পুণ্ড্রের পাঁচালী-২২ (বাঙালির গৌরব গাঁথা- পঞ্চম পর্ব )
পুণ্ড্রের
পাঁচালী-২২ (বাঙালির গৌরব গাঁথা- পঞ্চম পর্ব )
সাজেদুর
রহমান
নদীবিধৌত
এই যে ‘ব’ দ্বীপ-বাংলাদেশ নামের দেশটি, এ দেশের প্রকৃতি বড় সুন্দর। প্রসিদ্ধ ভৌগোলিক
টলেমির এ দেশটিই বড় পছন্দ। এত বড় ব-দ্বিপটির ভূপ্রকৃতির মধ্যে কত বৈচিত্র্য,
একদিকে গগনচুম্বী পাহাড়, আর অপর দিকে নীল সমুদ্র। মধ্যে কত নদী, কত অরণ্য, কত
প্রাচীন জনপদ। ঐতিহাসিক সম্পদ রয়েছে প্রচুর। কত কৃষি-খনিজপণ্য, হাতি-হাতির দাঁতের
সূক্ষ্ম কারুকাজ, মসলিন কাপড়ের শিল্পগুণ ক্লডিয়াস টলেমিয়াসকে আকৃষ্ট করে। ওই সব
কৃষি-খনিজ সম্পদ অপচয় হচ্ছে, বিপণনে গোছান হচ্ছে না বস্ত্র আর চিনি শিল্প,
মানচিত্র
প্রনেতা টলেমি সেগুলর সুষ্ঠু বাণিজ্য ব্যাবস্থা করতে চান। মসলিন সারা বিশ্বের
অন্যতম বিস্ময়কর বস্ত্র, সেই মসলিন সম্পর্কে টলেমির মুগ্ধতার শেষ নেই, বার বার
হাতে নিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। তিনি ঠিক করেছেন, বঙ্গাঞ্চলকে একতা মানচিত্র উপহার দেবেন,
সেটি হবে আস্মুদ্রহিমাচিলের ভৌগোলিক চিত্র, স্পষ্ট হবে এ অঞ্চলের সম্ভাবিনা।
এ দেশের অনেক কিছুই ভাল, শুধু এ দেশের মানুষগুলি টলেমির
উচ্চ ধারণা নেই। তার ধারণা এখানকার মানুষের চলে জাদুবিদ্যায়। এখানে সব সময় ঘটে চলে
অলৌকিক ঘটনা। এখানকার পিঁপড়ারা শেয়ালের সমান। সেই ভয়ঙ্কর রুপি পিঁপড়া মাটি খুড়ে
সোনা তুলে আনে। মানুষেরা সোনার জন্য সেসব পিঁপড়ার পেছু নেয়। তবে পিঁপড়ারা টের পেলে
মানুষদের ধরে মেরে ফেলে।
এই
সব জেনেছে মেগাস্থেনীস বই থেকে। পরিব্রাজক মেগাস্থেনীস এই এলাকায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালোন করেছেন।
তবে মহাকবি ভার্জিল চমৎকার কথা লিখেছেন। খ্রিস্টপূর্ব
প্রথম শতকে রোমের কবি ‘জর্জিক্সের’ মহাকাব্যে বাংলার
অধিবাসীদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের বর্ণনা পাওয়া যায়।
তিনি বাঙালি বীরদের গাঁথা রচনা করেছিলেন।
খ্রিষ্টীয়
৯০-১৬৮ সালে টলেমি গংগা মোহনায় আসান। “গঙ্গে”-বন্দরে আসার পর গ্রিক ভূগোলবিদের বিস্ময়য়ের শেষ নেই। বন্দর থেকে প্রবাল,
সূক্ষ্ম মস্লিন বস্ত্র এবং অন্যান্য দ্রব্য পশ্চিম দেশে রপ্তানি
হচ্ছে। এদের মত পরাক্রান্ত ও সমৃদ্ধ জাতি ভারতীয় উপমহাদেশে আর নেই।
এই ভূখণ্ডের সব অঞ্চল জুড়েই গংগারিড়ীরা বাস করে।
পুণ্ড্রের
পাঁচালী-২২তম অধ্যায়ে বাঙালির গৌরব গাঁথার পঞ্চম পর্বে গ্রিক ও লাতিন ঐতিহাসিক, পরিব্রাজক
ও ধ্রুপদী লেখকদের লেখা থেকে প্রাচীন বাংলার পরাক্রান্ত ও সমৃদ্ধ জাতি ইতিহাস তুলে
ধরব।
ইতিহাসের খাদের অন্ধকারে নৌবাণিজ্য
মসলিন পৃথিবীর প্রথম ‘গ্লোবাল ব্র্যান্ড’
হাজার বছরের
পুরোনো ঐতিহ্য, পৃথিবীর বিস্ময় এই
মসলিন কাপড় তৈরির নিয়ে নানা মিথ আছে। রোমানরা মসলিনকে বলত ‘বাতাসে
গেরো দিয়ে তৈরি করা কাপড়।’ ইংল্যান্ডের লোকেরা মনে করত, এত
সূক্ষ্ম কাপড় কোনো মানুষের পক্ষে বানানো সম্ভব নয়, এ নিশ্চয়
পরিদের কাজ।
একসময় পৃথিবীর
তাবত সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের
আভিজাত্যের প্রতীক ছিল মসলিন। যুধিষ্ঠিরের
রাজসূয় যজ্ঞ থেকে নেপোলিয়নের স্ত্রী জোসেফাইন হয়ে আওরঙ্গজেবের
মেয়ে জেবুন্নেসা আর ফ্রান্সের রানি মেরি অ্যান্টোনিয়েটের গায়ে সোভা বাড়াত।
একটা কাপড়, যাতে ঠিক শীত নিবারণ হয় না, শরীর ঢাকে না, যা তৈরি করতে লাগে প্রচুর সময় আর
পরিশ্রম, সেই কাপড়ের জন্য বিশ্বজুড়ে কেন এত উন্মাদনা,
সেই রহস্যের খোঁজে নেমেছিলাম।
মসলিনের
সুলুকসন্ধানে যখন দেশী-বিদেশী সোর্সে তালাশ করছি তখন একজন গবেষক বলেছিলেন সাজেদুর, মসলিন নিয়ে নতুন আর কী বলার আছে? উত্তরে বললাম, এ লেখা শুধু একটা কাপড়ের গল্পই নয়, এ
আমাদের ইতিহাস, রাজনীতির মুখোমুখি দাঁড়ানোরও একটা উপলক্ষ।
সেই মসলিন
বিশেষজ্ঞকে প্রশ্ন করলাম, ইতিহাসের খাদের অন্ধকারে পড়ে যায়, সেখানে বহিঃশক্তির পাশাপাশি আমাদেরও কি দায়
নেই সেগুলোর খোঁজ নেওয়া? ইতিহাসকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের
গল্পটা আমাদেরই বলা দরকার।
মসলিনের একটা
কারিগরি মাত্রা আছে, আছে রাজনৈতিক মাত্রা,
আছে সাংস্কৃতিক মাত্রাও। আমি গবেষক নই। চেষ্টা করেছি মসলিন নিয়ে
ভিন্ন মাত্রায় আলোচনা করতে। যে গল্প পশ্চিমাদের বলা নয়, এটি
আমাদের গল্প।
নিজের দেশের
একটা গৌরবের উপলক্ষ কী করে অন্যরা যখন আমাদের গল্প বলবে, তখন সে গল্পের নায়ক থাকবে তারাই। এখানে আমাদের
নিজস্ব গল্পটা নিজের মতো করে বলার চেষ্টারই একটা উদাহরণ। একটা জাতি পরিচয়ের
মানসগঠনে এ ধরনের কাজ জরুরি।
পৃথিবী দাপিয়ে
বেড়ানো সেই আশ্চর্য কাপড় মসলিন ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে বিশ্ব বাণিজ্যের মঞ্চ থেকে। ফুটি
কার্পাস নামে যে বিশেষ তুলা থেকে মসলিন হতো, তা-ও হারিয়ে যায় একসময়। কালের ধারারই বিশেষ কাপড়, জামদানি
মসলিনের শেষ বংশধর হিসেবে শুধু টিকে আছে এখনো।
হাজার বছরের
পুরোনো ঐতিহ্য এই মসলিন কাপড় তৈরির মূল এলাকা ছিল এই বাংলাদেশ, আমাদের এই মেঘনা আর ব্রহ্মপুত্র নদের তীর
ঘিরেই। এই ঢাকা থেকেই সেই কাপড় চলে যেত চীন, ফ্রান্স,
অটোমান সুলতানের প্রাসাদ থেকে রোম সাম্রাজ্যের দরবারে।
গঙ্গে অঞ্চলের উৎপন্ন দামি ও সূক্ষ্ম মসলিনের উল্লেখ আমরা
পেরিপ্লাসে বিপুলভাবে পাচ্ছি। এই পণ্যটি বাংলার উপকূল দিয়ে বিপুল সংখ্যায় বিদেশে
যেত। অথচ মসলিনকে বলেছেন পৃথিবীর প্রথম ‘গ্লোবাল ব্র্যান্ড’।
‘পেরিপ্লাস অব দি এরিথ্রিয়ান সি’ শীর্ষক গ্রন্থে
মসলিন সম্পর্কে বিশেষ ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। এতে মোটা ধরনের মসলিনকে মলোচিনা,
প্রশস্ত ও মসৃণ মসলিনকে মোনাচি এবং সর্বোত্কৃষ্ট মসলিনকে গেনজেটিক
বা গঙ্গাজলী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাণভট্টের হর্ষচরিতে পৌণ্ড্রবাস নামক একরকমের রেশমী
বস্ত্রের উল্লেখ আছে। এছারা বিভিন্ন
আরব, চীন ও ইতালীর পর্যটক
ও ব্যবসায়ীর বর্ণনাতে মসলিনকে পাই মোটা দাগে।
আমাদের এই অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণ ছিল এই
বস্ত্র। বাংলার মসলিনের পূর্বসূরীকে দেখতে পাই এখানে আমরা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে, বঙ্গ
ও পুন্ড্র এলাকায় সূক্ষ্ম বস্ত্রের উল্লেখ আছে, যার মধ্যে
ছিল ক্ষৌম, দুকূল, পত্রোর্ণ ও কার্পাসী।
এডওয়ার্ড
বাইনেস তাঁর হিস্ট্রি অব দ্য
কটন ম্যানুফ্যাকচার ইন গ্রেট ব্রিটেন নামের বইয়ে লিখেছেন,
মসলিনের সূক্ষ্মতাই একে করে তুলেছিল কাপড়ের জগতে অনন্য। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার পারের বিশেষ আবহাওয়া, এখানকার মাটির
বিশেষ গুণে জন্ম নেওয়া ব্যতিক্রমী তুলা, বাঙালি মেয়েদের
হাতের সূক্ষ্ম কাটুনির দক্ষতা, এখানকার তাঁতিদের অপরিসীম
ধৈর্য ইত্যাদি মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এই বিরল কাপড়।
মসলিনের
ইতিহাস অন্বেষণে প্রাচীনকালের হেরোডোটাস, স্ট্র্যাবো থেকে টলেমি,
প্লিনি পর্যন্ত অনেক ইতিহাসবিদের রচনায় ঢাকাই মসলিনের উল্লেখ পাওয়া
যায়। মসলিনের সূক্ষ্মতার কথা ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা থেকে জানা যায়। যেমন— প্লিনি অভিযোগ করেছেন যে, মসলিনের ক্ষীণ আব্রুর
ফাঁকে রোমান সুন্দরীরা দেহের বঙ্কিম রেখা প্রকাশ করতেন। শুধু তাই নয়, ঢাকার ‘ঝুনা’ মলমল নামের বিশেষ
ধরনের মসলিন পরার কারণে গ্রিক যুবকরা সেখানকার দার্শনিক ও ব্যঙ্গকাব্য লেখক-কবিদের
কঠোর সমালোচনার পাত্র হয়েছিলেন।
অরেলিয়সের
রাজত্বকালে সোণার ওজনে রেশম বিক্রয়ের উল্লেখ ঐতিহাসিকগণের গ্ৰন্থপত্ৰে দেখতে
পাওয়া যায়। এছাড়াও চিনা রেশমের লাছা, সুতো এবং চিনাংশুক গঙ্গে
এলাকা হয়ে দ্রাবিড় অঞ্চলে যেত। চৈনিক রেশম স্থানীয় উৎপাদন মসলিনের মতই অত্যন্ত
দামি পণ্য এবং ধনীভোগ্য এবং এটাও বাংলার অন্যতম ট্রানজিট পণ্য হিসেবে গণ্য হত। ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ বলা হয় মুঘল আমলকে। এ সময়
দেশে-বিদেশে মসলিন, জামদানির চাহিদা
বাড়তে থাকে এবং শিল্পেরও ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।
কিন্তু মসলিন নামের রহস্যময় সেই
কাপড়ের জয়যাত্রা থেমে যায় একসময়। থেমে যায় মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে।
আঠারো শতকে ইংল্যান্ডে যে কাপড়ের শিল্প গড়ে উঠেছিল,
তার বাজার প্রসারে একটা বড় বাধা ছিল মসলিন। মসলিনের প্রতিপত্তিকে
ধ্বংস করতে ব্রিটিশরা নেয় নানা কৌশল। জানা যায়, ব্রিটিশরা নকল মসলিন বানিয়ে কী করে
তাতে লাগিয়ে দিত মসলার গন্ধ, যাতে ক্রেতাদের ধোঁকা দেওয়া যায়,
ব্রিটিশদের ছাড়া ভিন্ন দেশের এক ক্রেতার কাছে মসলিন বিক্রি করার
কারণে বাংলার এক তাঁতিকে মাথার চুল কামিয়ে ঘোরানো হয়েছিল গ্রামের হাটে। ব্রিটিশ
করের চাপে নিঃস্ব হতে বসা তাঁতি পরিবারের একজন কাটুনি নারী আঠারো শতকে সমাচার দর্পণ পত্রিকায় যে মর্মস্পর্শী চিঠি
লিখেছিলেন, তাতে যে নির্মম ঘটনার নজির পাই। ভারতবর্ষের শাসক
হিসেবে মসলিনশিল্পকে ধ্বংস করতে এ কাপড়ের তাঁতিদের আঙুল কেটে ফেলার মতো ও আছে।
ছোটবেলায় শুনতাম, মসলিনের তৈরি একটা শাড়ি অনায়াসে একটা ম্যাচ
বাক্সে ঢুকিয়ে ফেলা যায়। বর্তমান থেকে দূর অতীতে যখন ভোরের শীতল হাওয়ায় জঙ্গলবাড়ি
বা কাপাসিয়ার কোনো নদীর কূলে বসে কাটুনি মেয়েরা সুতা কাটছে। ভুলনকাঠি, বোয়াল মাছের দাঁত, চিতল মাছের চামড়া, কাছিমের খোল ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে তৈরি হচ্ছে মসলিন সুতা। সেই সুতার কাপড়
নিয়ে তাঁতিদের ভেতর প্রচলিত গান, পুঁথিরও।
এক সময় বাংলার মসলিন কাপড়ের কদর ছিল আকাশচুম্বি। তখনকার উচ্চ
শ্রেণির নারিদের কাছে এই বস্ত্র সমগ্র প্রধান স্থান অধিকার করিয়াছিল। বিশ্বে ইতিহাসের বস্ত্র খাতে মসলিনের ব্র্যান্ড আমাদেরকে অতীত গৌরবের সত্য স্মৃত। সেই গরবের স্মৃতি আজ খাদের অন্ধকারে। অথচ এই
বাংলার
মসলিন প্রথম গ্লোবাল ব্র্যান্ড।
মেগাস্থেনীসের বর্ণনায় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভার চিত্র
গঙ্গাঋদ্ধির
বীর দেতিসের বীরত্ব
দেতিস
নামের এক বীরের কথা জানতে পারছি ল্যাটিন আমেরিকান ও গ্রিক ধ্রুপদী লেখকদের
বর্ণনায়। খুবই বিচিত্র সেই বর্ণনা। আমরা জানতে পারি ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ পারস্য
যুদ্ধে দেতিস গ্রিকদের বিরুদ্ধে পারস্য যুদ্ধে আর্টাফার্নিস বাহিনীর নেতৃত্ব দেন।
ইতিহাসের
জনক হিরোডটাসের মতে,
দেতিস ওই যুদ্ধে সাফল্য লাভ করেন। প্রথম দারিউসের পক্ষে তিনি
আর্টাফার্নিসের পাশাপাশি গ্রিকদের বিরুদ্ধে বিশ্বস্ততার সঙ্গে বীরত্বের পরিচয় দেন।
থ্রেসিয় যুদ্ধে আহত হওয়ার কারণে তাকে কিছুদিন বিশ্রাম দেয়া হয়।
মহাকবি
ভার্জিলের (২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত) জর্জিকস কাব্যে গঙ্গাঋদ্ধির বীর দেতিসের
অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা চমৎকার বর্ণনা দেন। দেতিস ছিলেন পারস্য সম্রাটের দারিউসের
অধীনস্থ নৌ-সেনাপতি।
দারিউসের
ভাই আর্টাফার্নিস। ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেতিসের দায়িত্ব ছিল নেক্সাস অবরোধ করা ও
নির্মমভাবে ইরিত্রিয়া লুণ্ঠন করা। ইতিহাসের জনক হিরোডটাসের মতে, দেতিস
এ যুদ্ধে সাফল্য লাভ করেন। প্রথম দারিউসের পক্ষে
তিনি আর্টাফার্নিসের পাশাপাশি গ্রিকদের বিরুদ্ধে বিশ্বস্ততার সঙ্গে বীরত্বের পরিচয়
দেন। থ্রেসিয় যুদ্ধে আহত হওয়ার কারণে তাকে কিছুদিন বিশ্রাম দেয়া হয়।
যুদ্ধে
দেতিসের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে গ্রিকনাট্যকার
এরিস্টোফেনিস ‘পিস’ নাটকে তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন। অপরদিকে রোডসের
(৬৯-১৬ খ্রিষ্টে) এ্যাপোলনিয়াসের আর্গোনটিকা কাব্যে বর্ণনা
করাছে, গঙ্গাঋদ্ধির দেতিস নামের এক দলপতি তৃতীয় পার্সিসের
পক্ষাবলম্বন করে ঈটিসের বিরুদ্ধে কলসির গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
এসব
কথায় আমরা একটা বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি-গঙ্গাঋদ্ধির মানুষ শুধু ব্যবসা করত না, ক্রেতাদের
স্বার্থ রক্ষার্থে (কাস্টমার কেয়ার) জীবনবাজি রেখে যুদ্ধও করত।
ডিয়োডোরস
সিকুলাস গঙ্গারিডিকে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য বলে উল্লেখ করেন, যার
রাজার ২০,০০০ ঘোড়া, ২০০,০০০ পদাতিক, ২,০০০ রথ এবং ৪,০০০ হাতির সমন্বয়ে প্রশিক্ষিত এবং যুদ্ধের জন্য সজ্জিত একটি বাহিনী ছিল।
ইতিহাসের
সাক্ষী মহাবীর আলেকজান্ডার বাহিনীর জয়রথ থামিয়ে দিয়েছিল গঙ্গারিডি বীর যোদ্ধারা। গঙ্গারিডি
সাম্রাজ্য এবং নন্দ সাম্রাজ্যের (প্রাসি) সহযোগী বাহিনী গঙ্গা নদীর তীরে এই ঘটনা
ঘতে খ্রিস্টপূর্ব দুই-তিন শতাব্দীতে।
প্রথম
শতকের লাতিন দার্শনিক প্লিনি পেরিপ্লাস অফ ইরিত্রিয়ান সি শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, বঙ্গরাজ
মগধসহ গোটা আর্যাবর্ত জয় করে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় একচ্ছত্র সম্রাট হয়ে বসেছেন।
প্লিনির
মতে, গঙ্গারিডাই রাজ্যের ভেতর দিয়ে গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হয়েছে।
গঙ্গার
দক্ষিণ অংশের অধিবাসীদের গাত্রবর্ণ ছিলো কালো এবং রৌদ্রে পোড়া, কিন্তু
তারা ইথিওপিয়ানদের মতো কালো ছিলো না। মেগাসথিনিস তাঁর
ইন্ডিকা কিতাবে লিখেছেন,
‘গঙ্গার শেষ অংশের প্রস্থ ৮ মাইল, এবং যেখানে এটি
সবথেকে কম প্রস্থের সেই স্থানে এর গভীরতা প্রায় ১০০ ফুট।
সেই
মানুষরা যারা সেই সুদুর প্রান্তে থাকেন তারা হলেন গঙ্গারিডাই।
এদের
রাজার ১ হাজার ঘোড়সওয়ার,
৭০০ হাতি এবং ৬ হাজার পদাতিক মুজাহিদ নিয়ে সজ্জিত প্রতিরক্ষা বাহিনী
আছে।’
[উইকিপিডিয়া] গ্রিকবীর আলেকজান্ডার এসব বিবরণী
শুনে বাংলাদেশ জয়ের দুরাশা ত্যাগ করেন।
গ্রিক
উপাখ্যানের সঙ্গে গঙ্গাঋদ্ধির প্রাগৈতিহাসিক যুগও বিজড়িত রয়েছে। বিষয়টি রীতিমতো
কৌতূহলের উদ্রেক করে। ডিওডোরাস (Diodorus) গঙ্গারিডই ও প্রাসি অয়গণকে একটি
অভিন্ন জাতি বলে উল্লেখ করেছেন। পুটার্ক (Pluntarch) এক স্থানে এই দুই জাতিকে গঙ্গারিডই রাজার অধীন এবং অন্যস্থানে এদের দুই পৃথক
রাজার উল্লেখ করেছেন।
পুটার্ক
লিখেছেন,
গঙ্গারিডই ও প্রাসি অয় রাজাগণের বিশাল সৈন্যবাহিনী ছিল। গঙ্গারিডই পরাক্রান্ত
ও সমৃদ্ধ জাতি ভারতীয় উপমহাদেশে আর নেই।
টলেমীর
মানচিত থেকে জানা যায় যে,
খ্রিষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শাতাব্দীতে বাংলাদেশ সমগ্র বদ্বীপ অঞ্চল
গাহুরাষ্ট্র নামে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গঙ্গা রাষ্ট্রের
অধিশ্বরের সুপ্রতিষ্ঠিত হস্তী সৈন্যের ভয়ে এই রাজ্য অন্য রাজ্যের আক্রমণ থেকে
রক্ষা পেত। এমনকি সর্বজয়ী মহাবীর আলেকজান্ডারও গঙ্গাতীরে উপনীত হয়ে গঙ্গারাঢ়ীদিগের
শক্তিমত্তা ও ধন ঐশর্যের পরিচয় পেয়ে সেই স্থান থেকে প্রস্থান করেন।
প্রাচীন গ্ৰীক ও লাতিন লেখকদের কৃপায় খ্ৰীষ্টপূর্ব শতকের
তৃতীয় পাদে বাঙলার রাজবৃত্ত-কথা অনেকটা স্পষ্ট। তাদের মাধ্যমে জানতে পারাগেছে, দুঃসাহসী বাঙালির
হাতিয়ার বলতে তখন প্রধানত তির-ধনুক আর
লাঠি। আর শুনে রাখো, বিরাট
সেনাবাহিনীর সামনে বাঙালিদের মূল শক্তি ছিল নারী যোদ্ধা। দুর্যোগে, সংগ্রামে তারা দুর্বার হয়ে ওঠে শত্রুর বিরুদ্ধে। এই সামান্য হাতিয়ার নিয়ে
বাঙালিরা মৌর্য সৈন্যদের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়।
রোমের
জাতীয় মহাকবি ভার্জিল গঙ্গাঋদ্ধির বীর দেতিসের মহিমা কীর্তন করেছেন।
মহাকবি
ভার্জিল্ [“জর্জিক্স্” কাব্যের তৃতীয় সর্গের সূচনায়] লিখিয়া
গিয়াছেন, দেতিসের রক্তে
বীরের রক্ত, তার চেতনায় স্বাধীনতা রাঙা
সূর্য। আর তাই তাঁর স্বকীর জন্মস্থান মেন্টুয়া-নগরে ফিরিয়া গিয়া, মর্ম্মর-প্রস্তরের
একটি মন্দির নির্ম্মাণ করিবেন; এবং সেই মন্দিরে রোম-সম্রাটের
প্রতিমূর্ত্তি স্থাপিত করিয়া, “মন্দিরের দ্বারফলকে সুবর্ণ
এবং হস্তিদন্তের দ্বারা ‘গঙ্গরিডিগণে’র
যুদ্ধের দৃশ্য এবং সম্রাটের রাজচিহ্ন অঙ্কিত করিবেন।”
ভার্জিলের
পক্ষে ভারতবর্ষের বিবরণ সংগ্ৰহ করিবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। ভারতের রাজন্যবর্গ তৎকালে
রোমে দূত প্রেরণ করিতেন;
এবং ভারতের সহিত রোমের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য-সম্বন্ধও বর্ত্তমান ছিল।
ভার্জিল্ “জর্জিক্সের” প্রথম সর্গে
লিখিয়াছেন, ভারতবর্ষ হতে রোমে হস্তি-দন্তের আমদানী হত।
সামরিক দিক দিয়েও প্রাচীন বাংলার
মানুষ খুবই শক্তিশালী ছিল। কালিদাস বলেছেন, বাংলার রাজারা নৌকা লইয়া যুদ্ধ
করিতেন।
একই সাথে বাঙালিরা গঙ্গাঋদ্ধি বন্দরকে ভারতের মদ্ধে প্রসিদ্ধ নৌবাণিজ্যকেন্দ্র
হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল বলে গ্রিক
ইতিহাস থেকে এর প্রমান পাওয়া যায়।
মেগাস্থিনিস বর্ণনায় এখানকার আজব প্রাণী
ভারতের
প্রসিদ্ধ নৌবাণিজ্যকেন্দ্র গঙ্গাঋদ্ধি
গ্রিক
ও রোমান ঐতিহাসিকগণ কথায় গঙ্গাঋদ্ধি নিঃসন্দেহে তদানীন্তন বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ
করেছিল। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস ভারত
এসেছিলেন। পাটালিপুত্রের চন্দ্রগুপ্তের মৌর্য দরবারের চমৎকার বিবরন দিয়েছেন তিনি
৩০২ খ্রীষ্টপূঃ। প্রাচীন
ভারত সম্পর্কে গ্রিক ভাষায় প্রণীত ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেন, ৩০০
খ্রিস্টপূর্বাব্দে গঙ্গার সম্পদ বা গঙ্গারাষ্ট্র হিসেবে গঙ্গাঋদ্ধি বা গঙ্গাহৃদয়
নামে বঙ্গরাজ্য পরিচিতি লাভ করে। তখন গঙ্গাঋদ্ধির অন্তর্ভূক্ত ছিল বর্তমান
বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। রাজধানী ছিল বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার
কোটালিপাড়ায়। গঙ্গারিডাইদের প্রধান নৌবাণিজ্যকেন্দ্র ছিল গঙ্গানগর।
‘প্যারিপ্লাস অব দ্যা (ইরিত্রিয়ান) সি’ নামক গ্রন্থে
(রচনা কাল ৪৪ সাল) বাঙালির বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
‘অত:পর পথ পুনরায় বাঁকনেয় এবং ডানে মুক্ত সমূদ্র এবং বায়ে দূরে উপকুল
রেখে জাহাজ চালালে পরে গঙ্গা দেখা যায়, এবং তার কাছেই পূর্ব
দিকে সর্বশেষ সূবর্ণ ভূমির নিকটে নদী আছে নাম গঙ্গা এবং এই নদীর উপত্তি এবং বিলয়
ঠিক নীল নদের মতো।
এই
নদীর তীরে এক হাট পত্তন আছে। তার নাম ও নদীর নাম একই গঙ্গা। এইখান দিয়ে আসে
তেজপাতা,
গাঙ্গেয় সুগন্দি তৈল ও মুক্তা এবং সর্বাধিক উৎকৃষ্ট প্রকারের মসলিস
যাকে বলা হয় গাঙ্গেয়। শোনা যায় যে, এই সব স্থানের নিকটে
সোনার খনি আছে এবং এক রকম সোনার মোহর চলে যাকে বলে কলতিস।’ –
খন্দকার মাহমুদুল হাসান – বাংলার প্রাচীন
সভ্যতা ও পুরাকীর্তি, শিখা প্রকাশনি, ১ম
প্রকাশ ২০০০, ঢাকা, পৃঃ ২৫
“পিরিপ্লাস্ ইরিথ্রি মেরি” নামক [খৃষ্টাব্দের প্রথম
শতাব্দে রচিত] গ্রন্থে নিম্ন গাঙ্গেয় ভূমিতে ‘ক্যালটিস’
নামক এক প্রকার স্বর্ণ মুদ্রা প্রচলনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউরোপীয়দের
মধ্যে মেগাস্থেনীসই সর্বপ্রথম গঙ্গা নদী দর্শন ও এর বিবরণ লেখেন। তবে এই ক্ষেত্রে
কিছু অতিকথনও রয়েছে তার বর্ণনায়। যেমন গঙ্গার বিস্তার যেখানে সবচেয়ে কম সেখানে
নাকি ৬৬ স্টাডিয়ম বা ৮ মাইল বা গড়ে ১০০ স্টাডিয়ম ইত্যাদি।
তবে
খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমির বর্ণনা পড়লে মনে হয় তিনি গঙ্গার মোহনার সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচিত ছিলেন। তার মতে গংগ
খ্যাতিসম্পন্ন এক আন্তর্জাতিক বন্দর। এখানকার তৈরি
সূক্ষ্ম মসলিন ও প্রবাল রত্নাদি পশ্চিম দেশে রপ্তানি হয়।
টলেমির রচনা থেকে জানা যায় তখন সমুদ্রপথে মালয়ের সঙ্গে চিকাকোল
ও গঞ্জাম সন্নিহিত পলুরার সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
এদিকে নরসিংদী জেলার বহুল আলোচিত উয়ারি-বটেশ্বর
এলাকার ব্রহ্মপুত্র বিধৌত অঞ্চলে সুপ্রাচীনকালে যে বাণিজ্যনির্ভর একটি মহানগর গড়ে উঠেছিল
তার পক্ষে প্রমাণের এখন আর অভাব নেই। এখান থেকে উত্খননের
মাধ্যমে খ্রিস্টপূর্বকালের নগরীর নিদর্শনাদি আবিষ্কৃত হয়েছে।
ইটে
তৈরি দালানকোঠার ধ্বংসাবশেষ যেমন পাওয়া গেছে, তেমনি আবিষ্কৃত হয়েছে অসংখ্য প্রত্নবস্তুও।
এসবের
মধ্যে বহির্বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগের প্রমাণবাহী প্রত্নবস্তুর সংখ্যাও
নগণ্য নয়। উদাহরণ হিসেবে নিচের বিবরণকে তুলে ধরা চলে।
প্রাচীন
গ্রিক বিবরণীতে পেন্টাপলিস অর্থাৎ পঞ্চনগরীর উল্লেখ থাকায় বোঝা যায়, প্রায়
দু’হাজার বছর আগেও গ্রিকরা পঞ্চনগরীর কথা জানত।
নিঃসন্দেহে
বাণিজ্যিক গুরুত্ব এই নগরীর ছিল। কেউ কেউ দিনাজপুরের
চরকাই বিরামপুরে,
আবার কেউ কেউ জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবির পাথরঘাটায় এই নগরীর অবস্থান থাকার
কথা উল্লেখ করেছেন। পঞ্চনগরী নামটা
শুনে প্রতীতী জন্মে যে,
পাঁচটি পরস্পর সংলগ্ন নগরীর একত্রীভূত নাম—পঞ্চনগরী।
আড়াই
হাজার বছর পূর্বে অথবা বুদ্ধদেবের আগে বাংলা দেশে উন্নত বড় বড় নৌকা তৈয়ার হত। বিজয় যে জাহাজে লঙ্কা
যান, সে জাহাজের একটা ছবি অজন্ত-গুহার মধ্যে পাওয়াগেছে।
ইউরোপীয়
পণ্ডিতেরা মনে করেন,
বুদ্ধের সময়ও তাম্রলিপ্তি একটি বড় বন্দর ছিল। অর্থশাস্ত্রে বলে যে, যিনি
রাজার ‘নাবধ্যক্ষ' থাকতেন, তিনি
‘সমুদ্র সংযানেরও অধ্যক্ষতা করতেন। সুতরাং তখনও যে বঙ্গ মগধ
হতে সমূদ্রে জাহাজ যেত,
সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই বঙ্গ মগধ।
‘রামেষু নাম্নেী যবন্যস্ত’
-
এর মানে, ‘সমুদ্র সংযানে'রও অধ্যক্ষ ‘নাবধ্যক্ষ' রামোয়ু নামে এক যবনের পোত তার নৌকায় চড়ে দূর সমুদ্রে যাওয়ার সময় অন্য এক পোতকে
ডুবিয়ে দেয়। এই কথার ভিত্তিতে অনেকে
মনেকরেন, ভারত
উপমহাদেশে বাঙালীরাই প্রথম সমুদ্রভ্রমণকারী শক্তিশালী জাতি। এর প্রমাণ হিসেবে পান্ডু
রাজার ঢিবিতে পাওয়া স্টিটাইট (Steatite) পাথরের কতকগুলি চিহ্ন খোদিত একটি
গোলাকার সীলকে হাজির করেন। এতে মনে করা হয় যে সীলটির খোদিত চিহ্নসমূহ চিত্রাক্ষর(Pictpgraph)
এবং সীলটি ভূমধ্যসাগরীয় ক্রিট দ্বীপের, প্রায়
সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে নির্মিত।
এই
সীল ও প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শন থেকে মনে করা হয় প্রাচীন সভ্যতার ক্রীট দ্বীপের
সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো।
কর্মচঞ্চল তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়ে নিয়মিত এই
সমস্ত বহির্বাণিজ্য হত। তেজপাতার ব্যবসাও হত
তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে। পুণ্ড্রে প্রচুর তেজপাতা উৎপন্ন হত, সেগুলো করতোয়া ও গঙ্গাদ্বারা বাহিত হয়ে তাম্রলিপ্তে এসে পৌঁছত। এদিকে পিপ্পলী (একরকমের দীর্ঘ গোলমরিচ) এক পাউণ্ড বা
আধ সের বিক্রি হত পনেরো স্বর্ণমুদ্রা দামে, প্লিনির ইন্ডিকা নামক গ্রন্থে জানা যায়।
সমুদ্র
বাণিজ্যে বাঙালির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কখন শেষ হয়েছিল তার সঠিক তারিখ নির্ণয় করা
কঠিন। ঐতিহাসিক অশীন দাশগুপ্তের অনুমান যে সতেরো শতকের শেষের দিকে বাঙালির
বাণিজ্যিক জাহাজের ব্যবসা ভীষণ কমে যায়। এর একটি বড় কারণ জাহাজি ব্যবসা থেকে মুঘল
সাম্রাজ্যের এই অঞ্চলের রাজকর্মচারীদের নিয়োজিত মূলধন তুলে নেয়া (দ্য ক্যামব্রিজ
ইকোনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া খ-১)। তবে বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ীরা (ঐতিহাসিক অশীন
দাশগুপ্তের মতে) বাণিজ্য উপলক্ষে সামুদ্রিক জাহাজে বিদেশে পাড়ি দেয়া অনেক আগেই শেষ
হয়ে গিয়েছিল।
গ্রিক-রোমান
লেখকের আবোলতাবোল ইতিহাস
গ্রিক
ও রোমান ঐতিহাসিকগণ গঙ্গাঋদ্ধির উচ্চারণ ও বানান বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে লিখত।
গঙ্গাঋদ্ধি,
গঙ্গারাষ্ট্র, গঙ্গারিদয়, গঙ্গারিদম, গঙ্গাহৃদ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করে বিকৃতভাবে
উপস্থাপন করেছে।
আলেকজান্ডারের
সময় একশ্রেণীর তথাকথিত লেখকের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এরা বিশ্বব্রহ্মন্ডের যাবতীয় বিষয়
নিয়ে লিখতে চাইতেন। প্রতিভা ও শিক্ষায় পিছিয়ে থাকলেও গ্রন্থ সম্পাদনায় তারা কখোনো
পিছিয়ে থাকতে পছন্দ করতেন না। তাদের লেখায় বিষয় ও ভাষার ভারসাম্য প্রায়শই খুঁজে
পাওয়া যেত না। শুণ্যগর্ভ ও অর্থহীন বাগাড়ম্বরে পর্যবসিত হত অনেক লেখা। মেগাস্থেনীসও
তেমন ধাঁচের লেখক ছিলেন কিনা তা জানা যায় না।
গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস মৌর্য
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্ব কালে ভারত এসেছিলেন। তিনি গ্রীক সম্রাট
সেলিউকাসের দূত হিসেবে রাজধানী পাটালিপুত্রে বছর পাঁচেক ছিলেন। তাঁর রচিত ‘ইন্ডিকা’
গ্রন্থে পাটালিপুত্রের
চমৎকার বিবরন আছে। কিন্তু প্রাচীন বাংলা সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কাহিনী
হাজির করেছেন।
গঙ্গার
পাশাপাশি মেগাস্থেনীস শিলা নামক আরেকটি অদভুত নদীর কথা উল্লেখ করেছেন। এই নদীতে
নাকি কিছুই ভাসে না। যা ফেলা হয় তাই পাথরে রূপান্তরিত হয়ে তলিয়ে যায় নদীর অতলে।
বোঝাই
যাচ্ছে যে পৌরাণিক কোনো কাহিনী থেকেই এমন নদীর অস্তিত্বের কথা জেনেছিলেন এই
পরিব্রাজক। তার রচনায় বঙ্গীয় বাঘ, হাতি, বানর, কুকুর, কৃষ্ণসার অশ্ব, বিদ্যুৎ
মাছ, সাপ, পাখাযুক্ত বৃশ্চিক সহ অনেক
প্রাণীর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। তবে বিশদ ভাবে এক অদ্ভুত পিঁপড়ের কথাও এসেছে তার
লেখায়। তার বর্ণনা মতে ভারতবর্ষের পূর্ব দিকের পাহাড়ী এলাকায় দরদ নামক এক বিশাল
জাতির বাস। সেখানে তিন হাজার স্টাডিয়ম বিস্তৃত একটি অধিতক্য রযেছে।
সেখানকার ভূ-গর্ভে রয়েছে স্বর্ণখনি
এবং এখানেই স্বর্ণখননকারী পিঁপড়ের বাস। এদের আকার বুনো শেয়ালের চেয়ে ছোট নয়। তারা
শীতকালে ভূমি খনন করে আর দরদ জাতির লোকেরা কায়দা মত তাদের খননকৃত স্বর্ণসমৃদ্ধ
মাটি হরণ করে আবার কখোনো সেই সব পিঁপড়ের হাতে নিহত হয় সদলবলে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে আরব কল্পকাহিনী
এবং মহাভারতেও এই রকম পিঁপড়ের উল্লেখ আছে। ধরে নেওয়া যায় আমাদের এলাকা সম্পর্কে
তার বিবরণ নিছকই লোকশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে লেখা। যার অধিকাংশই অসত্য, অতিরঞ্জিত তাই পরিত্যাজ্য। তবু, প্রথম প্রামাণ্য বর্ণনা হিসেবে তার রচনা ইতিহাস প্রিয়দের আগ্রহের কেন্দ্রে
থেকেছে।
মেগাস্থেনীসের সমসাময়িক বা অব্যবহিত
পরের কিছু গ্রীক লেখক যেমন আরিয়ান, স্ট্রাবো, প্লিনি,
আরিয়ন প্রমুখ গ্রিক ঐতিহাসিকগণ গঙ্গাঋদ্ধির অবস্থান সম্পর্কে
মেগাস্থিনিসের মতামত প্রাধান্য দিয়েছেন।
গ্রীকদের বিশ্বাস ছিল এ অঞ্চল রহস্যঘেরা এক
মায়াপুরী। যেখানে বাস করে অদ্ভূত আকৃতির কিছু প্রানী, যেখানে
সব সময় ঘটে চলে অলৌকিক ঘটনা। এখানে ভয়ংকর
গ্রিফিন পাখি খিলানের ওপর বসে আছে। আছে ডানা যুক্ত চিতা বাঘের কথা। ডানা যুক্ত চিতা
বাঘ নাকি তখন বাস করত ভারত বর্ষে।
প্রাচীন কালে গ্রীকদের এসব ভ্রান্ত
ধারনা অনেক খানি সংশোধন হয় যখন ৩২৬ খ্রীষ্টপূঃ আলেকজান্ডার উত্তর পশ্চিম সিন্ধু
প্রদেশে হাজির হন। এই অভিযানেই প্রথম সুস্পষ্ট জানা গেল ভারতবর্ষের জীবন যাত্রা, রীতিনিতি, পশু পাখি।
টলেমীর মাঞ্চিত্রে গঙ্গাঋদ্ধি
ইতিহাসের বিলক্ষণ সত্য
রোম-সাম্রাজ্য
থেকে প্ৰতি বছর লক্ষ লক্ষ পাউণ্ড স্বর্ণমুদ্রা ভারতে চলে যাচ্ছে বিলাস-দ্রব্য ক্রয়ের
মাধ্যমে। এতে স্বর্ণের আকাল পড়েছে। এ মন্তব্য প্লিনির। বিখ্যাত এই বুদ্ধিজীবীর এই
অঞ্চল কর্তৃক রোমের অর্থ শোষণ প্রিসঙ্গে দেওয়া উক্তি, বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারতের যে
অর্থসমৃদ্ধির পরিচয় পাই তা কল্পনা বলে ঐতিহাসিকগণেরা মনে করেন।
সম্ভবত
যে-মানুষটি গ্রীকদের জ্ঞান-বিজ্ঞান লাতিনে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি
অবদান রেখেছেন এই হলেন প্লিনি। তার আরেকটি কথা খুব বিখ্যাত- “ভাগ্য
সাহসীদের সহায়তা করে”।
এই
কথাটি বঙ্গজাতীর সাথে খুব যায়। এই যে ‘বঙ্গোপসাগর’ নামটির এসেছে। এর কারণ কি? আমাদের
অতীত সাহসী পূর্বসূরিদের সমুদ্র জয়ের সঙ্গে এই সাগরের নাম জড়িত। এই তথ্য পাই
গ্রিক-লাতিন-আরবদের বর্ণনায়।
প্রসিদ্ধ ভূগোলবিদ টলেমি ও পিস্ননি
এবং অজানা গ্রিক নাবিকের লেখা ‘পেরিপস্নাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি’ গ্রন্থে- শক্তি,
সমৃদ্ধিতে প্রতিষ্ঠিত বাঙালির পরিচয় মেলে এসব গ্রন্থে-প্রাচীন যুগ
অতিক্রম করে মধ্যযুগে এসে পরাক্রান্ত বাঙালিকে এতোটুকু হীনবল মনে হয়নি।
বাঙালির একটা ধ্রুপদী অতীত আছে। বাঙালির এক গর্বের অতীত আছে। এবং সে সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। “গ্রীনল্যান্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে; মাওরি জাতিরও ইতিহাস আছে; কিন্তু যে
দেশে গৌড়-তাম্রলিপ্ত-সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, সে দেশের ইতিহাস নাই। উপাদানের অভাবকে ইহার প্রকৃত কারণ বলিয়া স্বীকার করা যায় না, অনুসন্ধানের চেষ্টার অভাবই প্রধান অভাব।”
“বাঙ্গালা অতি প্রাচীনকালে সভ্যতার অতি উচ্চশিখরে আরোহন করিয়াছিল। যে কেহ মন দিয়া বাঙ্গলার কথা ভাবিয়াছে, বাঙ্গলাকে ভালো করিয়া বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছে, তাহাকেই বলিতে হইবে বাঙ্গলা একটি অতি প্রাচীন দেশ।”–—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
ইতিহাসের জনক হিরোডটাস
প্রাচীনকালের
গর্বিত ইতিহাসের কয়েকটি তথ্য
@ খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে বাঙালিরা
সেই প্রাচীন যুগে লিখতে পারতো। দীনেশ সেন তাঁর বঙ্গভাষা ও
সাহিত্য গ্রন্থে জানাচ্ছেন -
বঙ্গের নিজস্ব লিপি সেই প্রাচীন যুগেও ছিল।
@ আলেকজাণ্ডারের সেনাবাহিনী পাঞ্জাবে এসে জানতে
পারছে গঙ্গারিডিদের কথা। গঙ্গারিডি এমন এক জাতির, যারা কখনও পরপদানত
হয়নি। শশাঙ্ক, পাল, সেন আমলে সেই
পুরোনো গৌরব কিন্তু আর ফিরে আসবে না।
@ হাতি পোষমানানর বিষয়টি পুণ্ড্রবাসীর অন্যোন্য অর্জন।
হাতি
পোশ মানানোর কৌশল আবিস্কারক পালকাপ্য মুনি। হাতি ধরা, পালন
ও চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক পালকাপ্য মুনিও ছিলেন একজন বাঙালি।
খ্রিস্টের
জন্মের ৫/৬’শ বছর আগে হাতি পালনের চল ব্যাপক হারে ছরিয়ে পরে।
সে
সময়ে সবথেকে কার্যকর বাহন হাতিকে কাজে লাগানোর বীর বাঙ্গালীর গৌরবের ইতিহাস।
সেসময়
আমাদের বিরাট হস্তীবাহিনী ছিল।
@
বঙ্গ রাজ্য ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে। এখানকার অধিবাসীদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে
এরা সমুদ্রের দক্ষ নাবিক ছিলেন। জৈনদের কল্পসূত্রে পুণ্ড্রবর্ধন-নিবাসী পুণ্ডরীক নামক বণিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়।
@
শ্রীলঙ্কার লোকেদের সঙ্গে বাঙালির জেনেটিক সাদৃশ্য নিয়ে যে স্টাডি হয়েছে, আমরা
অনেকেই জানি, বাঙালির প্রাচীন সমুদ্রযাত্রার উদাহরণ সেগুলো।
সেখানে সঞ্জীব বিজয়সিংহকে আধা উড়িয়া বানিয়ে ছেড়েছেন। বাঙালি হিসেব আমাদের অবশ্য
অনেকগুলো অভিযোগ করার আছে। মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তকে নিয়ে এক লাইনও নেই, অথচ রক্তমৃত্তিকার বাসিন্দা এই বুদ্ধগুপ্ত বাংলার সমুদ্রযাত্রার ইতিহাসে,
ভারত মহাসাগরের ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই
মাত্র যে তথ্যটি জানলেন- তা আমাদের জন্য বেদনার,
হতাসার আর অসচেতনতার উদাহরণ। আপনাদের মনে আছে কিনা জামদানির প্যাটার্ন হাইজ্যাক হওয়ার
ঘোটনা। জানা আছে কি চর্যাপদ নাকি উড়িষ্যার আদি নিদর্শন। এই বিষয়ে ভারত আন্তর্জাতিক
পর্যায়ে প্রচারণা করছে অনেকদিন ধরে। আমদের তরফ থেকে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা
আমার জানা নাই।
আমাদের জাতিসত্তার ভেতর দীর্ঘমেয়াদি
একটা হীনম্মন্যতার বীজ কাজ করে চলেছে। পাশ্চাত্যের আধিপত্যের ব্যাপারটাকে একেবারে
নিয়তিনির্ধারিত ভেবে নেওয়ার প্রবণতাও আছে। অথচ ইতিহাস বলে, পাশ্চাত্য এই আধিপত্য রচনা করেছে অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই সুসংগঠিত নির্মমতার মাধ্যমে।
ইতিহাসের দিকে তাই বরাবর আমাদের
তির্যক চোখেই তাকানো প্রয়োজন। উপলক্ষ কী করে
পড়ে যায়, সেখানে বহিঃশক্তির
পাশাপাশি আমাদেরও কি দায় নেই সেগুলোর খোঁজ নেওয়া? ইতিহাসকে
মোকাবিলা করতে হলে আমাদের গল্পটা আমাদেরই বলা দরকার।
অন্যরা যখন আমাদের গল্প বলবে, তখন সে গল্পের নায়ক থাকবে তারাই। এই বই আমাদের
নিজস্ব গল্পটা নিজের মতো করে বলার চেষ্টারই একটা চমৎকার উদাহরণ। একটা জাতি পরিচয়ের
মানসগঠনে এ ধরনের কাজ জরুরি।
প্লিনি
দ্য এল্ডার. - বেঁচে থাকতে হলে
আপনাকে জেগে থাকতে হবে”
###
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
Comments