পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৬ (বাঙালির বীরত্ব গাঁথা-চতুর্থ পর্ব )
পুণ্ড্রের
পাঁচালী-১৬ (বাঙালির বীরত্ব গাঁথা-চতুর্থ পর্ব )
সাজেদুর
রহমান
বাসুদেব-
এই নামটি ঐতিহাসিক কাল থেকে নানা ভাবে এসেছে। মহাভারতে পৌণ্ড্রক রাজ বাসুদেব এবং
অবতার শ্রীকৃষ্ণের অন্য নাম হিসেবে এসেছে। মহাভারতে ভীমের সঙ্গে বঙ্গের রাজা
বাসুদেবের লড়াই বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোন সুত্রে (এখানে সাহিত্য) মাধ্যমে পাই।
প্রাচীন কালের এই বঙ্গবীর নিয়ে এবারে পর্ব।
এছাড়াও
বাসুদেব নামে ইতিহাসে আর যেসব চরিত্র পেয়েছি তারও সংক্ষিপ্ত আলচনা করবও। যেমন- হরিবংশ পুরাণ অনুসারে বসুদেব ও নন্দ (কৃষ্ণের পালক পিতা) ছিলেন
দুই ভাই। অথিবা নায়ারদের আদিপুরুষ; শেষ কুষাণ সম্রাট বাসুদেব, জৈনদের
নিজস্ব ধর্মীয় ইতিহাসে, শ্রীকৃষ্ণের অপর নাম ছিল বাসুদেব ছারাও পরব্রহ্মের অবতার
হিসেবে বাসুদেবের নাম পাই। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কয়েকজন বাসুদেব্র কথা জানতে
পারি।
মহাভারতের
অন্য জায়গায় আছে বঙ্গ ও কলিঙ্গ রাজ্যের রাজারা পুণ্ড্রের পুণ্ড্রক বাসুদেবের
সঙ্গে দ্র্পদির স্বয়ম্বর সভায়
উপস্থিত ছিলেন। আমরা সেই বাসুদেবের কথা দিয়ে শুরু করতে চাই। এই বাসুদেবকে দেখি
সাংখ দর্শনের প্রবর্তক কপিল মুনির পিতা এবং বড় ভাই বাসুদেব। তো কপিলের পিতা
বাসুদেব হিসেবেই গল্পটা শুরু করি।
পুন্ড্রক বাসুদেব
ঠাস
ঠাস করে ঘুমন্ত ছেলেকে চড় মারল বাসুদেব। কথাটা কানে ঢোকা মাত্রই মাথা ঝিমঝিমিয়ে
উঠেছিল, বুকের ভেতর দম আটকানো ভাব এবং শক্তি জড়ো হয়েছিল হাতের কবজিতে। বাসুদেবের খেয়াল ছিল না তার এই পুত্র
সাধারণ নয়, সে টলছিল রাগে এবং ঘেন্নায়।
আচমকা
আঘাতে খেয়ে ধরমড়িয়ে উঠল কপিল। বিস্ময় এবং ক্রধ একই সঙ্গে তার চোখে মুখে ফুটে
উঠেছে। তারপরই একটু ভয়ের ছাপ পড়ল সেখানে, গালে হাত রেখে পাথরের মত বসে রইল সে।
প্রচণ্ড জ্বলুনি শুরু হয়েছে গালে। বাসুদেব চাপা গলায় বলল, ‘বল, আবার বল কথাটা!
কপিল
আধাভাঙ্গা স্বরে বলল, কি কথা?
‘যে
কথা একটু আগে বলেছিস-!’
এইবার
হকচকিয়ে গেল কপিল। ঠিক কি কোথাটা মুখ থেকে বেড়িয়েছে সে মনে করতে পারছিল না। অন্যায়
কিছু বলে ফেলেছে নাকি! নিশ্চয়ই, তা নইলে বাবা তাকে মারতে যাবে কেন? সে খুব নিরীহ
গলায় বলল, সত্য বলছি, কি বলেছি মনে পড়ছে না’।
বাসুদেবের
চোখে যে ক্রোধের ফণাটা উঁচিয়ে উঠেছিল তা বিস্ময়ে মাথা নোয়ালো। ছেলে কথাটা বলেছে
ঘুমের ঘোরে, জেগে উঠলে মনে না পড়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ওই ভঙ্গীতে পিতা বিরুদ্ধ
মনোভাব অন্তরে গাঁথা না থাকলে অত স্বচ্ছন্দে ঘুমের মধ্যে বলতে পারত না। অথচ সে
ছেলের মুখে কোনোদিন পিতার সিদ্ধান্ত বিরুদ্ধ কথাবার্তা শোনেনি। তার মানে ও যখন
বাইরে থাকে তখন এইসব আলোচনা করে, ঘরে ফিরেই সচেতন হয়।
ছেলের
মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে। ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। ধীরে ধীরে সরে এল খাটের কাছে।
ছেলের মাথার পাসে বসল। তারপর চোখ বন্ধ করল। কপিল সজ্জার ওপর বসে বাবাকে দেখল।
তারপর সেখান থেকেই জিজ্ঞেসা করল, ‘আমি কি অন্যায় কিছু কিছু বলেছি’?
বাসুদেব
দাঁতে দাঁত চাপল। সে নিজে কি কখনও বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বিরুদ্ধচারন করতে পারত?
কপিল তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাসুদেব নিজেকে সংযত করে বলল, দেখ পুত্র, আমরা এক
কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আর্য ভাষাগোষ্ঠীর লোকজন আমাদের ধর্মের উপর আঘাত কতছে। তারা আমাদের
দেশ দখল করতে উদগ্রীব। আর তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে আমাদের অঞ্চলের খুদ্র খুদ্র
রাজশক্তি। কৃষ্ণ একের পর এক অনআর্য ভাষাগোষ্ঠীর রাজাদের হত্যা করে চলেছে। এঅবস্থায় আমাদের কি করা
উচিৎ বলে তুমি মনে করো?
কপিল
পিতার সাথে সহমত প্রসন করে বলল, আর্যদের সবচেয়ে বড়
শক্তি হচ্ছে অদের শিক্ষালব্ধ জ্ঞান। সেই সাথে যোদ্ধা জাতি হিসেবেও নাম আছে...
কথা
শেষ করতে পারলনা কপিল। বাসুদেব বাজখাই গলায় বলল, আমাদের শক্তি কম কিসে? দ্বারকাঅধিপতি বাসুদেব, জাল বাসুদেব; আমিই প্রকৃত বাসুদেব—ঈশ্বরাবতার। আমি কৃষ্ণকে জানিয়ে দিয়েছি, সে যেন আমার কাছে এসে, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মাদি
যে সকল চিহ্নে আমারই প্রকৃত অধিকার, তা আমাকেই দিবে।
ইতিহাস
সাক্ষ্য দেয় পুন্ড্র নরপতিদের মধ্যে বাসুদেব যুধিষ্ঠিরের
রাজসূয় যজ্ঞের পর অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিধর হয়ে উঠেছিলেন ছিলেন। তা দেখে স্বয়ং শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁহার অভূতপূৰ্ব্ব
বীৰ্য্যদর্শনে বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। কৃষ্ণ
তাই বাসুদেবের উত্তরে ‘তথাস্তু’ বলে জানিয়ে দিলেন।
হরিবংশ
ও নানা পুরাণ আলোচনা করলে মনে হবে যে, ক্ষত্রিয় বীর পৌণ্ড্রক
বাসুদেব বর্তমান বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সীর অধিকাংশ স্থান জয় করে একজন অতি
প্রতাপশালী রাজাধিরাজ হয়ে উঠেছিলেন। বহু নরপতি তাঁহার অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য
হইয়াছিলেন। নিষাদপতি অদ্বিতীয় বীর একলব্য, মগধপতি জরাসন্ধ
এবং প্রাগ্জ্যোতিষপতি ভগদত্তের পিতা নরক তাঁহার বন্ধু ছিলেন। শ্ৰীকৃষ্ণ নরককে
নিধন করলে পৌণ্ড্রক বাসুদেব শ্ৰীকৃষ্ণের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। তাঁহার
রাজ্য বিস্তারের সাথে কৃষ্ণদ্বেষিতাও বহুগুণে বৃদ্ধি হয়ে ছিল।
ততঃ পুণ্ড্রাধিপং বীরং বাসুদেবং মহাবলম্।
কৌশিকীকচ্ছনিলয়ং রাজানঞ্চ মহৌজসম্॥ ২২
উভৌ বলভৃতৌ বীরাবুভৌ তীব্রপরাক্রমৌ।
নিৰ্জ্জিত্যাজৌ মহারাজ বঙ্গরাজমুপাদ্রবৎ॥ ২৩
কৌশিকীকচ্ছনিলয়ং রাজানঞ্চ মহৌজসম্॥ ২২
উভৌ বলভৃতৌ বীরাবুভৌ তীব্রপরাক্রমৌ।
নিৰ্জ্জিত্যাজৌ মহারাজ বঙ্গরাজমুপাদ্রবৎ॥ ২৩
(সভাপর্ব্ব ৩০ অঃ)
এই
বিবরণ হতে বুঝতে পারি পৌণ্ড্রক বাসুদেব নিজেকে প্রকৃত অবতার হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সফল
হয়েছিলেন,
অথবা তাঁহার অধিকারভুক্ত বাঙ্গালী সামস্ত ও প্রজাগণ তাঁকে ভগবান্
বাসুদেব কৃষ্ণ হতে শ্রেষ্ঠ মনে করেছিল।
মহাভারতের
দ্বিতীয় পর্বে
(শ্লোক পর্বাধ্যায় ৪৩) কৃষ্ণের শত্রু পুণ্ড্রক
বাসুদেবকে (জরাসন্ধের বন্ধু) বঙ্গ,
পুণ্ড্র ও কিরাতদের রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (২।১৪)
অষ্টম পর্বে ভগদত্তকে বঙ্গের রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভগদত্ত
ছিলেন বঙ্গের উত্তর দিকে অবস্থিত প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের রাজা।
পুণ্ড্রক
বাসুদেব ও কর্ণ ছিলেন বঙ্গের পূর্ব দিকে অবস্থিত পুণ্ড্র ও অঙ্গ রাজ্যের রাজা।
মগধ, অঙ্গ, বঙ্গ, ও সুহ্মের ক্ষত্রিয় বীরগণ পরস্পর আত্মীয়তা ও মিত্রতা পাশে আবদ্ধ ছিলেন; তাঁহাদের আচার ব্যবহার অনেকটা এক ছিল। ঋষিকপিলের পিতা বাসুদেব ও নরকের সহায়তায় জরাসন্ধ ৮৬ জন
রাজাকে করাগাওে নিক্ষেপ করেন। ১০১ জন রাজার রক্তে নরকওে তিনি পৃথিবীর অধিশ্বও
হ্ওয়ার স্বপ্ন দেখেন। জরাসন্ধের এহেন কু-কর্মে সহোযোগিতা করায় কপিল তাঁর পিতা বাসুদেবের
বিরোধিতা করেন। এতদিন বিষয়টি মনের মধ্যে ঘুরপাক খেলেও মুখে কিছু বলেনি। কিন্তু আজ
কি দিয়ে কি হোল ঘুমের মধ্যে কপিল বলল, নর বলী অন্যায় কাজ। আর সেই সময় বাসুদেব ঘরেই
ছিল। আর পুত্রের কথা শুনে ফেলেন।
এর
পরে কপিলের আর বেশিদিন পুণ্ড্রে থাকা হয়নি। রাজার অবাধ্য সন্তান শত্রু সম বলে ধরা
হতো। তিনি রাজ্য থেকে বিতারিত হন এবং আর্যবর্তে চলে যান। অন্য
সুত্রে পাই সুদূর
দক্ষিণ দেশে (সাতক্ষিরা) আগমন করেন এবং স্বীয় নামে তথায় এক কালীমূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠা
করেন।
আশ্চর্য্যের
বিষয়, এই কপিল পরে দেবতার সমমান পায় সমগ্র ভারত বর্ষে। আর তার দর্শন দুনিয়ায়
সুখ্যাতি পায়।
কপিলের মা নারাচি স্বামীকে বললেন, ছেলেটার
উপর হাত চালালে কেন? তার উত্তর দেয় কপিলের বড় ভাই-এর বাসুদেব। বলে, আমরা আর্যদের জন্য কি করিনি? কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুর্য্যোধনের পক্ষভুক্ত
হইয়া পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে তুমুল সংগ্রাম করিয়াছি...।
জ্যেষ্ঠ ভাই বাসুদেবের প্রথম পত্নী সুতনু পাশেই
দাঁড়িয়ে ছিল। সে খেদক্তি করে বলল, আমরা সবাই শ্রীকৃষ্ণের শত্রু। কৃষ্ণ যার শত্রু
তার নিস্তার নেই। আমাদের যুদ্ধ করতেই হবে।
এদিকে
শ্ৰীকৃষ্ণের অসাধারণ প্রভাবে অনেকেই তাঁর অনুরক্ত ভাগবত হয়ে পড়িয়াছিলেন, অনেকে
তাঁহাকে ভগবানের অবতার বলে বিশ্বাস করছিলেন, কিন্তু পৌণ্ড্রক
বাসুদেবের তাহা মানতে পারছিল না। তিনি সৰ্ব্বসমক্ষেই বলতে শুরু করলেন যে, “সেই গোপনন্দন কৃষ্ণ কি সাহসে আবার বাসুদেব নাম গ্রহণ করেছে? আমার নিশিত সুদর্শন, আমার সহস্রার মহাঘোর চক্র,
আমার শার্ঙ্গনামক মহারব সম্পন্ন মহাধনু, কৌমোদকীনামক
আমার এই বিশাল গদা, কৃষ্ণের গৰ্ব্ব চূর্ণ করে দেবে। অতএব আমি
ধনু, শঙ্খ, শার্ঙ্গ, খড়্গ ও গদাধর হইয়া কৃষ্ণকে জয় কব। হে নৃপগণ! যদি তোমরা আমাকে শঙ্খ চক্র
গদাধর না বল, তা হলে তোমাদের শত ভার সুবর্ণ ও বহু ধান্য দণ্ড
করিব।”
পুণ্ড্রাধিপ
কৃষ্ণদ্বেষী হলেও একজন অসাধারণ বীর, ও ক্ষত্রিয় কুলগৌরব বলে
বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশে কীৰ্ত্তিত। যখন নরকহন্তা শ্ৰীকৃষ্ণের দিগন্তবিস্ফারিত যশোগাথা
পুণ্ড্রাধিপতির কাছে খবর পৌঁছল, তখন এই বঙ্গবীর আর কিছুতেই
স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি অষ্ট সহস্র রথ, অযুত হস্তী ও
প্রায় অর্ব্বুদ পত্তি লইয়া শ্রীকৃষ্ণের ধ্বংসোদ্দেশে দ্বারকায় যাত্রা করিলেন।
ভারতের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে গিয়া বাঙ্গালী বীরগণ যে অদ্ভুত বীরত্বের
পরিচয় দিয়া গিয়াছেন, তা কৃষ্ণভক্ত পুরাণকারের লেখনীতেও
সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়াছে। বলতে গেলে, বঙ্গাধিপের
অসাধাবণ শরপ্রহারে শত শত যাদববীর ধরাশায়ী হয়াছিল। সেই ভীষণ যুদ্ধে পৌণ্ড্রকের
অস্ত্রে নিশঠ, সারণ, কৃতবৰ্ম্মা,
উগ্ৰসেন, উদ্ধব, অক্রূর,
সাত্যকি প্রভৃতি মহারথীগণ আহত হয়াছিলেন। বঙ্গবীরকে পরাজয় করতে কোন
যাদববীর সমর্থ হয়নি। অবশেষে যখন সাত্যকীর সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করে বঙ্গবীর নিতান্ত
পরিশ্রান্ত, সেই সময় ভগবান্ শ্ৰীকৃষ্ণ রণক্ষেত্রে উপস্থিত
হলে।
শ্রীকৃষ্ণ
তাচ্ছিল্লের হাসি দিয়ে বললেন, তর রংচং আর অদ্ভুত পোশাকের সাজ দেখে মনে হচ্ছে, কাক
যতি ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করুক- কাক তো কাকই থাকে।
এমনিতে বাসুদেব
শ্রান্ত তার উপর কৃষ্ণের কটূক্তি তাকে উদ্ভ্রান্ত করে দিল। ওদিকে কৃষ্ণ বলেই
যাচ্ছে, “পৌন্ড্রক! তোর সমস্ত অনুগামী সহ তোর গলাটা ছেদন
করতে আমি বিশেষতঃ এই চক্র ব্যবহার করব।”
পুণ্ড্রের মানচিত্র
পুণ্ড্রাধিপ সত্যিকীকে রেখে কৃষ্ণকে
আক্রমণ করলেন। অমনি প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হল।
সেনাবাহিনীর মধ্যস্থলে আসল আর নকল দুই ভগবান একই রকম দেখাচ্ছিল। কে শ্রীকৃষ্ণ, কে পৌন্ড্রক বুঝে ওঠা মুশকিল ছিল। পৌন্ড্রকের সৈন্যই নিহত হল। যুদ্ধ শেষে
পৌন্ড্রক রাজের বহু পত্নী এবং লোকজনেরা দেখতে পেল তোরণ দ্বারা একটি ছিন্ন মুন্ড
পড়ে আছে। তারা ভাবল শ্রীকৃষ্ণকে বধ করা হয়েছে। পরক্ষণেই তারা বুঝল সে মুন্ডটি
স্বয়ং মহারাজ পৌন্ড্রকের। তখন তারা মুন্ড ধরে কাঁদতে শুরু করল।
বারাণসীর
অধিপতিগণ পৌণ্ড্রেকের পক্ষ হয়েছিল, এবং পৌণ্ড্রকের মৃত্যুর পরেও কৃষ্ণের সঙ্গে শত্রুতা করিয়া, যুদ্ধ করছিল। এজন্য তিনি বারাণসী আক্রমণ করিয়া শত্রুগণকে নিহত করিলেন এবং
বারাণসী দগ্ধ করেছিলেন। এরপরের ইতিহাস তো পরাজয়ের আর
রক্তক্ষয়ের।
ইতিহাস সবসময় বিজয়ীদের স্বার্থে লেখা হয়
এবং পরাজিতের ইতিহাস চলে যায় কালের অতল গহ্বরে। তেমনি হয়ত এ অঞ্চলের অর্থাৎ বঙ্গভুমির সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের ইতিহাস হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
ঐতরেয়
ব্রাহ্মণে (খ্রী.পূ.৭ম শতক) পুণ্ড্রের জনগণকে দস্যু বলা হয়েছে। ঐতরেয় আরণ্যকে
অনার্য বঙ্গ, বগধ (মগধ) ও চের
জাতির উল্লেখ রয়েছে। ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ ও
স্কন্দপুরাণ প্রভূতি প্রাচীন গ্রন্থে পুণ্ডদেশ ও পৌণ্ড্রজাতির উল্লেখ আছে। বর্তমান ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারের পুর্ণিয়া অঞ্চল, পশ্চিম বঙ্গের উত্তরবঙ্গ অঞ্চল ও বাংলাদেশের
উত্তরাঞ্চল পৌণ্ড্র রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতে অন্তত একটি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে যে
খ্রীস্টপূর্ব সাত শতকেও এদেশে জনবসতি ছিল এবং তাদের সম্বন্ধে কিছু সংবাদ আর্য সমাজে
আহৃত হয়েছে। পুরাণে বর্ণিত পুত্ত্বদেশের রাজা পৌঁওক (পুণ্ড্রের
পুণ্ড্রক) বাসুদেব দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত ছিলেন। মহাভারতের সভাপর্ব্বে আছে, ভীম দিগ্বিজয়ে এসে পুণ্ড্রাধিপতি বাসুদেব এবং কৌশিকীকচ্ছ বাসী মনৌজ রাজা,
এই দুই মহাবল মহাবীরকে পরাজয় করে বঙ্গরাজের দিকে অগ্রসর হলেন।
পৌণ্ড্রকের
মৃত্যু ভারতবর্ষের
রাজনৈতিক পটভূমিতে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। আমরা দেখি পূর্বভারতীয় প্রভাবকে
হারিয়ে উত্তরপশ্চিম ভারত জাগছে। নতুন রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে। বাসুদেব
তার হোতা।
অবতার বাসুদেব
দ্বাপর
যুগ ভিমের রাজত্বের পর যদু বংশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সতবতের দুই পুত্র অন্ধক ও
বৃষ্ণি নিজ নিজ নামে রাজ্য পরিচালনা করেন। কংসের পিতা উগ্রসেন ছিলেন অন্ধক বংশীয়।
অপরদিকে কৃষ্ণের পিতা বাসুদেব ছিলেন বৃষ্ণি বংশীয়। পিতার নামানুসারেই কৃষ্ণের এক নাম হল বাসুদেব।
বস্তুত বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, ব্রাহ্ম, খ্রীষ্টীয় ইত্যাদি ঈশ্বরবাদী মাত্রেই
যাঁহার উপাসনা করেন, তিনিই বাসুদেব। অবতারবাদ ইত্যাদি যাঁহারা মানেন না, তাঁহারাও বাসুদেবেরই উপাসনা করেন এবং বাসুদেব
তাহা অগ্রাহ্য করেন না, ইহা তাঁহারই শ্রীমুখের বাণী (‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে’, গী|৪|১১)। ভগবান বাসুদেব কর্তৃক যে উদার সর্বজনীন ধর্মমত গীতায় কথিত হইয়াছে
তাহাই ভাগবত ধর্ম। ভাগবত ধর্ম সম্পর্কে জগদীশচন্দ্র ঘোষ।
হিন্দু পুরাণ
অনুসারে বসুদেব (দেবনাগরী) হলেন যদুবংশীয় শূরসেনের পুত্র এবং কৃষ্ণের পিতা। বসুদেবের ভগিনী কুন্তী
হলেন পাণ্ডুর স্ত্রী, যিনি মহাভারতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখেন। পুরাণ অনুসারে বসুদেব হলেন ঋষি কশ্যপের আংশিক অবতার। পিতার নামানুসারেই কৃষ্ণের
এক নাম হল বাসুদেব। হরিবংশ পুরাণ অনুসারে বসুদেব ও নন্দ (কৃষ্ণের
পালক পিতা) ছিলেন দুই ভাই।
চতুর্থ
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকেই বাসুদেব, কৃষ্ণ ও গোপাল প্রভৃতি কৃষ্ণের নানা রূপের পূজাকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের
অস্তিত্বের কথা জানা যায়। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতেই দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণভক্তি
আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর ভারতে কৃষ্ণধর্ম সম্প্রদায়গুলি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়
মোটামুটি একাদশ শতাব্দী নাগাদ। দশম শতাব্দী থেকেই ভক্তি আন্দোলনের ক্রমবিস্তারের
ফলে কৃষ্ণ শিল্পকলার এক মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠেন।
রাঢ়ী শ্রেণী সিন্ধল গ্রামীণ অদ্বিতীয়
পণ্ডিত ভবদেব ভট্ট বঙ্গাধিপ হরিবর্মদেবের একজন সচিব এবং ভবদেবের কুল প্রশস্তি-রচয়িতা
বাচস্পতিমিশ্র তাহার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন।
অনন্ত
বাসুদেবের সুন্দর মন্দির ভবদেবেরই কীৰ্ত্তি। মন্দিরের
ছাদে একটি বড় গুম্বজ আছে এবং সমুখ ভাগের প্রাচীর গাত্রে ইষ্টকের উপর বহু পৌরাণিক
চিত্র উৎকীর্ণ আছে। প্রাচীন বাংলার শিল্প-নিদর্শন হিসাবে ইহাও একটি দ্রষ্টব্য
বস্তু| বাসুদেব মন্দিরটি বাঁশবেড়িয়ার মধ্যে সবর্বাপেক্ষা প্রাচীন। ১৬৭৯
খৃষ্টাব্দে নিৰ্ম্মিত হয়। এই
পরব্রহ্মের
অবতার
বস্তুত
শ্রীকৃষ্ণ বসুদেবের পুত্র বলিয়াই যে বাসুদেব তা নন, শ্রীকৃষ্ণ-অবতারের
পূর্বেও যাঁহারা পরব্রহ্মের অবতার বলে পুরাণে বলা হয়েছে, তাঁরাও
ভগবান 'বাসুদেব' বলিয়াই আখ্যাত হইয়াছেন
[ভাঃ ৫|৫|৬; ৫|৬|১৬]।
ব্রহ্মবাদী
বলেন- সমস্তই ব্রহ্ম ('সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম'); গীতা বলেন- সমস্তই বাসুদেব
('বাসুদেবঃ সর্বমিতি', গী|৭|১৯]); বিষ্ণুপুরাণ বলেন- জগৎ
বিষ্ণুময় ('ইদং বিষ্ণুময়ং জগৎ')। সর্বত্রই
এক তত্ত্ব। বস্তুত শ্রীকৃষ্ণ বসুদেবের পুত্র বলিয়াই যে
বাসুদেব তা নন,
শ্রীকৃষ্ণ-অবতারের পূর্বেও যাঁহারা পরব্রহ্মের অবতার বলিয়া পুরাণে
বর্ণিত হইয়াছেন, তাঁহারাও ভগবান 'বাসুদেব'
বলিয়াই আখ্যাত হইয়াছেন [ভাঃ ৫|৫|৬; ৫|৬|১৬]।
এসব
কথার মানে এই যে,
নির্গুণ-গুণী ভগবান পুরুষোত্তম বাসুদেবই পরব্রহ্ম। তিনিই সমস্ত ('বাসুদেবঃ সর্বমিতি'), সর্বভূতে তিনিই আছেন এবং
তাঁহাতেই সর্বভূত আছেন [গী|৬|২৬-৩০],
এই জ্ঞান লাভ করে তাঁতে একান্ত ভক্তি করা এবং সর্বভূতহিত-কল্পে
নিষ্কাম কর্ম করা, এটা এই ধর্মের স্থূলকথা
অষ্টম
পরিচ্ছেদ—কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা বাসুদেব
শব্দের অনেক অর্থ হয়। যিনি বসুদেবের পুত্র, তিনি বাসুদেব। এবং যিনি সর্বনিবাস অর্থাৎ সর্বভূতের বাসস্থান, তিনিও বাসুদেব। অতএব যিনি ঈশ্বরের অবতার, তিনিই
প্রকৃত বাসুদেব নামের অধিকারী।
বাসুদেবপরা
বেদা বাসুদেবপরা মখাঃ।
বাসুদেবপরা
যোগা বাসুদেবপরা ক্রিয়াঃ।।
বাসুদেবপরা
জ্ঞানং বাসুদেবপরা তপঃ।
বাসুদেবপরা
ধর্মো বাসুদেবপরা গতিঃ।। -[ভাঃ ১ম ২|২৮|২৯]
বলা
বাহুল্য যে,
'বাসুদেব' শব্দ পরব্রহ্মবাচক। সর্বভূতে
বাস করেন বলিয়াই তিনি বাসুদেব ('সর্বভূতাধিবাসশ্চ বাসুদেবস্ততো হ্যহম্',
মভাঃ শাঃ ৩৪১|৪১; বস্-
বাস করা), 'ব্রহ্ম' শব্দেরও উহাই অর্থ
('বৃহত্ত্বাৎ ব্রহ্ম', 'যেন সর্বম্ ইদং ততম্', গী|২|১৭)। এইরূপ, সমস্ত
ব্যাপিয়া আছেন বলিয়াই তিনি আবার 'বিষ্ণু' (বিষ্- বিস্তারে)।
নায়ারদের
আদিপুরুষ
সিংহলীদের পালিগ্রন্থ "মহাবংশ" এ পান্ডু বাসুদেব নিয়ে
আখ্যানটি বেশ কৌতুহলুদ্দীপক। ভগবান বুদ্ধের আদেশে ইন্দ্র বাঙ্গালী বিজয়কে
শ্রীলংকায় বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তারের সুবিধার্থে রক্ষা করেন এবং বিজয়ী করেন। তাঁর
মৃত্যুর পর বঙ্গদেশ থেকে ভ্রাতুষ্পুত্র পান্ডুবাসুদেব লঙ্কায় গিয়ে রাজা হন। (প্রাচীন
ইতিহাস: রমেশ চন্দ্র মজুমদার।)
বিজয়সিংহের
সন্তানাদি ছিল না৷ তিনি রাদঢ থেকে তাঁর জনৈক ভ্রাতুষ্পুত্র পাণ্ডু বাসুদেবকে এনে তাঁকে
সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেন৷ এই সিংহলে বসবাসকারী মানুষেরাই পরবর্তীকালে মালাবার উপকূলের
দক্ষিণাংশ
(আজকাল যাকে বলি কেরল) অধিকার করেন ও সেখানে বসতি
স্থাপন করেন৷ এঁরাই হলেন বর্তমান নায়ারদের আদিপুরুষ৷ নায়াররা আচার–ব্যবহারে, চালচলনে, মুখের ছাঁচে
হুবহু বাঙালীদের মত৷ এঁরা বুদ্ধিবৃত্তিতে অত্যন্ত প্রখর৷
কুষাণ বংশের শেষ সম্রাট
কণিষ্কের মৃত্যুর পর কুষাণদের ক্ষমতা আস্তে আস্তে লোপ
পেতে থাকে। ২৩ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর নিজেরই কিছু সৈনিক তাঁকে হত্যা
করেছিল। পরবর্তী সম্রাটরা হলেন বাসিষ্ক, হুবিষ্ক এবং বাসুদেব। বাসুদেবই এই বংশের
শেষ স্মরণীয় শাসক।
১৫১
খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনিষ্ক প্রয়াত হন। তার উত্তরসূরি হিসেবে বশিষ্ক, হুবিষ্ক
ও বাসুদেব পর্যায়ক্রমে গান্ধারায় ক্ষমতাসীন হন। ২২৫ খ্রিস্টাব্দে বাসুদেব
ক্ষমতাচ্যুত হন। বাসুদেবের শাসনকালের শেষ পর্যন্ত গান্ধারা ও পেশোয়ারের জনজীবনে
বৌদ্ধ চিন্তাধারার গভীর প্রভাব ছিল। তবে তার নাম থেকে বোঝা যায়, তত দিনে রাজসভায় ব্রাহ্মণদের প্রভাব জোরদার হয়। অভিজাতদের সমর্থন ফিরে
পেতে অনেক দেরিতে মরিয়া চেষ্টা চালান কুষাণ নৃপতিরা। এ কারণেই ধর্মান্তরের মাধ্যমে
প্রভাবশালী হিন্দুদের আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলে।
বাসুদেবের মুদ্রার
অগ্নিপুরাণে
ইঙ্গিত রয়েছে,
‘কুষাণরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করায় হিন্দু অভিজাতরা রাষ্ট্রের
স্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।’ অহিংসা ও নির্বাণের মন্ত্র
প্রচার করে যে বৌদ্ধ ধর্ম, বস্তুতই তা কুষাণদের মতো যোদ্ধা
জাতির ক্ষমতা সংহত রাখতে যথেষ্ট ছিল না। কারণ তারা ‘দখলের
দাবি থেকে শাসন’ করছিল।
অগ্নিপুরাণের
পূর্বোল্লিখিত ছত্রে রাজ্য দখল ও শাসনকারীদের প্রতি অভিজাতদের বিরূপতা প্রচ্ছন্ন
থাকেনি। ২২৬ ও ২৩০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো সময়ে সাসানীয় নৃপতি পারস্য সম্রাট
আরদাশির বাসুদেবকে পরাজিত করেন।
মুদ্রার প্রচলন করা এই রাজ বিংশের প্রথম
বাসুদেবের তাম্রমুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল উত্তর ও দক্ষিণ চবিবশ পরগনায়।
বাসুদেব
ও বাসুদেব
জৈনদের
নিজস্ব ধর্মীয় ইতিহাস আছে,
এ ধর্মের ২৪ জন তীর্থঙ্কর সময়ে সময়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে
তাঁদের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে তাদের কর্তব্য কর্ম করা শিখিয়েছেন। রাম,
জৈনরা যাঁকে পদ্ম হিসাবে চেনে তিনি পৃথিবীতে একজন স্বর্গীয় বীর
হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ ধর্মে আছেন নয়জন বাসুদেব ও নয়জন বলদেব/বলরাম,
এঁনারাও এক একজন বীর, প্রত্যেক
বাসুদেব-বলদেবের প্রতিপক্ষ হিসাবে মোট নয়জন প্রতিবাসুদেব আছেন। মহাভারতের কৃষ্ণ ও
তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জৈনধর্মের বাসুদেব ও বলদেব। প্রতিবাসুদেব হিসাবে অন্যানদের
সাথে আছেন রাবণ ও জরাসন্ধ। ভরত ও সাগর সহ আছেন ১২ জন বিশ্বাধিপতি চক্রবর্তী সম্রাট। ২৪
জন তীর্থঙ্কর,
৯ জন বাসুদেব, ৯ জন বলরাম, ৯ জন প্রতি বাসুদেব ও ১২ জন চক্রবর্তী সম্রাট কে একত্রে ৬৩ শাল্কো পুরুষ
(গ্রেট মেন) বলা হয়। ব্রহ্মদেব/ব্রহ্মদত্তকে
যেমন বৌদ্ধ ধর্মে পাওয়া যায়, জৈনধর্মে তাঁর উপস্থিতি আছে। প্রাচীন
ধর্মীয় উৎসগুলোতে ব্রাহ্মণদের থেকে জৈনদেরও আংশিক স্বতন্ত্রতা আছে বলে প্রতীয়মান
হয়। কেননা তাদের উপকথা বা কিংবদন্তীগুলো অপরাপর ধর্মের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে
বিধিবদ্ধ ও সুবিন্যাস্ত।
বাসুদেবরা
সহিংস যোদ্ধা এবং প্রতিবাসুদেবরা হলেন মূলত খলনায়ক। কিংবদন্তি অনুসারে, বাসুদেবরা
প্রতিবাসুদেবদের শেষ পর্যন্ত হত্যা করেছেন। নয় জন বলদেবের মধ্যে আট জন মোক্ষ লাভ
করেছেন এবং সর্বশেষ জন স্বর্গে গিয়েছেন। বাসুদেবরা তাঁদের হিংসাত্মক কার্যকলাপের
জন্য নরকে গিয়েছেন। সত্যের জন্য কাজ করতে চেয়েও শুধুমাত্র সহিংসতা অবলম্বনের
জন্য তাঁদের এই শাস্তি হয়েছে।
আর
যত বাসুদেব
কোন কোন ইতিহাস বিদ মনে করেন পুণ্ড্রক
বাসুদেব আর্য ভাষাগোষ্ঠীর
লোকজন, নেতা-উপনেতা। এই নৃপতি পাণ্ডবের আগমনের কয়েকশ বছর পূর্বে এসেছিলেন। পতঞ্জলির মতে
কৃষ্ণ বাসুদেব ক্ষত্রিয়বিশেষ নন, এক দেবতা। সুতরাং বর্তমান কৃষ্ণের দুটি
রূপ— তিনি রণপণ্ডিত, কূটনীতিজ্ঞ,
আশ্রিতবৎসল, পরমতত্ত্বজ্ঞ। আর এক রূপে তিনি
প্রেমিক, ভক্ত সখা ও গোপীবল্লভ।
জৈন গ্ৰন্থ বাসুদেবহিণ্ডি-তে স্ত্রীর
বিকল্পের কাহিনি আছে, সেখানে কৌমপতি ভারতের প্রাসাদে স্ত্রী ছাড়াও
একটি ভোগ্য নারী থাকত।
আনকদুন্দুভিঃ বসুদেব সৌন্দর্য্যের
জন্য বিখ্যাত। তাঁর অন্য নাম আনকদুন্দুভি। কথিত তাঁর জন্মকালে দুন্দুভি নিনাদে
বিশ্বপরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এবং সংবাদ হচ্ছে বসুদেব বৈষ্ণবদের মধ্যে 'বাসুদেব' উপাধির জন্য
মনস্থ ছিলেন। সেই উপাধি তাঁকে বৈষ্ণবদের পুরোধা পুরুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করতো।
তাঁর বিরুদ্ধে পূর্ব দেশীয় বহু বৈষ্ণব নরপতি রয়েছেন।
বাসুদেব
শব্দের তাৎপর্য জানা না থাকলেও স্পষ্টত সংস্কৃতি ভাষাজাত। আরজ ভাষীরা তাদের ভাষায়
এদেশীয় নেতাদের নামকরণ করেছে। পাণিনির কোন সূত্রে “কৃষ্ণ” শব্দ থাকলে তাহা বাসুদেব কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতার প্রমাণ বলিয়া গণ্য হয় না।
কিন্তু পাণিনিসূত্রে “বাসুদেব” নাম যদি
পাওয়া যায়, তবে তাহা প্রমাণ বলে গণ্য ঠিক।
পুন্ড্র নরপতি বাসুদেব, পৌণ্ড্রক বাসুদেব,
পুত্ত্বদেশের
রাজা পৌঁওক বাসুদেব, পুণ্ডুরাজ বাসুদেব, পুণ্ড্রাধিপ বাসুদে, পৌণ্ডক বাসুদেব, পুড়িরাজ বাসুদেব, পুণ্ড্রবর্ধন নরেশ পৌণ্ড্রক
বাসুদেব, পৌণ্ডদুক-বাসুদেব, পৌণ্ডুক-বাসুদেব, পুণ্ড্রাধিপতি, পৌণ্ড বাসুদেব পুন্ড্র
নরপতিদের মধ্যে বাসুদেব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শ্ৰীকৃষ্ণের
সমসাময়িক বাসুদেব
যাদবপতি শ্রীকৃষ্ণের জ্ঞাতি নেমিনাথ অঙ্গবঙ্গাদি দেশে এসে জৈন ধর্ম্ম প্রচার করেছিলেন। নেমিনাথের ন্যায় ক্ষত্রিয় প্রচারকদিগের উত্তেজনায় পৌণ্ড্রক বাসুদেব কৃষ্ণদ্বেষী হয়ে পড়িয়াছিলেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক অজয় রায় লিখেছেন,- ''এই বাসুদেব কেবল শ্রীকৃষ্ণের পার্থিব শক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করেননি তার আধ্যাত্মিক প্রভুত্ব ও প্রভাবকেও অস্বীকার করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন উত্তর ভারতের তথা আর্যাবর্তের পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রক্ষক, পরিপোষক এবং প্রতিভূ। অন্যদিকে পৌণ্ড্রক বাসুদেব ছিলেন, প্রাচ্য ভারতের শীর্ষ শিবের ভক্ত নেতা। বৈদিক আচার আচরণের
বিরোধী ছিল। যার রাজ্যের নিজস্ব উন্নত সংস্কৃতি ছিল যা
বৈদিক সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। সেই সাথে প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধনকে সামরিক পরাশক্তিতে অনন্য উচ্চতায় নিয়েগিছিল। মহাভারতকার “বীর্য্যশ্রেষ্ঠাশ্চ রাজানঃ”।
Comments