পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৫.২ (রবীন্দ্রনাথের চোখে মহাবিপ্লবী )
পুণ্ড্রের
পাঁচালী-১৫.২ (রবীন্দ্রনাথের চোখে মহাবিপ্লবী )
সাজেদুর
রহমান
কাল পুরুষ শিশুপাল
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’ নামক এক নাতিদীর্ঘ
প্রবন্ধে ‘প্রাচীনকালের মহাবিপ্লবী’ হিসেবে একজনকে অবিহিত
করেছে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে লিখিয়াছিলেন, সমাজকে
মুক্তি দিতে দাঁড়াইয়া ছিলেন তিনি একদিন পাণ্ডবদের সাহায্যে জরাসন্ধকে বধ করেন।
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের চোখে এই মহাবিপ্লবীকে নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলতে চাই। আমার কাছে বিষয়টা এমন
মনে হয়েছে, হিটলার কিংবা মসেলিনকে যদি হাঙ্গেরি বা স্কটল্যান্ডের কোনো মনিষী হাজার
বছরের ব্যাবধানে ‘মহাবিপ্লবী’ বলে আখ্যা দেন তা হলে যেমনটা হবে। বিষয়টার ব্যাখ্যা
দেবার আগে শিশুপাল ও জরাসন্ধের কাহিনী বলে নেই।
মহাবলসালী শিশুপাল
এই
কাল পুরুষের নাম শিশুপাল। বৃষ্ণিবংশীয় চেদি দেশের রাজা। অসুররাজ্য
সীমান্তে ভবঘুরে বলা যায় তাকে। করতোয়া নদীর দু’পারে তার ঘোরাফেরা। নিজ রাজ্যেও
বেশিদিন থাকে না। গায়ের জোরে আর অস্ত্রের বিনিময়ে রজগার করে। বেশি পয়সা পায় 'মগধ'
এবং যার রাজা ছিলেন জরাসন্ধর কাছ থেকে। জরাসন্ধর সেনাপ্রধান হয়ে কাজ
করে সে। মাঝা মাঝা সে পুন্ড্রবর্ধনের রাজা পৌন্ড্রবাসুদেবের হয়ে কাজ করেছে। এখন
মথুরা শহরের দখল নেয়ার চেষ্টা করছে। কৃষ্ণ হত্যার চেষ্টা করেছে ২১ বার।
এখন
কুরুক্ষেতের ময়দানে কৈরবদের পক্ষে, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে। চেহারায় উত্তেজনার ছাপ।
ফ্যাকাসে লাগছে তাকে দেখতে।
‘মহারাজ
জরাসন্ধ দেখেছেন, শ্রীকৃষ্ণের কারবারটা। সে রাজা কংসকে হত্যা করেছে। আমার বাগদত্তা
রুক্সিকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। এমনভাবে চললে সে আমাদের কাউকে ভালো থাকতে
দেবে নে। শ্রীকৃষ্ণের বিষয়ে কিছু একটা করতেই হবে’। কথা গুলি বলল, জরাসন্ধের সেনাপ্রধান
শিশুপাল।
হিন্দু
পৌরাণিক কাহিনী মতে– শিশুপাল ছিলেন কৃষ্ণের প্রধান শত্রু। তাঁর পিতার নাম দমঘোষ ও মায়ের নাম
শ্রুতশ্রবা। বিষ্ণু পুরাণের মতে– পূর্ব জন্মে ইনি
হিরণ্যকশিপু ও রাবণরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সম্পর্কের দিক থেকে এই শিশুপাল ছিলেন
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিসতুতো ভাই। কৃষ্ণপিতা বসুদেবের বোন শ্রতস্রবার ছেলে ছিল
শিশুপাল।
শিশুপালের
তিনটি চক্ষু ও চারটি হাত নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় ইনি গাধার মত চীৎকার করতে
থাকলে সকলে একে পরিত্যাগ করেন। পরে দৈববাণী হয় যে, একে যেন ত্যাগ না করা হয়। কারণ
এঁর মৃত্যুকাল এখনো উপস্থিত হয় নি। তবে যাঁর হাতে নিহত হবেন তিনি জন্মগ্রহণ
করেছেন। পরে শিশুপালের মা দৈববাণীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করেন যে, এই শিশুর
হত্যাকারী কে হবেন। দৈববাণী হয়, যাঁর স্পর্শে এঁর দুটি হাত ও তৃতীয় চোখ খসে পড়বে, তাঁর
হাতে এর মৃত্যু হবে। এরপর এই শিশুকে বিভিন্ন রাজার কোলে তুলে দেওয়া হয় কিন্তু
তাতে শিশুপালের হাত ও চোখের কোন পরিবর্তন হয় নি। একবার কৃষ্ণ চেদিরাজের দরবারে
গিয়ে শিশুপালকে কোলে নিলে এঁর চার হাতের মধ্যে দুটি খসে পড়ে এবং তৃতীয় চোখ
মিলিয়ে যায়। এরপর শিশুপালের মা কৃষ্ণকেই তাঁর সন্তানের হত্যাকারী হিসাবে চিনতে
পেরে, কৃষ্ণকে অনুরোধ করেন যে, তিনি যেন শিশুপালের সকল অপরাধ ক্ষমা করেন। উত্তরে
কৃষ্ণ শিশুপালের ১০০টি অপরাধ ক্ষমা করবেন বলে অঙ্গীকার করেন।
শিশুপাল
বড় হয়ে জরাসন্ধের কাছে প্রতিপালিত হন। উভয় মিলে কৃষ্ণের বিরোধিতা শুরু করেন। ভোজ
দেশের রাজকন্যা রুক্মিণী'কে, জরাসন্ধ শিশুপালের জন্য দাবী করেন। ভীষ্মক
চেয়েছিল তাঁর মেয়ে রুক্মিণীকে নিজের অনুগত শিষ্য জরাসন্ধের সেনাপতি ‘শিশুপালে’র সাথে বিয়ে দিতে। রুক্মিণী'র ভাই রুক্মী শিশুপালের সাথে বিয়ের আয়োজন করেন। ভীষ্মকের ছেলে রুক্মী ছিল
শিশুপালের অন্ধ সমর্থক। কোন কোন মতে ভীষ্মক রুক্মিণীর জন্য স্বয়ংবর সভার আয়োজন
করেন। কিন্তু কৃষ্ণ রুক্মিণীর পিতা ভীষ্মকের কাছে উপস্থিত হয়ে নিজেই বিয়ের
প্রস্তাব করলে, ভীষ্মক তাতে অসম্মতি জানান।
এমনকি
রুক্মিনীর ভ্রাতাকে পরাজিত করে শ্রীকৃষ্ণ সুকৌশলে রুক্মিণীকে বিয়ের আগের দিন
বিদর্ভ থেকে হরণ করে দ্বারকায় নিয়ে যায় এবং সেখানে কৃষ্ণ রুক্মিণীকে বিয়ের করেন।
অপহরণের সময় জরাসন্ধ,
শিশুপালসহ অন্যান্য রাজারা তাঁকে বাধা দিলেও কৃষ্ণ তা শোনেনি।
এবার
রাজসূয় যজ্ঞ নিয়ে বলি। যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে রাজধানী স্থাপন করে রাজসূয় যজ্ঞের
আয়োজন করেন। যজ্ঞ শেষে রাজন্যবর্গের মধ্যে কাকে প্রথম অর্ঘ প্রদান করা যায় এমন
আলোচনা উঠলে, ভীষ্মের পরামর্শে কৃষ্ণকে প্রথম অর্ঘ দেওয়া হয়। ফলে শিশুপাল একে
অসমীচীন বিবেচনা করে কৃষ্ণের বিরোধিতা করেন। শিশুপাল তখন শ্রীকৃষ্ণকে চ্যালেঞ্জ
জানান, “শ্রদ্ধাপূর্বক আমাকে ক্ষমা করিতে ইচ্ছা হয় কর,
না হয় করিও না; ফলতঃ তুমি ক্রুদ্ধ হইলে আমার
কোন ক্ষতি নাই এবং প্রসন্ন হইলেও কোন লাভ নাই।” মহাভারত থেকে জানি, “রাজারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেও ভয়ে
কিছু বলতে পারলেন না।”
ক্ষত্রিয়রীতি
অনুযায়ী এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে দুরাত্মা শিশুপালকে শ্রীকৃষ্ণ বধ করেন। উল্লেখ্য
ইতোমধ্যে কৃষ্ণ শিশুপালের একশত অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন। সে কারণে, এবারের
এই বিরোধিতা করার অপরাধের জন্য কৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দ্বারা শিশুপালের শরীর থেকে
মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেন। শিশুপালের পুত্রকেই করা হল চেদীদেশের রাজা। এই বীর পুত্র,
ধৃষ্টকেতু, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ছিলেন
পাণ্ডবদের পক্ষেই।
জীবন যার বীরত্বময় আর যুদ্ধময়, আর্যদের পাল্লায় পড়ে সেই জীবন হয়ে উঠল, মানবতা বিরধি আর ধর্মাদ্রহি।
দুঃখ
শোক ভোগাভোগ ভাগ্যে সব করে।
দেশে
সাত বিভা দিব চল বাপু ঘরে॥
আর
না আসিব আমি বিদর্ভ নগরে॥
শিশুপাল
প্ৰবোধিয়া মহাবীর বলে।
রণভেরী
দামামা দগড় করতালে৷
এক
অক্ষৌহিণী বীর সেনা লয়্যা সাথে।
ধনুৰ্ব্বাণ
খড়গ চৰ্ম্ম লয়্যা চাপে রথে॥
(‘শিশুপাল বধ’ মাঘ) ভাগবত—কবিচন্দ্ৰ
মহাভারতে
চেদিরাজ শিশুপালের হত্যা ছিল শ্রীকৃষ্ণের নিজ হাতে হত্যার প্রথম ঘটনা। অবশ্য এর
আগে ও পরে অনেক হত্যালিলায় শ্রীকৃষ্ণের অংশগ্রহণ ছিল।
মহাপরাক্রমশালী
মগধরাজ জরাসন্ধ
উত্তর-পূর্ব
ভারতের সম্পদ-সমৃদ্ধ দেশগুলকে গ্রাস করতে চলেছে আর্যরা। প্রস্তুতির কাজ শেষ। এমন
সময় যুধিষ্ঠি ঠিক করেছেন এক রাজসুয় যজ্ঞ করারা। কিন্তু কৃষ্ণ এসে বললেন, যতদিন
জরাসন্ধ জীবিত আছে ততদিন আপনার পক্ষে রাজসূয় যজ্ঞ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেননা
বর্তমানে সমস্ত রাজারাই জরাসন্ধের পক্ষে আছেন। নেহাত আপনার মামা পুরুজিত আপনার
পক্ষে আছেন, আর জরাসন্ধের বিরোধ করে এই রাজসূয় যজ্ঞ করা
সম্ভব হবে না।
যুধিষ্ঠির
ভাবলেন তাহলে সব কাজ বৃথাই যাবে কেননা রাজসূয় যজ্ঞ না করলে তিনি রাজাদের মধ্যে
শ্রেষ্ঠ হতে পারছেন না। কি করবেন ভাবছেন, তখন কৃষ্ণই আবার বললেন, তাতে
চিন্তার কি আছে। জরাসন্ধ কে আক্রমণ করে মেরে ফেললেই হয়। অবশ্যি মহাদেবের বরে
জরাসন্ধ ছিয়াশী জন রাজাকে বন্দী করে তার রাজধানীতে আটকে রেখেছে। আর চোদ্দজন রাজাকে
পেলেই এই একশো রাজাকে বলি দিয়ে সে মহাপরাক্রমশালী হয়ে যাবে। কাজেই যদি জরাসন্ধকে
হারাতে হয় তবে এই রাজাদের মুক্তি দিলে তারাও আপনার হয়ে লড়বেন এবং জরাসন্ধ কে আপনি
সহজেই হারাতে পারবেন।
যুধিষ্ঠির
পরলেন দ্বিধায়। একদিকে রাজসূয় যজ্ঞের ইচ্ছে আর অন্য দিকে ভাই ভীম আর অর্জুনকে হারানোর ভয়। অর্জুন এবং ভীম তো মনে
মনে খুসী এইবার চান্স পাওয়া গেছে কিছু একটা করে দেখানোর। বলে দাদা চিন্তার কি আছে।
এই যাব,
মারব আর ফিরে আসব। আর যদি ভয় পেয়ে থাক তবে রাজ্য ছেড়ে বনে গিয়ে
থাকলেই হয়। রাজা হয়ে থাকতে গেলে যুদ্ধ ইত্যাদি করতেই হবে।
কৃষ্ণ
বলেন, যে জরাসন্ধ তার শক্তি সম্বন্ধে খুব গর্বিত। তাঁকে সন্মুখ যুদ্ধে হারানো
অসম্ভব। তাই কৌশল করতে হবে। আমরা তার প্রাসাদে ছদ্মবেশে গিয়ে আর সুযোগ বুঝে তাঁকে
মল্লযুদ্ধে হারিয়ে দিতে পারি। তার শক্তি তাঁকে গর্বিত করেছে তাই সে আমাদের মধ্যে
ভীমকেই বেছে নেবে লড়াই করবার জন্য। আর ভীম স্বচ্ছন্দে তাঁকে বধ করতে পারবে।
তাই
হল। কৃষ্ণ কে নিয়ে অর্জুন আর ভীম সাধারণ বেশে বেড়িয়ে পরল জরাসন্ধের প্রাসাদে যাবার
জন্য। হস্তিনাপুর থেকে মগধ কি একটু খানি রাস্তা। তার উপর নিজের রথ নিয়েও বেরোয়নি।
ছদ্মবেশে তাই যা পাওয়া যায় তাই ব্যবহার করতে হবে। তাই লোকেদের কাছ থেকে সাহায্য
নিয়ে ব্রাহ্মণের বেশ ধরে যাত্রা শুরু হল।
বেশ
কয়েক দিন বাদে তারা গিরিব্রজ শহরে এসে উপস্থিত হলেন। এই গিরিব্রজ শহরেই হচ্ছে
জরাসন্ধের রাজধানী। পাশেই চৈত্যক পাহাড়, যেখানে জয়দ্রথ এক ষন্ডবেশী
রাক্ষসকে মেরে তার দেহাবশেষ দিয়ে তিনটি ভেরী বানিয়ে টানিয়ে রেখেছিলেন। অর্জুন আর
ভীম তাদের আগমন জানানোর জন্য চৈত্যক পাহাড়ের একটা শৃঙ্গ ভেঙ্গে দিলেন সাথে ঐ তিনটি
ভেরীও ভেঙ্গে দেওয়া হল।
তার
পর রাস্তায় এক মালাকারের দোকান থেকে মালা জবরদস্তি নিয়ে গলাতে ঝুলিয়ে রাজার দরবারে
এসে উপস্থিত। জরাসন্ধ তখন পুজাতে বের হচ্ছিলেন। ব্রাহ্মণ বেশে এই তিন জনকে দেখে
তাদের সাধারন ব্রাহ্মণ ভেবে বলেন- আসুন বসুন এই নিন কিছু ফলমূল। আর বলুন আপনারা কে
বা কেন এসেছেন।
জরাসন্ধের
খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। এরা যে তিনজন ছদ্মবেশী তা বুঝে ফেলে বললেন - মহাশয়েরা
আপনারা তো ব্রাহ্মণ নন,
কারণ আপনাদের দেহে যদিও ব্রাহ্মণদের মত মালা চন্দন ইত্যদি লেপন করা
হয়েছে, তবুও আপনাদের দেহের ক্ষতের দাগ বলে দিচ্ছে যে আপনারা
ব্রাহ্মণ হতে পারেন না।
তখম
কৃষ্ণ বলেন,
জরাসন্ধ তুমি ঠিক ধরেছ, আমরা ব্রাহ্মন নই,
আমি যাদবকূলের কৃষ্ণ আর ইনি গান্ডীবধারী অর্জুন, আর ওপাশে আছেন বৃকোদর ভীম। তুমি বিভিন্ন রাজাদের আটক করে মহাদেবের সামনে
বলি দেবে বলে মনস্থ করেছ তাই তোমাকে আমরা শাস্তি দেবার জন্য এসেছি। ভাল চাও তো ঐ
রাজাদের সসন্মানে মুক্তি দাও আর তাদের রাজত্বও ফেরত দাও।
জরাসন্ধ
বলে, আমি তাদের ধরে এনেছি রুদ্র দেবতার সামনে বলি দেব বলে, তারা বলি প্রদত্ত হবার জন্য মানত করা, এদের ছেড়ে
দিলে আমি দেব কোপে পড়ব। কৃষ্ণ বলেন, তাহলে তোমাকে আমরা
যুদ্ধে আহ্বান করছি। জরাসন্ধ বলে তাই হবে। কিন্তু আপনারা যুদ্ধ কি ভাবে করতে চান।
কৃষ্ণ বলে তোমার যা ইচ্ছে। আমাদের তিনজনের
একত্রে, বা প্রত্যেকে একা বা তোমার পছন্দ মত কারুর সাথে। সব
তুমি যে ভাবে চাও, কেননা তোমাকে তো আমরা মেরেই ফিরব।
জরাসন্ধের
রাগ মাথায় উঠল। সে বলে দিল ঐ মোটাটার সাথেই আমি মল্লযুদ্ধ করব। তোরা তো সব ফড়িঙের
মত। ভীম ক্ষেপে বলে -চলে আয়। ঠিক হল যে পরের দিন সকালে লড়াই শুরু হবে।
পরের
দিন সকাল বেলায় মল্লভূমিতে রাজধানীর লোকেরা হাজির। সবাই ভাবছে মরল এবার কটা
ব্রাহ্মণ,
রাজামশাইর সাথে লড়াই। কিন্তু যুচ্ছ চলতে চলতেই যা একটু উপচার সম্ভব
তাই করতে হবে, যুদ্ধ থামবে না।
ঘন্টা
বাজিয়ে স্তোত্র উচ্চারণ করে কার্তিক মাসের পয়লা তারিখে সকালে মল্লযুদ্ধ শুরু হল।
কৃষ্ণ আর অর্জুন মাঠের ধারে বসে দেখছেন। রাত হল, আবার দিন, আবার রাত, লড়াই চলছে তো চলছেই। দেখতে দেখতে চোদ্দ
দিন পেরিয়ে যাবার পরে জরাসন্ধ একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে দেখে কৃষ্ণ বললেন- হে বৃকোদর,
ক্লান্ত শত্রুকে বিশেষ জোরে আঘাত করতে নেই, তুমি
জরাসন্ধের দুপা ধরে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দাও। কিন্তু দেখালেন দু হাতে দুটো আলাদা পা
ধরে একটু ফাঁক করে।
ভীম
ইঙ্গিত বুঝলেন আর জরাসন্ধের দুটো পা ধরে টেনে তাঁকে দু আধখানা করে ছুড়ে ফেলে
দিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার, আবার সেই দুটি টুকরো একসাথে হয়ে এসে লড়াই
করতে লাগলো। এবার কৃষ্ণ একটা কাঠিকে লম্বালম্বী দু টুকরো করে ডান দিকের টুকরোটাকে
বা দিকে আর বা হাতেরটাকে ডান দিকে ছুড়ে ফেললেন। সেই অনুযায়ী ভীম জরাসন্ধের
সন্ধিবিচ্ছেদ করে দুটা টুকরো দুই আলাদা দিকে দুরে ফেলে দিলেন। আর বিচ্ছেদের পরে
টুকরোরা তাদের নিজস্ব জায়গা না পেয়ে জোড়া লাগতে পারল না। জরাসন্ধ মারা গেল।
রাতেই
গিয়ে অর্জুনের পার্টী ঐ ছিয়াশিজন রাজাকে
মুক্তি দিয়ে দিল। কিন্তু মগধে রাজা কে হবে, জরাসন্ধের ছেলে সহদেবকে
সিংহাসনে বসিয়ে অর্জুন আর ভীম কৃষ্ণের সাথে যুধিষ্ঠিরের কাছে ফেরত এলেন। আর রাজসূয়
যজ্ঞ করতে কোন বাধা থাকল না।
প্রাগৈতিহাসিক
যুগের বৃহৎ বঙ্গের প্রধান পুরুষ জরাসন্ধ। মহাভারত, হরিবংশ প্রভৃতি পুরাণে
এই অদ্বিতীয় বীরের কাহিনী বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ আছে। ভারতবর্ষে এমন কোনও নৃপতি নেই
যিনি জরাসন্ধের পরাক্রম ও সমৃদ্ধিকে সমঝে চলেননা। উত্তরপশ্চিম ভারতের কুটিল
রাজনৈতিক ছক বিনষ্ট করে দেবার শক্তি যদি কারোর থাকে তবে পূর্বভারতের এই রাজা,
যাকে বাকী ভারত সম্মান করে। খাতির করে।
কুরু
বংশীয় বসু,
যদু বংশের চেদী রাজ্য জয় করে সেখানে শাসন করতে থাকেন। তাঁর
জ্যেষ্ঠপুত্র বৃহদ্রথ মগধের রাজগিরিতে রাজধানী স্থাপন করেন। বৃহদ্রথের পুত্র
জরাসন্ধ তাঁর ক্ষমতা উত্তরে মথুরা ও দক্ষিণে বিদর্ভ পর্যন্ত বিস্তার করতে সক্ষম
হন। উল্লেখ যে মথুরার অন্ধক রাজ কংশ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন।
বাংলার
ইতিহাস জানার মূল উৎস হল মহাভারত, রামায়ন এবং সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে
চর্যাপদ। বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে মগধ শাসনামল থেকে বাংলার রাজাদের নাম পরিচয় পাওয়া
যায়। সে হিসেবে মগধদের প্রথম রাজা আবার আরেক কথায় বাংলার প্রথম রাজা হিসেবে
বৃহদ্রথই সম্মানটা পান। তারপরেই সিংহাসনে বসেন জরাসন্ধ। কিন্তু
জরাসন্ধ ঠিক কবে সিংহাসনে বসেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না। আবার এদিক দিয়ে মগধ
শাসনামল শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ সালের দিকে, এবং শেষ হয়েছিল
খ্রিস্টপূর্ব ৭৯৯ সালে। বাংলার ইতিহাসে তারাই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসন করেছিল।
তারপরে আসে প্রাদ্যত বংশ।
মহাভারতের
দ্বিতীয় পর্বে
(শ্লোক পর্বাধ্যায় ৪৩) কৃষ্ণের শত্রু পুণ্ড্রক
বাসুদেবকে (জরাসন্ধের বন্ধু) বঙ্গ,
পুণ্ড্র ও কিরাতদের রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (২।১৪)
জরাসন্ধের
জন্ম ইতিহাস নিয়ে অদ্ভুত গল্প আছে। গঙ্গার তীরে এক রাজ্য ছিল নাম ছিল তার মগধ। এই
রাজ্যের রাজার নাম ছিল বৃহদ্রথ। মুনি সন্ন্যাসীর নাম চন্ডকৌশিক। তিনি নানান
রকম মন্ত্র পরে একটা আম বৃহদ্রথকে দিয়ে বললেন এটা তোমার স্ত্রীকে খাইয়ে দিলে তার
এক পুত্র হবে। রাজা প্রাসাদে ফিরেই পড়লেন বিপদে। আম পেলেন একটা আর স্ত্রী আছে
দুটো। অনেকক্ষণ ভাবার পরে আমটিকে লম্বালম্বি দুটুকরো করে দুই রাণীকে খেতে দিলেন।
রানীরা তো আমের টুকরো খেলেন। যথা নিয়মে তারা মা হলেন। দুজনেই একসাথে ছেলের মা
হলেন। কিন্তু কি বিপদ। রাজা আমটাকে দুটুকরো করে আধখানা করে খাইয়েছিলেন তাই ছেলেও
আধখানা করে হল। রাজার প্রাসাদে এক রাক্ষসী থাকত (এখানে রাক্ষসী মানে কোন বৈদ্য বা
সার্জন মেনে নিতে হবে)। নাম ছিল তার জরা। জরা বাচ্চাটাকে জুড়ে দিয়েছিল বলে তার নাম রাখা
হল জরা+সন্ধ (সন্ধি থেকে) বা জরাসন্ধ। জরাসন্ধের যৌবন প্রাপ্তির পরে পিতা বৃহদ্রথ
তখনকার প্রথা অনুযায়ী তার দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনবাসে গেলেন। আর যাবার আগে জরাসন্ধ
কে সিংহাসনে বসিয়ে গেলেন। গিরিব্রজ শহরেই হচ্ছে জরাসন্ধের রাজধানী। প্রজাহিতৈষী জরাসন্ধ
ছিল ক্ষত্রিয় বিরোধী।
জরাসন্ধ
ছিলো চক্রবর্তী সম্রাট,
যার ছিলো ২০ অক্ষৌহিনী সেনা, যা কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধে আর সব সমস্ত সৈন্যের চেয়ে বেশি। এখানে বলে রাখি, কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধে ছিলো মোট ১৮ অক্ষৌহিনী সেনা। শক্তিশালী জরাসন্ধ তার শক্তি আরও বৃদ্ধি করতে
লাগল। একে একে নরকাসুর, পুন্ড্র বাসুদেব, ছেদি রাজা শিশুপাল, শুভা রাজা শল্ব আর বিশ্বমক তার সাথী হলেন। এই সময় বনাসুরের
পরামর্শ অনুযায়ী জরাসন্ধ তার দুই মেয়ে অস্তি আর প্রাপ্তি কে মথুরার নরপতি কংসের
সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
কংসকে
হত্যা করায়,
কংসের শ্বশুর জরাসন্ধের সাথে কৃষ্ণের সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। জরাসন্ধের
সৈন্য বলের কাছে মথুরার সৈন্যবল ছিলো নিতান্তই শিশু, তারপরও
জরাসন্ধ যখনই মথুরা আক্রমন করেছে, কৃষ্ণ তার শক্তি, বুদ্ধি ও কৌশলের দ্বারা জরাসন্ধকে হতাশ করে মথুরা ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।
কিন্তু জরাসন্ধের আক্রমনের ফলে প্রতিবারই মথুরার সৈন্য ক্ষয় হচ্ছিলো, এই অযথা মৃত্যু ঠেকাতে, শ্রীকৃষ্ণ, রাজধানীকে মথুরা থেকে তিন দিক জল দিয়ে ঘেরা দ্বারকায় স্থানান্তরিত করে,
ফলে সেখানে আক্রমন করে আর কোনো ফল হবে না বিবেচনা ক’রে, জরাসন্ধ, দ্বারকা আক্রমন
থেকে বিরত থাকে; কারণ, চতুর্দিকের
আক্রমন ঠেকানোর চেয়ে একদিকের আক্রমন ঠেকানো সহজ।
কংসের
দুই স্ত্রী ছিলেন জরাসন্ধের দুই কন্যা অস্তি ও প্রাপ্তি। শ্রীকৃষ্ণ কংসকে হত্যা
করার পর জরাসন্ধ পর পর একুশ বার মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু রণ কৌশলের কারণে, মথুরা
দখল করতে সক্ষম হন নি। বারবার আক্রমণে অতীষ্ট হয়ে কৃষ্ণ দ্বারকায় যাদবদের পুরী
নির্মাণ করতে আদেশ দেন। কিন্তু যাদবরা দ্বারকায় যাবার আগেই জরাসন্ধ আবার মথুরা
আক্রমণ করেন। এবার সঙ্গী ছিল কালযবন নামক এক কৃষ্ণ বিদ্বেষী রাজা। শ্রীকৃষ্ণ এবার
কালযবনকে হত্যা করার জন্য একটি কৌশলের আশ্রয় নিলেন। ইনি কালযবনকে কৌশলে দেখা দিলে,
কালযবন শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য তাঁকে অনুসরণ করতে থাকে।
শ্রীকৃষ্ণ পলায়নের ভান করে দূরবর্তী এক পাহাড়ের গুহায় প্রবেশ করে। এই গুহায়
মুচুকুন্দ নামক এক ঋষি ঘুমিয়ে ছিলেন। কালযবন শ্রীকৃষ্ণের অনুসরণ করে উক্ত গুহায়
প্রবেশ করে এবং অন্ধকারে মুচুকুন্দকে শ্রীকৃষ্ণ মনে করে পদাঘাত করে। মুচুকুন্দ ঘুম
ভেঙে কালযবনের দিকে দৃষ্টিপাত করা মাত্র- কালযবন ভষ্মীভূত হয়ে যায়। এরপর জরাসন্ধ
নিজেই আক্রমণ করতে এলে, জরাসন্ধের হংস নামক একজন অনুচর
বলরামের হাতে নিহত হন। হংসের ভাই ডিম্বক এই দুঃখে যমুনা নদীতে আত্মহত্যা করেন। এই
দুই বীরের মৃত্যুর পর জরাসন্ধ দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিজ রাজত্বে ফিরে যান।
এই বাস্থবতায় একটি বিষয় এখানে স্পষ্ট যে, “মহাভারতে কুরু-পাণ্ডবের জ্ঞাতি-রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগে এতদিন ধরে
মগধরাজ জরাসন্ধকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিল, শ্রীকৃষ্ণ তার নিয়ন্ত্রণ নিতেই জরাসন্ধকে শেষ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের মতের
বিরুদ্ধ মত
ক)
১৯১২ সালে প্রকাশিত ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’ নামক এক নাতিদীর্ঘ
প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিয়াছিলেন, ‘প্রাচীনকালের এই
মহাবিপ্লবের আর যে একজন প্রধান নেতা শ্রীকৃষ্ণ কর্মকাণ্ডের নিরর্থকতা হইতে সমাজকে
মুক্তি দিতে দাঁড়াইয়া ছিলেন তিনি একদিন পাণ্ডবদের সাহায্যে জরাসন্ধকে বধ করেন। সেই
জরাসন্ধ রাজা তখনকার ক্ষত্রিয়দলের শত্রুপক্ষ ছিলেন। তিনি বিস্তর ক্ষত্রিয় রাজাকে
বন্দী ও পীড়িত করিয়াছিলেন। ভীমার্জুনকে লইয়া শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁহার পুরমধ্যে প্রবেশ
করিলেন তখন তাঁহাদিগকে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধরিতে হইয়াছিল। এই ব্রাহ্মণ-পক্ষপাতী
ক্ষত্রবিদ্বেষী রাজাকে শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের দ্বারা যে বধ করাইয়াছিলেন এটা একটা
খাপছাড়া ঘটনামাত্র নহে। শ্রীকৃষ্ণকে লইয়া তখন দুই দল হইয়াছিল। সেই দুই দলকে সমাজের
মধ্যে এক করিবার চেষ্টায় যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করিয়াছিলেন তখন শিশুপাল
বিরুদ্ধ দলের মুখপাত্র হইয়া শ্রীকৃষ্ণকে অপমান করেন। এই যজ্ঞে সমস্ত ব্রাহ্মণ ও
ক্ষত্রিয়, সমস্ত আচার্য ও রাজার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকেই
সর্বপ্রধান বলিয়া অর্ঘ্য দেওয়া হইয়াছিল।’ (ঠাকুর ১৩৯৫:
২৬-২৭)
দীনেশচন্দ্র
সেন জরাসন্ধ বধ প্রসঙ্গে সরাসরি বলেছেন, ‘অবশ্য ভীমার্জ্জুনের
সাহায্যে ছলনা করিয়া কৃষ্ণ জরাসন্ধকে বধ করিয়াছিলেন, তাঁহারা
কপট স্নাতকবেশে যাইয়া জরাসন্ধকে আক্রমণ করেন। তাঁহার মৃত্যুতে মগধের দীপ্তি
কতকদিনের জন্য নিবিয়া গিয়াছিল।’ (সেন ২০০৩: ২৮) তিনি
লিখিয়াছেন, ‘কৃষ্ণ মগধরাজের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ উপস্থিত
করিয়াছিলেন, জরাসন্ধ তাহাদের সকলগুলিই [নিরসন] করিয়াছিলেন।
তাঁহার বিরুদ্ধে সর্ব্বপ্রধান অভিযোগ—যাহা আমরাও প্রতিবাদ
করিতে দ্বিধাবোধ করি—তাহা তাঁহার মহাদেব মন্দিরে একশত রাজাকে
বলি দেওয়ার সংকল্প।’ দীনেশচন্দ্র সেন লিখিতেছেন, ‘এই নিষ্ঠুর ও বর্ব্বরজনোচিত ব্যবহার সমর্থন করা যায় না। কিন্তু জরাসন্ধ এই
অভিযোগের উত্তরে কি বলিয়াছিলেন, তাহা প্রণিধানযোগ্য—‘হে কৃষ্ণ। আমি কোন রাজাকেই জয় না করিয়া আনয়ন করি নাই। বিক্রম প্রকাশপূর্ব্বক
লোককে আপনার বশে আনিয়া তাহার প্রতি স্বেচ্ছানুসারে ব্যবহার করাই ক্ষত্রিয়ের
ধর্ম্ম।’ (সেন ২০০৬: ৪৩) দীনেশচন্দ্রের মতে, ‘কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় আমাদের বৃহৎ বঙ্গ পরাক্রান্ত রাজগণের নিবাসস্থল
এবং শ্রেষ্ঠ আর্য্যভূমিরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল। অবশ্য বঙ্গদেশের পূর্ব্ব-সীমান্তের
রাজগণের প্রসঙ্গে যদিও কিরাত, চীন ও যবন সৈন্যের উল্লেখ
দৃষ্ট হয়, তথাপি তাঁহাদের সঙ্গে সমস্ত আর্য্যাবর্ত্তময়
বৈবাহিক আত্মীয়তা ছিল তাহা প্রমাণিত হইতে পারে।’ (সেন ২০০৬:
৩০) দীনেশচন্দ্র সেন দেখায়েছেন, সেদিন এই বৃহৎ বঙ্গের কেউ
কেউ সার্ব্বভৌম সম্রাট ছিলেন। সেই সময় ‘ব্রাহ্মণেরা কৃষ্ণকে
কেন্দ্রস্থানীয় করিয়া উত্তর-পশ্চিমে যে নূতন হিন্দুসমাজ গঠন করিতেছিলেন—পূর্ব্বদেশের সার্ব্বভৌম রাজারা তার ঘোরতর বিরুদ্ধতা করেছিলেন।
খ)
আমরা সকলেই জানি যে,
“শান্তিস্থাপন ও ধর্মরাজ্য সংস্থাপন”- এই দুই
কাজ করতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। যুদ্ধমত্ত অধার্মিক শক্তিকে ধ্বংস করে
নতুনভাবে যুধিষ্ঠিরের মত শান্তিকামী ও ধার্মিক রাজাকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আর সেজন্যই, রাজসূয় যজ্ঞের মাধ্যমে
অধার্মিক জরাসন্ধকে বধ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরের হাতে। এটাই ছিল
ধর্মরাজ্য প্রবর্তনের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রথম প্রয়াস।
গ)
জরাসন্ধের সৈন্যবাহিনী ছিল বিশাল, কাজেই সম্মুখ যুদ্ধে জরাসন্ধকে হারানো
কঠিন। জরাসন্ধকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করা অসম্ভব তাই সুচতুর শ্রীকৃষ্ণ কৌশলের আশ্রয় নেয়।
ঘ)
কৃষ্ণ বলতেই আমাদের কাছে বাঁশি হাতে রোমিও pattern এর এক নারী লোলুপ
মানুষের ছবি ভেসে আসে। তিনি রাধাকে প্রেমে নিঃস্ব করে মথুরা চলে গেলেন চিরকালের
মতন।
ঙ)
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর রচিত কৃষ্ণচরিত্র প্রবন্ধে শ্রীকৃষ্ণের বহুবিবাহের
ভিত্তিহীন তথ্য সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ দেওয়া আছে৷ কৃষ্ণচরিত্রে দেখা যায় যে, কৃষ্ণের
১৬০০০ অধিক পত্নী শুধু পুরাণের একটি অংশে সীমাবদ্ধ৷
বঙ্কিম
যাকে মহাভারতের প্রথম স্তরের কবি বলেন, তিনি কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বে
বিশ্বাস করিতেন না, এ কথা বঙ্কিম স্বীকার করিয়াছেন। এমন-কি,
এই তথ্যটি তাঁহার মতে প্রথম স্তর নির্ণয় করিবার একটি প্রধান উপায়।
সেই
কারণেই বলছিলাম,
প্রথম স্তরের মহাভারতকার কবি যদি কৃষ্ণকে দেবতা বলে মানতেন না এটা সত্য
হয়, তবে তিনি যে তাকে নীতিশিক্ষার অখণ্ড উদাহরণ-স্বরূপ গড়েছিলেন
তা আমাদের কাছে সম্ভবপর বোধ হয় না।
চ)
বৈদিক যুগে ঋগ্বেদের ভাষা কাদের ভাষা বা কোন অঞ্চলের সঙ্গে সাযুজ্য, তার
উপর একটু আলোকপাত প্রয়োজন। প্রথমত ভাষাবিজ্ঞান বিচারে ঋগবেদের সঙ্গে ইরানীয়
ধর্মগ্রন্থ "আবেস্তা"র বেশ আত্মীয়তার সম্পর্ক। অর্থাৎ ইন্দো-
ইরানীয়(আর্য) এবং যাদের ধর্ম গ্রন্থে গৃহপালিত এবং ঘোড়ায় টানা রথের উল্লেখ পাওয়া
যায়। যেখানে অশ্ব এক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত এবং এই খুরের চিহ্ন ধরেই, উত্তর পশ্চিমের খ্রিস্টপূর্ব
১৮০০-১৪০০ সোয়াটের ঘালিঘাই এবং উত্তর- পূর্ব বেলুচিস্তানে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০-১৪০০
এবং তৃতীয় দশায় খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০-৮০০ সিন্ধুনদের পশ্চিমে উপস্থিত হয়ে সেই অঞ্চল
থেকে এই ভারতভূমির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল।
কে
না বলতে পারে এই ছড়িয়ে পড়া এবং ছড়িয়ে পড়তে গেলে অধিকার করা– এরই
মূল কারণ ছিল 'মহাভারতের যুদ্ধ' (কেবল
এটিই একমাত্র নয়)। কারণ এর আগেও উত্তর পশ্চিমে নগর সভ্যতা ছাড়াও পূর্বে এবং
দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে একেবারে সম্পর্কহীন না হলেও এক ধরনের যোগাযোগ ছিল।
আর
জরাসন্ধের জন্মবৃত্তান্ত থেকে জানা যায় কোন এক রাক্ষসি(জরা) তাঁকে জন্মকালীন
বিকলাঙ্গতা থেকে মুক্ত করেছিলেন। তাহলে অনুমেয় রাক্ষসদের সঙ্গে এদের সু-সম্পর্কই
ছিল। তাহলে রাক্ষস সহ এই ত্রয়ীকে নিকেশ করতে না পারলে ভারতবর্ষ আর্যাবর্ত হবে কি
করে! অন্যদিকে মুনিঋষিরাও অরণ্যচারী (বেদ থেকেই জানা যায়)।
দ্রাবিড়দের
মাললিয়ার (রাজা) ও বাল্লাল (অধীনস্থ রাজা) নিয়ে গড়া রাজনৈতিক এবং মল্লুর (উপরের
শ্রেনি) ও বেলাইবাল্লার (খেটে খাওয়া শ্রেনি) নিয়ে গড়া সামাজিক কাঠামোর [শরৎচন্দ্র
রায় ১৩৪৫ বাং] ভিতর উভয় মানব গোষ্ঠির লোকদের জন্য শান্তিতে সহ-অবস্থান ও সমঝোতার
সুযোগ ছিল। এটা যদি সঠিক হয়, তাহলে বংগ ও মগধ নামের আলাদা বুনিয়াদের
একটা বড় রকমের তাৎপর্য্যরে কথা মানতে হয়। বংগের মত মগধ নামটা স্বনির্বাচিত নয়।
পশ্চিমের বৈদিক মানব গোষ্ঠি সদানীরা নদীর পূবের অপরিচিত অঞ্চলের বনিক ও গায়কদের
মগধ বলে ডাকতেন। এর থেকে আস্তে আস্তে দক্ষিন বিহারের মগধ নামের প্রচলন ও পরিচিতি।
[D.D. Kosambi 1991: 122; নীহাররঞ্জন
রায় ১৯৯৩: ৫৬৭] বংগের ব্যাপারে এদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্ধারিত জন্মগত
বন্ধনের ঐক্য তথা সংস্কৃতে জাতি বলতে যা বুঝায় তার গুরুত্ব ছিল না।
ছ)
এই জরাসন্ধের সাথে,
কৃষ্ণ বিরোধিতায় যুক্ত হয়েছিলো কাল যবন নামে এক রাজা, এই দুজনেরই দৈহিক শক্তি ছিলো যেমন অতুলনীয়, তেমনই
কোনো সাধারণ অস্ত্রেও এদের মৃত্যু হতো না, তাই এদের হাত থেকে
রাজ্যবাসীকে বাঁচাতে কৃষ্ণকে ঐ পথ অবলম্বন করতে হয়েছিলো।
দ্বারকায়
রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পর, অর্থাৎ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর,
উগ্রসেন নামে মাত্র রাজা হলেও কৃষ্ণই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি। এই
কৃষ্ণের কাছ থেকে স্যামন্তক মণি লুকানোর জন্য পুরাণ রচয়িতারা সত্রাজিৎকে দিয়ে যা
করিয়েছে, তা এক হাস্যকর ব্যাপার। কারণ, কৃষ্ণ যদি মণি চায়, তাহলে কৃষ্ণকে তা দিতেই হবে,
এই ভয়ে সত্রাজিৎ সেই মনি তার ভাই প্রসেনকে দিয়ে দেয়। প্রসেন কি এমন
মহারথি ছিলো বা প্রসেনের কি এমন ক্ষমতা ছিলো যে, কৃষ্ণ চাইলে
সে তাকে মণি না দিয়ে তা নিজের কাছে রক্ষা করতে পারতো? দ্বারকায়
যেখানে কৃষ্ণের ইচ্ছাই আইন, সেখানে এই প্রসেনের কথা বা
ইচ্ছার মূল্য কী? আর যে কৃষ্ণ, রাজা
হওয়ার সুযোগ পেয়েও মথুরা বা দ্বারকায় রাজা হয় নি, সেই কৃষ্ণ,
সামান্য এক মণির লোভ সামলাতে পারবে না, এটা
সত্রাজিৎকে দিয়ে পুরাণ রচয়িতারা ভাবাতে পারলো কিভাবে বা পুরাণ রচয়িতারাই ভাবলো
কিভাবে?###
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
Comments