ঐতিহাসিক ভাষণের আবছায় ইতিহাস; সাজেদুর রহমান


ঐতিহাসিক ভাষণের আবছায় ইতিহাস


মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও  নেপথ্যের নায়ক এম.এ.মুবিন

বাঙ্গালীর ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তাঁর প্রথম সুস্পষ্ট স্বাধীনতার বার্তা যদি হয় ৭ মার্চের ভাষন তাহলে এই ঘটনার নেপথ্যের নায়ক এম.এ.মুবিন। কেনো? ইনি সেই মানুষ ঐতিহাসিক এই ভাষনের প্রধান চিত্রগ্রাহকই ছিলেন না সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে অসামান্য বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার মাধ্যমে ভাষণ সংরক্ষণ করেছেন। এই কাজটার জন্যই তিনি নেপথ্যের নায়ক। আজ তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

এই বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখি। সেটি নিচে পেস করলাম। দৈনিক খোলা কাগজে ‘৭ মার্চের ভাষন পাগলা মবিনের হাত থেকে বিশ্বের মানুষের কাছে’ শিরনামে গতবছর এই দিনে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখেনে আমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন যিনি তার নাম ভুল ছাপা হয়েছিল। তাঁর নাম- আনিসুর রহমান সাব্বির। আজ সেই জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।       
      

৭ মার্চের ভাষন
পাগলা মবিনের হাত থেকে
বিশ্বের মানুষের কাছে
সাজেদুর রহমান
অনেকে কম বেশি জানেন ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষনের চিত্রগ্রহনের পরিকল্পনা কোথা থেকে হলো। তারপরেও কম লোকেরই জানা আছে ভাষনটি পাগলা গোছের একজন মানুষ কিভাবে সংরক্ষণ করেছেন। সে সব ইতিবৃত্ত নিয়ে কিছু জানা-অজানা কথা তুলে ধরছি। এ ব্যাপারে সহযোগীতা করেছেন পাগল গোছের সেই মানুষটির দৌহিত্র আনিসুর রহমান সাব্বির। ছাব্বির এখন টিভি সাংবাদিক। তার কাছ থেকে শোনা, জানা বঙ্গবন্ধু জি.জেড.এম.এ.মুবিনকে পাগলা বলে ডাকতেন।
এই আউঙ্গুল উত্তলন বঙ্গবন্ধুর  দুইবার করতে হয়েছে 

১.
৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু ও প্রধান চিত্র গ্রাহক মুবিনের কথপোকথন অনেকটা এরকম।
   :পাগলা বল, তোর কি পরিকল্পনা?
   :স্যার আমি মাস্টার ক্যামেরা চালাব আর আমার চারজন সহযোগী অন্যান্য চিত্র    ধারন করবে।
   :আমি যখন বক্তব্য রাখব তখন যদি তোর রিল শেষ হয় ?
  :স্যার অফিসিয়ালি ২ টা রিল নিয়েছি। এছাড়াও গোপনে আরো ২ টা নিয়েছি।      : রেকডিং কি হচ্ছে কিনা তা বুঝবো কি করে?
  :আমি তো সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। তারপরেও ঝামেলা হলে আমি হাত তুলে ঈশারা দিবো।
 :তোকে এটা পেতেই হবে।
 :স্যার মেইন কথাটা যখন বলবেন তখন, কোন কারনে যদি ঠিক মতো না পাই তাহলে বাম হাতটা তুলে রাখবো। বুঝবেন পারফেক্ট সর্ট পাইনি। হাত তুলে আছি মানে আমি মেইন কথাটা ধারনের জন্য রেডি আছি। সাত মার্চের ভাষনের মেইন কথা বলতে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম...স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই কথাটা যখন প্রথমবার বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সেই চিত্র ঠিকমতো ধারণ করতে পারেননি। তাই চিত্রগ্রাহক হাত তুলে রাখলে বঙ্গবন্ধু স্টেজের খানিকটা বামে সরে এসে ডান হাত উচিয়ে তর্জনি তুলে সেই ঐতিহাসিক কথাটি দ্বিতিয় বার বলেছিলেন। এখন আমরা যেটা দেখি সেটি দ্বিতীয়বার বাল ধারণ করা টেপটি দেখানো হয় । তাঁর ডান হাত উপরে তোলা সেই ঐতিহাসিক ভাষনের চিত্রটি, যেটা আমরা দেখি, সেই চিত্রটি এভাবেই ধারন হয়।

দৈনিক খোলা কাগজে গতবছর ‘৭ মার্চের ভাষন পাগলা মবিনের হাত থেকে বিশ্বের মানুষের কাছে’ শিরনামে প্রকাশিত 

২.
ইতিহাসের বাঁক বদলে দেওয়া ভাষনের চিত্রগ্রহনের পরিকল্পনাটি হয়েছিল ছয় মার্চ। অয়োজনের মূল কারিগর প্রয়াত আবুল খায়ের । যাকে আমরা অভিনেতা হিসেবেই চিনি। তিনি তখন চলচিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের চীফ ছিলেন। অন্যদিকে তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অতি ঘনিষ্ঠ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রাইভেট টিচার। ‘প্রাইভেট টিচার হওয়ার কারনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উনার যে যোগাযোগ ছিল অমন আর কারর ছিলনা ছয় মার্চ রাতে ৮টার পরপরই খায়ের সাহেবের সাথে ৩২ নম্বর ধানমন্ডীতে যাই। অত্যন্ত গোপনীয় সেই আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন নেছাও উপস্থিত ছিল। খায়ের সাহেবই সব ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছাসহ আমরা চারজন বসে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি। চিত্রগ্রহনের পাশাপাশি ভয়েজ রেকডিং করা হবে। টেপ রেকর্ডার নিয়ে স্টেজে থাকবে ডিএফপির চীফ আবুল খায়ের। ১৯৭১ সালে পাগলা মুবিন সর্টফ্লিম বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তাঁর পুরো নাম জি.জেড.এম.এ.মুবিন। ঐতিহাসিক ভাষনের চিত্রগ্রহনে প্রধান সহকারি ছিলেন তোহিদ বাবু। এছাড়াও ফ্লিম ডিভিশনের জুনায়েদ, হাবিব জোয়াদ্দার ও আমজাদ হোসেন। অুনষ্ঠান ৩টায় শুরু হওয়ার কথা হয়েছে সাড়ে ৩ টায়। কোনো প্রকার অনুষ্ঠানিকতা ছাড়ায়, বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেদেন। অনুষ্ঠানের আগেই স্টেজের উপর থেকে বিভিন্ন সট নিলাম আমি। তোহিদ ও জুনায়েদ গাছে চড়ে ফুটেজ নিচ্ছিল। ফায়ার সার্ভিস থেকে ক্রেন এনেছিল রৌফ। পার্কের পেছনের দিকে যেখানে মন্দিও সেখানটায় ক্রেনটা সেট করা হয়েছিল। আমজাদ ক্রেনে করে স্টেজের কাছাকাছি অর্থাৎ আমার যেখানে ছিলাম সেখানকার ফুটেজ নিয়েছে। তবে এখন ৭মার্চের ভাষনে যে উপর থেকে নেওয়া (টপ সেট) দেখানো হয় অর্থাৎ যে অংশে আমরা দেখি লক্ষ লক্ষ মানুষ গিজ গিজ করছে সেটি কিন্তু৭মার্চের ভাষনের দিন তোলা হয়নি। কয়েক সেকেন্ডের সেই ভিডিও ফুটেজ দেখলেই বোঝা যায় সেটি হেলিক্টরের সর্ট। আমরা সেদিন হেলিকপ্টর ব্যবহার করিনি। দৃশ্যটি অন্যখান থেকে এনে জোড়া দেওয়া হয়েছে। কাজটা করা হয়েছিল স্বাধীনতার পর। স্বাধীনতা পর্যন্ত মূল ভিডিও ফুটেজটি সংরক্ষণ করাটা ছিল সাংঘাতিক ঝুকির। বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝেছিল, ভাষনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। তিনি সেভাবেই দিক নির্দেশনা দিয়েছে। বলেছিলেন, ওরা (পাকিস্তানিরা) নিয়ে যায় তখন কি করবি?

৩.
সাত মার্চের ভাষনের মাস্টার কপিটি এখনো চিত্রগ্রাহক মুবিনের পরিবারের কাছে আছে। তবে সম্পাদনা করা মূল ভিডিওটি স্বাধীনতার পর বিটিভিতে ও বঙ্গবন্ধুর কাছে হস্তান্তর করেন জি জেড এম এ মুবিন। চিত্রগ্রহক মুবিন মূল ফুটেজ সংরক্ষনের ইতিহাস বহুস্থানেই বর্ণনা করেছেন। বিষ্মকর ব্যাপার এই ফুটেজে সংরক্ষনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য সাহায্য না করলে হয়তো আমরা দেখতেই পেতাম না পৃিথবীর ইতিহাস সেরা ভাষনটি। যমন পাইনা পেট্রিক হেনরি রিমেন্ডের ‘আমাকে স্বাধীনতা দাও, নয়তো মৃত্যু’ অথবা আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিস বার্গ ভাষনটি। নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু ‘জয় হিন্দ’, মহাত্মাগান্ধীর ‘ভারত ছাড়’, ভাষনের মতো অডিও নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ভাষণটির চিত্র ধারণ এবং সংরক্ষণের নেপথ্যের নায়ক বঙ্গবন্ধুর আদর করে ডাকতেন ‘পাগলা মুবিন’। পাগলা গোছের এই মানুষটি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে ৭মার্চের ভাষনের ফুটেজটি দ্রুততম সময় কপি করে ফেলেন। তাঁর ভাষ্য মতে, ‘তৎকালিন সেনা সাশক যখন ফুটেজটি যখন চেয়েছিল তখন আমি কৌশলে মূল ফুটেজটি রেখে দিয়ে কপিটি দিয়েই। ওরা তা পুড়িয়ে ফেলে। মাস্টার ফ্লিম এবং টেপ ছোট বাক্সে (সুটকেস সাইজের) ভরে সেভ যায়গায় রেখে দেই।’ ‘সেভ যায়গা বলতে প্রথমেই রাখি প্রধান নির্বাচন কমিশনার আব্দুস সাত্তারের অফিসে আর কখনো তাঁর বাসায়। এরপর মহম্মদপুর পশ্চিম পাকিস্তানের এক সেনা কর্মকর্তার শশুরের বাড়িতে। এসময় আমাকে সেনারা ধরে নিয়ে যায়। কারণ আমি তখন পাগলের মতো যখন যা দেখছি তারই ফুটেজ নিচ্ছিলাম। তবে সহজেই ছাড়া পেয়েছি। পশ্চিম পাকিস্তান আর্মিতে বেশকজন উচ্চ পদস্ত কর্মকর্তা ছিলো, যারা আমার সহপাঠি এবং তার আমাকে বিশ্বাস করত।’

৪.
সেনা ক্যাম্পে থেকে ছাড়া পেয়েই আমি মহম্মদপুর থেকে ফুটেজটা নিয়ে এসে নিজ (ডিএফপি) অফিসের, থিয়েটার হলের এক কোনে যেখানে প্রায় অব্যাবহৃত স্টিলের আলমিরার পেছনে ফেলে রাখি। ফেলে রাখা সেই স্থানটিতে ময়লার স্তুপ ছিলো, সেই সঙ্গে সুটকেসটির চারপাশে মাক্রসার জাল থাকায় সহজে নজর এড়াতো সবার। এই ব্যাপারটা কেউ জানতো না। তবে সহকারী তোহিদ বাবু শুধু জানত। এই জানাটা দরকার ছিল। কারণ আমার অবর্তমানে কেউ একজন যেনো সংরক্ষণ করতে পারে। পাগলাটে টাইপের সেই তরুণের অসামান্য চেষ্টায় সংরক্ষিত সেই ভাষণটি এখন সংরক্ষণ করছে পুরো পৃথিবী। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রক্ষা করা ভাষণটি এখনো বিশ্বের ঐতিহ্যের অংশ। ২০১৭ সালে ইউনেস্ক বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য (মেমরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড) হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে এ স্থান দেয়। রেজিস্ট্রেশনের প্রকৃয়াটি শুরু হয় ২০১৬ সালে। সেবছর প্যারিসের ইউনেস্কের সদর দফতরে জমা দেওয়া হয়। পরের বছর ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কর মহাপরিচালক ইরিনা বোকাভা মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড (এমওডাব্লিউ) ঘোষনা দেন। ৭ মার্চের ভাষণ এখন থেকে বিশ্বের অংশ। ইউনেস্কর এই স্বীকৃতি তাবত দুনিয়ার মানুষের জন্য। সারে সাত কোটি মানুষের জন্য দেওয়া বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য, অনন্যসাধারন, অভূতপূর্ব হৃদয়গ্রহী, মর্মস্পশী ভাষণটি এখন সাড়ে সাতস কোটি মানুষের। যেটিকে ধারন, সংরক্ষণ করেছিল একজন পাগলা মোবিন।
##
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী 
০১৯১২০৭৮৫৯৩

 sajedurrahmanvp@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান