পুণ্ড্রের পাঁচালী-১৭ (চিত্রে প্রতিবাদ এবং হতভাগ্য চিত্রকরগণ; বা.বী.গাঁথা-পঞ্চম পর্ব )
পুণ্ড্রের
পাঁচালী-১৭ (বাঙালির বীরত্ব গাঁথা-পঞ্চম পর্ব )
সাজেদুর
রহমান
প্রথমেই
পাঠকদের একটা কথা বলে নিতে চাই, যে অবিশ্বাস্য বীরত্তের ইতিহাস আপনাদের শোনাতে
যাচ্ছি, তার নির্মম বর্ণনা করার ক্ষ্মতা আমার নেই। শুধু এই টুকু বলতে পারি পুণ্ড্রের
এক চিত্রকর ধর্মীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি চিত্র এঁকেছিলেন। স্থানীয়দের মাঝে চিত্রটি
অসম্ভব সুখ্যাতি পেয়েছিল।
স্থানীয়দের
এই প্রতীবাদের পাল্টা জবাবে সম্রাট অশোক পুণ্ড্রবর্ধনের ১৮ হাজার মানুষকে হত্যা
করা। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি বীর বাঙালি চিত্রশিল্পী এতে দমিত না হয়ে কিছুদিন পরে
একই রকম চিত্র আঁকে। বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েও সম্রাট ওই চিত্রকর ও তার পরিবারকে
আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।
আজকের
পর্বে এমন বিদ্রোহী চিত্রকর ও তার সম্প্রদায়ের করুণ পরিণতির কথা বলব। আর বলব বাংলার
প্রাচীন নারী চিত্র শিল্পী ‘চিত্রলেখা’র বিষয়ে। যিনি বাণরাজার মন্ত্রীর কন্যা।
বাংলার চিত্রকলা
ইতিহাস তিন/চারহাজার পুরন। বর্ধমান জেলার পাণ্ডুরাজার ঢিবি খুঁড়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা
বাংলার প্রাচীনতম চিত্রকলার নিদর্শন আবিস্কার করেছেন। অজয় নদ আর কুনুর নদীর
অববাহিকায় পাওয়া তাম্রপ্রস্তর পর্যায়ের পুরাবস্তুগুলোর মধ্যে নকশা আঁকা দুটো
মৃৎপাত্র তিনহাজার বছর আগেও বাংলায় চিত্রাঙ্কন প্রচলনের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
মৃৎপাত্রের
ওপর অঙ্কিত ছবিদুটির একটি হল জালের সংলগ্ন একসার মাছ, আরেকটি
হল একটি ময়ূরী সাপ ধরে আছে তার ঠোঁট দিয়ে। বাণগড় থেকে পাওয়া উভয় প্বার্শে
সহচরীসহ মেঘ বর্ষিত জলে স্নানরতা নারী মূর্ত্তি খচিত বিশেষ ফলকটি বাংলার টেরাকোটা
শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। বাঙালির জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবির সেই ধারাবাহিকতাকে
ধারণ করে চলে এসেছে।
এখানকার
শিল্পিরা দক্ষ হাতে সূক্ষ্ম ও শৈল্পিক অলংকরণের মাধ্যমে টেরাকোটা ফলকগুলিতে তাঁদের
স্ব প্রতিভার যে স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দেবদেবী, রাজা জমিদার দের প্রতিকৃতি যোদ্ধা,
কুস্তিগীর, গায়ক, বাদক,
নর্তক বিভিন্ন পশু প্রাণী কীট পতঙ্গ, পাখী,
বৃক্ষ লতা, ফল ফুল ইত্যাদি মূর্তি খচিত
টেরাকোটা শিল্পকলার নিদর্শন পাওয়া যায়। এই শিল্পকলা গুলি বেশির ভাগই কুষাণ যুগের।
চিত্রে প্রতিবাদ এবং
হতভাগ্য চিত্রকরগণ
তিনটে শরীর উদ্দাম নেচে
যাচ্ছে। তাদের লম্বা লম্বা চুল কিন্তু সরু লিকলিকে লেজের মত ঝাপটা মারছে সমানে। নির্গ্রন্থী
পন্থী তিন যুবক বৃষভদত্ত,
সিংহ আর সত্যক এক চিত্রের সামনে নাচ্চছে। তাদের নাচে দেখতে ভীর করেছে
পুণ্ড্রবর্ধনের অধিবাসী।
জনতার চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। তারা এমন
চিত্র আগে দেখেনি। কাঠের উপর আঁকা চিত্রে দেখা যাচ্ছে, জৈন ধর্মগুরু ধর্ম গুরু নির্গ্রন্থ মহাবীরের সামনে
বৌদ্ধ গুরু তথাগত বুদ্ধ মাথা নত করে বসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন
করছেন। কৌতূহলী জনতার মাঝে একজন বলল, বৌদ্ধদের
কি ছোট করা হোল না? তিন যুবকের মধ্যে একজন, সত্যক বলল, তথাগতর পূর্ববর্তী আচার্য। তিনি তাই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেই
পারেন। এতে তার কোন দোষ নাই।
সত্যকের কথায় সকলে
ধন্য ধন্য বলে উঠল। এর মধ্যে আজীবিক সম্প্রদায়ের কেউ কেউ নাচতে শুরু করেছে।
নাচতে নাচতে একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পরছে। মহিলারা আরতি
ও গীতবাদ্য সহকারে নৃত্য করছে।
চিত্রটি অসম্ভব সুখ্যাতি
পেয়েছে। এক শ্রেষ্ঠীর চিত্রশালায় সগৌরবে নিয়ে রাখল। পুণ্ড্রবর্ধনে বৌদ্ধ ধর্মের
অনুসারী নেই বললেই চলে। এখানকার আজীবিক ও জৈন ধর্মের মানুষের জান সকলে গিয়ে
শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছেন। কয়েকদিনের মাথায়
এক রাজ কর্মচারী এসে
জিজ্ঞেস করল, এই চিত্র কে একেছে?
উপস্থিত জনতার মাঝ থেকে
কেউ একজন উত্তর দিল, নির্গ্রন্থের ভক্ত ভাবের ঘোরে এঁকেছে। উত্তরটা শুনে রাজ
কর্মচারী কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেল। রাজ ভৃত্যার এভাবে চলে যাওয়াতে উপস্তিত জনতা কেউ
একজন বলল, রাজা গুপ্তচর। মুখ বোঁচা করে চলে গেল। এই কথা হাসির রোল উঠল।
পুণ্ড্রের আজীবিকদের সেই
হাসির চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম-দ্বিতীয় শতকে রচিত
দিব্যাবদান গ্রন্থের অশোকাবদান কাহিনীতে জানা যায় যে, দূতমুখে সম্রাট অশোকের কাছে সংবাদ চলে যায়। সম্রাটও
বহুদিন ধরে পৌণ্ড্রদের সভ্যতা শেখানোর প্রয়াস করছেন। এদের এমন স্পর্ধা যে রাজধর্ম
গ্রহণ করেনা! আজ এই সংবাদে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হলো। তথাগতের অবমাননা!
কি অসম্ভব স্পর্ধা! অবিলম্বে নির্দেশ জারি
করলেন প্রধান মহামাত্যকে। হত্যা। এই শাস্তি অজীবিকদের। এদের সমূলে উৎপাটন করতে
হবে। মহামাত্যের বিস্মিত স্তম্ভিত মুখের পরে চেয়ে দূত চতুর হাসলেন।
সেদিন করতোয়ার স্রোতও লাল
হয়ে উঠল আবার। হাজার হাজার অজীবিকের রক্ত মিশল জলধারায়। নিশ্চিহ্ন হলো পুণ্ড্রের
অজীবিক সম্প্রদায়। একটি মাত্র নির্দেশে পুণ্ড্রের অষ্টাদশ সহস্র অজীবিক একসঙ্গে
নিহত হলেন। অহিংস বৌদ্ধধর্মের প্রধান প্রচারক, মৌর্যসম্রাট অশোক
পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন তথাগতকে।
এখানেই শেষ নয়। এর কিছু
দিন পরে এধরণেরই
আরেকটি ঘটনা ঘটে পাটালিপুত্র নগরীতে। এক্ষেত্রে যে লোক ওই ছবি এঁকেছিল তাকে
সপরিবারে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। ঘোষণা করা হয় যে রাজাকে একজন নির্গ্রন্থের
মাথা এনে দিতে পারবে তাকে একটি স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেয়া হবে। এর ফলে হাজার
হাজার নির্গ্রন্থ প্রাণ হারায়।(সুজিতকুমার মুখোপাধ্যায়: অশোকাবদান, সাহিত্য
অ্যাকাডেমি, দিল্লী, ১৯৬৩,পৃষ্ঠা ৩৭।
এই হত্যা লিলা থামে
প্রকৃতির চরম প্রতিশোধের মাধ্যমে। সম্রাটের হত্যার আদেশের ফলে ভুলক্রমে
এক পশুপালক তাঁর ভাই বীতাশোককে(ভিটাশোক নামে অশোকের একজন প্রিয় বৌদ্ধ ভিক্ষু) জৈন
সন্ন্যাসী ভেবে গোয়াল ঘড়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেন।
হত্যা হওয়া বীতাশোক ছিলেন
এক মাত্র ভাই জাকে অশোক তার নিরানব্বইজন ভাইয়ের মদ্ধে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সিংহাশনের
ভাগিদার ভেবে তিনি এই নির্বিচারে হত্যা করেছেন বলে জানা যায়।
পুণ্ড্রবর্ধনে এই হত্যা লিলার সত্যতা
সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ করেছেন কোন কোন ঐতিহাসিকগণ। তবে একটা বিষয়ে কেউ সন্দেহ
করেননি তা হোল, খ্রিষ্টপূর্বকালেও সমৃদ্ধ নগর পুণ্ড্রবর্ধনে চিত্রকলার চর্চা ছিল
এবং সেই চিত্র প্রতিবাদের হাতিয়র হিসেবে ব্যাবহার করেছে বাংলার বীর চিত্রকরা।
চিত্রের কারণে জৈনদের হত্যার কাহিনীটি কৌতূহলোদ্দীপক।
ঘটনাটির
উল্লেখ পাওয়া যায় দিব্যাবদান গ্রন্থে। দিব্যাবদান শব্দটির অর্থ “ঐশী
কাহিনী”। দিব্যাবদান (সংস্কৃত) মূলসর্বাস্তিবাদী বিনয়
থেকে উদ্ভূত বৌদ্ধ কাহিনীর সংস্কৃত সংকলন বিশেষ। গ্রন্থসংকলনটি দ্বিতীয় শতাব্দীতে
রচিত হওয়ায় কাহিনীগুলি যথেষ্ট প্রাচীন এবং লেখ রূপে প্রাপ্ত বৌদ্ধ সাহিত্যগুলির
মধ্যে প্রথম দিককার বলে গণ্য করা হয়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার তার “বাংলা
দেশের ইতিহাস(প্রাচীন যুগ) গ্রন্থেও এই ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন কিন্তু তিনিও পরে
মন্তব্য করেছেন যে “এই গল্পটির মূলে কতটা সত্য আছে বলা কঠিন”(সপ্তম সংস্করণ,পৃষ্ঠা ২০৮)।
হত্যার এই যেহেতু অশোকাবদান বৌদ্ধদের দ্বারা রচিত, এবং অশোকের
গুণগানে ভর্তি, তাই এতে অশোক সম্বন্ধে কুৎসা স্থান পায়নি,
সেটা বলাই যায়। এটা মেনে নেয়া কষ্টকর যে তারা অশোকের এই
ঘটনাটি পুরোপুরি বানিয়ে লিখবেন। অশোকাবদান অংশটি অশোকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এবং
পৃথিবীতে বৌদ্ধধর্মকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তার অবদানকে বার বার স্মরণ করেছে।
সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোক ২৬৯
খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধের রাজ সিংহাসন লাভ করেন।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সম্রাট ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পর্য্যন্ত দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করেন।
প্রথম জীবনে তাকে নিষ্ঠুর পরবর্তীতে দেখি তিনি অহিংস বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হতে দেখি।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে পুন্ড্রবর্ধনে
চিত্রিত এইসব চিত্রকর্ম যথাযথ উপাত্ত সংরক্ষণের অভাবে বিলীন হয়েগেছে। তবে পুণ্ড্রনগরে
খুঁড়ে যেসব মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে, তাতেও নানা রকমের নকশা বা চিত্র দেখা
গেছে।
বাঙ্গলার আদি যুগের চিত্রকরী
পৌরাণিক যুগে সুপ্রসিদ্ধ বানের নামে তার রাজ্যে নাম হয় বান রাজ্য এবং
রাজধানী হয় বানগড়। এই বাণরাজার রাজত্ব ছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলা
দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে। বান রাজার কন্যা ঊষার
চিত্রলেখা
নামে এক সখী ছিলেন। হরিবংশে উল্লেখ
আছে, চিত্রলেখা তখন ভারত প্রসিদ্ধ সমস্ত রাজকুমারের চিত্র অঙ্কন করে উষাকে
দেখিয়েছিলেন, তার মধ্য থেকে উষা চিনে নিয়েছিলেন তাঁর
স্বপ্নের রাজকুমারকে।
উষা
স্বপ্নের রাজকুমার দ্বারকার রাজা শ্রী কৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধ। চিত্রলেখা তার
অবিকল
চেহারা আঁকেন। হুবহু মুখাবয়ব আঁকার বিষয়টি হরিবংশের পূর্বে অন্যত্র সম্ভবত পাওয়া
যায় না বলে দীনেশ সেন অনুমান করছেন, চিত্রলেখা এই বাংলার আদি
যুগের চিত্রকরী”। এই ইতিহাসবিদ মনে করেন, চিত্রলেখার সময়ে ও তার
পূর্ব থেকেই এদেশে চিত্রবিদ্যার বিশেষ উৎকর্ষ ঘটেছিল। কিন্তু
চিত্রকরদের নাম পরচয় অদৃশ্য।
এই ক্ষীণ
পরিচয় পাওয়া চিত্রকর চিত্রলেখা বাণরাজার মন্ত্রী-কন্যা। পুরাণ অনুসারে চিত্রলেখা রাজকুমারী ঊষার মুখের বর্ণনা শুনে
ছবি আঁকতে বসেন। কাহিনীটা এমন- একদিন কৈলাস পর্বতে শিবের সাথে পার্বতী ক্রীড়ারত
ছিলেন। ঊষা এই দৃশ্য দখে অত্যন্ত কামপীড়িত হয়ে পড়েন। পার্বতী ঊষার এই মনোভাব
বুঝতে পারেন। পার্বতী তাঁকে বলেন যে, স্বপ্নে যাকে তুমি দেখবে,
সেই তোমার স্বামী হবে। ঊষা সেই রাত্রে স্বপ্নে অনিরুদ্ধকে দেখেন এবং
তাঁকে পতি হিসাবে বরণ করেন। বিষয়টি ঊষার সখী চিত্রলেখাকে জানান। চিত্রলেখা বিভিন্ন
দেশের রাজকুমারদের ছবি দেখিয়ে ও বিবরণ শুনে অনিরুদ্ধের পরিচয় পান।
সব
কথা শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবে চিত্রলেখা। তারপর উঠে গিয়ে রাজকন্যার
চিত্র-অংকনের সাজসরঞ্জাম গুলো নিয়ে আসে। ঊষার কাছ থেকে বর্ণনা শোনে তার আঁকা
চিত্রে যার চেহারা ফোটে উঠে রাজকুমারী সেই চেহারাই স্বপ্নের রাজপুত্রের বলে জানায়।
চিত্রলেখা
ঊষাকে বলে তাকে সাতদিন সময় দিতে, এরমধ্যেই সে খোঁজে বের করবে এই রাজপুত্রের
পরিচয়। যদি সে এই পৃথিবীর রক্ত-মাংসের মানুষ হয় তবে চিত্রলেখা তাকে অতি অবশ্যই
রাজকুমারীর কাছে এনে দেবে।
প্রচণ্ড
বুদ্ধিমতী ও যাদুবিদ্যায় পারদর্শিনী চিত্রলেখা সামান্য চেষ্টাতেই সেই রাজপুত্রের
সন্ধান পেয়ে অদৃশ্যভাবে সেই রাজবাড়ীর সামনে পৌঁছাল কিন্ত্ত অনেক চেষ্টা করে ও তার
কড়া সুরক্ষা ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনা।
সেখানে
প্রথমে তাঁর সাথে নারদের দেখা হয়। সব শুনে নারদ তাঁকে তামসীবিদ্যা শিখিয়ে দেন। এই
বিদ্যার দ্বারা চিত্রলেখা অন্তঃপুরে প্রবেশ করেন। এরপর সবাইকে মোহাচ্ছন্ন কর
অনিরুদ্ধকে নিয়ে ইনি বাণের রাজধানী শোণিতপুরে প্রবেশ করেন। এরপর ঊষা গন্ধর্বমতে
অনিরুদ্ধকে গোপনে বিবাহ করেন। এই বিবাহের কথা বাণ জানতে পেরে, ইনি
অনিরুদ্ধের বিরুদ্ধে সৈন্য পাথায়। অনিরুদ্ধ সবাইকে হত্যা করলে, বাণ ঐন্দ্রজালিক মায়া বিস্তার করে অনিরুদ্ধকে বন্দী করেন। নারদ এই সংবাদ
কৃষ্ণ ও বলরামকে জানালে— কৃষ্ণ, বলরাম
ও প্রদ্যুম্ন শোণিতপুর আক্রমণ করেন। এঁরা যুদ্ধে বাণকে পরাজিত করে অনিরুদ্ধকে
উদ্ধার করেন। এরপর এঁরা ঊষাকে নিয়ে নববধু সাজে সাজিয়ে দ্বারকায় নিয়ে আসেন।
পুণ্ড্রবর্ধনে
চিত্রকলার চর্চা তিন থেকে চার হাজার বছর পুরন
প্রাচীন
সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে চিত্রকলা বিষয়ে অনেক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়।
সেসব তথ্য থেকে অনুমান করা যায়, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বঙ্গে চিত্রকলার
প্রচলন ছিল। বঙ্গদেশে চিত্রকলার প্রথম পথচলার সঠিক তথ্যনির্ভর প্রমাণাদি পাওয়া না
গেলেও এদেশে চিত্রকলা যে প্রসার লাভ করেছিল, সে ব্যাপারে
কিছু কিছু বিবরণ একেবারেই অপ্রতুল নয়। প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থ ‘দিব্যাবদান’সহ প্রাচীন ‘চিত্রলক্ষণ’, ও ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর’ নামক সংস্কৃত গ্রন্থে উল্লেখিত
বিবরণী থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্বকালে উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ
নগরী পুণ্ড্রবর্ধনে চিত্রকলার চর্চা হতো। চীনা পর্যটক ফা-হিয়েনের ভ্রমণবৃত্তান্তে
দেখা যায়, তিনি নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সময় এদেশের বৌদ্ধবিহারগুলোতে
যে মূর্তি দেখেছিলেন, সেসব মূর্তির রেখাচিত্র এঁকে
নিয়েছিলেন। কালীদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ নাটক এবং ‘শকুন্তলা’
নাটকেও চিত্র রচনার কাহিনী উল্লেখিত হয়েছে। এসব তথ্যবিবরণ প্রমাণ
করে যে, প্রায় তিন থেকে চার হাজার বছর আগেও এ অঞ্চলে
শিল্পীরা চিত্রকর্ম করত। পৌরাণিক সূত্র মতে, বৌদ্ধযুগের আগে
বঙ্গদেশে ‘পটচিত্র’ বা ‘মস্করী’ চিত্র বলে এক ধরনের চিত্র প্রচলিত ছিল।
ধর্মের বিভিন্ন বিষয় চিত্রে ধারণ করে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তা গ্রামে গ্রামে
প্রদর্শন করানো হতো। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎবঙ্গ’
গ্রন্থে বলেছেন খ্রিষ্টজন্মের বহু আগ থেকে পটচিত্র এ দেশে প্রচলিত
ছিল। এ ছাড়া প্রাগৈতিহাসিক বঙ্গের চিত্রকলা সম্বন্ধে আর কোনো নমুনা নিদর্শনের
বিবরণ পাওয়া যায় না।
যে
সময় থেকে বঙ্গে চিত্রকলার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে, সে সময় থেকেই
চিত্রকলার বিষয় হিসেবে ধর্মকে দেখা যাচ্ছে। ধর্মের অনুষঙ্গ প্রচারের প্রধান
উদ্দেশ্যে চিত্রকলা চর্চা হয়েছে। মৌর্য সম্রাজ্য থেকে শুরু করে শূঙ্গ, কুশাণ, গুপ্ত ও পাল সম্রাজ্য পর্যন্ত চিত্রকলার বিষয়
হিসেবে বৌদ্ধধর্ম আধিপত্য বিস্তার করেছে।
বঙ্গে
চিত্রকলার চর্চা তুঙ্গে উঠেছিল গুপ্ত ও পাল আমলে। মৌর্য ও কুশাণ সম্রাজ্যেও
চিত্রচর্চা হয়েছে। এ সময় ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে ‘গান্ধার’
ও ‘মথুরা’ শিল্পচর্চা
কেন্দ্রে সাঁচে ঢালাই শিল্পকর্ম তৈরি হয়েছে। গুপ্তযুগীয় শিল্পকেন্দ্র পরিচয়ে ‘নালন্দা’ ও ‘বুদ্ধগয়া’ উল্লেখিত হয়েছে। গুহাচিত্র বা প্রাচীর চিত্র ছাড়া বৌদ্ধযুগের আগে মৌর্য,
শূঙ্গ, কুশাণ ও গুপ্ত চিত্রকলার কোনো নিদর্শন
আজ অবধি আবিষ্কৃত না হওয়ায় প্রাচীন বঙ্গের চিত্রচর্চার নিদর্শন হিসেবে পাল
চিত্রকলা পরিচিতি লাভ করেছে।
পাল
পুঁথিচিত্র বঙ্গের আদি চিত্রকলার নিদর্শন রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ঐতিহাসিক ‘লাউফার’-এর মতে, রাজদরবারেই ভারতীয় চিত্রশিল্পের জন্ম
হয়েছিল। পাল রাজাদের তত্ত্বাবধানে ‘ইস্টার্ন স্কুল অব আর্ট’
প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ‘মগধ’ চিত্রশালার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেখান থেকে বঙ্গে চিত্রশিল্পীর জোগান
হয়েছে। এ সময়ে বিখ্যাত শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছে পিতাপুত্র ‘ধীমান’
ও ‘বীতপাল’।
নীহাররঞ্জন
ইঙ্গিত করছেন পাল পুঁথিচিত্রের সাথে অজন্তা – ও বাঘের গুহাচিত্রের
সাদৃশ্যের। ভারতীয় ভাস্কর্য ও চিত্রকলার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে গুপ্তসম্রাটদের
শাসনামলে (খ্রিঃ ৩২০-৫৭৬) ও তার নিকটবর্তী সময়ে।
প্রাচীন
কালের বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের ইতিহাস যদি অনুসরণ করতে যাই, তা হলে মনে হবে
এমন সমৃদ্ধ সময় আর হয় না। শিল্পের প্রতিটি শাখায় উন্নত। বাংলার সাহিত্যিকরা ভারতে
অবিসংবাদিতভাবে শ্রেষ্ঠ। খ্রিস্টীয় শতকের গোড়াতেই মহাকবি কালিদাস কিংবা খ্রিষ্ট
পূর্ব সাতশ বছর আগের কপিলমুনির সাংখ্য দর্শন, চার্বাক-নাথ পন্থির সম্প্রসারণ বিশাল
ভারতবর্ষের পটভূমিতে স্বকীয়তা তইরিকরেছে। সেই সাথে আমাদের চিত্রশিল্পের বিকাশ
হয়েছে। দুখের বিষয় এইসব গুনজনের নাম আবিস্কার করা সম্ভব হয়নি।
Comments