পুণ্ড্রের পাঁচালী-২৩ (বর্ষার সম্রাট কালিদাস )
পুণ্ড্রের
পাঁচালী-২৩ (বর্ষার সম্রাট কালিদাস )
সাজেদুর
রহমান
১৯৫৯ সালে কবিকে নিয়ে ‘মহাকবি কালিদাস’ নামে একটি হিন্দি সিনেমাও নির্মিত হয়। সেই সিনেমার পোস্টার
ছোট
একটি গল্প। ধনের দেব কুবের। তার বাড়িতে চাকরি করে এক যক্ষ। 'যক্ষ'
হলো লোকটির জাত-পাতের পরিচয়। যক্ষ বিয়ে করেছে সবেমাত্র। নতুন বৌ,
ঘরসংসার গোছগাছ করায় যক্ষ ব্যস্ত। এর ফলে চাকরির কাজে বেচারার
ত্রুটি ঘটতে লাগল। তখন রেগেমেগে কুবের তাকে শাস্তি দিলেন। তারা ছিল অলকাপুরীতে।
অলকাপুরী হলো মানসসরোবরের কাছে কৈলাস পর্বতে এক শহর। কুবের তাকে সোজা পাঠিয়ে দিলেন
রামগিরি পাহাড়ে। উত্তর প্রদেশের দক্ষিণাংশ ও মধ্যপ্রদেশের সংযোগস্থলে অত্যন্ত দূর
ও দুর্গম পাহাড়ি জায়গাটি ঘন অরণ্যে ঢাকা। রাজধানী থেকে এসে এরকম বুনো জায়গায় একটি
বৎসর একা একা নির্বাসনে থাকবে যক্ষ- এটাই তার শাস্তি।
এর
মধ্যে দশ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে, মাত্র দুটি মাস বাকি, তার পরেই সে ফিরে যেতে পারবে রাজধানী অলকাপুরীতে। এলো আষাঢ় মাস। বর্ষা
কাল। মেঘের সে কী নয়ন-ভোলানো মনমাতানো রূপ! সমস্ত পর্বত ও অরণ্যানী নতুন সাজে সেজে
উঠেছে যেন। দশটা মাস তার কোনো কষ্ট হয়নি, হঠাৎ এখন বাড়ির
জন্য এমন মন কেমন করতে লাগল যক্ষের যে সে যেন পাগল হয়ে যায়। নববধূর জন্য কষ্ট হতে
লাগল, শহুরে জীবনের আমোদ-আহ্লাদের জন্য শোক উথলে উঠল। তার ভয়
হয়, বেচারি অভাগিনী বৌটি বেঁচে আছে তো। যক্ষ বেঁচে নেই ভেবে
সে-ও যদি দুঃখ-শোকে মরে গিয়ে থাকে! সেকালে তো আর ডাকব্যবস্থা ছিল না যে যক্ষ
স্ত্রীকে চিঠিপত্র লিখবে।
কী
করে এখন! হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আচ্ছা, মেঘ তো উড়ে উড়ে দেশ-দেশান্তরে
যায়; যদি মেঘকে অনুনয়-বিনয় করে বলি যে, 'ভাই মেঘ, তুমি আমার খবরটা আমার স্ত্রীকে একটু পৌঁছে
দিয়ে এস', তো সে যাবে না?
এটাই
হলো 'মেঘদূতম্' কাব্যের কাহিনী। পূর্বমেঘ জুড়ে মেঘকে
বর্ণনা দিচ্ছে যক্ষ- কীভাবে কোন পথ দিয়ে মেঘ অলকাপুরীতে যাবে। আর উত্তরমেঘে যক্ষ বুঝিয়ে
দিচ্ছে মেঘকে- রাজধানী অলকায় অত ঘরবাড়ি রাস্তাঘাটের ভেতরে মেঘ কী করে চিনে নেবে
যক্ষপ্রিয়াকে, তার হদিস। মেঘকে দূত হিসাবে পাঠানো হয়েছে বলেই
কাব্যটির নাম মেঘদূত।
সংস্কৃত
ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাসের চূড়ান্ত নিদর্শন ‘মেঘদূত’
বা মেঘদূতম! বলা হয় এই কালজয়ী কাব্য গাঁথা রচনায় হাত দেন আষাঢ়ের প্রথম দিবসে।
এইজন্য মেঘদূতকে বলা হয় “বর্ষাকাব্য”।
পুরাকালে
বর্ষাকাল ছিল অপাংতেও। কৃষক মাঠে জেতে পারে না। বণিক বাজারে যায় না। এমনকি
যোদ্ধাদেরও হয়েপরে বেকার। এক কথায় বর্ষা ঋতু সকলের কাছে অসহ্য ছিল। হাতে কাজ
থাকেনা, বেবসা হয় না। এমনকি করা যায়না।
কিন্তু কবি কালিদাস বর্ষাকে এমন নান্দনিক ভাষায় এমন ভাবে উপস্থাপন করলেন যা তার
আগে বর্ষাকে দেখেনি কেউ।
বর্ষার
এমন বিরহী রূপ তিনিই প্রথম দেখেন এবং অনুভব করালেন এই সময় প্রকৃতির সাংবাৎসরিক
মেঘোৎসবের অদ্ভুত দৃশ। এর পর থেকে ঘটে গেলো অদ্ভুত পরিবর্তন। এর পর থেকে বাঙ্গালীর
কাছে বর্ষা বিশেষভাবে আদৃত। সেই থেক রামায়ণের
কিস্কিন্ধাকাণ্ড,
মেঘদূত, জয়দেব ও বৈষ্ণব গীতিকা, তারপর রবীন্দ্রনাথ- এমনি করে একটি আবহমান ধারা চলে আসছে এবং আজকের
যন্ত্রযুগেও বর্ষার মেঘ আমাদের মনে কীরকম মায়াবিস্তার করে, তার
প্রমাণ আছে নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ, জসিমউদ্দিন,
হুমায়ূন আহমদসহ সকল কবি-সাহিত্যিকের গান, কবিতা ও গল্পে। আর
তাই বলা যায়, বর্ষার সম্রাট কালিদাস।
কালিদাস
শুধু কবিতা বা নাটকের কারণেই আজকের দিনে গুরুত্বপূর্ণ নন। তার লেখালেখিতে রয়েছে
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস,
ভূগোল ও রাজনৈতিক নানা উপাদান। তিনি আজও আমাদের অনুপ্রেরণার কারণ। পুণ্ড্রের
পাঁচালী-২৩ তম পর্বে এই মহাকবিকে নিয়ে আলোচনা করব। সম্পূর্ণ নতুন তথ্য দিতে না
পারলেও কিছু অজানা কাহিনী দিতে পারব বলে বিশ্বাস রাখি।
কালিদাসের চূড়ান্ত নিদর্শন ‘মেঘদূত’! বলা হয় এই কালজয়ী কাব্য গাঁথা রচনায় হাত দেন আষাঢ়ের প্রথম দিবসে।
পৌণ্ড্রের কবি কালিদাস !
কালিদাসের বাড়ি নিয়ে অনেকগুলো মতবাদ
পাই। তার মধ্যে প্রবল মত হচ্ছে-এই কালজয়িতা কবির বাড়ি উজ্জয়িনীর কাছে পৌণ্ড্র গ্রামে। কালিদাস শুধু সংস্কৃত
সাহিত্যেই নয়,
বিশ্বসাহিত্যেরও একজন সেরা কবি। এত বড় একজন কবির জন্ম কথা নিয়ে
দেশ-বিদেশের রথী-মোহারথীরা আট দশ রকমের হদীস দিয়েছেন। এর মধ্যে আরেকটি সংখ্যাধিক্য মত হোল কালিদাস বাঙালি ছিলেন। আর তার বাড়ি
বৃহৎ বাংলায়।
কেউ
যুক্তি দেখান অযোধ্য প্রদেশ গজদানীতে। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর মনে করেন কালিদাস
নাথ নামে প্রাচীন বাঙ্গাণ সাহিত্যে বিশেষত বৈষ্ণব সহশে সুপণ্ডিত ছিলেন। কবি কালিদাস
গুপ্ত সাম্রাজ্যের কোন এক নরপতির সভাকবি ছিলেন।
এই
গুপ্ত খ্রিস্টের জন্মের আগে বা পরে হতে পারে। ত সেটা যে সময়ে হক- কারো মতে গুপ্তগণ
বাঙালি ছিলেন এবং প্রথমে বাংলাদেশেই রাজত্ব করতেন। আবার চৈনিক পরিব্রাজক ইৎসিং-এর
বিবরণের উপর নির্ভর করে ইতিহাসবিদ ডি. সি. গাঙ্গুলি অনুমান করেছেন যে, গুপ্তবংশীয়
রাজাদের আদি বাসস্থান বাংলাদেশেই ছিলো। সেটা বাংলার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে
থাকতে পারে অনুমান করা হয় (বাংলাদেশের ইতিহাস, গ্রন্থকার:
ফোর ডক্টরস)। তবে এ দুই অভিমতের পক্ষে কোনো জোড়ালো যুক্তি বা তাথ্যিক প্রমাণ পাওয়া
যায় নি (মজুমদার, প্রাগুক্ত, পৃঃ
৩৩-৩৪)।
দীনেশ
সেন তাঁর বৃহৎ বঙ্গে বলছেন যে আমরা বাঙালিরাই সেই প্রাচীন মগধ সাম্রাজ্যের
ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। গুপ্তযুগের মহাকবি কালিদাস
তাঁর রঘুবংশে বাঙালি জাতিকে “নৌসাধনোদ্যতান্” আখ্যা
দিয়েছেন। পুণ্ড্রর্ধনেবর বণিক চাঁদ সদাগর খুব সম্ভবত এই করতোয়া নদীপথেই সাগরে
যেতেন এককালে। কালিদাসের বর্ণনায় জানতে পারি, বাংলার রাজারা নৌকা নিয়ে যুদ্ধ করতেন।
কালিদাসের
সময়কাল ও তাঁর জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ গুলির মধ্যে প্রধান দুটি মতের পক্ষে সমর্থন
বেশি। প্রথম মতে,
তিনি খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে বিদ্যমান ছিলেন। প্রধান সূত্র হিসেবে দেখান,
কবির স্বরচিত মালবিকাগ্নিমিত্রম নাটকের নায়ক অগ্নিমিত্র ছিলেন শুঙ্গবংশীয় রাজা,
যাঁর শাসনকাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫-৪৮ অব্দ। শূঙ্গবংশীয় রাজা
অগ্নিমিত্রের কাহিনী অবলম্বনে তাঁরই জীবদ্দশায় রচিত বলে গবেষকদের ধারণা।
অপর
মতে, তাঁর সময়কাল খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে।
বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভাকবি হিসাবেই
খ্যাতি পান। কালিদাসের বহু রচনায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য, রাজধানী
উজ্জয়িনী ও রাজসভার উল্লেখ পাওয়া যায়।
‘কুমারসম্ভব’-এর শুরুতেই কবি কালিদাস হিমালয়ের যে
অসাধারণ বর্ণনা করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য: ‘গিরিরাজ হিমালয়!
গগনচুম্বী তাঁর শিখর দেশ, চির উন্নত। চিরবন্দিত। প্রভুত
সম্পদের অধিকারী গিরিরাজ হিমালয়। মেঘেরা তাঁর শিখর দেশে লীলা সহচরদের ন্যায় সতত
পরিক্রমায় রত। তুষার আবৃত হিমালয়, কিন্তু তুষার বা শৈত্য-
তাঁকে শীতার্ত করেনি। সিংহের দল, বুনো হাতীর, কিরাতের দল- সকলেই রয়েছে হিমালয়কে আশ্রয় করে।…’
জীবনকাহিনি
সম্পর্কে বিশেষ নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। খৃষ্টায় দ্বিতীয়, কেউ
বা তৃতীয়, কেউ বা পঞ্চম ও কেউ বা ষষ্ঠ শতাব্দীর লোক বলেছেন।
সপ্তম শতাব্দীতে বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত গ্রন্থে কালিদাসের সপ্রশংস উল্লেখ আছে।
কালিদাসের
জন্মকাল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও কৌতূহল কম ছিল না।
‘হায় রে কবে কেটে গেছে
কালিদাসের
কাল
পণ্ডিতেরা বিবাদ করে
লয়ে
তারিখ-সাল।
হারিয়ে গেছে সে সব অব্দ,
ইতিবৃত্ত
আছে স্তব্ধ-
গেছে যদি আপদ গেছে,
মিথ্যা
কোলাহল।
বাঙালি
কবি কালিদাস বলে, যারা মনেকরেন তাদের যুক্তি কিছুটা দুর্বল মনে হলেও কৌতূহল জাগায়
মনে। তারা বলেন, কালিদাসকে বলা হয় সরস্বতীর আশিসধন্য| অথচ
তাঁর নামে দেখুন দেবী কালিকার উপস্থিতি| (কালিদাস সংস্কৃত অৰ্থ:
কালির দাস বা উপাসক)
দুর্গা
বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী প্রতীক। দুর্গাকে নিয়ে বাঙালি বড় লেখক-কবিরা
তাঁদের অনুভূতি চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেছেন। বাঙালি কবি কালিদাস তাঁর রামায়ণে শরৎকালের
দুর্গাপূজাকে অকালবোধন বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও প্রাচীনতর মার্কণ্ডেয় পুরাণে
শরৎকালই দুর্গাপূজার সময় বলে উল্লিখিত।
আবার
বাল্মিকী রামায়ণে কিন্তু কোথাও রাম দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে পরিষ্কার উল্লেখ নেই!
এই
মতের পণ্ডিতরা কালিদাসের সাহিত্য বিশ্লেষণ করে বলেন, প্রাচিন এই কবির মধ্যে প্রবলভাবে
বঙ্গজ স্পর্শ| ‘নলোদয়’ কালিদাসের অপর একটি
নাটক। নল নামের এক প্রসিদ্ধ রাজার রাজনীতি এবং তার নীতিপরায়ণতার কথা নাটকটির বিষয়।
ওই রাজার রাজত্বকালে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, মুষিক বা পঙ্গপাল প্রভৃতির উপদ্রব ছিল না। যা কিছু শ্রেষ্ঠ, যা কিছু উত্তম- তিনি তা আয়ত্ত করে সর্বদা প্রজাদের সুখে রাখায় তৎপর ছিলেন।
নল রাজার বলতে এই বঙ্গের আদি রাজা বুঝি।
যদিও
প্রামাণ্য তথ্য বলছে তিনি কলিঙ্গ সম্পর্কিত হলেও হতে পারেন| বঙ্গ
সংযোগ প্রতিভাত হয়নি| আর যে স্থান অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে
আছে তাঁর সঙ্গে, তা হল প্রাচীন উজ্জয়িনী| সেইসঙ্গে গবেষকদের আর এক সংযোজন হল কাশ্মীর| ঊনবিংশ
শতাব্দীর কাশ্মীরি পণ্ডিত লক্ষ্মী ধর কাল্লা তো কালিদাসকে কাশ্মীরের ভূমিপুত্র
ছাড়া অন্য কিছু মানতেই নারাজ| তাঁর দাবি হল, জন্মভূমি কাশ্মীর থেকে ক্রমশ দক্ষিণে অগ্রসর হয়েছিলেন কবিবর|
কুমারসম্ভব
কাব্যে যে বিবিধ বর্ণনা আছে, যেমন জাফরান, দেবদারু
গাছ, কস্তুরী মৃগ, এসব সহজলভ্য ছিল
ভূস্বর্গেই| কলিঙ্গ বা উজ্জয়িনীতে নয়| কল্লার
মতে, কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম-ও কাশ্মীরের শৈব দর্শন
দ্বারা প্রভাবিত|
আবার
অনেক ভারত বিশেষজ্ঞ ভারতীয় পণ্ডিত বলেন কালিদাস কোনও নির্দিষ্ট একজন কবি ছিলেন না| পরবর্তীকালে
এটা হয়ে উঠেছিল একটি পদের নাম| সেই পদাসীন বহু কবি
মিল্লিতভাবে সৃষ্টি করে গেছেন চির শাশ্বত সংস্কৃত সাহিত্য|
‘বাগার্থাবির সম্পৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপত্তয়ে।’ মানে- আষাঢ়ে মেঘ জমে বৃষ্টি নামল। কমলার চোখে আনন্দের অশ্রু। মিলন সম্পূর্ণ হল
কালিদাসের
পালা, কালিদাস কর্পূর, ঘটকর্পর কালিদাসাঃ, কালিদাস নাথ, কালিদাস গজদানী, মুনীর কালিদাস প্রভৃতি।
বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন উল্লেখ স্থলে ভানুসিংহের নাম পাওয়া যায় ভাবিয়া আমরা বিস্তর
অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি--
ধন্বন্তরিঃ
ক্ষপণকোমর সিংহ শঙ্কুর্বেতাল ভট্ট ঘটকর্পর কালিদাসাঃ
খ্যাতা
বরাহ মিহিরো নৃপতেঃ সভায়াং রত্নানি বৈ বররুচির্ণব বিক্রমস্য।
কৈ
ইহার মধ্যেও তো ভানুসিংহের নাম পাওয়া গেল না। তবে, কোনো কোনো
ভাবুকব্যক্তি সন্দেহ করেন কালিদাস ও ভানুসিংহ একই ব্যক্তি হইবেন। এ সন্দেহ নিতান্ত
অগ্রাহ্য নহে, কারণ কবিত্বশক্তি সম্বন্ধে উভয়ের সম্পূর্ণ
সাদৃশ্য দেখা যায়।
ভানুসিংহের
জন্মকাল সম্বন্ধে চারি প্রকার মত দেখা যায়। শ্রদ্ধাস্পদ পাঁচকড়িবাবু বলেন, ভানুসিংহের
জন্মকাল খৃস্টাব্দের ৪৫১ বৎসরে পূর্বে।
প্রকৃতি
ও মানুষের কবি
উপমায়
অনন্য। শব্দের শক্তির তীব্রতা প্রদর্শনে কবি কালিদাসের দক্ষতা বিস্ময়কর। সেই অতীত সজিব
প্রকৃতি ও মানুষের বিরহ ব্যাথা এমন ভাবে বলেছেন, যে হাজার বছর পরেও ঢেউ বর্তমানেও
স্পর্শ করে। আবেগী হই এলখনো।
হবেই
না কেন? কালিদাস আবিষ্কার করেন জীবনের সব জ্ঞান পুঁথিতেই লিখিত থাকে না, তার
বাইরেও অতল অনুসরণ চাই। আর নূতন কাব্য রচনা করতে এইসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে।
কালিদাস ভাবেন, সাধারণ মানুষ কী চায়?
তিনি
শুনেছেন,
আদিকবি বাল্মীকির রামায়ণের বিভিন্ন পাঠ ভূভারতে প্রচলিত। এইসব
পাঠের বিভিন্নতাও আছে, যেমন দক্ষিণের রামায়ণের সাথে
পূর্বদেশের রামায়ণের বিস্তর ফারাক! কবি স্থির করলেন তিনিও রামায়ণ লিখবেন।
কবি
ভাবতে থাকেন। একইসঙ্গে নিয়তি আর পুরুষকারে বিশ্বাস? প্রজানুরঞ্জনের কল্পিত
আশ্বাস? শুধু কি ভক্তিই পারে নিত্যনৈমিত্তিক জীবনধারণের
কাঠিন্যকে সহনীয় করে তুলতে?
কালিদাস
একাধারে নাট্যকার এবং মহাকাব্য ও গীতিকাব্যের রচয়িতা। তাঁর রচনাবলির মধ্যে
অভিজ্ঞান শকুন্তল,
বিক্রমোর্বশীয় এবং মালবিকাগ্নিমিত্র নাটক, রঘুবংশ
ও কুমারসম্ভব মহাকাব্য এবং মেঘদূত ও ঋতুসংহার গীতিকাব্য সাহিত্যমাধুর্যে অতুলনীয়।
রঘুবংশ মহাকাব্যে তিনি রঘুর দিগ্বিজয় উপলক্ষে প্রাচীন বঙ্গের অনেক বর্ণনা
দিয়েছেন। তার অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে শৃঙ্গাররসাষ্টক, শৃঙ্গারতিলক,
পুষ্পবাণবিলাস নামক কাব্য এবং নলোদয় ও দ্বাদশ-পুত্তলিকা নামক দুটি
আখ্যানকাব্য।
মেঘদূত
কাহিনীকাব্যটি দেশে-বিদেশে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মেঘের মাধ্যমে বিরহিণী
প্রিয়ার নিকট এক নির্বাসিত যক্ষের বার্তা প্রেরণ মেঘদূত কাব্যের উপজীব্য।
পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ এ দুটি অংশে কাব্যটি বিভক্ত।
কালিদাস
সবিস্তারে মেঘের বিচিত্র যাত্রাপথের সানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন; শুষ্ক
তৃষ্ণার্ত ভূমি, বিরহখিন্না প্রণয়িনীর মতো শীর্ণ অগভীর
জলধারাগুলি মেঘের পথ চেয়ে আছে, পথ চেয়ে আছে পর্বতগুলিও তাদের
প্রিয় বন্ধু বর্ষার মেঘের জন্য।
কালিদাস তখন কাব্য লিখতে
শুরু করলেন—
‘অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা
হিমালয়ো নাম নগাধিরাজ।’
কখনও লিখলেন—
কশ্চিৎ কান্ত বিরহগুরুণা
স্বাধিকারপ্রমত্তঃ।’
অথবা
‘বাগার্থাবির সম্পৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপত্তয়ে।’
আষাঢ়ে মেঘ জমে বৃষ্টি
নামল। কমলার চোখে আনন্দের অশ্রু। মিলন সম্পূর্ণ
হল।
কালিদাস
বিরহের কাব্য রচনা করেছেন নানা স্থানে। প্রথম দিকের রচনা কুমারসম্ভব-এ রতি বিলাপ
করছেন মদনের মৃত্যুর পরে;
সে বিলাপে কত অলংকারী:
শশিনা
সহ যাতি কৌমুদী সহ মেঘেন তড়িৎ প্রলীয়তে।
প্রমদা
পতিবর্তুগা ইতি প্ৰতিপন্নং হি বিচেতনৈরপি।।
চাঁদের
সঙ্গেই জ্যোৎস্না মিলিয়ে যায়,
মেঘের সঙ্গে বিদ্যুৎ,
নারী
যে পতিপথগামিনী এ তো অচেতনারাও প্রতিপন্ন করেছে।
(কুমারসম্ভব
৪:৩৩)
ধূতিরস্তমিত
রতিশচু্যতা বিরতং গেয়মৃতুনিরুৎসবঃ।
গতমাভরণপ্রয়োজনং
পরিশূন্যং শয়নীমদ্য মে।।
ধৈর্য শেষ হয়েছে,
প্রেম নিরাশ্রয়,
সংগীত থেমে গেছে,
ঋতু উৎসববিহীন,
অলংকারের প্রয়োজন
ফুরিয়েছে,
আমার শয্যা আজ শূন্য।
(রঘুবংশ ৮:৬৬)
গন্ধশ্চ
ধারাহতপল্বলানাং কাদমর্ধোদগত কেসরঞ্চ।
স্নিশ্বাশ্চ
কেকাঃ শিখিনাং বভুর্বুৰ্ষস্মিন্নাসহ্যানি বিনা ত্বয়া মে।।
পুকুরে বৃষ্টি
পড়ছে তার গন্ধ,
আধাফোটা কদমফুল,
ময়ূরের স্নিগ্ধ কেক ধ্বনি–এ সবই
এইখানে
তোমার অভাবে আমার অসহ্য হয়ে উঠেছিল।
‘দর্শ শুক্লপক্ষাদৌ চন্দ্ররেখা মিবামলাম শুক্লপক্ষের শুরুতে নির্মল
চন্দ্ৰকলার মতো দেখলেন’ (উত্তরমেঘ ২৬) বা, মেঘলা দিনের স্থলপদ্মনিব মতো— ঠিক জাগ্রতও নয়
প্রসুপ্তও নয় (২৭); এ সব নানা উপমায় তার বিরহদীন মূর্তিটি
ফুটে উঠেছে। কিন্তু যক্ষ যখন তার নিজের বিরহের বর্ণনা করছে তখন সে অলংকার ব্যবহার
করছে না। একবার বলছে:
শব্দাখেয়ং যদ্যপি কিল তে যঃ সখীনাং
পুরস্তাৎ
কৰ্ণে লোলঃ কথয়িতুমভূদাননাস্পৰ্শলোভাৎ।
সোহিত্যিক্রান্তঃ
শ্রবণবিষয়ং লোচনাভ্যামদৃষ্ট-
স্তামুৎকণ্ঠবিরচিত পদং মন্মুখেনেদমাহ।
মনে
রাখতে হবে এই দুঃখান্ত নাটকেই অ্যারিস্টটল শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বলে অভিহিত করেছেন।
তাঁর সংজ্ঞায় ‘গম্ভীর’ শব্দটি তাৎপৰ্যপূর্ণ, কারণ
কবিদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, যাঁরা গভীর শ্রেণির
(কবি) তারা নাটকে মহৎ কর্ম ও মহামানবদের কর্মের অনুকরণ করেন।
অপরপক্ষে
শতককাব্য ছাড়াও শৃঙ্গাররসাশিত কবিতার অনুরূপ সংকলন পাই; এগুলির
মধ্যে শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কালিদাসের মেঘদূত, পরে এর অনুসরণেও
কিছু শৃঙ্গাররসের দূতকাব্য রচিত হয়। সম্ভবত কালিদাসেরও পূর্বে মাত্র বাইশটি
শ্লোকের একটি কবিতাগুচ্ছ ঘটকর্পারকাব্য (ইয়াকবি এটিকে প্রাককালিদাস রচনা বলেছেন)।
এখানে
বিরহিণী মেঘকে দিয়ে বিদেশে প্রেমিককে বার্তা পাঠাচ্ছে। (সম্ভবত এটি ও মেঘদূত
দুটিরই ওপর চিনা এক মেঘদূতকাব্যের প্রভাব আছে)। পরবর্তীকালে গোবর্ধনাচার্যের
আর্যসপ্তশতী ৭০০টি বর্ণনা।
বিষয়গত
ভাবে চৌরপঞ্চাশিকা-র সঙ্গে কিছু মিল থাকলেও ময়ুরের কবিত্ব বিলহণের তুলনায় দীন, তেমনই
সুভাবিতাবলী বা কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-তে পাণিনির নামে আরোপিত শৃঙ্গাররসাত্মক
শ্লোকগুলি চৌরপঞ্চশিকার তুলনায় অপকৃষ্ট। কেবল মেঘদূত, অমরুশতক
ও শৃঙ্গারশতক-এর কয়েকটি কবিতা ঘটকপারকাব্য ও গীতগোবিন্দ-এর কিছু শ্লোকের সঙ্গেই
চৌরপঞ্চশিকা-র তুলনা চলে।
বিক্রমোর্বশীয় কাব্যের - কল্প চিত্র
মেঘদূত-এর
প্রভাবই এ কাব্যে বেশি;
মেঘদূত-এর মতো একটি ছন্দেই সমগ্র কাব্যটি রচিত। কিন্তু মেঘদূতে
শ্লোকগুলির বিষয়গত পারম্পর্য আছে, চৌরকাব্যে তাও নেই।
আসন্নমৃত্যু প্রেমিকের স্মৃতিতে মিলনের বিভিন্ন লীলায় প্রেমিকার ভূমিকা, রূপ, আচরণ ও প্রতিক্রিয়া একে একে উদিত হচ্ছে,
এইটি এর বিষয়গত যোগসূত্র। যেমন আঙ্গিকগত যোগসূত্র হচ্ছে প্রায়
প্রত্যেক শ্লোকের শুরুতে অদ্যাপিতং’ এবং শেষদিকে স্মরামি’বা ‘চিন্তয়ামি’–আজও তাকে মনে
পড়ে। এটি ধ্রুবপদের মতো এবং আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ
শ্লোকগুলিকে একসূত্রে গ্রথিত করে।
মন্দাক্রান্তা
ছন্দে রচিত মেঘদূত কাব্যে রচিত হয়েছে মানুষের অতলস্পর্শী বিরহ। শুদ্ধ বিরহকে
অবলম্বন করে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ কাব্য মেঘদূত।
মেঘদূতের
কাহিনী সরল অথচ কাব্যগুণ সমন্বিত; কর্তব্যে অসাবধানতায় প্রভুর অভিশাপে
যক্ষকে রামগিরি পর্বতের বিজন আশ্রমে নির্বাসিত হতে হয়। সেখানে বসে আষাঢ়ের প্রথম
দিবসে নববর্ষার মেঘ দেখে তারই মাধ্যমে অলকাপুরীর প্রাসাদে তাঁর বিরহী প্রিয়ার
উদ্দেশে বার্তা প্রেরণ করবে বলে মনস্থির করে সে। প্রিয়ার রূপ বর্ণনায় বলে:
‘তৈলশূন্য কুন্তল জালে
আয়ত লোচন পড়েছে ঢাকা,
অজ্ঞনহীন নয়ন প্রান্তে
কটাক্ষবাণ নাহিক’
আঁকা;
মদির-অলস ভ্রু-বিলাস ভুলে মৃগাক্ষী
মোর তোমার প্রাণে,
তুলি’ আঁখি
দুটি চাহিবে যখন, স্পন্দন ঘন জাগিবে প্রাণে,
হয়ত ফুটিবে নয়নে তখন চাহনি চপল কৌতূহলে,
যেন চঞ্চল মীনদল ক্ষোভে আহত কমল
কাঁপিছে জলে!’
বিরহের
আতিশয্যে যক্ষের জড় ও জীবের ভেদাভেদজ্ঞান লুপ্ত হয়। মেঘকে সে জানাতে থাকে কোন কোন
নগর, নদী ও পর্বত পেরিয়ে তাকে অলকায় পৌঁছতে হবে। উত্তর মেঘের উদ্দেশে সে বলে:
‘হে মেঘ, শোনো তবে
অলকার কথা বলি
তোমায়
দীপ্তিময়ী ললনারা যেথা
বিদ্যুত্সম ঝলকি
যায়।
হে মেঘ, ইন্দ্রধনু
তোমার সঙ্গে যেমন,
অলকার প্রাসাদে, প্রাসাদে
তেমন অনবদ্য
চিত্রণ।’
কাব্যের
এই অংশে প্রাচীন ভারতের এক অসামান্য ভৌগোলিক বিবরণ ফুটিয়ে তুলে মেঘকে অনুরোধ করে
প্রিয়তমার নিকট তাঁর কুশল সংবাদ নিবেদন করতে, কাতর অনুরোধ জানায় তার
বিরহিণী প্রেয়সীর কাছে বার্তা পৌঁছে দেবার। মেঘদূত কাব্য শেষ হয়েছে মঙ্গলাচরণ
দিয়ে। মঙ্গল আচরিত হয়েছে মেঘের প্রতি যক্ষের আশিস বাণীতে: ‘ক্ষণকালের
জন্যও যেন বিদ্যুত্ প্রিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদ না ঘটে।’
কালিদাসের
রঘুবংশ-এ আদর্শ রাজা দিলীপের বর্ণনায় জাতি সম্বন্ধে কালিদাসের কালের সমাজের যে বোধ
ছিল তার একটি দ্ব্যর্থহীন সংজ্ঞা পাই: মনুর খুঁড়ে দেওয়া পথটি থেকে তাঁর প্রজারা
একচুলও এ-দিক ও-দিকে যেত না।’ (১৪:৬৭) অর্থাৎ গুপ্ত সাম্রাজ্যের কালে
মনুসংহিতা-র অনুশাসনই অলঙ্ঘ্য ছিল।
রঘুবংশ-এ
রামায়ণ-এর শম্বুকবধ উপাখ্যানের পুনরাবৃত্তি আছে। রাম এখানে তপস্বী শূদ্ৰকে হত্যা
করে দেশকে পাপমুক্ত করলেন;
কিন্তু কালিদাস রামায়ণ-এর উপাখ্যানে যে খুব স্বস্তিবোধ করেননি। তার
দুটি প্রমাণ রেখে গেছেন। প্রথমত, তপঃশীর্ণ শূদ্রের মুখটি
শুষ্করেণুমুক্ত পদ্মের মতো, রাম খঙ্গের আঘাতে সেটিকে মৃণাল
থেকে বিচুত করলেন।’ (১৫:৫১-৫২)–এই
উপমাটির মধ্যে। দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর পরে শম্বুক সদগতি লাভ
করলএই বৈপ্লবিক উক্তির মধ্যে। বৈপ্লবিক, কারণ বাল্মীকির মতে
যে পাপিষ্ঠ, তার সদগতিলাভের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
অলৌকিক কবিত্ব শক্তি কালিদাস
দিগ্বিজয়ী
বীর অথবা ধনাঢ্য সম্রাট ছিলেন না, কিন্তু তিনি যে অলৌকিক কবিত্ব শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে
জন্মগ্রহণ করে ছিলেন ও স্ব প্রণীত কাব্য ও দৃগু কাব্য সমূহে যে অদ্ভূত কবিত্ব
শক্তি প্রকাশ করেছেন, সেই কবিত্ব শক্তির জন্যই তার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে বিদ্যমান
আছে। যত দিন এই জগতে সংস্কৃত সাহিত্যের সমাদর থাকবে, তত দিন
তার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে সজীব থাকবে।
কালিদাসের
রচনায় প্রাচীন ভারতের এক অভিজাত সমাজের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি সংস্কৃত
ভাষাকে সমৃদ্ধ করে বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি তাঁর কাব্যে প্রায়
৩০টির মতো ছন্দ ব্যবহার করেছেন। শিল্পরূপময়তা, অর্থের গভীরতা ও কল্পনার
ব্যাপকতা তাঁর সকল রচনাকে রসোত্তীর্ণ করেছে। তাঁর অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকের ইংরেজি
অনুবাদের (১৭৮৭) মাধ্যমে পাশ্চাত্য প্রথম ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করে।
অসাধারণ কবিপ্রতিভার জন্য কালিদাস হোমার, শেক্সপীয়র,
মিলটন, দান্তে, গ্যেটে,
ভার্জিল প্রমুখ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিকের সমপর্যায়ভুক্ত।
কিবি
গুরু রবিন্দ্রনাথ বলেন, ‘কালিদাস কুমারসম্ভবের গল্পটাকে মাঝখানে ধরিতেই সতী নারীর
সম্বন্ধে যে-সকল ভাব হাওয়ায় উড়িয়া বেড়াইতেছিল তাহারা কেমন এক লইয়া, শক্ত
হইয়া ধরা দিল! ঘরে ঘরে নিষ্ঠাবতী স্ত্রীদের যে-সমস্ত কঠোর তপস্যা গৃহকর্মের আড়াল
হইতে আভাসে চোখে পড়ে তাহাই মন্দাকিনীর ধারাধৌত দেবদারুর বনচ্ছায়ায় হিমালয়ের শিলাতলে
দেবীর তপস্যার ছবিতে চিরদিনের মতো উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
বর্ষাঋতুর
মতো মানুষের সমাজে এমন এক-একটা সময় আসে যখন হাওয়ার মধ্যে ভাবের বাষ্প প্রচুররূপে
বিচরণ করিতে থাকে। চৈতন্যের পরে বাংলাদেশের সেই অবস্থা আসিয়াছিল। তখন সমস্ত আকাশ
প্রেমের রসে আর্দ্র হইয়া ছিল। তাই দেশে সে-সময় যেখানে যত কবির মন মাথা তুলিয়া
দাঁড়াইয়া ছিল সকলেই সেই রসের বাষ্পকে ঘন করিয়া কত অপূর্ব ভাষা এবং নূতন ছন্দে কত
প্রাচুর্যে এবং প্রবলতায় তাহাকে দিকে দিকে বর্ষণ করিয়াছিল’।
রবিন্দ্রনাথ
প্রথম থেকেই মন্ত্র মুঘদ্ধ ছিলেন মেঘদূতে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘মেঘদূত ছাড়া
নববর্ষের কাব্য অন্য কোনো সাহিত্যে কোথাও নাই। ইহাতে বর্ষার সমস্ত অন্তর্বেদনা
নিত্যকালের ভাষায় লিখিত হইয়া গেছে। প্রকৃতির সাংবাৎসরিক মেঘোৎসবের অনির্বচনীয়
কবিত্বগাথা মানবের ভাষায় বাধা পড়িয়াছে।”
কালিদাস
শুধু সংস্কৃত সাহিত্যেই নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও একজন সেরা কবি। তাঁর অসামান্য
সৃষ্টিশীলতা, দুরন্ত মেধা, সীমাহীন
কল্পনাবিলাস, ছন্দের উপর অসাধরণ দখল, কাব্য
রাজ্যে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ, তাঁর উন্নত সংস্কৃতি তাঁকে
সবযুগের সেরা কবিদের সম্মুখ সারিতে অবস্থান করে দিয়েছে।
পণ্ডিত পুকুর পাড় , কালিদাস -
টাঙ্গাইল
কালির
কুহক
মনের
গভিরে থাকা কালিদাসকে আমরা যতটা জানি তার চেয়ে জানিনা অনেক বেশি। জানি না তার জন্ম
কথা, জন্মভূমি কোথায়? মূর্খ থেকে মহাজ্ঞানী হলেন কিভাবে? মৃত্যু নিয়েও আছে ধোঁয়াশা।
কবির
পরিচয়ের এই প্রহেলিকার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মনে হয়েছে, কবি ইচ্ছে করেই এই
কাজটি করেছেন। কবি এত কিছু লিখেছেন – নিজের পরিচয় কেন লেখেন নি। অথচ সে কালে কবিরা
তাদের রচনার সুরুতে বর্ণনা করতেন।
তাহলে
কবি কি চেয়েছিলেন, তিনি কোন নির্দিষ্ট স্থান বা কালের মানদণ্ডে থাকবেন না। তিনি
হবেন পুরা ভারতের কবি। সর্ব কালের মানুষ। তাই দেখি চারবার ভারত ভ্রমণ, রচনার ধরণ,
প্রেমিকের পরিচয় – সব ক্ষেতের আছে রহস্য।
কালিদাস
ছিলেন রাজকবি। রাজা তাকে অত্যন্দ পছন্দ করতেন। শোনা যায় রানী হিংসান্বিত হয়ে রাজার
অবর্তমানে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলো। পরে রাজা ফিরে এসে সব জানতে পেরে কালিদাস
এর জলন্ত চিতায় রানীকে পোড়ানোর আদেশ দে।...সেই গল্পটি কালিদাস পন্ডিতের লেখা।
বাংলায় এটি অনুবাদ করেছেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৯৬৬ সালে তামিল ভাষায়
কালিদাশের জীবনির উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় চলচিত্র 'মহাকবি
কালিদাস'। কিন্তু
দুঃখের বিষয় এই মহা পন্ডিত সিংহলের এক গনিকার হাতে নিহত হন।
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, মেঘদূতের প্রথম অনুবাদক একজন ইংরেজ। আবার বিস্ময়কর না তো! একটি বিদেশী গ্রন্থের ইংরেজীতে অনুবাদকতো ইংরেজই হবেন। রামায়ন, বেদ এবং বেশ কয়েকটি পুরাণের ইংরেজী অনুবাদকও ছিলো ইংরেজরাই।
কালিদাসের
কিছু তথ্য
কালিদাসের
রূপান্তর এবং বিশ্বসভায় তার সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনার পশ্চাৎপট অনেকটা রূপকথার
মতন অবিশ্বাস্য শোনায় তো বটেই প্রায় অলৌকিকত্বের ধার ঘেঁসে যায়।
সেই
মহামূর্খ কালি, আর মহাপণ্ডিত কালি। পৌণ্ড্র
গ্রামে গ্রামের সেই ছন্নছাড়া
পরহিত ভিক্ষাজীবী এক বাউণ্ডেলে যুবক, আর ভারতবর্ষের সংস্কৃত ভাষার সাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্তের
সম্মানে ভূষিত এই সাহিত্যিক।
উজ্জয়িনীর কাছে সেই পৌণ্ড্র গ্রামে জীর্ণ বাড়িতে বিধবা
মাকে নিয়ে থাকত। সময়টা খ্রিস্টের জন্মের নিকট অতীত থেকে তিন/চারশ বছরের মধ্যে। তার
বাবার নাম ছিল সদাশিব মিশ্র। তিনি স্বশিক্ষিত ছিলেন।
সদাশিব ছেলেকে
টোল-পাঠশালায় ভর্তি করে দিলেন। দিলে কী হবে। ছেলে একেবারে আকাট মূর্খ— এক কলমও শিখতে পারলেন না। বাবা
সরস্বতীর পায়ে মাথা ঠুকে কপাল ফুলিয়ে ফেললেও কিছু সুরাহা হল না। এর মধ্যে তিনি
আরেকটা অকাজ করলেন। মারা গেলেন।
অনাথ
হয়ে পড়ল কালিদাস। ফলে তাঁর
বিদ্যার্জনের সুযোগ থাকল না। অগত্যায় রাখাল হয়ে গরু চরাতেন আর নানা বকামি করতে
লাগলেন। গাছের ডালে বসে সেই ডালের গোরা কাটার গল্প তো সবাই জানি।
আর
একটা বোকামি হল—
তাঁর বিয়ে করা বিদ্যাবতী বউ তাঁকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কারণ
তিনি উটের ভালো শব্দ যে উষ্ট্র— তার ঠিক ঠিক উচ্চারণ করতে
পারেননি।
কালিদাসের
বউয়ের নাম ও তার পরিচয় নিয়ে ভিন্নতা আছে। কোথাও দেখি রাজগুরু শারদানন্দের কন্যা
বিদ্যোত্তম নামী পত্রীর সাথে আবার কথাও স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে যে, উজ্জয়িনী
নগরীস্থ ধ্বন্ধি নামক প্রসিদ্ধ প্রবল প্রতাপান্বিত রাজার কন্যা সত্যবতী নামী! আবার
দেখি, কালিদাস পণ্ডিত বিয়ে করেছিলেন রাজা বিক্রম আদিত্যের মেয়ে সত্যবতী কমলা।
গাছের ডালে বসে সেই ডালের গোরা কাটার গল্প তো সবাই জানি
জানা
যায়, বিয়ের পর কালিদাসের মূর্খতার কথা জেনে রাজকন্যা মর্মাহত হন। ঘড় থেকে বের করে
দেন। তখন কালিদাস কালিকাদেবীর আরাধনা করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য অনুপ্রাণিত করেন।
দেবী কালিদাসের আরাধনায় প্রসন্ন হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করেন। এরপর কালিদাস লেখাপড়া
শিখে বেদ,
রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ,
ইতিহাস, কাব্য, অলঙ্কার,
ছন্দ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ,
দর্শনশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে
পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং তাঁর মধ্যে অভিনব কবিত্বশক্তির প্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে
তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্য সাধনা করেন এবং তাঁর রচনায় অধীত বিদ্যার গভীর
প্রভাব পড়ে।
রূপান্তরে
অতিলৌকিকের পরে বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার তিনি নিজেকে সেরা রত্নটি হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন। স্পষ্ট না জানলে মহামূর্খ কালিদাস কী করে যে মহাকবি হয়ে
উঠলেন তার ব্যাখ্যা হোল- কালিদাসের অদ্ধাবসায়। লোকে বলে, একদি তিনি নদীর ঘাটে
বসেছিলেন। তখন মেয়েরা মাটির জল পাত্র নিয়ে আসে জল নিতে। তো মেয়েরা পাথরের উপর যেখানে
জল পাত্র রাখছিল সেখানে সেখানে কলসির দাকগ তৈরি হয়েছে।
কালিদাস
বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, মাটির কলশির ঘষায় পাথর খয়ে দাগ তৈরি করেছে। তিনি
ভাবলেন, নিয়মিত চেষ্টা থাকলে কঠিনকেও জয় করা যায়। কালিদাস প্রথম জীবনে অপরিণত
ছিলেন। কিন্তু এই দর্শনে পাল্টে গেলেন।
রামায়ণ
রচয়িতা বাল্মীকির দস্যু থেকে সাধক হয়ে ওঠার গল্পের মতো কালিদাস মূর্খ থেকে হয়ে
উঠলেন মহাকবি। তার বুদ্ধির তারিফ করতে গিয়ে তার নামে আজও প্রচলিত আছে হাজার হাজার
জটিল ধাঁধাঁ। তিনি হয়ে উঠলেন প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার।
পন্ডিত
কালিদাসের হেয়ালী
কালিদাস তাঁর হেঁয়ালি বা ধাঁধার জন্য আমাদের কাছে অধিক
পরিচিত। কিন্তু তিনি ধাধাগুলো সংস্কৃত ভাষায় লিখে গিয়েছিলেন। কালিদাস পন্ডিতের
লেখা না বুঝলেও তার রচিত (পরিবর্তিত হয়ে আসা হয়ত) ধাঁধাঁ সমূহ বাংলা ভাষার অলংকার
হয়ে যুগযুগ ধরে মানুষের মনে আনন্দ বয়ে বেড়াবে বলে আমি মনে করি।
ধাঁধার
জন্য কালিদাসের আলাদা সময় দিতে হতো না, চলতে ফিরতে সবসময় কিছু একটা
দেখলেই তার মাথায় চলে আসত ছন্দ, রচিত হতো ধাঁধা। এ নিয়ে একটা
গল্প বলা চলে: একদিন বৌ বলল কালিদাসকে বাজারে যেতে। বাজারে যাবার প্রস্তুতি প্রায়
শেষ। বৌ চটি জোড়া এনে রাখল পায়ের কাছে। চটিতে পা গলাতে গলাতে কালিদাস বলল:
‘জন্ম তার জলে নয়, জন্ম নয় খালে
হস্ত
নাই পদ নাই,
দুই চরণে চলে।’
ছড়া
বলা শেষ করে হাসিমুখে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল জিনিসটা কী হতে পারে। বৌ তার
মুখ ঝামটা দিয়ে আঁচলে বাঁধা চাবির তোড়া পিঠের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলে কিনা, ‘মিনসের
ঢং দেখে আর বাঁচি না’... বাজারের থলি হাতে ঘর থেকে বের হবার
মুখে বৌ আবার ডাক দিল। একটু আগেই দিচ্ছিল মুখ ঝামটা, এখন
শুরু করল রহস্য। বাজার থেকে অন্যান্য সদাইয়ের সঙ্গে আরো যা আনতে হবে তা জানাল।
জানাল বটে, তবে তা সরাসরি নয়, ছড়ায়-ছন্দে,
কালিদাসের কায়দায় বলল:
‘কাঁসারীর সারী ছাড়া, পাঁঠা ছাড়া পা,
লবঙ্গের
বঙ্গ ছাড়া,
কিনে এনো তা।’
বাজারে
যাবার পথে কালিদাস দেখতে পেল ফসল ভরা মাঠের পাশেই চারণ ক্ষেত্রে গরু, মহিষ,
ছাগলের পাল চরছে। আপন মনে পথ চলতে চলতে কালিদাস আওড়াতে লাগল:
‘কালিদাস পণ্ডিতে কয়, পথে যেতে যেতে
নেই
তাই খাচ্ছ,
থাকলে কোথায় পেতে?’
অন্য
একদিন কবি ভ্রমণে বের হয়ে দেখলেন পথের পাশে একটা গরুর কাঁধের ক্ষতস্থান ঠুকরে
খাচ্ছে কয়েকটি কাক এবং অসংখ্য মাছি। গরুটির লেজ কাটা। লেজ না থাকায় গরুটি তাদের
তাড়াতে পারছে না। তাই মাছি এবং কাকেরা মনের সুখে মধ্যাহ্নভোজন চালিয়ে যাচ্ছে। কবি
কাক ও মাছিদের উদ্দেশে ছড়া কেটে বলছেন, ‘খুব তো মজা করে খাচ্ছো। ওর
লেজ নেই বলেই না খেতে পারছো, লেজটা থাকলে কি আর পারতে?
এভাবেই
রচিত হয়েছে কালিদাসের ধাঁধাগুলো। কালিদাস পণ্ডিতের হেঁয়ালি ধাঁধাঁর কয়েকটি নমুনা
দেওয়া যাক-
কালিদাস পন্ডিতের ফাঁকি,
আড়াইশ থেকে পাঁচ পঞ্চাশ গেলে
আর কত থাকে বাকী।
উত্তরঃ কিছুই না, শূন্য
শোন
ভাই কালিদাসের হেয়ালীর ছন্দ,
দরজা
আছে হাজারটা তবু কেন বন্ধ।
উত্তরঃ
মশারী
পোলা কালে বস্ত্রধারী যৌবনে
উলঙ্গ,
বৃদ্বকালে জটাধারী মাঝখানে
সুড়ঙ্গ।
উত্তরঃ বাঁশ
বাংলায়
ধাঁধার উৎপত্তি অনেক কাল আগে বলে মনে করা হয়| কবি কালিদাস বা 'কালিদাস পন্ডিতের' ধাঁধা নামে আমরা ছোটবেলা থেকে
অনেক ধাঁধা পরে এসেছি|
বাঘের
মত লাফ দেয়,
কুকুর হয়ে বসে,
পানির
মধ্যে ছেড়ে দিলে সোলা হয়ে ভাসে।
উত্তরঃ
ব্যাঙ
হাসিতে হাসিতে যায় নারী
পর পুরুষের কাছে,
যাইবার সময় কান্নাকাটি
ভিতরে গেলে হাসে।
...মেয়েদের হাতের চুরি
আমার
মনে প্রশ্ন ছিল কবি কালিদাসকে কেন কালিদাস পন্ডিত বলা হয়! সংস্কৃত ভাষায় তিনি যে
পন্ডিত ছিলেন এতে মনে কোন সন্দেহ নাই। তারপর আরো যতদুর বুঝতে পারলাম, তার
উপস্থিত বুদ্দির জন্যও তিনি পন্ডিত হতে পারেন। হতে পারেন তার ধাঁধাঁ লিখার জন্য!
ধাঁধাঁ মানেই তো কালিদাস পণ্ডিত!
জলেতে
জন্ম যার,
জলে ঘর বাড়ী
ফকির
নহে, ওঝা নহে, মুখেতে দাড়ী।
...
কচুরি পানা
চার পায়ে বসি, আট
পায়ে চলি
বাঘ নয়, ভালুক
নয়, আস্ত মানুষ গিলি।
...পালকি
হাত
নাই, পা নাই, এ কেমন রসিক নাগর
আনায়েসে
পার হয় নদী কিংবা সাগর।
...
নৌকা/জাহাজ
আমাদের
ছেলেবেলায় এসব ধাঁধা দাদু ঠাকুমারা আমাদের ধরে শান্ত করিয়ে রাখতেন| আজও
গ্রামবাংলায় বিয়েতে বর আটকাতে কিংবা নিছক আড্ডায় বাঙালিরা ধাঁধা ব্যবহার করেন|
কালো হরিণ থাকে কালো
পাহাড়ে
দশ জনে ধরে আনে দুইজনে
মারে।
...উঁকুন
হাত
আছে পা নাই মাথা তার কাটা
আস্ত
মানুষ গিলে খায় বুক তার কাটা।
...জামা
দুই
অক্ষরে নাম আমার,
পৃথিবীতে থাকি
শেষের
অক্ষর বাদ দিলে সেই নামে ডাকি।
...কাক
এবার
কয়েকটা ধাঁধা দিলাম উত্তর ছাড়া।
এক বস্তু দুটি বর্ণ,
ছয়টি তল তার রক্তবর্ণ।।
মাছের
পেটে জন্মাল নারী,
হলো সে রাজেশ্বরী।।
ও
পাড়ায় মরল বুড়ি,
এ পাড়ায় গন্ধ ভরা ভুরি।।
ভাই
ভাতারি কেবা ছিল বল সাধু ভাই,
বাপ ভাতারি আনল ডেকে কাদের কথা ভাই।।
থাকতে
ঘরে আপন স্বামী,
ঈশ্বর প্রেমে মজলো মামী।।
আজ থেকে এক হাজার বছর পরেও কোন বাংলাভাষী মাতা-পিতা তার
সন্তানকে যখন ধাঁধাঁ ধরবে, তখন কবি
কালিদাস তথা কালিদাস পন্ডিতের নাম মুখে আসবে। এটাই মনে হয় কবি কালিদাসের সাফল্য।
গুরুর
আকার ধরি গুরু স্ত্রী হারলো।
একজন রাজা তিনি কিবা নাম বল।।
কার
মাংস রান্না করি অসুর খাইল।
গুরু তারে মন্ত্রবলে বাঁচাইয়া দিল।।
পুত্রের
ঔরসে মাতার পুত্র জন্মাইল।
মাতা পিতা পুত্রের কিবা নাম বল।।
মহাভারতে আছে লেখা মিথ্যা কথা নয়,
কেমন জ্ঞানিজন তুমি দাও পরিচয়।
থাকিতে
নিজ পত্নী রতিতে বঞ্চিত।
এমন লোক কেবা ছিল বলহ ত্বরিত।।
সাধুবেশে
নিজ কন্যা করিল হরণ।
কি নাম বল তাহার, ভাই
বলহ এখন।।
শোন
ভাই কালিদাসের হেয়ালীর ছন্দ,
দরজা
আছে হাজারটা তবু কেন বন্ধ।
ধাঁধাঁগুলো
কালিদাস পণ্ডিতের হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কালিদাস পরিচিত তার অসংখ্য ধাঁধার
জন্যও, তবে বর্তমান সময়ে যে কোন ধাঁধাই প্রচলিত কালিদাসের নামে। যেমন— ‘শুভ্রবসন দেহ তার, করে মানুষের অপকার।/ চিতায় তারে
পুড়িয়া মারে, তবু সে উহ আহ না করে।’
এর
উত্তর হচ্ছে সিগারেট,
কিন্তু ভারতবর্ষে সিগারেটের প্রচলন শুরু ১৮৪০ শতকের পর।
কালকে
দাস করেছেন যে দাস
প্রকৃতি
ও মানবজীবনের আনন্দময় বর্ণনার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে কালিদাসের জীবনবোধ। তার
কাব্যের মূল প্রেরণা এই পৃথিবী ও মানবজীবন; রচনায় ব্যক্ত হয়েছে আবেগের
সমুন্নত উচ্ছ্বাস, চিরন্তন সত্য ও পর্যবেক্ষণলব্ধ
নৈতিকতাবোধ। ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের যে বীণাতন্ত্রে সূক্ষ্মতম ও
স্বর্গীয়তম ঝংকার প্রাচীন ভারতবর্ষে অনুরণিত হয়েছিল, সেই
স্বর্ণ-বীণা ছিলেন মহাকবি কালিদাস।
ছিলেন
বলাটা ভুল হোল। তিনি আছেন। মহাশক্তিধর সময়কে বুড় আঙ্গুল দেখিয়ে কবি এখনো আমাদের মনমানুষ।
আর তাই দেখি ফুটপাথ- রেলষ্টেশনে ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে ‘কালিদাস পণ্ডিতের ধাঁধাঁ’-এর
বই। আবার দেখি প্রেমিকের নোটবুকে কিমবা কবি-সাহিত্যিকের সেলফে।
গণ্ডমূর্খ
থেকে বিশ্বকবি-সাহিত্যিকের বিমুগ্ধ করা মহাকবি কালিদাসের অমর সৃষ্টি বর্তমান প্রজন্মের
অধিকাংশের কাছে ধোঁয়াটে। যেহেতু সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাবহৃত হচ্ছে
না। এটাতো অনস্বীকার্য যে কালিদাস মানেই সংস্কৃত ভাষা। সে কারনেই বর্তমান সাহিত্য-
সংস্কৃতি অনুরাগী ও ইতিহাসবিদরা কালিদাস সম্পর্কে উদাসীন।
এটাই
দুঃখের যে ভারতের মতো সুপ্রাচীন এক দেশ, যেখানে একদা সংস্কৃত ভাষা ও
সাহিত্য পরম্পরা মানব জীবনের ঐতিহ্যের আধার ছিল, বর্তমানে তা
প্রায় মৃত। সে ভাবেই কালিদাস ও বর্তমান সাহিত্য জগতে অপ্রাসঙ্গিক। ভাবলে কষ্ট হয়।
তবে
এটা ভাবলে অবাক লাগে কালী দেবীর একজন দাস কি করে এতকাল টিকে আছে? যেন - কালকে দাস
করেছেন কালিদাস। তাকে নিয়ে হয়ত গবেষণা চলতে থাকবে আরও দীর্ঘকাল।
###
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
###
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
Comments