পুণ্ড্রের পাঁচালী-২১ (বাঙালির গৌরব গাঁথা- চতুর্থ পর্ব )
পুণ্ড্রের
পাঁচালী-২১ (বাঙালির গৌরব গাঁথা- চতুর্থ পর্ব )
সাজেদুর
রহমান
আপনারা
ইউনুস (আঃ)-এর মাছের পেটে ঢুকে পড়ার গল্পটা নিশ্চয়ই জানেন।
ঐ যে হজরত ইউনুস (আঃ) নামের এক নবী ছিলেন – আল্লাহ
তাঁকে নিনেভা নামক জনপদে প্রেরণ করেন। কিন্তু নিনেভার লোকজন তার ডাকে সাড়া দেয় না।
তখন তিনি লোকজনদের গজবের খবর দিয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা না করে অন্যত্র চলে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
পথিমথ্যে
সমুদ্র পড়লে তা পাড়ি দেওয়ার জন্য একটি জাহাজে ওঠেন। জাহাজটি মাঝ সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়ে
কবলে পড়ে। তখন জাহাজের কাপ্তান ধারণা করে যে, জাহাজে কোনো অপরাধী আছে,
যে কারণে জাহাজটি বিপাকে পড়েছে। অপরাধীকে চিহ্নিত করতে লটারির
ব্যবস্থা করা হয়। লটারিতে বার বার ইউনুস (আঃ)-এর নাম ওঠে। তখন কাপ্তান বলল, তুমি
পাপিষ্ঠ। এখন তোমাকে সমুদ্রে ফেলে দেব। তোমার অপরাধের কারণে আমরা সবাই বিপদে আছি।
কি যে বিপদে পড়ল বেচারা ধর্ম-প্রচারক ইউনুস
(আঃ)।
ঠিক একই রকম বিপদে পড়েছিল অন্য এক ধর্ম-প্রচারক।
তার গল্প এখন আপনাদের বলি। ধর্ম-প্রচারকের নাম মীননাথ। মাছ তথা ‘মিন’-এর উদরে বাস
তাই মীননাথ। মৎস্যেন্দ্রনাথ কিংবা মচ্ছেন্দ্রনাথ নামেও পরিচিত।
মীননাথ
তথা মীনপা ছিলেন বাঙালি। বাড়ি চন্দ্রদ্বিপে মানে আজকের বরিশালে। কেউ
কেউ বলেন চন্দ্রদ্বিপের অধিন সন্দ্বীপে। তাঁর জীবিকা ধীবর বা জেলে। বঙ্গোপসাগরে
মাছ ধরতেন এবং অন্য জেলেদের সাথে সে মাছ বিক্রি করতেন কাছের কোনো বাজারে।
একদিন
তিনি বড়শিতে মাংস গেথে ফেললেন সমুদ্রে। বড়শি গিললো এক বিশাল মাছ। দৈত্যাকার মাছ
টেনে নিলো গভীর সমুদ্রে এবং গিলে ফেললো তাকেও।
এ
সময় মহাদেবের স্বগীয় স্ত্রী উমাদেবী স্বামীর কাছে শিখতে চাইলো তাঁর ধর্ম। মহাদেব
চাচ্ছিলেন না এই জিনিস তিনি এমন কোনো জায়গায় বসে শেখান যেখানে অন্য কেউ শুনে
ফেলতে পারে এবং শিখে ফেলতে পারে তাঁর চর্চা। ফলে সাগরের তলে উমা একটি ঘর বানালেন
এবং মহাদেব সেখানে তাঁর পাঠদান শুরু করলেন। মীনপা যে মাছের পেটে আটকা ছিলেন
ঘটনাক্রমে সে মাছটি উমার সাগরতলের বাড়ির পাশেই বিশ্রাম নিচ্ছিলো।
উমা
ধর্ম কথা শুনতে শুনতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পরে। কোন সাড়া না পেয়ে মহাদেব জানতে
চাচ্ছিলেন উমা জেগে আছে কিনা। মীনপা মাছের পেটে বসে বলে দিলেন, তিনি সজাগ আছেন।
মহাদেব বুঝলেন উত্তরটি উমাই দিয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর পুরো পাঠদান শেষ করলেন।
মহাদেবের পঠদান শেষ হলো,
উমা জেগে উঠলেন এবং বললেন ‘আমি জেগে উঠেছি,
এবার আবার বলো’।
ঃ আমি তো সব বলে ফেলেছি।
ঃ আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঃ তাহলে কে আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল?
ঃ আমি জানি না, আমি কোনো উত্তর দেইনি।
এবার মহাদেব তাঁর তৃতীয় নেত্র উন্মীলন করলেন এবং দেখলেন
মাছের পেটে শুয়ে আছে মীনপা। ‘অবশ্যই এই লোকটি এখন আমার শিষ্য’ ভাবলেন মহাদেব, ‘তাকে দীক্ষা দিতে হবে’।
মীনপা দীক্ষা নিলেন এবং বারো বছর মাছের পেটে সাধনা করলেন।
বারো বছর শেষে শ্রী তাপরী নামে এক জেলের জালে মীনপাকে পেটে আটকে রাখা মাছটি ধরা
পরল। মাছের অত্যধিক ওজন দেখে ভাবলেন পেটে সোনারূপা কিছু একটা হবে। এই ভেবে বাড়ি
এনে মাছের পেট কাটলেন। ভিতর থেকে বের হলেন মীনপা। ‘তুমি কে?’ তাপরী ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলো।
মীনপা পুরো গল্পটি বললেন। উপস্থিত জনতা তার কাছ থেকে জানলো।
তাঁর নাম দিলো মীনপা অর্থাৎ ‘মৎস্য-সিদ্ধা’। তারা
তাঁকে মাথা নুয়ে প্রণাম জানালো। তারা তাঁকে নৈবেদ্য দিলো।
এই মীনপা যে ধর্মের প্রচার করলেন তার নাম নাথ ধর্ম। খুবই
আশ্চর্যের বিষয় নাথ সম্প্রদায়ের লকেরায় বাংলায় প্রথম ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়।
মীনপা বারো বছর মাছের পেটে সাধনা করলেন
ভারতেতিহাসের নির্ণায়কশক্তি মৎস্যেন্দ্রনাথ
নাথ সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ মৎস্যেন্দ্রনাথ, মধ্যযুগের বিশাল
ধর্মীয় আন্দোলনের নায়ক নাথযোগী মীনপা এবং ধীবর সম্প্রদায় চিরকালই
ভারতেতিহাসের নির্ণায়কশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। কৌতূহলের বিষয়, নাথপন্থ
নামে ধর্মসম্প্রদায় বহু শত বৎসর ধরে বাংলায় এবং পুরা ভারতবর্ষে প্ৰভুত্ব করেছে।
মৎস্তেন্দ্রনাথ ও তার ধর্মসম্প্রদায়ের যোগীদের প্রভাব
উত্তর ভারত হয়ে তৎকালীন আফগানিস্তান পর্যন্ত ছিল। নাথধর্মের ব্যাপ্তি খ্রিস্টীয় ৭ম
থেকে একাদশ- দ্বাদশ শতক;
এবং ভক্তরা নাথধর্মটিকে ভারত বর্ষজুড়ে গ্রহন করেছিল।
ভারতবর্ষজুড়ে
নাথধর্মের জনপ্রিয়তার কারণও শিব। কেননা শিব আর্যদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে একটি বিরাট
লোকশক্তি। যোগ দর্শন প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন: ‘যোগ আদিম
অস্ট্রিক (নিষাদ)- কিরাত মনন-উদ্ভূত।’ (বাঙলা বাঙালি ও
বাঙালীত্ব:পৃষ্ঠা-৪১) তবে পরবর্তী পর্যায়ে যোগ আরও পরিশ্রুত হয়েছে। যোগের মূলে
অনার্য দেবতা শিব। যোগের উদ্দেশ্য কায়ার মাধ্যমের সিদ্ধিলাভ বা শিবত্ব লাভ।
এই
নাথ-যোগী সম্প্রদায় বা প্রকৃত অর্থে, নাথ-ধর্মমত সুদৃঢ় ভিত্তি লাভ
করবে মীননাথের সাক্ষাৎ অথবা পরম্পরাগত শিষ্য গোরক্ষনাথের হাত ধরেই এবং তা ছড়িয়ে
পড়বে নেপাল, সিকিম, ভূটান, তিব্বত ছাড়াও ভারতের উত্তর প্রদেশ, গুজরাত, পাঞ্জাব ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে।
নেপাল
সীমান্তবর্তী উত্তর প্রদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হল গোরক্ষপুর। সারা ভারতবর্ষে
ছড়িয়ে থাকা নাথ সম্প্রদায় এবং নাথপন্থী যোগীদের অন্যতম প্রধান তীর্থকেন্দ্র হল এই
শহরের গোরক্ষমঠ। যোগী গোরক্ষনাথের ধুনি এখনও প্রজ্জ্বলিত এই মঠে। তার নামেই শহরের
নাম। শহরের আর একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের নাম গীতা প্রেস। ভারতবর্ষে রাজনীতিতে
দীর্ঘদিন ধরেই এই মঠের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আধুনিক ভারতের স্বাধীনতা
আন্দোলনে এই মঠ প্রথমে কংগ্রেসের সাথেই ছিল।
১৩৮২
খ্রিস্টাব্দে এক নাথযোগী ধর্মনাথ বালুচিস্তানের হিংলাজ থেকে এসে তৎকালিক
কচ্ছপ্রদেশ বা বর্তমান গুজরাটে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই মঠের নাম ধীনোধর মঠ।
দিল্লিতে তখন মুসলিম তুঘলক রাজাদের শাসন। এই ধর্মনাথ হঠযোগী হিসেবে প্রসিদ্ধ
ছিলেন। কথিত আছে দ্বাদশ বৎসর মস্তকোপরি দণ্ডায়মান থেকে সাধনা করে তিনি অসীম
ধৈর্যের পরিচয় দেন। ধীনোধর অর্থে সহিষ্ণুতার ধারক।
হিংলাজ
হল বর্তমান পাকিস্তানের বালুচিস্তানে অবস্থিত একটি শৈব তীর্থক্ষেত্র। কথিত আছে
দক্ষযজ্ঞের সময় সতীর শরীরের একটি অংশ ওখানে পড়ে। এটি শৈবদের এবং শৈব ধর্মের
প্রচারক যোগীদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান। এই তীর্থ করার পর দক্ষিণ বাহুতে যোনিচিহ্ন
আঁকার যোগ্যতা অর্জন করা যায়। যা সন্ন্যাসী এবং নাথপন্থী যোগীদের কাছে খুব
সম্মানের।
নাথযোগীদের
আর এক মহন্ত ছিলেন চৌরঙ্গীনাথ। যার আশ্রমের উল্লেখ পুরনো কলকাতার অনেক তথ্যে পাওয়া
যায়। চৌরঙ্গীনাথের আশ্রম থেকেই স্থানটির নাম বর্তমানে চৌরঙ্গী হয়েছে।
‘কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে
অন্ধজনে
নয়নে দিলে অন্ধকারে ফেলিলে।’
রবীন্দ্রনাথে
এই অবিস্মরণীয় চরণে বিবর্তনবাদের গূঢ় ইঙ্গিত হয়েছে। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের
পরিবর্তে যে ‘নাথ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেই ‘নাথ’ শব্দটি কে কেন্দ্র করে মধ্যযুগের বাংলায়
নাথপন্থিগণ এক বিশাল ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।
যোগীর ভবন বগুড়ার কাহালু উপজেলায় অবস্থিত একটি
মন্দির
নাথধর্মের
উত্থান বাংলায়
ডঃ
মুহম্মদ শহিদুল্লাহ অনেক তথ্যের বিশ্লেষণ করে মীননাথকে বাংলার ভুমিপুত্র হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই সাথে প্রমাণ করেছেন নাথধর্মের সূতিকাগার এই বাংলা!
যুক্তিটি এমন দ্রাবিড়-ভূমি
বাংলাতে নাথমুনিদের অবদান বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান-সহযান নামের এই দুটি শাখা তৈরি করার ক্ষেত্রে। “নাথপন্থা যে বৌদ্ধ মন্ত্রযান
হইতে উদ্ভূত বা প্রভাবিত তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। এই নাথ পন্থা বৌদ্ধ ধর্মের
মহাযান শাখার শূন্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত”।- ড.মুহাম্মদ
শহীদুল্লাহ, বাঙলা সাহিত্য কথা (১ম খন্ড), পৃ: ১৭,২১,২৮।
বাঙালির
ধর্মের ইতিহাসে রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য। চীনা এবং তিব্বতীয় তথ্য হতে জানা যায় যে, প্রাচীন
যুগে বাংলার ধর্ম জীবন খুব উন্নত ছিল এবং পরধর্ম সহিষ্ণুতা বাঙালি চরিত্রের অন্যতম
বৈশিষ্ট্য ছিল।
বাঙালীর ধর্ম আসলে প্রকৃতি আর ভোগবাদী
দর্শনে পূর্ণ। বাঙালীর ধর্মের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জাদুটোনা-প্রেততত্ত্ব। বাঙালীর
দেব-দেবীরা স্বর্গ-নরকের লোভ-ভয় দেখান না। সম্প্রদায়গত নিষ্ঠার চেয়ে তাঁরা ব্যক্তিগত বোধ ও উপলব্ধির
ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। ধর্ম বলতে বাঙালি কেবল মোক্ষসাধনা কিংবা
পরলোকচর্চাকে বোঝে নি, বুঝেছে সমগ্র
জীবনচর্চাকে।
এই দর্শনচিন্তায় নাথপন্থিদের
ধর্ম বিশ্বাস। বাঙ্গালীর ইতিহাসের আদিকাল ছুঁয়ে প্রাক্-মধ্যযুগীয় বঙ্গদেশের
নাথ-যোগী সম্প্রদায়ের লোকবিশ্বাসেও পূজা-পার্বণ
ও আচার-অনুষ্ঠানে তেমন আস্থাশীলতা দেখা যায় না।
নাথপন্থিদের
ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে জানা যায়, ‘প্রাচীন নাথপন্থিগণের মতে মহাপ্রলয়ের
শেষে একমাত্র ‘অলেখ নিরঞ্জন’ই অবশিষ্ট
থাকেন এবং সিদ্ধ নাথগুরুগণ নিরঞ্জনের স্বরূপ বলে কথিত হন’।
নাথ শব্দের অর্থ ‘প্রভু’। প্রভুর দীক্ষান্তে নাথ মতালম্বীরা তাঁদের নামের শেষে 'নাথ' পদবী ব্যবহার করতেন। বিশেষ সাধন
প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোক্ষ লাভ করাটাই ছিলই নাথ মতাবলম্বীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য। “নাথপন্থা
মূলত আদিম মৈথুন তত্ত্ব ও টোটেম বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত এবং মূলত এটি অনার্য দর্শন।
সাংখ্য ও যোগ এই দুই শাস্ত্র ও পদ্ধতি যে আদিম অনার্য দর্শন ও ধর্ম তা আজকাল আর
কেউ অস্বীকার করেনা। এই শাস্ত্র অস্টিক কিংবা বাঙলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিরাত
জাতির মনন উদ্ভূত।
বাঙালির
শিব ও ধর্মঠাকুর অনার্য মানস প্রসূত। তেমনই অনাদি এবং আদিনাথও কিরাত জাতির দান।
ভোট-চীনার (মঙ্গোলীয়) নত>
নথ> নাত> নাথ
থেকেই যে “নাথ” গৃহীত তা আজ গবেষণার
অপেক্ষা রাখে না”। - ড. আহমদ শরীফ, বাঙালী
ও বাঙলা সাহিত্য; বাঙালীর মৌল ধর্ম, পৃষ্ঠা:
৭৯।
ড.
আহমদ শরীফ তার বাঙলার সূফী সাধনা ও সূফী সাহিত্য, ভূমিকা দ্রষ্টব্যে
বলেন, “ব্রাহ্মণ্য-শৈব ও বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া সমবায়ে গড়ে
উঠেছে একটি মিশ্রমত, এর আধুনিক নাম নাথপন্থ”। এ মত ছাড়াও, নাথধর্মের উৎপত্তি নিয়েও রয়েছে বহু
মতামত। যেমন: কেউ লিখেছেন, “নাথপন্থা যে বৌদ্ধ মন্ত্রযান
হইতে উদ্ভূত বা প্রভাবিত তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই।”
আবার
কেউ জানালেন,
“নবম,দশম এবং একাদশ খ্রিষ্ট শতাব্দে বৌদ্ধ
মহাযান সম্প্রদায়ের শাখা বিশেষের সহিত শৈব ধর্মের যোগ ও তন্ত্রাচার মিলিত হইয়া
নাথপন্থের সৃষ্টি করিয়া ছিল।” আর অনেকে বলেন যে, “ব্রাহ্মণ্য-শৈব ও বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্রমত,
এর আধুনিক নাম নাথপন্থ।” একটি গবেষণায়
জেনেছিলাম, “নাথপন্থা মূলত আদিম মৈথুন তত্ত্ব ও টোটেম
বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত এবং মূলত এটি অনার্য দর্শন।” ইত্যাদি
ইত্যাদি।
বৌদ্ধ
মহাযান সম্প্রদায়ের শাখা বিশেষের সহিত শৈব ধর্মের যোগ ও তন্ত্রাচার মিলিত হইয়া নাথ
পন্থের সৃষ্টি করিয়াছিল”। এ ধর্মে ঈশ্বর নেই। এ ধর্মের সাধনায়
কেন্দ্রে থাকে একজন গুরু বা সিদ্ধা। তাই এ ধর্ম গুরুবাদী। এ প্রবণতা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে শুরু করে যুক্তিবাদী দর্শনের
লীলাভূমি ইউরোপেও দেখা যায়।
গুরুবাদী
এই ধর্মের আদি ও প্রধান গুরু বা সিদ্ধা মীননাথ নিজেই। তার যোগ্য শিষ্য গোরক্ষনাথের
প্রচেষ্টায় এই ধর্মমত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মীননাথ-গোরক্ষনাথ কাহিনতত্ত্ব নিয়ে গড়ে
উঠেছে বিশুদ্ধ নাথপন্থা। আর হাড়িফা- কানুফার তত্ত্ব ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কামাচারী
তান্ত্রিক সাধনা যার ফলে গড়ে উঠেছে সহজিয়া মতবাদী গৃহযোগী সম্প্রদায়। এরা বিশুদ্ধ
নাথপন্থী নয়। এদেরকে বলা হয় ‘ফা’পন্থী।
মীননাথের
নাথ ধর্মে একটি সৃষ্টিতত্ত্বও রয়েছে। এতে বলা হয়েছে জলময় অন্ধকার অবস্থা থেকেই
অনাদিশক্তি গড়ে ওঠে এবং তার ইচ্ছা থেকে কায়াধারী আদিনাথ ও নিরঞ্জনের উদ্ভব। আদি
শক্তির ঘর্ম থেকে জল,
জল থেকে কূর্ম (কুমির) তারপর হংস, উল্লুক এবং
তারপর হলো বাসুকির (সাপ) জন্ম। আদিনাথের মন থেকে আদি শক্তির উদ্ভব। এই আদ্যাশক্তিই
জন্ম দিলেন শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মার।
আবার শৈব শক্তি থেকে দেব ও মানবের সৃষ্টি।
নাথ
সাধনা প্রণালীতে বলা হয় দেহের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নাড়ী। তার মধ্যে তিনটি প্রধান
ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না এদেরকে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী
এই তিনটি মহানদী কল্পনা করা হলে অন্যগুলো উপনদী। এগুলো দিয়ে শুক্র, রজঃ, নীর, ক্ষীর ও রক্ত
প্রবাহমান। এ প্রবাহ বায়ুচালিত। অতএব নাথ সাধনা প্রণালীতে বলা হয় বায়ু নিয়ন্ত্রণের
শক্তি অর্জন করলেই দেহের উপর কর্তৃত্ব জন্মায়।
নাথধর্ম
তন্ত্র,
হঠযোগ, সহজিয়া, শৈবাচার,
ধর্মপূজা প্রভৃতি মতের সমন্বয়ে উদ্ভূত একটি সাধনমার্গ। নাথপন্থা
নিরীশ্বর, ধর্মমঙ্গল, শূন্যপুরানের ধর্মঠাকুর
আর নাথ ঐতিহ্যের নিরঞ্জন আদিনাথ অভিন্ন। ধর্মঠাকুরের পুরানকথা আর নিরঞ্জনের সৃষ্টি
বর্ণনা একই। নাথদের আদিনাথ শিব। জৈন ধর্মের আদিনাথও সম্ভবত শিব, জৈন ধর্মের প্রচারক মহাবীর নির্গ্রন্থ নাথ। নিগন্থ>নিগ্রন্থ>বেদবিরোধী।
“যাহারা নিরঞ্জনপন্থী, কনফট, মচ্ছেন্দ্রী,
সারঙ্গীহার, কানিপা ইত্যাদি নামে আছেন তাহারা
(সন্ন্যাসীরা) নাথপন্থেরই পথিক, ...নাথপন্থের উৎপত্তি ও
বিকাশ যে বাঙ্গলা কেন্দ্রিক পূর্ব ভারতে ঘটিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ করিবার কিছুই নাই”। - ড. সুকুমার সেন।
চৌরাশি
সংখ্যাটি বিভিন্ন কারণে নাথপন্থায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চৌরাশি আঙুল পরিমিত কায়ার
সাধনে সিদ্ধ হলে নাথপন্থায় তাকে সিদ্ধা বলে। বৌদ্ধপূর্ব যুগের আজীবিকদের বিশ্বাস
ছিল যে চৌরাশি লক্ষ স্তর বা অবস্থা (জন্মান্তর) অতিক্রম করে আত্মা মনুষ্য দেহে
স্থিতি পায়। মৈত্রায়নী উপনিষদে চৌরাশি হাজার বার জন্মের বা জন্মান্তরের উল্লেখ
আছে। কোন কোন তন্ত্রে ও পুরাণে বিভিন্ন অবস্থায় চৌরাশি লক্ষ যোগী ও জন্মের কথা
আছে। বৌদ্ধদের “ধর্মখন্ধ” (ধর্মস্কন্ধ) এর সংখ্যা চৌরাশী হাজার। যোগ
ও তন্ত্রের গ্রন্থে যোগাসনের ব্যায়াম চর্যাপদ্ধতি চৌরাশি প্রকার। কানফাটা যোগীদের
জপমালায় রয়েছে চৌরাশি বিটি বা দানা। স্কন্ধপুরাণে রয়েছে চৌরাশি প্রকার শিবলিঙ্গের
বর্ণনা।
প্রাচীন
মধ্যযুগে উত্তরবঙ্গে নাথধর্মের বিশেষ প্রভাব থাকলেও বর্তমানে নাথপন্থি সম্প্রদায়ের
আলাদা অস্তিত্ব নেই। এখন নাথ উপাধিধারী ব্যক্তিরা হিন্দু সমাজভুক্ত হয়ে কোনো
প্রকারে তাদের প্রাচীন স্মৃতি রক্ষা করছেন মাত্র।
নাথধর্ম
গুরুদের মধ্যে মৎস্যেন্দ্রনাথ, গোরক্ষনাথ, চৌরঙ্গীনাথ,
জালন্ধরীপাদ প্রমুখ সিদ্ধাচার্য ছিলেন প্রধান। মৎস্যেন্দ্রনাথ বেশ
কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার পাঁচটি নেপালে পাওয়া যায়।
মৎস্যেন্দ্রনাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ ছিলেন ময়নামতীর রাজা গোপীচন্দ্রের সমসাময়িক।
গোপীচন্দ্রের মাতা ময়নামতী ছিলেন গোরক্ষনাথের শিষ্যা এবং যোগশক্তিতে পারদর্শিনী,
আর গোপীচন্দ্র ছিলেন জালন্ধরীপাদ বা হাড়িপার শিষ্য।
গোরক্ষনাথের স্মৃতিচিহ্ন গোরক্ষ কূপ
দেহেই পেতে চায় পথের নির্দেশ
কবি
আল মাহমুদ মীননাথ তথা নাথ সম্প্রদায়ী নিয়ে লিখেছেন:
মধ্য যুগের এক যুবক গোস্বামী
দেহেই পেতে চায় পথের নির্দেশ। (সোনালি কাবিন)
মধ্য যুগের এক যুবক গোস্বামী
দেহেই পেতে চায় পথের নির্দেশ। (সোনালি কাবিন)
নাথধর্মের প্রবর্তক মীননাথের অনেক নাম পাই। মৎস্যেন্দ্রনাথ,
মচ্ছেন্দ্রনাথ, মচ্ছিন্দ্রনাথ, মীনপাদ, মোছন্দর, মীননাথ নাথ গুপ্ত, লুই-পা, বজ্রপদ
ও অচিন্ত্যপা। তাঁর ধর্মের নামও অনেক: নাথপন্থা, নাথধর্ম, সহজিয়া ইত্যাদি। বলা হয় তার মূল নাম মীননাথ নাথ গুপ্ত। মৎস্যেন্দ্রনাথ
ছিলেন নাথপন্থী বৌদ্ধদের আদি গুরু। নাথপন্থার চুরাশি সিদ্ধাচার্যের শীর্ষজন। আবার
একইসাথে তিনি ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ তথা বরিশালের তথা বাংলা ভাষার প্রথম কবি।
মীননাথের
জন্ম ও জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। মীননাথের জন্মস্থান চন্দ্রদ্বীপ এবং জীবনের
অনেকটা সময় চন্দ্রদ্বীপেই তিনি অতিবাহিত করেছেন। এ মর্মে রায় পাওয়া যায় ‘কৌলজ্ঞান
নির্ণয়’ গ্রন্থে এবং জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও
ওয়াকিল আহমদ এর বিশ্লেষণে।
‘গোরক্ষ বিজয়ে’ মীননাথের এক জন্মবৃত্তান্ত পাওয়া
যায়-
“বদনে
জন্মিলে শিব যোগীরূপ ধরি।
শিবেতে
উত্তম জটা শ্রবণেতে কোড়ি॥
নাভিতে জন্মিল মীনগুরু ধন্বন্তরি।
সাক্ষাতে
সিদ্ধার ভেস অনন্ত মুরারী।”
‘কৌলজ্ঞান নির্ণয়ে’ মীননাথকে ‘চন্দ্রদ্বীপ
বিনির্গত’ বলা হয়েছে। কথিত আছে মীননাথ তার পান্ডুলিপিসহ
সন্দ্বীপ চলে যান। হয়ত হিন্দুধর্মের অত্যাচারে মীননাথ সন্দ্বীপ হয়ে ময়নামতি এবং
পরে নেপালে চলে যান। অনেকে মনে করেন মীননাথ সন্দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু একথা
সত্য নয়। ১১শ’ ও ১২শ’ শতকে সন্দ্বীপে
বৌদ্ধ সভ্যতার কোন নিদর্শন দেখা যায় না।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন যে মীননাথ-এর সময়কাল খ্রিস্টীয়
সপ্তম শতক। ফরাসী পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভির (Sylvain Levi) তাঁর Le Nepal ( Vol. I.P 347) গ্রন্থে বলেছেন- “মৎসেন্দ্রনাথ (নাথপন্থার আদি গুরু) ৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজা নরেন্দ্র দেবের
রাজত্বকালে নেপালে গমন করেন”। ফলে এটা ধারণা করা
অস্বাভাবিক নয় যে, ৬৫০
খ্রীঃ এর দিকেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম। কিন্তু আরেকজন প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডক্টর
সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Origin and Development
of the Bengali language (Vol I.P 122)-এ উল্লেখ করেন, “মীননাথের শিষ্য গোরাক্ষনাথের সময় খ্রীঃ ১২শ শতকের শেষে।” ফলে মীননাথ দ্বাদশ শতকের লোক। ডঃ প্রবোধ চন্দ্র
বাগচী মীননাথকে এগারো শতকের লোক বলেছেন।
তিব্বতীয় গ্রন্থ অনুসারে মীননাথের পরিচিতিঃ Masters of
Mahamudra: Songs and Histories of the Eighty-Four Buddhist Siddhas নামে একখানি মূল্যবান পশ্চিমা বই রয়েছে। বইটি ১৯৮৫ সালে State
University of New York Press, Albany থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এ
বইয়ে নাথপন্থার ৮৪ জন সিদ্ধার জীবন সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। সিদ্ধাগণের জীবন
সম্পর্কিত তথ্যের জন্য লেখক ব্যবহার করেছেন তিব্বতীয় ভাষায় লিখিত Grub
thob brgyad bcu tsa bzhi’i lo rgyus (Legends of the Eightyfour Mahasiddhas) নামক বইটি।
ঐতিহাসিকভাবে মীনপা সরাসরি শিবের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছেন, নিজে
সাধনা শিখিয়েছেন কামরূপে এবং বিখ্যাত গোরক্ষ তার শিষ্য ছিলেন। এছাড়াও দেখা যায়
গুরু মীননাথ একইসাথে শৈব ও শাক্তদেরও গুরু। এসময় পর্যন্ত সাধনায় শাখা বা
গোষ্ঠীবিভেদ ছিল না, ফলে সিদ্ধারা বৌদ্ধ দীক্ষা এবং শাক্তও
শৈব দীক্ষা একই সাথে বা একের পর এক গ্রহণ করতে পারতেন। এর ফলে গোত্র পরম্পরায়
কিছুটা আধ্যাত্মিক বিনিময় থাকলেও সাধনপন্থা আলাদাই রয়ে গেছে।
বঙ্গে মচ্ছেন্দ্র ছিলেন ‘কৌল’, ‘নাথ’ ও ‘কানফাটা’ যোগীদের আদি গুরু। বাঁহাতি বাঙ্গালি ‘শাক্ত’ যাদেরকে ‘যোগিনী-কৌল’ অথবা ‘সাধনামৃত’ বলা হয় তারা মীন বা মচ্ছেন্দ্রকে ‘ভৈরব-শিব’ নামে তাদের আদি গুরু হিসেবে জানে। তাদের
গ্রন্থ ‘কৌলজ্ঞান-নির্ণয়’-এ বর্ণিত
আছে সেই ধর্ম যা মহাদেব উমাকে শিখিয়েছিলেন। ‘কৌলজ্ঞান-নির্ণয়’-এ বলা আছে যে মচ্ছেন্দ্র এটা শিখেছিলেন। তবে মহাদেব যে এই জ্ঞান উমার
অনুরোধে উমাকে বিতরণ করেছিলেন তা ‘কৌলজ্ঞান-নির্ণয়’-এ বলা নেই।
অন্য এক কাহিনিতে আছে মহাদেবের ছেলে কার্তিক ইঁদুর রূপে এই
জ্ঞান চুরি করেছিলেন এবং সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মচ্ছেন্দ্র সাগর থেকে উহা
উদ্ধার করেন। ‘শক্তি’র পথ ‘কৌল-মার্গ’এর গন্তব্য বা লক্ষ্য হলো ‘কূল’ (শক্তি) ও ‘অকূল’ (শিব) এর
মিলন। এই গন্তব্যে পৌঁছা যায় যোগিনীদের আচার সহযোগিতায়।
তারানাথ তাঁর মীনপা কাহিনিতে কিছু ভিন্ন কথা বলেন। তাঁর
বক্তব্যমতে মহাদেব উমাকে তাঁর ধর্ম শিখাচ্ছিলেন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে উমাগিরি নামে
এক পাহাড়ে। মীনপা তখন মাছের পেটে নদীতে পাশে এক জায়গায় চুপটি মেরে ছিলেন।
মহাদেবের শিক্ষা ছিল মানস-শক্তির (প্রাণ) প্রবাহরূপে। তারপরে অবশ্য তারানাথ তাঁর
গল্পে এক জেলেকে নিয়ে আসেন। জেলে উক্ত মাছ ধরে পেট কেটে একটি ছেলে পান। ছেলেটিকে
নিয়ে তিনি গুরু চারপাতির কাছে যান। গুরুর দীক্ষায় জেলে পরিণত হন মীনপা রূপে এবং
ছেলেটি পরিণত হয় মচ্ছেন্দ্রপা রূপে। মীনপা পরে হালিপা, মালিপা
ও তিবোলিপার গুরু হন এবং মচ্ছেন্দ্রপা গোরক্ষ ও চৌরঙ্গীর গুরু রূপে আবির্ভুত হন।
হতে পারে এভাবে তারানাথ মীনপা ও মচ্ছেন্দ্রনাথ নামের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন।
পরবর্তী সময়ের নেপালী পুরাণে দেখা যায় বোধিসত্ত্ব
অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি শিবকে যোগ শিখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই মচ্ছেন্দ্ররূপে
মানুষের আকারে শুনতে আসলেন শিব তাঁর জ্ঞান উমাকে কিভাবে দিচ্ছেন। এরপর মচ্ছেন্দ্র
যখন যোগিনীদের সাথে কামরূপ বা শ্রীলঙ্কা চলে যান তখন নেপালে এক দুর্ভিক্ষ দেখা
দেয়।
রাজা জানতেন নেপালের একমাত্র সিদ্ধা মচ্ছেন্দ্রই শুধু
ফসলের জন্য বৃষ্টি আনতে পারবেন। তাই তিনি তাঁর এক মন্ত্রী পাঠিয়ে দিলেন
মচ্ছেন্দ্রের কাছে। মচ্ছেন্দ্র মন্ত্রীর আর্জি কবুল করলেন। তিনি বললেন তিনি এক
মৌমাছি রূপে কিছুদিনেই দেশে যাবেন। সময়মতো এক রাতে তিনি ঠিকই আসলেন। মৌমাছিটি ধরে
ফেলা হলো এবং প্রচুর বৃষ্টি হলো। রাজা মন্ত্র দিয়ে তাঁর একটি মূর্তি নির্মাণ
করলেন। এটি নেপালের রক্ষার প্রতীকরূপ দেবতা হয়ে গেল।
মীননাথ
বা মৎস্যেন্দ্রনাথ নেপালে শৈবধর্ম প্রচার করতে যান। তিনি শৈবযোগী হলেও নেপালি
বৌদ্ধদের মধ্যে চতুর্থ বোধিসত্ত্ব রূপে উপাস্য হন। তাঁর শিষ্য এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ
নাথযোগী গোরক্ষনাথ। নেপালের মুদ্রায় তার নাম অঙ্কিত হয় এবং পশুপতিনাথ তূল্য সম্মান
তিনি নেপালি হিন্দুদের মধ্যে পান।
নেপালে কাঠমানডু একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরে
মচ্ছেন্দ্রনাথের একটি মূর্তি রয়েছে। এমূর্তিকে ‘করুণাময়’, ‘লোকনাথ’, ‘অবলোকিতেশ্বর’ ইত্যাদি
নামে পূজো দেয়া হয়। নেপালে আরো বলা হয় মচ্ছেন্দ্র এখানে প্রথম ধানের বীজ
আশীর্বাদরূপে দান করেছেন। মীনপার প্রধান শিষ্য গোরক্ষ ‘নাথ
যোগী সম্প্রদায়’-এর প্রতিষ্ঠাতা গুরু ছিলেন। মীনপা এভাবে
নাথ সম্প্রদায়ের আদি মানবগুরু রূপে উপাসিত।
যদিও এদের কয়েকজন গুরু লুউপা, কাহ্নুপা
প্রমুখেরা আদি বাংলা ভাষায় চর্যাপদের গান লিখেন। নাথসাহিত্যের অর্ন্তগত। নাথসাহিত্যের সঙ্গে চর্যাপদের সর্ম্পকও গভীর। এ প্রসঙ্গে শ্রীকুমার
বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা’ বইতে
লিখেছেন: ‘নাথসাহিত্য ও চর্যাপদ এই উভয় ধারাতেই সিদ্ধদিগের
কয়েকটি সাধারণ নাম পাওয়া যায়। এই ঘটনা দ্বারা দু’য়ের মধ্যে
যে সর্ম্পক ছিল তা প্রমানিত হয়।’ অর্থাৎ নাথধর্ম ও চর্যাপদ
এর মধ্যে সর্ম্পক গভীর। চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়ের অর্থাৎ চর্যাপদের
টীকায় মীননাথের নামে একটি কবিতা উল্লেখ রয়েছে-
কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।
কর্ম্ম কুরঙ্গ সমাধিক পাঠ।
কমল বিকসিল কহিহ ণ জমরা।
কমল মধু পিবিবি ধোকে ন ভোমরা।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর বাংলা অনুবাদ করেছেন-
কহেন গুরু পরমার্থের বাট।
কর্মের রঙ্গ সমাধির পাট।
কমল বিকশিত, কহিও না জোংড়াকে (শামুককে)
কমল মধু পান করিতে ক্লান্ত হয় না ভোমরা।
কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট।
কর্ম্ম কুরঙ্গ সমাধিক পাঠ।
কমল বিকসিল কহিহ ণ জমরা।
কমল মধু পিবিবি ধোকে ন ভোমরা।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর বাংলা অনুবাদ করেছেন-
কহেন গুরু পরমার্থের বাট।
কর্মের রঙ্গ সমাধির পাট।
কমল বিকশিত, কহিও না জোংড়াকে (শামুককে)
কমল মধু পান করিতে ক্লান্ত হয় না ভোমরা।
মৎস্যেন্দ্রনাথ
হিন্দু ও বৌদ্ধ নাথযোগী এবং তান্ত্রিকদের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার
করেন। তাঁর রচিত কৌলজ্ঞান–নির্ণয় নামক গ্রন্থ সাক্ষ্য দিচ্ছে, শৈব ও বৌদ্ধ,
উভয় তন্ত্র দর্শন সম্পর্কেই তিনি গভীরভাবে অবহিত ছিলেন।
মহাস্থানগড়: যোগীর ভবন
এক মুঠ অতীত গৌরব
বাংলা
সাহিত্যেও মীননাথ এর অবদান অসামান্য। ঐতিহাসিকদের মতে, মীননাথ
বাংলা ভাষার আদি কবিদের অন্যতম। তিনি ‘বাহ্যান্তর-বোধিচিত্ত
বঙ্গোপদেশ’ শিরোনামে একটি বই লিখেছিলেন।
তাঁর ভাষাই বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন। তাছাড়া নাথধর্মকে কেন্দ্র করে নাথসাহিত্য গড়ে উঠেছিল।
বাংলা
সাহিত্যের জন্মের সঙ্গে জড়িত এই সম্প্রদায়টি ছিল স্বাধীনচেতা। এদের চিন্তায়
সাধারণ মানুষের স্থান ছিল উর্ধ্বে। আসলে নাথধর্মের চূড়ান্ত বিকাশের সময়ই চর্যাপদ
লেখা হয়। এ প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের বিকাশের
ধারা’
বইতে লিখেছেন: ‘নাথসাহিত্য ও
চর্যাপদ এই উভয় ধারাতেই সিদ্ধদিগের কয়েকটি সাধারণ নাম পাওয়া যায়। এই ঘটনা দ্বারা
দু’য়ের মধ্যে যে সর্ম্পক ছিল তা প্রমানিত হয়।’
বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা গোপাল হালদার মনে করেন, নাথযোগী ও
সিদ্ধাচার্যদের কথা বাংলা সাহিত্যের জন্মকথার সঙ্গে জড়িত। অবহট্টের নতুন ঐতিহ্য
তাঁরাই তৈরি করেন। (‘আর্যদের মুখের ভাষা ছিল প্রাকৃত। সেই প্রাকৃত
আবার উত্তর ভারতের এক -একটা অংশে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এক-একটা নাম নিয়েছিল।
পূর্ব ভারতে যে-প্রাকৃত প্রচলিত ছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছে মাগধী
প্রাকৃত। বঙ্গ অঞ্চলের প্রাকৃতকে মহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন গৌড়ী প্রাকৃত। এই
প্রাকৃত ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে- রূপ নেয়, তার
নাম দেওয়া হয় অপভ্রংস। অপভ্রংসের পরের পর্যায়ে তার নাম হয় অবহট্ট। মোটামুটি সেই
ভাষার নমুনাই আমরা দেখতে পাই চর্যাপদে। (গোলাম
মুরশিদ। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি। পৃষ্ঠ;
২৩) গোপাল হালদার আরও মনে করেন যে, নাথযোগীদের
ভাবলোক ছিল আর্যদের ভাবলোক থেকে পৃথক। সরল জীবন ছিল তাদের লক্ষ্য।
গোরক্ষবিজয়,
রাজা মানিকচন্দ্রের গীত,
ময়নামতীর গান বা গোপীচন্দ্রের গান নাথসাহিত্যের অর্ন্তগত। বিভিন্ন স্থানিক সংস্করণে পৃথক পৃথকভাবে প্রকাশিত হলেও এগুলি মূলে একই
কাহিনীর রকমফের। নাথসাহিত্যের এই ধারাটি সাধারণ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
রূপকের মাধ্যমে নিষ্ঠা ও চরিত্রশুদ্ধির মহান আদর্শকে এ ধরনের কাহিনীতে উচ্চে তুলে
ধরা হয়েছে। ফলে নীতিমূলক লোকশিক্ষার গৌরবে এসব কাহিনী সহজেই সমাদৃত হয়েছে।
বাংলা
ছাড়াও হিন্দি,
ওড়িয়া, মারাঠি, গুজরাটি,
নেপালি ও তিববতি ভাষায় গাথামূলক কাহিনীগুলির আলাদা আলাদা সংস্করণ
পাওয়া যায়। ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের গানে গার্হস্থ্য জীবনের আধারে যোগজীবনের
নির্দেশিকা স্থান পেয়েছে।
নাথসাহিত্য
নাথধর্মের আচার-আচরণ ও নাথযোগীদের কাহিনীভিত্তিক সাহিত্য। এটি মধ্যযুগীয় বাংলা
সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। এ সাহিত্য দুটি ধারায় বিকাশ লাভ করে: একটি হলো
সাধন-নির্দেশিকা (guideline);
এগুলি সাধনার গুহ্যতা রক্ষার্থে কতগুলি রহস্যজ্ঞাপক পদ বা দোহা;
এতে প্রচুর পারিভাষিক শব্দ ও বাক্য (code language) রয়েছে এবং বাক্যগুলি উপদেশমূলক। দ্বিতীয় ধারার সাহিত্য হচ্ছে গাথাকাহিনী
বা আখ্যায়িকা; এতে সিদ্ধাদের সাধনজীবনের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ
বা সিদ্ধিলাভের কথা পরিবেশিত হয়েছে। এই শ্রেণির কাহিনীর লক্ষ্য ছিল সাধারণ
মানুষের দৃষ্টিকে বিশেষ ধর্মপথের দিকে আকৃষ্ট
করা।
নির্দেশিকামূলক
পদ বা দোহাগুলি সংকলন বা প্রত্যক্ষ রচনা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছিল। গোরক্ষসংহিতা এবং
যোগচিন্তামণি এরূপ দুটি সংকলন। কাহ্নপা ও জালন্ধরীপার রচনা হিসেবে কিছু দোহার
সন্ধান মিলেছে এবং চর্যাগীতিকার দোহা সংকলনে সেগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
গোরক্ষপন্থীদের মধ্যে গোরক্ষনির্দেশিকা হিসেবে যা প্রচলিত তা শ্রুতিনির্ভর সংকলন।
মীননাথ বা গোরক্ষনাথের ব্যক্তিগত কোন রচনা নেই।
এই
ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাহিনী হলো নারীসিদ্ধা গোরক্ষশিষ্যা রানী ময়নামতী
স্বামী মানিকচন্দ্রকে স্বল্পায়ুর ভবিতব্য থেকে ফেরাবার জন্য ভোগজীবন ত্যাগ করে
সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রাজা তা না মেনে অকালে মৃত্যুবরণ
করেন। পরে পুত্র গোপীচন্দ্রকে একই কারণে তিনি তাঁর রাজ্যে ঝাড়ুদারের কাজে নিযুক্ত
যোগী হাড়িপার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে বলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও শিষ্যত্ব নিয়ে
গোপীচন্দ্র বারো বছরের জন্য গৃহছাড়া হন। পরে হীরা নটীর মোহপাশ লঙ্ঘন করে সংসারে
ফিরে আসেন। গোপীচন্দ্র তাঁর পত্নীদের যোগবিভূতি দেখিয়ে চমৎকৃত করার লোভে পড়ে
গুরু হাড়িপার ক্রোধে পড়েন। এতে বিরক্ত গোপীচন্দ্র স্ত্রীদের পরামর্শে গুরুকে
মাটিতে পুঁতে ফেলেন। পরে হাড়িপার শিষ্য কানুপা গোরক্ষের কাছ থেকে এ কথা শুনে
গুরুকে উদ্ধার করেন। গোপীচন্দ্র কী কৌশলে হাড়িপার ক্রোধ থেকে রেহাই পেয়ে চিরতরে
সন্ন্যাস নিলেন,
তারই বিবরণ আছে এই গল্পে।
গোরক্ষবিজয়
সংক্রান্ত ১৭টির মতো পুথি অবিভক্ত বাংলা থেকে সংগৃহীত হয়েছে। সংগ্রাহকরা হলেন
নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১টি পুথি), আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (৮টি পুথি),
আলি আহমদ (৭টি পুথি) এবং পঞ্চানন মন্ডল (১টি পুথি)। এসব পুথির
অধিকাংশই খন্ডিত। পুথি অনুসরণে সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন। নলিনীকান্ত ভট্টশালী
সম্পাদিত গ্রন্থের নাম মীনচেতন এবং আবদুল করিম ও পঞ্চানন মন্ডল সম্পাদিত গ্রন্থের
নাম যথাক্রমে গোরক্ষবিজয় ও গোর্খবিজয়।
দুর্লভ
মল্লিকের কাব্যের নাম গোবিন্দচন্দ্র গীত; সম্পাদনা করেন শিবচন্দ্র শীল।
নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সম্পাদনায় ভবানী দাসের ময়নামতীর গান এবং সুকুর মহম্মদের
গোপীচাঁদের সন্ন্যাস কাব্যদুটি ঢাকা সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত হয়।
হরপ্রসাদ
শাস্ত্রী মহাশয় নেপাল থেকে বেশ কিছু পুঁথি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তা তিনি “হাজার
বছরের পুরনো বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নামে প্রকাশ করেন।
বাঙালি বৌদ্ধ ও শৈবতান্ত্রিক সিদ্ধেরা অপভ্রংশে সাধনসম্বন্ধীয় যে সকল পদ রচনা
করতেন তা ‘দোহা’ নামে পরিচিত।
সুনীতিবাবু এই দোহাগুলোকেই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম রূপ বলে বলেছেন। এই পদের
অন্যতম রচয়িতা লুইপা বা মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ। এই লুইপা এবং মীননাথ যে এক ও
অভিন্ন ব্যাক্তি এই নিয়ে পণ্ডিতেরা একমত হয়েছেন। পরবর্তীকালে ডক্টর প্রবোধচন্দ্র
বাগচী নেপাল থেকে মীননাথ রচিত আরও কিছু পুঁথি উদ্ধার করেন। বাংলাদেশের সাথে
নাথযোগীদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকায় নাথপন্থার অনেক পুঁথি বাংলায় রচনা করা হয়। গোরক্ষ
রচনাবলী হিন্দি সাহিত্যের মূল উৎস স্বরূপ ধরা হয়।
বাংলায়
নাথধর্মের সামাজিক অবদানের কথাও কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলে থাকেন। ষোড়শ শতকে গৌড়ীয়
বৈষ্ণব মঠের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীচৈতন্যদেব বাংলায় যে ভক্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা
করেছিলেন তার মূল প্রেরণা একমাত্র সুফিবাদের মধ্যে নিহিত ছিল না। সেই প্রেমবাদী
ভাববিপ্লবের অন্যতম প্রেরণা ছিল বাংলার নার্থধর্মটির মানবতাবাদী চেতনা।
নাথযোগী
যোগীর
ভবনে অলৌকিক কূপ
বাংলায়
নাথধর্মটি টিকে থাকতে পারেনি। একাদশ শতকের পরে ধর্মটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বাংলায়
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের উত্থান এর এক কারণ। একাদশ শতকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনরা বাংলার
ক্ষমতা দখল করে নেয়। সেনরা নাথযোগীদের ধর্মহীন আখ্যা দিয়ে নির্মম ভাবে পীড়ন
করেছিল। এরপর নাথযোগীরা হয়ে গেল যুগী। এদের বৃত্তি হল কাপড় বোনা।
ইতিহাস
বলে যে,
একদা বাংলার নৃপতি বল্লাল সেনের শাসনকালে নাথ ব্রাহ্মণ বা রুদ্রজ
ব্রাহ্মণরা, ব্রাহ্মণদের মধ্যে উচ্চ স্থানের অধিকারী ছিলেন।
তাঁরা রাজপুরোহিত হিসাবে কাজ করতেন। গোল বাঁধলো বল্লাল সেনের পিতা লক্ষণ সেনের
মৃত্যর পরে। তখন রাজপুরোহিত ছিলেন নাথ ব্রাহ্মণ পীতাম্বর নাথ। তিনি বল্লাল সেনের
গুরুদেবও ছিলেন। পিতৃ শ্রাদ্ধে রাজা বল্লাল সেন চাইলেন যে তাঁর গুরু ও রাজপুরোহিত
পীতাম্বর নাথ তাঁর মৃত পিতার পিন্ড গ্রহণ করুন, রাজার দান
হিসাবে। পীতাম্বর নাথ কোনও মৃত ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত কোনও দান গ্রহণ করতে
অস্বীকার করলেন। ব্যাস! প্রচন্ড ক্রোধে ও আত্মভিমানে বল্লাল সেন তাঁর উপবিত (পৈতা)
টেনে ছিঁড়ে দিলেন ও সমগ্র বঙ্গদেশে প্রচার করলেন যে নাথ ব্রাহ্মণ বা রুদ্রজ
ব্রাহ্মণদের রাজার নির্দেশে শুদ্র বলে গণ্য করা হবে। অথচ বঙ্গের বাইরে কিন্তু
নাথেরা ব্রাহ্মণ হিসাবেই গণ্য হতেন ও আজও হন।
তবে
নাথধর্ম বিলুপ্ত হলেও নাথধর্মের বিশ্বাস বাঙালির বিশ্বাসের জগতে আজও রয়ে গেছে, বিশেষ
করে- আজকের হিন্দুধর্মে। প্রথমে বুদ্ধ ও পরে শিবকে কেন্দ্র করে যে নাথধর্মের
উত্থান সেটি বাঙালি হিন্দু সমাজে পরবর্তীকালে শিব এর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে
শেষ হয়।
বগুড়ার
সাত মাইল উত্তর-পশ্চিমে যোগীরভবন নামক গ্রামে নাথপন্থী কাণফটু যোগীদের একটি
দেবপুরী আছে। দেবপুরী মধ্যে ধৰ্ম্মভুঙ্গি বা ধর্মের মন্দির আছে এবং এর গদীঘরে একটি
অগ্নিকুণ্ড সবসময় জ্বালিয়ে রাখা রাখা হয়। যোগীর ভবনের চারটি মন্দিরের মধ্যে একটি
গোরক্ষনাথের বলে মনে করা হয়। জনশ্রুতি আছে এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যোগী ও
সাধু-সন্নাসীদের যাতায়াত ছিল বলে এ স্থানটির নামকরণ ‘‘যোগীর
ভবন’’।
লোকচেতনায়
গোরক্ষনাথের আরও রূপান্তর ঘটেছে। দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলের রাজবংশী ও পলিয়া কৃষককুল
তাঁকে গো-রক্ষক দেবতারূপে পূজা করে। তিনি গৃহপালিত গবাদিপশুকে সব রকমের রোগ থেকে
রক্ষা করে থাকেন। দিনাজপুরের গোরক্ষকূপে এক চূড়াবিশিষ্ট তিনটি মন্দিরের একটি
গোরক্ষনাথের মন্দির আছে।
গোরক্ষনাথের
প্রতীক একটি কাঠের মূর্তি তেল-সিঁদুর মাখিয়ে গোয়ালঘরে রেখে নানা উপকরণ দিয়ে
পূজা করা হয়। এ পূজায় এক কূলা ধান নিবেদন করতে হয়।
সাধারণ
কৃষক সমাজেও গোরক্ষনাথের পূজার প্রচলন ছিল। পাবনা জেলায় ‘গোরক্ষনাথের
ব্রত’ এবং ময়মনসিংহ, ঢাকা প্রভৃতি
অঞ্চলে ‘গোরক্ষনাথের শিরনি’ নামে
লোকাচার পালন করা হতো। এ আচার পালনের পদ্ধতি হচ্ছে বাছুর জন্মের ৩০ দিন পর গাভীর
দুধ দোহন করে সবটাই গাঢ় করে জ্বাল দেওয়া হয়। তারপর চিনি মিশিয়ে সেই দুধ দিয়ে
গরু ও বাছুরের মূর্তি, নাড়ু, স্বস্তিকা
প্রভৃতি তৈরি করা হয়। সন্ধ্যার সময় একটি রাখাল বালক কলাপাতায় করে ওই ভোগ
গোয়ালঘরের এক কোণে রেখে আসে। বিশ্বাস করা হয় যে, রাতের
বেলা গোরক্ষনাথ এসে ওই ভোগ গ্রহণ করেন। গাভীর অধিক দুধ পাওয়ার উদ্দেশ্যেই
গোরক্ষনাথের শিরনি আচারটি পালিত হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে উঠানের একটি স্থান লেপে
পরিষ্কার করে পাড়ার রাখাল ছেলেদের ডেকে এনে পায়েস খাওয়ানো হয়। খাওয়ার পর তারা
এঁটো হাতে গাভীর পিঠে কিল দেয়। (তথ্যসূত্র: নাথ
সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দর্শন ও সাধনপ্রণালী: শ্রীমতী কল্যাণী
মল্লিক।)
সব
থেকে জাঁকজমকের সাথে গোরক্ষনাথ মন্দির পুজা
চলে ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার দেড়’শ বছরের পুরাতন গোরক্ষনাথ মন্দিরে। জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এখনও
আকর্ষনীয়। নাথ মন্দিরটি চত্বরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত বৈচিত্রময় প্রস্তর নির্মিত
আশ্চর্য কূপ ও তার পানি মহা পবিত্র জিনিস হিসাবে তাদের কাছে বিবেচিত হয়ে আসছে।
কূপটি বড় বড় কালো পাথরের খন্ড দ্বারা নির্মিত। এ কূপের
একেবারে নীচু অংশটুকু পর্যন্ত পাথর দিয়ে বাঁধানো। এই কুপের মাঝখানে আছে একটি
ছিদ্র। প্রতি বছরের ১৮ ফাল্গুন এ কূপের পানিতে স্নান করে নিজেরা পুত-পবিত্র হওয়ার
জন্য উত্তারাঞ্চলের হাজার হাজার নরনারীর আগমন ঘটে। এ উপলক্ষ্যে শীবযাত্রী মেলা
বসে।
কথিত আছে, গোরক্ষনাথ
ছিলেন নাথ পন্থীদের ধর্মীয় নেতা খীননাথের শিষ্য। নবম-দশম শতাব্দির মধ্যে ভাগে
গোরক্ষনাথের আভির্ভাব ঘটে। তিনি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এখানে মন্দির স্থাপন
করেন। অলৌকিক ওই কূপটি সেই সময়ে নির্মিত বলে প্রবীনদের ধারনা।
বাংলাদেশে
নাথপন্থার অনুসারীরা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মে ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁতি
শ্রেণীর বৌদ্ধরাই প্রধানত নাথপন্থী। ইসলাম ধর্মে যারা জোলা ‘জুলহা’ নামে পরিচিত তারা আদিতে নাথপন্থী ছিল।
মহাযোগী গুরু গোরক্ষনাথের ধ্যান-মুর্তি
আছে
টাকে সত্য করে তুলতে
সমুদ্রের
মৎস্য আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতীক হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত (কোরাণ ও বাইবেল দুই
জায়গায়ই ইউনুস (আঃ) বা জোনার কাহিনি প্রচলিত আছে)। এই পটভূমিতে মীনপার মাছের
পেটে বেঁচে থাকার বিষয়টি অতীতের পুণ্যে বর্তমানের সৌভাগ্য।
মীনপার
সৌভাগ্য এই বিশ্বব্রহ্মা-রূপ সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা এক আংটির সন্ধানে সফল হয়ে
আধ্যাত্মিক আলো অর্জন করে তিনি ফিরে এসেছেন আবার পাড়ে- জীবনে। দশ বছরের সাধনায়
তার তরলে (পানিতে) যাপিত অনিশ্চয়তার জীবন শেষ। মাছ থেকে বের হয়ে আসা মানুষ
অর্থাৎ মৎস্য-মানুষ রূপেও রয়েছে প্রতীকী অর্থ। মাছের সাতার শ্রমহীন অর্থাৎ
আয়াসহীন,
মাছের ঘুম নেই- তন্দ্রা নেই, সে পানিতে থাকে
কিন্তু পানি তাকে ভেজায় না, কখনো শ্রমে ঘেমে খাবার খুঁজে
ফেরে না অথচ অভুক্তও থাকে না, জীবনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে
বাঁচতে হয় না এবং কারোর সাথে সংঘর্ষে-সংগ্রামেও লিপ্ত হতে হয় না। এই হলো মাছের
জীবন এবং তিব্বতীয়দের কাছে এই মাছ পবিত্রতার প্রতীক। সাধনায়
এমন জীবনই আরাধ্য। ফলত মৎস্য-প্রভু বা সমার্থক নামে মৎস্যেন্দ্রনাথ কিংবা
মচ্ছেন্দ্রনাথ হতে পারে যোগসাধনায় সিদ্ধ যেকোনো সাধক ‘অবধূতি’
কিংবা ‘অচিন্ত্যপা’র
উপাধি।
মীননাথ
নিয়ে গোরক্ষবিজয় নাথধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য। যোগিশ্রেষ্ঠ গোরক্ষনাথের জীবন ও
আধ্যাত্মিক সাধনার কথা এতে বিবৃত হয়েছে। উজ্জ্বল চারিত্রিক আদর্শের জন্য
গোরক্ষনাথ নাথসিদ্ধাদের মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠেন এবং সর্বত্র ভক্তি ও সমাদর লাভ
করেন। গৌরীর (শিবজায়া) সম্মোহন পরীক্ষায় তিনি অনায়াসে উত্তীর্ণ হন এবং নিজে
শিশুসন্তানের ভূমিকা নিয়ে স্ত্রী ও রমণীকুলের আকর্ষণ ও বন্ধন অতিক্রম করে যান।
একবার তাঁর গুরু মীননাথ আত্মবিস্মৃত হয়ে কদলী নামক প্রমীলারাজ্যে ষোলোশত রমণীর
ভোগচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। তখন গুরুকে উদ্ধারের উদ্দেশ্যে গোরক্ষনাথ নর্তকীর বেশে
মৃদঙ্গবোলের সঙ্গত দ্বারা গুরুকে তাঁর যোগশিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেন এবং তাঁর চেতনা
ফিরিয়ে এনে তাঁকে উদ্ধার করেন। সংক্ষেপে এটাই হলো গোরক্ষবিজয়ের কাহিনী।
নাথগীতিকায়
গোরক্ষনাথ তাঁর গুরু মীননাথকে (মৎস্যেন্দ্রনাথ)উদ্ধার হেতু যে নৃত্য করেছিলেন তার
বর্ণনা আছে—
“নাচন্তি যে গোর্খনাথ মাদলে করি
ভর।
মাটিতে না লাগে পদ আলগ উপর।
নাচন্তি যে গোর্খনাথ ঘাগরের রোলে,
কায়া সাধ কায়া সাধ মাদলেতে বলে।”
গোরক্ষবিজয়, গোপীচন্দ্রের
গান, মানিকচন্দ্রের গানে বাংলাতে যে ধর্ম ও দর্শনের বহু
প্রাচীন ঐতিহ্য আছে, সে সম্পর্কে বিশ্বের পণ্ডিতেরা ভালোভাবেই জানেন। যদিও বাঙালির প্রথম মেধা বিস্ফোরণ ঘটান সাংখ্য
দর্শনের জনক ঋষি কপিল। খৃস্টপূর্ব পঞ্চম
শ্তকে। এর পরেই খৃস্টীয় নবম শতকে নাথধর্ম
দর্শনের উত্থান।
সাম্প্রতিক
উৎখনন ও গবেষণা দর্শনের লুপ্ত ভাণ্ডার পুনরুদ্ধার করার পর ফরাসী বুদ্ধিজীবীসহ
চৈনিক ইতিহাসবিদদের বিস্ময়ের যেন শেষ নেই। এই সমস্যাসঙ্কুল দরিদ্র দেশে সাংখ্য-নাথের
মতন ধর্ম-দর্শনের উত্থান ঘটেছে কতকাল আগে। সক্রেটিস ও এরিসটটলের মতন সূক্ষ্ম দর্শন
ও জীবনবোধ কোথায় আর কোন দেশে পাওয়া যায়।
নোবেল পুরস্কার-বিজয়ী অমর্ত্য সেন
ক্যালিফোর্নিয়া ম্যাগাজিন-এর জন্য প্রণব বর্ধনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে
(ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কেলে কর্তৃক জুলাই-অগস্ট ২০০৬ সংস্করণে প্রকাশিত) বলেন: কোনো কোনো
ভাবে মানুষের ধারণা হয়েছে ভারত আধ্যাত্মিক ও ধর্মকেন্দ্রিক। এর ফলে ভারতের একটি
ধর্মীয় ব্যাখ্যার পথ খুলে গিয়েছে। যদিও সংস্কৃত ভাষায় এমন একটি বৃহৎ
নাস্তিক্যবাদী সাহিত্যের সম্ভার রয়েছে, যা অন্য কোনো
ধ্রুপদি ভাষায় নেই।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বাঙালির ইহা একটি গৌরবময় বিষয় যে একজন বাঙালি গোটা
ভারতবর্ষকে একটি ধর্মমত দিয়াছিলেন।’ এই গৌরব টাকে সত্য করে তুলতে হবে। এই দায়
সবার।
###
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
###
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
Comments