। শক্তি দেবী এবং উপাসনার স্থান কামাখ্যার সাথেও তাঁর নাম যুক্ত করা হয়। আসামে রচিত উপপুরাণ কালিকা পুরাণে (১০ম শতক) নরকাসুরের কিংবদন্তি অনেক বেশি বর্ণিত হয়েছে। এতে সীতার পিতা বিদেহর জনকের কাহিনীও নরকাসুরের কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
# মহাভারতের স্বর্গও কিন্তু বর্তমানের স্বর্গ না। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ হিসাব কইরা অতুল সুর কন মহাভারতের স্বর্গ হইল মূলত হিমালয়ের উত্তর অংশ যেইখানে আছিল দেবরাজ ইন্দ্রের নগর আর রাজধানী অমরাবতী।
কৃষ্ণের চক্রখানের হিসাব বলতে রথের চাকা ধরা যেতে পারে। এর আগে কৃষ্ণ ভীষ্মরে তারা করে; ঠিক একইভাবে তার শিষ্য আর ভাগিনা অভিমন্যুও কিন্তু রথের চাকা নিয়ে কৌরবগো দাবড়ায়। এতে কৃষ্ণ ঘরানায় চাকা জাতীয় অস্ত্রে সাবলীলতা বোঝা যায়। কিন্তু সুবর্ণচক্রখান এক্কেবারে চাকতি জাতীয় কিছু হইলে খুব ভালো অস্ত্র হওয়ার কথা না। ঠিকভাবে ধরা যাবে না।
পৌরাণিক কাহিনীগুলি সূত্র থেকে সূত্রান্তরে পরিবর্তিত হয়| পাঠকের যদি মনে হয় দেবতার বিপরীতে মনুষ্য-ঔদ্ধত্যের এই আখ্যান ভিত্তিহীনতবে বলে রাখি এর উৎস
পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয় রামায়ণ, মহাভারত, মনুস্মৃতি নামক আর্য সমাজের অমৃতকথা। এই নব্য লিখনে ফিরিয়ে আনা হয় কৃষ্ণকে। অসুরের বেশে নয়, একেবারে ব্রাহ্মণদের বিধাতা ঈশ্বর হিসেবে। তার মুখ দিয়েই অমৃত বর্ষণ করা হয়
ব্রাহ্মন্যবাদী কৃষ্ণকে দিয়ে শুরু হয় অসুর বধের মহাযজ্ঞ। মানুষকে হত্যা করা হয়ে ওঠে ধর্মযুদ্ধ। ধর্মের নামেই চলতে থাকে অবাধ নরমেধ।  
বেদের অমৃত বাণী (যে যত অসুরদের হত্যা করতে পারবে, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করতে পারবে স্বর্গে তার তত বেশি সুখ ভোগের ব্যবস্থা হবে। ইন্দ্র তাকে নারী, সুরা ও সম্পদ দান করবে) এই সকল নরমেধকে উৎসাহিত করতে থাকে।
"হে ইন্দ্র, আমাদের পাপ সকল লঘু করো। আমাদের ঋকের শক্তি দাও, যেন ঋক হীন মানুষদের আমরা বধ করতে পারি। যারা  ঋক শূন্য যজ্ঞ শূন্য ও ব্রাহ্মণ হীন তাদের শেষ করো"। ঋক ১০/১০৫/৮ 
কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে সমস্ত বন্দী নারীদের মুক্ত করেন।  কৃষ্ণের এই ষোল হাজার একশ মেয়েকে উদ্ধার সম্পর্কিত কিছু ভৌগোলিক ঘটনার কথা বলতে পারে, যেমন একটি জায়গার নাম আছে অশ্বক্লান্ত, বলা হয়, কৃষ্ণ, মেয়েগুলোকে উদ্ধার করে ফেরার সময় সেই জায়গায় তার রথের ঘোড়ারা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো বলে, কিছু সময় বিশ্রাম নিয়েছিলো, এই ভাবে সেই জায়গার নাম হয় অশ্বক্লান্ত।
উত্তর গুয়াহাটীতে "অশ্বক্রান্ত" (অর্থ-অশ্বের আরোহণ) নামে একটি মন্দির আছে। গোণ্ড আদিবাসীরাও ভৈঁসাসুরকে রাজা মনে করে পুজো করেন। আমরা জানি নরকাসুরকে ভৈঁসাসুর বলা হয়।   
মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে ২০টি সর্গে সংস্কৃত কবি মাঘ (খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী) শিশুপালবধ নামে একটি মহাকাব্য রচনা করেন। এই কাব্যের উপজীব্য ছিল সুদর্শন চক্র দ্বারা কৃষ্ণ কর্তৃক অসাধু রাজা শিশুপালের মস্তকছিন্নকরণ।
পুরাণ মতে অন্যায়-অশুভ শক্তির দমন এবং শান্তি প্রতিষ্টার জন্য বিষ্ণু সুদর্শন চক্র ব্যবহার করেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি চক্রটির মাধ্যমে অনেক অসুর বধের মাধ্যমে স্বর্গ এবং মর্ত্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই বৈষ্ণবীয় ঐতিহ্য মেনে আজও বহু বিষ্ণুমন্দিরের শীর্ষভাগে সুদর্শন চক্রের প্রতীকস্বরূপ একটি ধাতুনির্মিত চক্র বা বলয় স্থাপন করা হয় সকল অশুভ শক্তির হাত থেকে সুরক্ষা পাবার জন্য। এর উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের চূড়ার নীলচক্রটি।            
নরকাসুরের মৃত্যুর পূর্বে তিনি মাতা সত্যভামাকে অনুরোধ করেন যে, সকলে যেন তাঁর মৃত্যু রঙিন আলোকোজ্জ্বলভাবে উদ্‌যাপন করেসেইজন্য এই দিনটি 'নরক চতুর্দশী' হিসেবে (দীপান্বিতার আগের দিনটি) পালন করা হয়। দক্ষিণ ভারতে এই প্রথা জনপ্রিয়। সনাতন ধর্মমতে কোজাগরী পূর্ণিমা পরবর্তী কৃষ্ণপক্ষ বা অন্ধকার পক্ষের চতুর্দ্দশী তিথি তে সক্রিয় হয়ে ওঠে সমস্ত ভূত, প্রেত ও অতৃপ্ত আত্মারাদিওয়ালি ও কালিপূজার আগের দিন সারা ভারতে, প্রতিবেশী দেশ নেপালে ও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস সেখানে এই তিথি নানা নামে পালিত হয়কোথাও কালি চতুর্দ্দশী’, কোথাও বা নরক চতুর্দ্দশীনামে পালিত হলেও বাংলায় এই দিন ভূতচতুর্দ্দশীনামে খ্যাত...কথিত যে এই দিন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, পত্নী সত্যভামা সহযোগে যুদ্ধ করে প্রাগ্‌জ্যোতিষের অধিপতি বরাহপূত্র দূরাচারী নরকাসুর কে বধ করেছিলেন সুদর্শন চক্র দ্বারামৃত্যুকালে নরকাসুরের অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ বর দেন যে এই দিন নরকাসুর বধের দিনহিসাবে মহা ধুমধামে পালিত হবে তাই দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের গোয়া তে আতসবাজি দ্বারা নির্মিত নরকাসুর এর বিশাল মূর্তি জ্বালিয়ে পালিত হয় নরক চতুর্দ্দশীএছাড়া তামিলনাড়ু, অন্যান্য রাজ্য ও প্রতিবেশী দেশ নেপালেও এই বিশেষ উৎসব পালন করেন সাধারণ মানুষ
নরকাসুর নামের এক দৈত্য বধের পর কৃষ্ণ ফিরে এসেছেন বোন সুভদ্রার কাছে। তখন তাকে কপালে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টি খেতে দেন সুভদ্রা। অনেকের মনে করেন, ভাই ফোঁটার শুরু এর মধ্য দিয়েই।  

### 

সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী 
০১৯১২০৭৮৫৯৩
 sajedurrahmanvp@gmail.com  

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান