পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৮ (বাঙালির গৌরব গাঁথা-প্রথম পর্ব )


পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৮ (বাঙালির গৌরব গাঁথা-প্রথম পর্ব ) 
সাজেদুর রহমান


ইশপের গল্পের মতো নীতি-গল্প। এক চিত্রশিল্পী সিংহের ছবি এঁকে এক সিংহকে ডেকে দেখাল। সিংহটি ছবি দেখে বেশ হতাস। ভেবেছিল সে বনের রাজার, তার ছবি হবে সেই শৌর্য-বীর্যের প্রতিরূপ। কিন্তু চিত্র এঁকেছে, সিংহকে লোকে জুতাপেটা করছে। সিংহটি অপমানিত হয়ে বলল, আমরা যদি ছবি আঁকতে পারতাম তা হলে নিঃসন্দেহে ছবিটি ভিন্ন রকম হতো।                

সারার্থ- নিজের ছবি অন্য কেউ আঁকলে তার মতো করেই আঁকে।

ঠিক আমাদের ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা ঘটেছে। আমাদের অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস শিকার না করে উলট তাচ্ছিল্য করেছে। অতীত নথী থেকে পাই- বঙ্গের পট নাচানো অনুকরণ করেছে রোম খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে। আশ্চর্যের বিষয় এই পট নাচানো তারও বহুপূর্বে বাঙ্গালি শুরু করেছিল। এছাড়াও নাটক-সঙ্গীত-বিনদনের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রগুলিতে আমাদের যে কি আসম্ভব গৌরবময় অবদান আছে- জানলে বুকটা ফুলে তিন হাত হয়ে যায়।           

আমি সেই গৌরব গাঁথা তুলে ধরতে চেষ্টা করবো। টাইম ফ্রেম খ্রিস্টীয় জন্মের এক হাজার বছর আগে থেকে খ্রিষ্টীয় জন্মের এক হাজার। আজকের পর্বের বিষয়গুলি খুব ছোট্ট করে বলে নিয়ে মূল কথায় যাই। নাটক রচনায়, সঙ্গীত সাধনায় এবং নৃত্যগীতিতে তথা বিনদনের ক্ষেত্র আমাদের অবদান-                         

১) ভরতকে ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রে চার রীতির মধ্যে গুড় মাগধী বা ওড্রমাগধী রীতির আদি উৎপত্তি এই বঙ্গে।

২) কথোপকথন রীতির আদি উৎপত্তি এই বঙ্গে। খ্রিষ্ট পূর্ব ছয় শতাব্দী আগে রচিত স্থানীয় হস্তিচিকিৎসায় খ্যাত পালাকাণ্য মুনি ‘হস্ত্যায়ুৰ্বেদ এই কথোপকথন পদ্ধতিতে রচনা করেন। যা পরবর্তীতে ভারতী অর্থাৎ কথোপকথন সহযোগে উচ্চণ্ড এবং কৈশিকী (কেশ হইতে কৈশিকী’) অর্থাৎ লাবণ্যমণ্ডিত লাস্যাঙ্গ রীতি নামে পরিচয় পায়

৩) খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে গৌড়রীতি সংস্কৃতসাহিত্যে চারটি রীতি মধ্যে অন্যতম। দাক্ষিণাত্যা, উদীচ্যা, প্রাতীচ্য এবং গৌড়ী। ওজঃ” (এখানে, সাহিত্যের গাম্ভীর্য সৃষ্টিকারী দীপ্তি) প্রকাশক শব্দের ব্যবহার, আড়ম্বরপূর্ণ সমাসবহুল কাব্য রচনার এক বিশেষ রীতিকে গৌড়রীতিবলা হতো। সারা ভারতবর্ষ, এই গৌড়রীতিকে সাদরে গ্রহণ করেছিল।

৪) প্রাচীন পুণ্ড্রনগরের স্কন্দমন্দির বা কার্তিকের মন্দির ছিল সেসময়ে এই ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে নৃত্যগীতের শ্রেষ্ঠ জায়গা। বলা হয়, কাশ্মিরের নৃত্য-বিকাশে বাংলা অঞ্চলের এই কমলার ভূমিকা অপরিসীম


পৌন্ড্রবর্ধনের পাদপীঠেই সর্বপ্রথম পরিবেশিত হয়েছিল গীত, নৃত্য আর নাটক। স্কন্দ মন্দিরের নাট মন্দিরে এসব অনুষ্ঠান হতো। এখানেই ধর্ম প্রচারের কারনে ধর্মের আচার/আচরনে স্তরে স্তরে একদিন জমে ওঠেছিল সমৃদ্ধশীল সংস্কৃতির। এ বিষয়ে
প্রমাণ সুপ্রচুর। রামচরিত, পবনদূত প্রভৃতি কাব্যে, নানা লিপিতে, সদুক্তিকর্ণামৃতের প্রকীর্ণ শ্লোকে, চর্যাগীতি ও দোঁহাকোষের নানা জায়গায় নানাসূত্রে নৃত্যগীতবাদ্যের উল্লেখ পাই। সেন-লিপিতে এবং পবনদূতে ইঙ্গিত আছে, উচ্চ ও নিম্নকোটি উভয় স্তরেই এই দুই বিদ্যা ও ব্যসনের সমাদর ছিল যথেষ্ট। পাহাড়পুর ও ময়নামতীর পোড়ামাটির ফলকগুলিতে এবং অসংখ্য ধাতব ও প্রস্তরমূর্তিতে নানা ভঙ্গিতে নৃত্যপর পুরুষ ও নারীর প্রতিকৃতি সুপ্রচুর। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত উভয় পুরাণেই নট পৃথক বর্ণহিসাবেই উল্লিখ আছে।

রাজতরঙ্গিণী-গ্রন্থ মতে তখনকার পুণ্ড্রের রাজারাও পৃষ্ঠপোষকতা দিতো। নৃত্যগীতমুগ্ধ জয়ন্ত স্বয়ং ভরতানুমোদিত নৃত্যগীত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। কাস্মীরের রাজা ছিলেন জয়াপীর হঠাৎ স্কন্দমন্দিরে সুন্দরী কমলার নাচ দেখে তার প্রেমে পরে যান। এরপর তাকে বিয়ে করে রাণী বানিয়ে কাশ্মীরে নিয়ে যান। কথিত আছে, কমলাকে নিয়ে জয়াপিরের ভীমের জাঙ্গালের উপর দিয়ে কাশ্মীরে পালিয়ে যায়।

সুন্দরী কমলা নাচে

আজ ভালো করিয়া
বাজানরে দোতারা
সুন্দরি কমলা নাচে

এই গানের সাথে আমরা পরিচিত। কমলার গানের সাথে বঙ্গ কন্যাদের নাচ; যেকোনো আসোর জমানোর জন্য যথেষ্ট। এই নৃত্যগীতির ইতিহাস কি জানি?
সম্ভবত সেন আমলের শেষের দিকে মহাস্থানের গোকুল ম্যাড়ের প্রাসাদে, কারও কারও মতে, স্কন্ধের ধাপে অবস্থিত প্রমোদ ভবনের তৎকালীন রাজার প্রমোদবালাদের মধ্যে অসাধারণ রূপবতী, গুণবতী ও প্রমোদকলায় পটিয়সী এক সুন্দরী প্রমোদবালা ছিল। যার নাম কমলা। যার রূপ-গুণ-কৃতি নিয়ে পরবর্তীকালে লোকগান ও লোকনাটক উনিশ শতকেও অত্র জনপদ ছেড়ে উত্তরবঙ্গের অনেকটা এলাকাসহ বিদগ্ধ মানুষকে বিনোদন জুগিয়েছিল।

‘ওরে কমলার নাচনে বাগিচার পিছনে

চাঁদ ও ঝলমলে হাঁসেরে
ভাহালো করিয়া বাজাওগো দোতারা
সুন্দরী কমলা নাচে...’  


এই কমলা সুন্দরীকে কেন্দ্র করেই বিখ্যাত এই গানটি রচিত হয়েছিল উত্তরবঙ্গের নাম না জানা কোনো স্বভাবকবির হাতে। পরবর্তীকালে যেটা উত্তরবঙ্গের গণ্ডি পেরিয়ে পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র বাংলাভাষী মানুষের একটি প্রিয় ও রসালো গান হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।     

এখন কথা হল, এই সুন্দরী কমলার অস্তিত্ব কি বাস্তবে আদৌ ছিল, না এটা একটা মিথ? আসলে প্রত্যকেটা মিথই ইতিহাস থেকে তৈরি... মানুষ যখন ইতিহাস ভুলে যায়, তখন সেখান থেকে মিথের সৃষ্টি হয়। তবে কমলা সুন্দরী যে মহাস্থানে বাস্তবে ছিল ও কাশ্মীরের রাণী হয়েছিল তার প্রমাণের খোঁজ পাওয়া যায় কাশ্মীরের কবি কলহন রচিত ইতিহাস গ্রন্থ রাজ তরঙ্গিনীতে। তার বইতে পুন্ড্রনগরের কমলার কথার উল্লেখ রয়েছে।   

সেই হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধনে এক রূপসী নৃত্য বিভঙ্গে প্রকৃতির চাঞ্চল্যের কথা কলহনের রাজতরঙ্গিনীতে লিখিত আছেএই জয়াপীর-কমলার গল্পটি লোকের মুখে মুখে এতদিন চলে এসেছে। এ ছাড়াও বাঙালি সংস্কৃতিতে কমলানামে একাধিক চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। আজো নানা গানে, নানা সাহিত্যে নাচে কমলাভূমিকায় বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়ই বিবৃত করা হয়। জানা যায়, বাংলার আদি-মধ্যযুগের পালাগুলোতে বিচ্ছেদাত্মক কমলাচরিত্রের স্বতন্ত্র কাহিনি পাওয়া যায়। কমলার পুঁথিনামে বিয়োগান্ত কমলা চরিত্র অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল বাংলার সমাজে। অষ্টাদশ শতকের দ্বিজ ঈশান-রচিত কমলা পালা  দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর সংকলনেও তুলে ধরেছেন। এও বিয়োগান্ত পরিণতির কমলা। কমলাচরিত্রকে কেন্দ্র করে বাঙালি জীবনে নানা গীতিপালা তৈরি হয়েছে। তবে ভিন্ন ভিন্ন পালায় ভিন্ন ভিন্ন কমলা, ভিন্ন ভিন্ন তার ঘটনা।  উনবিংশ-বিংশ শতকে কমলার বনবাস, কমলা রানীর। 

সাগরদিঘি পালা হাজার হাজার বাঙালি দর্শকের হৃদয়ের অতলকে করুণরসে সিক্ত করেছে। ক্ষিতিশচন্দ্র মৌলিকের কমলারানীর পালা নামে পালার সন্ধান পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের ট্র্যাজেডির সমান্তরালই যেন এ কমলা-ধর্মরাজ চরিত্রের বিচ্ছেদ। কমলা চরিত্রটি আজ বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রতীকী চরিত্র। চট্টগ্রামের গণায়ন কমলা চরিত্রের বিয়োগান্ত কাহিনিটি নিয়েছে বর্তমান নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর অঞ্চলের অতিকায় এক দিঘিকে কেন্দ্র করে কমলারানীর সাগরদিঘির কিংবদন্তি থেকে। এ-নাটকে সুসং দুর্গাপুরের কমলার কিংবদন্তি থাকলেও গল্প বলায় গণায়নের নানা নিরীক্ষা লক্ষ করা গেছে। কমলারানীর সাগরদিঘির কিংবদন্তিটি বর্তমান বাংলাদেশের তিনটি অঞ্চলে অতিকায় দিঘি ঘিরে প্রচলিত। কমলা সুন্দরীর কিসসা। 
 
শ্যামল বঙ্গে নৃত্যের অনুপম ছন্দে সেই কবে বেজেছিল নৃত্যকী কমলার পায়ের ঘ্ঙ্ঘুর, জানি না আমরা। কাশ্মীরের কবি কালহনের রাজতরঙ্গিনীতে লেখা আছে পৌন্ড্রবর্ধনের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতির উত্থ্যান পতনের কথা

পৌন্ড্রনগর বিনদনের ইতিহাস



ইউরোপের অনেক পণ্ডিতের বলে যে, ভারতবর্ষে থিয়েটার ছিল না, থিয়েটারের ব্যাপারটা গ্ৰীস থেকে এসেছে। তাহলে একটা ঘটনার কথা বলি। আমরা জানি রাজা বলির অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম নামে পাঁচ পুত্রের কথা। পুরাণ অনুসারে অসুররাজ বলির সাথে দেবতাদের যুদ্ধ হয়। দেবাম্বরের যুদ্ধ নামে সেই যুদ্ধের শেষে কয়েকজন যুদ্ধ ফেরত অসুরযোদ্ধা অদ্ভুত কায়দায় বর্ণনা করছিল।           
শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও বলার ধরণ দেখে প্রথমে দেবতারা মজা পেলেও অল্পপরেই আসোর ভাংতে উদ্যত হোল। তারা মহাদেবের কাছে নালিশ করে বলল, ওরা কৌতুকের ছলে নেচে গেয়ে সংলাপ বলছে। সেই সাথে আমাদের বেঙ্গ করছে। মহাদেব বলল, ‘এটা কিছুতে দেব হবে না’

দেবাম্বরের যুদ্ধ কাহিনী নকল করে যে বিনোদন রীতি উৎপত্তি হয়েছিল চার/ সাড়ে চার হাজার বছর আগে সেটাকেই বিজ্ঞজনেরা আমাদের থিয়েটার চর্চার শুরুর ক্ষণ বলে ধরে নিচ্ছেন। আর সেখান থেকেই 'প্ৰেক্ষাগৃহ' বা 'পেকূখ্য ধরন্স'      
পুরাকালে ‘পাখবি’ নামে সম্প্রদায়ের লোকেরা বাঁশের ডগার সাথে আরেক বাঁশ আঘাত করে শব্দের তালে তালে নেচে কাহিনী বর্ণনা করত। মুলত যুদ্ধের আগে ও পরে এই ভাবে যুদ্ধের কাহিনী শোনাত লকেদের। প্রথম প্রথম তাদের নাম ছিল পাখাবি! এখানেও ওই সম্প্রদায় ছিল পাখিনিতে আমরা দু’খানি নটসূত্রের নাম পাই, একখানি শিলালিয়, অপরটি কৃশাখের

আরেকটি মজার তথ্য পাই মহাভারতে। ভরতমুনি তাঁহার নাট্যশাস্ত্রকে (আনুমানিক তৃতীয় শতক) পঞ্চম বেদ’ বলা হয়ে থাকে। এই সর্বভারতীয় শাস্ত্রগ্রন্থ নাট্যশাস্ত্রের আদি সুত্রাকর। এই মনিষী যে বংশে জন্মেছেন সেই বংশেই বৎস দেশের রাজা উদয়ন। এই উদয়ন ছিলেন একাধারে শ্রেষ্ঠ বীণাবাদক ও হস্তি বিদ্যায়। আর এ কথা তো প্রমাণিত হস্তি বিদ্যায় আমরাই পথকৃৎ।

ভারতের প্রথম নাট্যকার তাই মনেকরেন ভরতমুনি বাংলার লোক। তার কথার যুক্তি খুঁজে পাই যখন দেখি কথ্য রীতিতে নাটক পরিবেশন রীতি অনুসরণ করছেন ভরতমুনি। এই রীতিতে হস্তি-আয়ুরবেদ রচনা করেছে পালকাপ্য। বাংলা মুলুকের পালকাপ্য শাস্ত্রগ্রন্থ নাট্যশাস্ত্রের রচনার সাতশ বছর আগে রচনা করেন।
এবার আশি ভারতের ইতিহাস বিষয়ক প্রথন গ্রন্থ কাশ্মীরের কবি কালহনের রাজতরঙ্গিনীর কথায়। সেখানে পৌন্ড্রনগরের সংস্কৃতির প্রামাণ্য চিত্র দেখতে পাই। অনেকটা নির্মোহ কায়দায় রচিত এই কাব্য গ্রন্থে দেখি পৌন্ড্রনগরে স্কন্দমন্দির বা কার্তিকের মন্দির ছিল সেসময় ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে নৃত্যগীতের শ্রেষ্ঠ জায়গা।         


পৌন্ড্রনগরে স্কন্দ মন্দিরের নাট মন্দিরেপাদপীঠেই সর্বপ্রথম পরিবেশিত হয়েছিল গীত, নৃত্য আর নাটক। এখানেই ধর্ম প্রচারের কারনে ধর্মের আচার/আচরনে স্তরে স্তরে একদিন জমে ওঠেছিল সমৃদ্ধশীল সংস্কৃতির।

মহাস্থান দুর্গ থেকে বগুড়া সহরের দিকে (৪/৫ কি.মি.) যেতে বাঘপারা নামক স্থান স্কন্ধের ধাপ (স্কন্ধনগর গ্রাম) অবস্থিত। যেখানে কলহনের বর্ণনায় উর্বশী কমলার বাসস্থান বা স্কন্ধ মন্দির বা কার্তিক মন্দির। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ও একটি পুরন জলাশয় আছে। যাকে ময়নামতীর দিঘি নামে পরিচিত। ব্রিটিশ ভারতের পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার কানিংহামের মতে এই মন্দির পুন্ড্রনগরের বৌদ্ধ মন্দির।
স্কন্দের ধাপের দৈর্ঘ্য ৪৫মিটার, প্রস্থ ৪০ মিটার ও উচ্চতা ৪.৫০ মিটার বিশিষ্ট ঢিবি। সরাকরি পর্যায়ে খনন হয়নি। তবে স্থানিয় দের আনাড়ি উৎখনন করার কারণে ঢিবির অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তারা একটি বেলে পাথরের তৈরি কার্তিক মূর্তি এবং প্রত্নঢিবিটির দক্ষিণ পাশে ২৮২৭৫ ঘন সেমি এবং ২৩১৯৪ ঘন সেমি পরিমাপের ইট নির্মিত একটি দেয়াল উন্মোচিত হয়েছে। প্রত্নস্থলের সর্বত্র প্রাচীন মৃৎপাত্র এবং ইটের টুকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এই প্রত্নঢিবিতে রাজতরঙ্গিণী ছাড়াও খুব সম্ভবত করতোয়া মাহাত্ম্য এবং রামচরিত গ্রন্থে উল্লিখিত কন্দের মন্দিরটি লুকিয়ে আছে। যথাযথ খনন হয়নি এদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জমি। অবহেলা আর অবহেলিত থেকেছে আমাদের উৎসের সন্ধান।

পৌন্ড্র বর্ধনং ক্ষেত্রং নৈব মুনচতি কেশব
ধারিত্রা নাভি কমলাং প্লুতং করজৈলম
করতোয়া সদানীরে সবিৎ সুশ্রিতে
পৌন্ড্রান প্লায়েসে নিত্যং পাপং করোদ্ভাবে

প্রাচীন নগরী পুন্ড্রবর্ধনের জলকাদায় আর প্রাচীন নদী কলতু (আজকের করতোয়া)র সমাতটের রন্ধে রন্ধে তার স্পন্দমান ছিলো সংগীত, দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য প্রার্থনারত নর্তকীর সবল শরীরের ভঙ্গিমাসহ রমনীর পায়ের নূপুর ধ্বনি। হাজার বছরের চিরায়ত বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছিল, কালের চক্রে আজ তা লুপ্ত।

নাট্যতত্ত্ব বিশারদ সেলিম আল দীন তাঁর নাট্যকোষগ্রন্থে প্রামাণ দেখান যে, হাজার বছরের আবহমান বাংলা নাট্যরীতিতে কল্পনার আশ্রয়ে দৃশ্যপট তৈরি অতিপরিচিত একটি বিষয়। এ-নাটকে দৃশ্যপটের বিশ্বাসযোগ্যতা অবাক করার মতোই। সংগীত কোরিওগ্রাফিতে অনবদ্য শিল্পকুশলতায় ধরা দেয় দৃশ্য। গ্রামীণ পালাগুলোতে উড়না, পর্দা, বালিশ ইত্যাদির বহুমাত্রিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এখানের মনোভঙ্গিতেও সে-রীতির ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট।

বাঙলা নাট্যকোষ গ্রন্থে সেলিম আল দীন সংজ্ঞায় এ নাট্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন- বর্ণনা ও উক্তি-প্রত্যুক্তি প্রাধ্যান্যে মধ্যযুগের পাঁচালি ও কথকতা ধারায় আধুনিক কালের উপন্যাস বা কথা সাহিত্যের ধাঁচে রচিত নাট্যই বর্ণনাত্মক নাট্য।
পাঁচালি, লীলা, গীত, গীতনাট, পালা, পাট, যাত্রা, গম্ভীরা, আলকাপ, ঘাটু, হাস্তর, মঙ্গলনাট, গাজীর গান ইত্যাদি বিষয় ও রীতিকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে।’ (মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-০৪)।

আবহমান বাংলার অভিনয়রীতিও বর্ণনা ও উক্তি-প্রত্যুক্তির অদ্বৈত মিলনে অভিনয় ক্রিয়ার বর্ণনাত্মক অভিনয় বৈশিষ্ট্য। পাশ্চাত্য নাট্যরীতি সংলাপ নির্ভর কিংবা বাঙলার নাট্যরীতি বর্ণনা বা ব্যাখ্যা নির্ভর। সেলিম আল দীন বলেন- আমাদের নাটক পাশ্চাত্যের মতো ন্যারেটিভও রিচুয়্যাল থেকে পৃথকীকৃত সুনির্দিষ্ট চরিত্রাভিনয় রীতির সীমায় আবদ্ধ নয়।

জয়দেব স্বয়ং সঙ্গীত বিশারদ ছিলেন। গীতগোবিন্দ গাইবার ও নাচবার জন্য জয়দেবের দল ছিল। পদ্মাবতী সেই দলে নাচতেন এবং জয়দেব মৃদঙ্গ বাজিয়ে গাইতেন। গীতগোবিন্দের পদগুলিতে সেকালের নৃত্যগীত বা নাটযাত্রা পালার নিদর্শন পাওয়া যায়।
কোচবিহারের ছোটরাজা শুক্লধ্বজ তাঁর গীতগোৱিন্দ’–এর টীকায় এই কথা বলেছেন এবং তাঁর সভাকবি রাম সরস্বতীও সে কথার পুনরুক্তি করেছেন জয়দেৱকাৱ্য’–তে

কৃষ্ণের গীতক জয়দেব নিদ্গতি
রূপক তালে চেবে নাচে পদ্মাবতী।

জয়দেবপদ্মাবতীর সঙ্গীতাভিজ্ঞতার চমকপ্রদ কাহিনী আছে সেকশুভোদয়ায়। জয়দেবের গানের দল ছিল এবং তিনি ছিলেন দলের অধিকারী। তাঁর এক দোঁহায় পরাশরের নাম তো গীতগোবিন্দের শেষে পরিচয়শ্লোকেই আছে
শ্রী ভোজদেব প্রভরস্য বামাদেবীসুতশ্রীজয়দেবকস্য।
পরাশরাদিপ্রিয়বন্ধু কণ্ঠে শ্রীগীতগোবিন্দকরিতরমস্তু।

পরাশর ছিলেন বন্ধুশ্বশুরবাড়ী অথবা মামারবাড়ীর লোক, সুতরাং গানের দল ছিল ঘরোয়া। জয়দেব রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়সম্পৃক্ত গীতগোবিন্দ সারাভারতে প্রচারিত হয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে, তার মূলে বিশেষ অবদান শ্রীচৈতন্যের। যার ফলে ভারতের সব রাজ্যেরই নৃত্যগীতনাট্যকাব্যচিত্রকলায় গীতগোবিন্দ তথা রাধাতত্ত্ব স্থান পেয়েছে ষোড়শ শতক থেকে। এই পরকীয়া রাধার ক্রমবিকাশ এবং প্রতিষ্ঠার জোরালো ভূমি বাংলা। ভাগবতে, মহাভারতে কোথাও রাধার উল্লেখ নেই। প্রসঙ্গত, এই রাধাকৃষ্ণের দ্বৈতবাদ কপিল মুনির সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতিপুরুষের দ্বৈতবাদেরই বৈষ্ণবীয় সংস্করণ। কথিত, আদিবিদ্বান মহাসিদ্ধাচার্য কপিল খুলনায় জন্মেছিলেন এবং গঙ্গাসাগরে ওঁর আশ্রম আজ এক পুণ্যতীর্থ।

বুদ্ধ-নাটকের উল্লেখ লক্ষ করিবার মতন। নৃত্য এবং গীতের সাহায্যে এক ধরনের নাট্যাভিনয় বোধ হয় প্রাচীন বাঙলায় সুপ্রচলিত ছিল, এবং এই নাচ-গানের ভিতর দিয়াই বোধ হয় কোনও বিশেষ ঘটনাকে (এই ক্ষেত্রে বুদ্ধদেবের জীবন কাহিনীকে?) রূপদান করা হইত। চর্যাপদে পাই বজ্রাচার্য ও দেবী দুজনে মিলিত হয়ে বুদ্ধের জীবনকাহিনী নৃত্য ও সঙ্গীতের মাধ্যমে অভিনয় করছেন
নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী,
বুদ্ধনাটক বিসমা হোই।।

যেরকম নথিভুক্ত ইতিহাসে দেখা যায়, তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, অর্থাৎ গুপ্তযুগের প্রাথমিক সময়কাল থেকেই ষোড়শ শতক পর্যন্ত সম্পূর্ণ পুরাণ যুগে বসন্ত বা মদন বা কামমহোৎসব নামে একটি উৎসব উত্তর ভারতের সর্বত্র অতিসমারোহে পালিত হতো। এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায় তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাৎসায়নের কামসূত্রে, সপ্তম শতকে শ্রীহর্ষের রত্নাবলীতে, অষ্টম শতকের মালতী-মাধব নাটকে, একাদশ শতকে অল-বিরুনির লেখায়, দ্বাদশ শতকে জীমূতবাহনের কালবিবেক গ্রন্থে এবং ষোড়শ শতকে রঘুনন্দনের বিবরণে। এই উৎসবে প্রচুর নৃত্যগীতবাদ্য, শৃঙ্গারসূচক সংলাপ ও যৌনতাব্যঞ্জক অঙ্গভঙ্গি মুখ্য স্থান নিয়ে থাকতো। পূজা অনুষ্ঠানের অভীষ্ট দেবতা ছিলেন মদন ও রতি দেবী এবং পুষ্পময় চৈত্রের অশোক বৃক্ষের ছায়ায় তার আয়োজন করা হতো। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীহর্ষের রত্নাবলী নাটকে মদন মহোৎসবে ভিজ্যুয়ালটি এইভাবের বর্ণনা করা হচ্ছে   

ত্রয়োদশপঞ্চদশ শতকে উত্তরবঙ্গের বারেন্দ্র লাহিড়ী পরিবার ভুক্ত পণ্ডিত শুভঙ্কর বিরচিত সঙ্গীত দামোদর এক আকর গ্রন্থ। এসব নাট্যশাস্ত্র থেকেই বাংলার তথা বাঙালীর সঙ্গীতইতিহাসের শুরু ধরতে হবে। গউড়া এবং গবড়া একই রাগ বলে মনে হয়, এবং এই রাগ গৌড়বঙ্গের উদ্দেশ্যেই রচিত। শীবরী ও শবরী এই রাগদুটিও একই। মনে হয় কলমের প্রমাদে শবরী রাগটি শীবরী লেখা হয়েছে। গুঞ্জরী ও কহ্নুগুঞ্জরী রাগদুটিও একই পর্যায়ের। সম্ভবতঃ প্রাচীন গুর্জরী রাগকেই বাংলায় গুঞ্জরী আখ্যা দেওয়া হত। মনেহয় কাহ্নুপাদ গুঞ্জরী রাগের একটি বিশেষ প্রকরণ ব্যবহার করেছিলেন এবং তাঁর নিজের নামানুসারে ঐ রাগটির নামকরণ করেছিলেন কহ্নুগুঞ্জরী। এগুলির মধ্যে এমন বহু রাগ আছে যার উল্লেখ সমকালীন কোন সর্বভারতীয় সঙ্গীতগ্রন্থেই নেই, যেমনবলাড্ডী ও অরু। তাছাড়া গবড়া ও বঙ্গাল় রাগদুটি নিতান্তই আঞ্চলিক রাগ। মালশী বলে যে রাগটির উল্লেখ আছে, অনেকে এটিকে মালশ্রী বলে মনে করেন। কিন্তু এবিষয়ে উল্লেখ্য হল, মালশী নামে একটি সঙ্গীতধারা অতিপ্রাচীনকাল থেকেই এদেশে প্রচলিত ছিল।

গুড় মাগধী (ওড্রমাগধী)   

ভাস এই ভারতবর্ষের প্রথম নাট্যকার। তাঁর মতে সমগ্র অঞ্চলে মানুষেরা মূলত চারটি ধারায় নাটক রচনা করত। সেই ধারা বা প্রবৃত্তির গুল হোল- আবিস্তী, দাক্ষিণাত্যা, পাঞ্চালী ও গুড় মাগধী     

গুড় মাগধী বা ওড়ামাগধী (ওড্রমাগধী) ভারতের পূৰ্বাঞ্চলের লোকের বা বঙ্গের একটা প্ৰবৃত্তি বলে ভাসসহ ভরতমুনি মনে করেন। বঙ্গদেশ প্রধান নাট্যরীতি গুড় মাগধী বিশিষ্ট ছিল মূলত প্রহসনমূলক। ছোট কাহিনী। গান ও হাস্যরস প্রচুর।
ভরতমুনি তাঁহার নাট্যশাস্ত্রকে (আনুমানিক তৃতীয় শতক) পঞ্চম বেদ’ বলা হয়ে থাকে। এই সর্বভারতীয় শাস্ত্রগ্রন্থ নাট্যশাস্ত্রের চতুর্দশ অধ্যায়ে ‘প্রব্রিত্তি’ অর্থাৎ শিল্পে চারপ্রকার রীতির উল্লেখ আছে। এর মধ্যা ওড্রমাগধীরীতির প্রসারের অঞ্চল যদি পর্যবেক্ষণ করা হয় তবে দেখা যাবে প্রায় পুরোটাই বৃহৎবঙ্গ এবং একেবারে বাংলা সংলগ্ন অঞ্চলে এটি প্রচলিত ছিল
অঙ্গা ৱঙ্গা উৎকল়িঙ্গা বৎসাশ্চৈবৌড্রমাগধাঃ। 
পৌণ্ড্রা নেপাল়কাশ্চৈৱ অন্তর্গিরিবহির্গিরাঃ।।
তথা প্রবঙ্গ মাহেন্দ্রমলদা মল্লবর্তকাঃ।
ব্রহ্মোত্তর প্রভৃতয়ো ভার্গবা মার্গবাস্তথা।।
প্রাগ্জ্যোতিষাঃ পুলিন্দাশ্চ বৈদেহাস্তাম্রলিপ্তকাঃ।
প্রাঙ্গপ্রভৃতয়ৎশ্চৈ যুঞ্জন্তি চৌড্রমাগধিম্।।

এই শ্লোকটি থেকে বৃহৎবঙ্গের যে অঞ্চলগুলি পাই সেগুলি হল অঙ্গ (বর্তমানের ভাগলপুর জেলার মুঙ্গেরের অন্তর্ভুক্ত), বঙ্গ (বঙ্গদেশের মধ্যভাগ), পৌণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ মূলত রাজশাহীবগুড়া ইত্যাদি অঞ্চল), তাম্রলিপ্ত (তমলুক), দক্ষিণ (মেদিনীপুর ও ভাগীরথী নদীর লাগোয়া বদ্বীপ অঞ্চলসমূহ), ব্রহ্মোত্তর (মুর্শিদাবাদ অঞ্চল), অন্তর্গিরি (বিহারের রাজমহল পাহাড় অঞ্চল), বহির্গিরি (বীরভূম), প্রবঙ্গ (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণভাগ), মলদা (মালদহ), মল্লবর্তক (পুরুলিয়া এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যের লাগোয়া অঞ্চল), ভার্গব (সিকিমভুটান অঞ্চল) এবং প্রাঙ্গ (বাঁকুড়া)

এছাড়া বাংলা লাগোয়া পার্শ্ববর্তী রাজ্য কল়িঙ্গ এবং প্রাগ্জ্যোতিষপুরের উল্লেখ পাই। এর দ্বারা বোঝা যায় যে ওড্রমাগধী রীতি যথার্থই সারাবাংলা জুড়ে (বৃহৎবঙ্গ) ছড়িয়ে ছিল। দক্ষিণে তাম্রলিপ্ত থেকে উত্তরের পৌণ্ড্রবর্ধন তথা হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত এবং পশ্চিমে মল্লভূম অর্থাৎ পুরুলিয়া ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে পূর্ববঙ্গ পর্যন্ত। এই রীতির

‘বৃত্তিবা style ভারতী ও কৈশিকী আশ্রিত
ভারতীং কৈশিকীং চৈব ‘বৃত্তিমেষা সমাশ্রিতা।

ভারতী অর্থাৎ কথোপকথন সহযোগে উচ্চণ্ড এবং কৈশিকী (কেশ হইতে কৈশিকী’) অর্থাৎ লাবণ্যমণ্ডিত লাস্যাঙ্গ যেহেতু গঙ্গাঋদ্ধি বা গঙ্গাহৃদি বা গঙ্গারাঢ়ী সভ্যতার যুগের সঙ্গীত সম্বন্ধে কোন সাহিত্যিক অথবা প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি তাই এই নাট্যশাস্ত্র থেকেই বাংলার তথা বাঙালীর সঙ্গীতইতিহাসের শুরু ধরতে হবে। ভরতপরবর্তীযুগ থেকে আজ অবধি বাংলা এই ভারতী ও কৈশিকী বৃত্তির উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। খ্রিস্টের দুই’শ বৎসর পূর্বেও যদি বাংলায় নাটকের একটা স্বতন্ত্র রীতি প্রচলিত থাকার ব্যাপারটা বাঙালীর কম গৌরবের কথা নয়


প্ৰাচীন বাংলায় গৌরব গৌড়ীরীতি
  
গৌড় অঞ্চলে এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, স্থানবাচক শব্দটি বিশেষণহিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে। ভারতের নাট্য শাস্ত্রে প্রাচীনকালে উল্লেখ আছে যে, নাট্যাভিনয়ে গৌড়পাত্রগণঅর্দ্ধ মাগধী ভাষা ব্যবহার করতেন। আজকের বাংলাভাষারই পূর্বসূরী বলা যায় এই অর্ধমাগধীকে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে দেখা যাচ্ছে যে গৌড়ীয় চরিত্ররা মঞ্চে অর্ধমাগধী ভাষায় কথা বলত।

বিষয়টি স্বীকার করেছেন বাণভট্ট (ষষ্ঠসপ্তম শতক) এবং বিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তী তাঁর সাহিত্যদর্পণ গ্রন্থে। এই গৌড়ীরীতির বৈশিষ্ট্য হল অক্ষরডম্বরঅর্থাৎ ঘনরসময়ী বঙ্গাল়রাণীঅক্ষরডম্বরের প্রাবল্য মাধুর্য দেখতে পাই গীতগোবিন্দের প্রতিটি ছত্রে। যেমন
প্রল়য়পয়োধিজলে ধৃতবাণ্ অসি বেদম্
বিহিতবহিত্রচরিত্রম্ অখেদম্…” ইত্যাদি।
ঠিক এই পথ ধরেই উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথের রচনা
ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরসে
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা।
অথবা- 
অয়ি ভুবনমনোমোহিনী, মা,
অয়ি নির্মলসূর্যকরোজ্জ্বল ধরণী
জনকজননীজননী…”

এক্ষণে সংস্কৃতকাব্যের গৌড়ীরীতি, সপ্তগীতির অন্তর্গত গৌড়ীগীতি, এবং গৌড়ী প্রাকৃত ভাষা সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। গৌড়ীরীতি এবং গৌড়ীগীতির মূল সাঙ্গিতিক বৈশিষ্ট্য হল তার ছন্দ।

অথচ গৌড়ী প্রাকৃত বরাবরই গৌড়ী সংস্কৃতের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে থেকেছে এবং কখনই এই নিয়ম মেনে চলেনি। গৌড়ী, গৌড়-সারঙ্গ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ রাগ-রাগিণীর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে এই সময়ের বিভিন্ন সংস্কৃত শাস্ত্রে।

সঙ্গীত রত্নাকর বইতে সঙ্গীতের যে সব রীতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে যে সব রাগ-রাগিনীর কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে গৌড়মল্লার”, “গৌড়সারঙ্গ”, “গৌড়কৌশিক”, “কর্ণাট- গৌড়এই সব নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
তাছাড়া চর্যাগীতির মধ্যে বলা গবড়াবা গউড়ানামটি সম্ভবত গৌড়নামের সঙ্গে যুক্ত।
গৌড়বাসীদের সংস্কৃত রচনাশৈলী অলঙ্কারশাস্ত্রে গৌড়ী রীতিনামে খ্যাত। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে স্বীকৃত চারপ্রকার রচনাশৈলীর মধ্যে এটি একটি। আলঙ্ককারিক ভামরু এবং দণ্ডী সেকালের কাব্য রীতির সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রাচীন বৈদর্ভরীতির সঙ্গে গৌড়রীতির কথাও সম্ভ্রমের সাথে বারবার বলেছেন। সেযুগে সর্বভারত গ্রাহ্য বৈদর্ভরীতির মানের পাশে গৌড়রীতির তার একটা আলাদা আসন নিয়েছিল। প্রাচীন বাংলার এটা একটা দারুণ গর্বের ব্যাপার।

আলঙ্ককারিক ভামরু (কাশ্মীরের ভামহ; ষষ্ঠ শতক) এবং দণ্ডী (দ্রাবিড়দেশের দণ্ডিণর ‘কাব্যাদর্শে; ষষ্ঠ শতক) সেকালের কাব্য রীতির সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রাচীন বৈদর্ভরীতির সঙ্গে গৌড়রীতির কথাও সম্ভ্রমের সাথে বারবার বলেছেন।প্রাচীন বাংলার এটা একটা দারুণ গর্বের ব্যাপার।

বঙ্গের পট নাচানো দেখে শিখেছে রোম  


পট নাচানো খৃষ্ট-জন্মের বহপূর্ব হতে এদেশে প্রচলিত ছিল। বিক্রমপুরে পট নাচানোনামে পরিচিত। বঙ্গের কোন কোন স্থানে এই শ্রেণীর পটুয়াদিগকে পটিদারবলে। এই রীতিতে বৌদ্ধগণ জাতকের গল্পগুলি সাধারণের মধ্যে প্রচার করতেনএই কলাকে প্রাচীন কালে ‘মঙ্করী বলা হত এবং চিত্রগুলিকে কখনও কখনও ‘যমপট বলা হত, যেহেতু চিত্রের উপসংহারে ধৰ্ম্মরাজের সভা ও পাপের দণ্ড প্রদর্শিত হত। শেষোক্ত প্ৰথাটা এখন পৰ্যন্তও বিদ্যমান। মুম্বারাক্ষস প্রকৃতি নাটকে এধরণের চিত্র-প্রদর্শনের উল্লেখ আছে। বৌদ্ধদের অনুকরণে খৃষ্টানেরাও এইরূপ চিত্র দেখিয়ে তাদের ধর্ম প্রচার করতেন, রোমে ভ্যাটিকানে খ্রিষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে 'পেপিয়াস’ (Papyrus) পত্রে অঙ্কিত এইরূপ কয়েকখানি ছবি আছে। আশ্চর্য্যের বিষয় এই মস্কয়ী প্রাচীন ধারাটি সেদিন পৰ্যন্তও বাদামী চিত্রকারেরা রক্ষণ করে আসছিল

কলহন নিয়ে কলহ  

প্রাচীন ভারতের প্রথম ইতিহাসমূলক গ্রন্থের নাম রাজতরঙ্গিনী এর রচনা কাল নিয়ে বিতর্ক দেখছি। বাংলাপিডিয়ায় দেখছি সপ্তম শতাব্দী। তবে বেশীরভাগ ঐতিহাসিকের মত দেখছি ১১৪৮ থেকে ১১৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কাশ্মীরপতি মহারাজ জয়সিংহ দেবের সময়ে রচিতকিছু কিছু স্থানে দেখছি দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত।
রচনার কাল বিভ্রান্তির কারণে পুণ্ড্র তথা এই অঞ্চলের ছবি ঠিকঠাক তৈরি করতে সমস্যা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কলহনের রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে মৌর্য আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী অনেক ঘটনা বিশেষ করে কাশ্মীরের রাজাদের কাহিনি বিস্তারিত বর্ণনা লেখক বর্ণনা করেছেনশৈব শাস্ত্রে সুপণ্ডিত কলহন নিরপেক্ষ বিচারবুদ্ধি, তথ‌্যবিন‌্যাস এবং দেশ ও জাতি সম্বন্ধে জ্ঞাতব‌্য তথ‌্যসমূহের নিবিড় পরিচয়ই ঐতিহাসিককে প্রকৃত ইতিহাস রচনায় প্রেরণা জোগায়। মুদ্রা, জালমুদ্রা, যুদ্ধবিগ্রহ, অপরাধপ্রবণতা, গুপ্তচরবৃত্তি, সজ্ঞানে অপরকে প্রতারিত করার পাশাপাশি মন্দির-উদ‌্যান-বিহার নির্মাণ, খালখনন, জলবণ্টন ব‌্যবস্থার উন্নয়ন ইত‌্যাদি ভেদে অমা-উমা উভয়ই চিত্রিত হয়েছে গ্রন্থটিতে।

তিনি বৌদ্ধমতের প্রতিও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেনপণ্ডিতের অনুমান করেন যে, কহলন তাঙ্গার গুরু অলক দত্তের নির্দেশে রাজতরঙ্গিণী রচনা করেনউক্ত গ্রন্থ পুধবৰ্ত্ত কবিদের গ্রন্থাবলীর সহিত বিশেষ পাবচিত ছিলেনজ্যোতিষশ'ম্বে ও তাহার বুৎপত্তি ছিল



কলহনের রাজতরঙ্গিনী একখানি নিরপেক্ষ প্রামাণিক ইতিহাসকবি তার গ্রন্থে স্বদেশ বাসীদিগের দোষ ক্রটা উপেক্ষ করেন নাই! তিনি গ্রন্থের প্রারম্ভেই স্বীকার করিয়াছেন যে, পূৰ্ব্ববৰ্ত্তী কবি ও ঐতিহাসিকদের গ্রন্থাবলীহইতে তিনি প্রভূত সাগল গ্রহণ করিয়ছেনকিন্তু তাহার গ্রন্থ পাঠে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তিনি নূতন ও নিজ সংগৃহীত তথ্যও যোজন। করিয়াছিলেনতাহার গ্রন্থের ভাষা প্রাঞ্জল ও স্থানে স্থানে কবিত্ব পূর্ণ।

কাশ্মীরি পণ্ডিত কলহানের রাজতরঙ্গিনীগ্রন্থ অনুযায়ী সম্রাট হর্ষ বিক্রমাদিত্য শক আক্রমণ কারীদের পরাজিত করেছিলেন। ঐতিহাসিক ডি সি সরকারের মতে কলহান সম্ভবত পুষ্পবতী রাজবংশের রাজা হর্ষবর্ধনের সহিত কিংবদন্তি সম্রাট বিক্রমাদিত্যকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। এছাড়াও বিক্রমাদিত্য উপাধিধারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দক্ষিণাত্যের চালুক্য বংশের সম্রাটরা। অন্তত সাতজন চালুক্য সম্রাট বিক্রমাদিত্য উপাধি ব্যবহার করেছিলেন। এদের মধ্যে সম্রাট দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য চালুক্য সম্রাট নাগভট্ট দ্বিতীয় আর বাপ্পা রাওয়ালের সঙ্গে হিন্দু বাহিনীর এক মহাজোট নির্মাণ করে আরবের খলিফা বাহিনীর ইসলামিক আগ্রাসনকারীদের পরাজিত করেছিলেন। ওনার শাসনকাল ছিল ৭৩৩ থেকে ৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দ।

নানান লোকগাথা, কিংবদন্তি, জনশ্রুতি আর রোমাঞ্চকর ও ঐতিহ্যশালী ইতিহাসে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ প্রাচীন ভারতবর্ষ। প্রাচীন ভারতবর্ষে শাসন করেছেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সম্রাট বিন্দুসার, সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত, সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, সম্রাট খারবেলা, সম্রাট গৌতমীপুত্র শতকার্ণী প্রভৃতিদের মতো বহু শক্তিশালী ও মহান সম্রাট। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্থানীয় লোকগাথা আর জনশ্রুতির ফলে ঐতিহাসিক চরিত্র থেকে কিংবদন্তি চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। প্রাচীন ভারতবর্ষের কিংবদন্তি সম্রাটদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিক্রমাদিত্য। 
রাজতরঙ্গিণী থেকে জানা যায় যে, কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্যের পৌত্র জয়াপীড় পৌন্ড্রনগরে কার্তিকেয়ের মন্দিরে কমলা নামের সুন্দরী ও দক্ষ নৃত্যশিল্পীর অভিনয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। 

শেষ কথা

সেই ঐতিহাসিক পৌন্ড্রবর্ধন। কত অতীত ঠিক করে বলা যাবেনা। দিব্যাবদান, রাজতরঙ্গিনী, বৃহত্কথা মঞ্জুরীসহ নানা প্রাচীন গ্রন্থে পুণ্ড্র ও লিপিমালায় প্রধান নগর হিসেবে পুণ্ড্রবর্ধনের উল্লেখ রয়েছে। বারো শতকের করতোয়া মাহাত্ম্য গ্রন্থে পুণ্ড্রবর্ধনকে পৃথিবীর আদি ভবন (আদ্যম ভুবোভবনম) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন, (বৈদিক) আর্য্যগণ আপনাদের বসতি বিস্তার করিয়া যখন এলাহাবাদ পর্যন্ত উপস্থিত হন, তখন বাঙ্গালার সভ্যতায় ঈর্ষ্যাপরবশ হইয়া তাঁহারা বাঙ্গালীকে ধর্ম্মজ্ঞানশূন্য এবং ভাষাশূন্য পক্ষী বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন
  
পৌন্ড্র নগরীর জলমাটিতে যে সভ্যতার আলো দেখা দিয়েছিল তা লৌকিক উৎসব কিংবা ধর্মীয় বা প্রাত্যেহিক জীবনের বিচিত্র জীবন ভাষ্য নিয়ে নির্মিত হয়েছিল যে অনুপম উপাখ্যানের ধারা, আজ হারিয়ে গেছে নি:শব্দে এই চরাচরে। অথচ অনবরত সংগ্রামূখর পৌন্ড্রনগরের মানুষের বিচিত্র কর্ম কাহিনী নিয়ে সৃষ্টি হতে পারতো আমাদের সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির উৎস।

ঐতিহাসিক সময়ে আমরা দেখি আমাদের বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে পুণ্ড্র, দক্ষিণে রাঢ়, এবং দক্ষিণ সমুদ্র উপকূল বরাবর সুহ্ম রাজ্য গড়ে উঠেছিল পূর্বে ছিল বঙ্গ এবং বঙ্গের দক্ষিণভাগে সমুদ্র উপকূলে সমতট রাজ্য গড়ে উঠেছিল আজকের নিরিখে বলতে গেলে, পুণ্ড্র (পাল আমলে যা বরেন্দ্রী বলে পরিচিত) হল উত্তরবঙ্গ পুণ্ড্র রাজ্যের রাজধানী ছিল মালদার পাণ্ডুয়ায় পুণ্ড্রের মধ্য থেকেই গৌড়ের উত্থান  ক্রমশঃ গৌড়ীয় নামটিকে পেছনে ফেলে দিয়ে এই জাতির নাম হয়ে দাঁড়ায় বাঙালি

ভারতের ইতিহাস আর বাংলার ইতিহাসের মধ্যেও রয়েছে সাংস্কৃতিক পার্থক্য। তাই এখানকার অনুসন্ধান করা হোক নিজস্ব রীতিতে। তা না হলে সিংহের ছবির মতো হবে। মনে রাখতে হবে এ জনপদের রন্ধে রন্ধে যে গীত রচিত হয়েছিল তা উঠে আসুক আমাদের সংস্কৃতিতে। এখন বড় প্রয়োজন এ জনপদের মানুষের সংস্কৃতির শিকড় সন্ধানী অভিযাত্রীর।

বঙ্কিম চন্দ্রের কথা দিয়ে শেষ করি। তিনি আত্মশ্লাঘ করেছেন, আমার বিশ্বাস বাঙ্গালী একটি আত্মবিস্মৃত জাতি বিষ্ণু যখন রামরূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, তখন কোন ঋষির শাপে তিনি আত্মবিস্মৃত হইয়াছিলেন তিনি ধরাধামে আসিয়া ঈশ্বরেরই লীলা করিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তিনি যে ঈশ্বর একথা তিনি কখনও বলেন নাই, কার্যে বা কর্মে কখনও দেখান নাই এবং কখনও তিনি স্মরণ করেন নাই বাঙ্গালীও তেমনি  

##

সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী 
০১৯১২০৭৮৫৯৩

 sajedurrahmanvp@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান