অতীশ দীপঙ্করের গুরু ডাইনী
পুণ্ড্রের
পাঁচালী-২৫ (তেজস্বিনী-২য় পর্ব )
অতীশ
দীপঙ্করের গুরু ডাইনী
পুণ্ড্রের ডাইনীর কথা কি জানেন?
জানা নাই, তাই না? সত্যি ছিলও। কিন্তু
এখন কেউ জানে না। একজন
প্রখ্যাত ডাইনী ছিলেন যিনি অতীশ
দীপঙ্করের গুরুর গুরু ছিলেন। তিনি পাঁচ-ছটি বই লিখেছিলেন। তার ছিল হাজার হাজে
অনুসারী। ডাইনীদের পাশাপাশি কয়েক জন মহিলা পণ্ডিত ও তান্ত্রিক ছিলেন, যারা খবই
প্রভাবশালী ছিলেন।
চলতি
বাংলায় ডাইনী বলতেই যে ছবিটি ভাসে তাতে কোনও লোলচর্ম বুড়ি, ভীষণদর্শনা,
মন্ত্রসিদ্ধা নারীকে দেখি। কিন্তু ডাইনী আদিতে ছিল সম্মানজনক উপাধি।
তিব্বতী অর্থ জ্ঞানী- স্ত্রীলিঙ্গে ডাকিনী।
ডাইনী
বা ডাকিনী ডাকিনীর অর্থ বদলেছে। কি আশ্চর্য না?
আরও
আশ্চর্যজনক তথ্য হচ্ছে মহাস্থানে ডাকিনীর ধাপ বা ঢিবি নামে প্রত্ন স্থান আছে। এই
ধাপে যে ডাকিনী থাকতেন তিনি বিক্রমশীলায় অধ্যাপনা করতেন এবং তাঁর উপাধি ছিল
জ্ঞানডাকিনী।
ডাকিনীর
সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে যে শব্দটি, সেই যোগিনী কথাটা সেযুগের মত
তো আজও পজিটিভ অর্থে ব্যবহৃত হয়, সাধিকা অর্থে ব্যবহৃত হয়। মহাস্থানে
ডাকিনীর ধাপ ছাড়াও শিলা দেবীর প্রাসাদ, লহনার ধাপ, খোজার ঢিবি, রোজাকপুর, ষষ্ঠিতলা,
বিষমর্দন ঢিবি, মঙ্গল চণ্ডী বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত
একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এসব স্থানের সাথে
জড়িত উজ্জ্বল নারীর জ্ঞান-শক্তির বিস্মৃত ইতিহাস।
পুণ্ড্রের পাঁচালির এই তেজস্বিনী
দ্বিতীয় পর্বে বিস্মৃত
ইতিহাস আপনাদের জানাতে চাই। এই সব মন্ত্র সিদ্ধারা
আদি বাংলার মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
জ্ঞান–ডাকিনী নিগু–মা
অধ্যাপিকা নিগু-ডাকিনী
নদীর ওপর দিয়ে ভেসে চলছে মন্ত্রীর
ময়ুরপঙ্খী নৌকা। শ্রাবণ মাসের জমাট মেঘ ঢেকে রেখেছে সূর্য, কখনও হঠাৎ এক পশলা
বৃষ্টি, কখনও কামান দাগার মতো গম্ভীর গর্জন।
করতোয়ার দু পাশের তটভূমী জলরঙে আঁকা।
কোথাও জনবসতি, কোথাও নিবিড় গাছপালা, আবার মাঝে শূন্য প্রান্তর। নিছক শূন্য
প্রান্তর কোনও শিল্পীর তুলিতে ধরা পড়ে না, কিন্তু প্রকৃতির মধ্যা তা-ও ছিবি হয়ে
যায়। কখনও আলোক বিভা, কখনও মেঘের ছায়ায় ছবিগুলির রং বদলে যায়।
ময়ুরপঙ্খী নৌকাটি বড় নয়, দাঁড়ি-মাঝির
সংখ্যা সাত জন। ছাদের ওপর দুজন বল্লমধারি প্রহরী বসে আছে বর্ষাতি মাথায় দিয়ে।
নৌকার ভেতোরে দুজন যাত্রী, একজন তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে অর্ধ শয়নে রয়েছেন আরেকজন মাথা
নিচু করে বসা বালক
ভিক্ষু মঙ্গরী।
অর্ধ শয়নে থাকা বেক্তি রাজা গোপালের মন্ত্রী মস্করী।
পুণ্ড্রনগরীতে গিয়ে সহজেই খুঁজে পেলো ডাকিনীর
নিবাস। মূল নগরী থেকে তিন মেইল উত্তর-পশ্চিমে আচার্য-পণ্ডিত নিগু-মার আশ্রম।
আশ্রমের ভেতরে গিয়ে মঙ্গরী খবর দতেই মস্করীকে ভেতরে নেওয়ার জন্য দুজন ভিক্ষু এলো।
জ্ঞান-ডাকিনী-নিগু
তখন পুথি পরছিলেন। তিনি মস্করীকে
দেখে পুথিটি পাসে রেখে দিলেন এবং স্নিগ্ধ হাসলেন। মস্করী বলল, বাঙ্গলায় প্ৰতিভাশালিনী রমণীদের এক সম্মেলনের
আয়োজন করেছেন রাজ। আগামি মাসে রাজসভায় অনুষ্ঠিত হবে। রাজ কুমারী মায়া বাঙ্গলায়
কবিতা লেখে রাজসভায় উপস্থিত থাকিবেন।
জ্ঞান-ডাকিনী
বলল, শুধু কি নারীদের নিমন্ত্রণ করা হচ্ছে?
গুরুপুল
মস্করী বলল,
আমরা যে শুধু নারীদের নিমন্ত্রণ করেছি, তা নয়,
অনেক পুরুষকেও নিমন্ত্রণ
করেছি।
সব
কথাতেই সায় দিলেন জ্ঞান-ডাকিনী-নিগু। মস্কারীর বলল, আপনাদের মধ্যে আর
কে কে প্ৰতিভাশালিনী রমণী আছেন, জানতে পারলে, তাদেরকেও নিমন্ত্রণ করি।
জ্ঞান-ডাকিনী
বললেন, আপনি যখন এ অধমের সাহায্য নিতে এত দুর এসেছেন, তখন আমি আমাদের দলের ভিক্ষু
ও ভিক্ষুণীদের নিয়ে যাবো ও জাতে তারাও পরীক্ষা দেন।“আপনার জয় হউক”-
বলে মস্করী প্ৰস্থান করলেন।
ইতিহাসের
একজন বিখ্যাত ডাকিনীর কথা এভাবেই শুরু করলাম। বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত
অধ্যাপক নাঢ়–পা (বিকল্পে নাড়োপা), ইনি চুরাশি সিদ্ধাচার্যের
অন্যতম, এবং ইনি অতীশ দীপঙ্করের শিক্ষক ছিলেন, এই নাঢ়ের স্ত্রী ছিলেন নাঢ়ী। তিনি এমনকি নাঢ়ের থেকেও বেশি জ্ঞানী ছিলেন
বলা হয়। এই নাঢ়ীও অধ্যাপনা করতেন, এবং তাঁর উপাধি ছিল
জ্ঞানডাকিনী। নাঢ়ীর অন্য নাম ছিল নিগু, এবং এই জ্ঞান–ডাকিনী নিগু–মা।
এই
নাঢ়-নাঢ়ীর নামেই তাঁদের শিষ্য-শিষ্যারা নেড়ানেড়ি বলে পরিচিত হয়েছিল বাঙালিদের
মধ্যে, এঁরা দুজন গুরু হিসেবে এতটাই বিখ্যাত হয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে বজ্রযান থেকে
সহজযানের একটা অনায়াস গতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কারণ
নেড়ানেড়িরা সহজযানী।
নাঢ়ী
পালযুগের একজন প্রখ্যাত মহিলা চর্যাকার। সিদ্ধাচার্য নাড়োপা ছিলেন তাঁর স্বামী।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে নাঢ়ী ও নাড়োপার শিষ্যরাই পরে বাংলায় নেড়ানেড়ি বলে পরিচিত
হয়।
জ্ঞান-ডাকিনী যে বইগুলি রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে ছিল উপায়
মার্গচণ্ডালিকা ভাবনা, চক্রসম্বরমণ্ডলবিধি, প্রণিধান রাজ, মহামরজ্ঞান। নিগু ডাকিনী চর্যাপদ রচনা
করেছেন। তিব্বতী উৎস থেকে জানা যায়, নাঢ়া এবং নিগুমা ৭৬০খ্রি.-এর দিকে
গোপাল-ধর্মপালের রাজত্বকাল(৭৫০খ্রি. ৭৭০খ্রি.৮০৬খ্রি.)-এ স্বকীয় সাধনসিদ্ধিতে
দীপ্তিমান ছিলেন। তিনি সাঙ্গীতিক ভাব-ঐশ্বর্য ও মোহময় ছন্দ-শিল্পায়োজনে বরেন্দ্রী
জনতার মনোযোগ আকর্ষণ ক’রে ছিলেন।
নাঢ়া
পণ্ডিতের ইতিহাস প্রায় বিস্মৃত, হরপ্রসাদ না লিখলে আধুনিক বাঙালি জানতেও
পারত না। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জানান, বাঙালিদের মধ্যে গুরু হিসেবে বিখ্যাত
হয়েছিলেন। কিন্তু মধ্যযুগে তুর্কি আক্রমণে এবং তাদের ধ্বংস লিলায় সমস্ত লাইব্রেরি
ধ্বংস হয়। সেই সাথে আমাদের গৌরব হারীয়ে যায়।
এই
নাঢ়া এমনই কিংবদন্তী যে অদ্বৈত আচার্যকে চৈতন্য নাঢ়া বলে সম্বোধন করেছেন। সরহপা
তাঁর সঙ্গীত গ্রন্থগুলি হ’লো: ‘বজ্রগীতি’, ‘চিত্তকোষ-অজবজ্রগীতি’, ‘ডাকিনী-গুহ্য-বজ্রগীতি’, ‘দোহাকোষ-উপদেশগীতি’,
‘চর্যাগীতি-দোহাকোষ’, ‘সরহপাদ-গীতিকা’ ইত্যাদি।
মহাস্থান
জাদুঘর থেকে ২/৩ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে সেকেন্দ্রাবাদ মৌজা এলাকায় অবস্থিত। ইটের
প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। মহাস্থান জাদুঘরের সকারী কাস্তাদিয়াম কাসটাডিয়াম
এস এম হাসনাত জানান, উৎখনন হয়নি। মহাস্থান জাদুঘরের খুব কাছে শিলা দেবীর আশ্রম। গড়ের
পূর্বপাশে রয়েছে করতোয়া নদী এর তীরে ‘শীলাদেবীর ঘাট।
ডাকিনি-তন্ত্রে সিদ্ধা দেবী শিলা
মানুষ
বাঁচে তার মহৎ কাজে। পরাক্রমশালী রাজা পরশুরামকে মানুষ মনে রাখেনি। মনে রেখেছেন
তার বোন বা কন্যা শিলা দেবীকে। পৌষ পারবিনে তার নামে পূজা হয়। সেই পূজা উপলক্ষে করতোয়া
নদীর তীরে
‘শীলাদেবীর ঘাটে মেলা বসে। লক্ষ্য লোকের মুখরতায় থাকে দিনমান। ঐতিহ্যবাহী
মেলা ছারাও বার বছর অন্তর মহাস্নান সনাতন ধর্মাবলম্বী কাছে অত্যন্ত পুন্নের।
ডাকিনি-তন্ত্রে
সিদ্ধা দেবী শিলা গ্রামীণ সমাজে বৈদ্যের ভূমিকা পালন করতেন। বালামুসিবত দূর করতেন।
প্রচলিত আছে শীলাদেবী ভূত বা ডাকিনী, নানাপ্রকার জন্তু জানোয়ারের হাত থেকে রক্ষায় যন্ত্র
(যন্ত্র হল মোহিনী প্রতীক) ব্যাবহার করতেন।
শিলা
দেবী ডাকিন্যাদির আছর থেকে রক্ষার নির্ভুল যন্ত্রটার চিত্র হচ্ছে-দুইটা বৃত্ত এঁকে
তাতে চারটি মায়াবীজ লেখে তার বাইরে দুইটী চতুষ্কোণ আঁকতে হয়। এই যন্ত্রটা ধারণ
করলে আর ডাকিন্যাদির ভয় থাকে না, এমন কি, এটা বন্ধারও পুত্র জন্ম দিতে পারে।
এখনও অনেক তান্ত্রিকের কাছে যন্ত্রের চিত্র দেখা
যায়।
একটা
সময় ছিল যখন গ্রাম বাংলায় চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া যেত না। তাই গ্রামীণ সমাজ কবিরাজ-তান্ত্রিক
নির্ভর ছিল। সেই প্রেক্ষিতে শীলাদেবী মন্ত্র পড়া তেলিনির তেল রোগের চিৎকসা
দিতেন-
“তেলিনীর তেল, পলার চৌরাশী সহস্র ডাকিনার তেল। এ
তেলের ভার মুই তেল পড়িয়া দেম।
মৌখিক
ইতিহাস থেকে জানি, শাহ
সুলতান (বখলী) মাহীসওয়ারের সাথে রাজা পরশুরামের যুদ্ধ হয়।
সেই যুদ্ধে শীলাদেবী তন্ত্র-মন্ত্রের ব্যাবহার করেছিলেন কিন্তু পীর বখলীর কৌসল্যার কাছে শীলাদেবীর তন্ত্র পরাজিত হয়।
রাজা পরশুরাম
যুদ্ধে পরাজিত হলে শীলাদেবী তখন করতোয়ায় আত্মবিসজর্জন দেন। যে
স্থানে শীলাদেবী আত্মহুতি দিয়েছিলেন সেখানে পৌষ সংক্রান্তি ও জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা
দশমীতে স্নান হয়।
বাঙলার প্রাচীন সমাজে নারীকেন্দ্রিক
তান্ত্রিক সাধনায় শীলাদেবী ছিলেন ডাকিনি-তন্ত্রে সিদ্ধ। আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন
দুর্গনগরী মহাস্থানগড়ের ইতিহাস লেখেন জয়ী মুসলমানদের হাতে। সেখানে রাজা পরশুরামকে অত্যাচারী আর শীলা দেবীকে নেতিবাচক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
তা
সত্তেও অতি প্রাচীনকাল থেকে শীলাদেবীর আত্মবিসজর্জনের স্থান তীর্থ স্থান হিসেবে
বিবেচিত হয়ে আসছে। যেখানে শুধু হিন্দুরায় আসে না অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা উপস্থিত
থাকে।
আবহমান
বাংলার নিম্নবর্গীয় মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। প্রেতের
আছর থেকে শুরু করে রোগব্যাধীর নিরাময় এমন কি সাপে কাটলেও তার প্রতিকারের জন্য
আলাদা আলাদা তন্ত্রবিদ্যার আশ্রয় নিত এরা, আর এইসব কাজ করার জন্য আলাদা
আলাদা তান্ত্রিক ছিল।
সত্যি
কথা বলতে কি,
আর্য-অনার্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও বৌদ্ধধর্মের গতি প্রকৃতি পাল্টে
যাওয়ার পেছনে তন্ত্রশাস্ত্র একটি অনুঘটক। তবে এই অঞ্চলে কত জন নারী ডাকিনি-তন্ত্রে
ভূমিকা রেখেছেন তা উদঘাটন করা অসম্ভব।
তবে
আমার পক্ষে যেটা সম্ভব, তা হোল পুণ্ড্রের ঠিক কোথায় ডাকিনীদের আশ্রম গড়ে উঠেছিল।
যাদের উচ্চ মার্গীয় সাধনায় তন্ত্র বিদ্যা ভারতবর্ষে অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
কিংবদন্তী আশ্রিত বিস্মৃত কতিপয় নারী
পুণ্ড্রের
ডাকিনীদের আশ্রম গড়ে উঠেছিল মূল নগর থেকে একটু দূরে। গড় থেকে ২/৩ কিলোমিটার
উত্তর-পশ্চিমে। বর্তমানে সেকেন্দ্রাবাদ মৌজায়। এখানে প্রসিদ্ধ নিগু-মা ছারাও
লহনাসহ ১০টি ঢিবি তান্ত্রিক/যোগিনীর আশ্রম বলে পরিচিত। এসব ঢিবির কয়েক মাইলের
মধ্যা গোকুল ও হরিপুর গ্রামে ডাকিনীদের (খোজার ঢিবি) রোজাকপুর অবস্থিত।
লহনা
নামে আকর্ষনীয় এক নারীর কিংবদন্তী অনুসারে বিস্মৃত ডাকিনীর কথা জানতে পারি। লহনার
ধাপ বা লহনার ঢিবি মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে সেকেন্দ্রাবাদ
মৌজায় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত
একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। লহনার ঢিবির পূর্বে
দৈর্ঘ্য ছিলো ৭২ মিটার,
প্রস্থ ৪২ মিটার ও উচ্চতা ৬ মিটার।
বর্তমানে
এটির দৈর্ঘ্য ৬০ মিটার,
প্রস্থ ৫৪ মিটার ও উচ্চতায় ৩ মিটার।
এই
ঢিবির প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যাবে ইমারতের উৎখনন করলে।
অন্যান্য
ঢিবির মতো এই ঢিবিটিতেও ইট চোরের কারণে বিপর্যয়ের চিহ্ন বিদ্যমান।
স্থানীয়
মৎস্য শিকারি জীবীদের মুখে মুখে একটি মন্ত্র উচ্চারিত হতে শুনি।
-
কার মঙ্গে অমুকারে ভার। আড়দলশূলে যক্ষ বক্ষিণী দৈত্য দৈত্যান ভূত ভূর্ত গ্রেতা
প্রেতী দানব দানবী নিশাচের|
মৎস্য
শিকারি জীবীদের স্থানীরা ডাকে ‘হাড়ি’ নামে। এই হাড়ি সম্প্রদায় নারীকে দিয়েছে গুরুর
মর্যদা। এটি তারা গ্রহণ করেছে বৌদ্ধ সহজিয়া তত্ত্ব থেকেই। এই প্রাধান্য তান্ত্রিক লহনার
ঐতিহ্যাশ্রয়ী। দেবী লহনার হচ্ছেন গুরু সকল নারীই কোনো না কোনোভাবে দেবীর গুনাবলী
সম্পন্ন। এই গুনাবলীতে ভাগ আছে সকল নারীর। তাই
কোন না কোন ভাবে সকল নারীই গুরু।
বেহুলার বাসরঘরখ্যাত গোকুল মেড়
লখিন্দর-বেহুলা
পালা ছাড়াও রাধা-কৃষ্ণের কীর্তন, গাজী
কালু ও চম্পাবতী কন্যা নিয়ে গাজীর গান, সংগীতসহ নৃত্য,
পাঁচালি, পুঁথিপাঠ এবং লৌকিক উপাখ্যান বা গাথা
নিয়ে রামলীলা, কৃষ্ণলীলায় ইতিহাস থাকলেও কৌতূহল নিবৃত্ত
করার মতো তথ্য পাওয়া যায়না।
মানুষ
আগ্রহী হলেও সচরাচর আকরগ্রন্থ পাওয়া যায় না। বিপুল, বিশাল, বিস্তৃতি ইতিহাস আমাদের
ভাষায় বিরল। সেই সাথে ইতিহাস বর্ণনাকারীদের বহুধাবিভক্ত চর্চা ও অভ্যাসের কারণে সাধারণ
পাঠক বিভ্রান্ত হয়।
বিভ্রান্তির
মাত্রা চরম পর্যায়ে। বহুল কিংবদন্তী আশ্রিত বেহুলা লখিন্দরে কাহিনী কথায় ধরা যাক। সাধারণ মতে এক সাধক নাড়ি
করতোয়া নদী পথে দেবতাদের রাজ্যে পৌছায়। সাধক সেই নারীর বেহুলার বাসরঘরখ্যাত গোকুল মেড় এলাকায়।
অন্য মতে দ্বিতীয় তাম্রশাসন দ্বারা মহারাজা তৃতীয় বিগ্রহপাল কর্তৃক
প্রথম মহীপালের তাম্রশাসনে যে লক্ষ্ণীন্দর দূতক এর নাম উল্লেখ আছে সেই সুত্র ধরেই
এ অঞ্চল বহুল প্রচার লাভ করেছে ‘বেহুলা লখীন্দরের’ উপাখ্যান। ঐ সময় ঘোড়াঘাটের উত্তরে
নবাবগঞ্জ থানা সীমানায় মাহমুদপুর ইউনিয়নের চকজুনিদ পালদের একটি টাকশাল ছিল মর্মে
জানা যায়। সেখানে বেহুলার বাসর ঘর নামে উল্লেখ আছে।
যাই হক চকজুনিদ এলাকায় প্রচলিত মজার কথা জানালেন স্থানিয় গণমাধ্যম কর্মী।
প্রচলিত কথাটা এমন, করতোয়া আর সুবিল খালের সঙ্গমে নিগু ডাকিনীর খোলা চুল
মেঘলা বাতাসে উড়বে,
তখন নাড়োপা মন্ত্র উচ্চারণ করবেন, তখন
ভাসুবিহার আর কালিদহ নতুন করে জেগে উঠবে সমস্ত ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে।
এই
জেগে ওঠাটা দরকার। কেননা আর্যদের হিংসাত্তক বর্ণনায় পুণ্ড্র তথা বঙ্গের তেজস্মপন্নাদের
রাক্ষসী-অসুরিনী-দানবী উপাধি দিয়ে ছোট করে দেখানো হয়েছে।
পুণ্ড্রের রাক্ষসী-অসুরিনী-দানবী
বৈদিক
যুগে আর্যরা বিহারের মিথিলা পর্যন্ত দখল করলেও শেষ পর্যন্ত তারা পূর্ব ভারতের
পুণ্ড্রবর্ধনের অসুর জাতির কাছে বারবার পরাজিত হতে থাকে। পরাজয়ের কারণগুলির মধ্যে
একটা কারণ হোল, এখানকার নারীরা পুরুষের সাথে সমান তালে লড়ায় করত।
বগুড়ার
করতোয়ানদী কূলে অবস্থিত মহানগড়ের ধ্বংসাবশেষই এ সত্যের প্রকৃত প্রমাণ। তাই দেখা
যায়, অসুর জাতির গর্বিত কোল, শরব, পুলিন্দ,
ডোম, চন্ডাল(নম:), পৌন্ড্র,
কৈবর্ত্য, ইত্যাদি সম্প্রদায় সমূহ সাহসী
নারীরা শরধনু নিয়ে শিকার ও যুদ্ধ করতে জানত।
রাক্ষস
হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী একপ্রকার দানবীয় প্রাণী। স্ত্রী রাক্ষসকে
রাক্ষসী বলা হয় এবং মানুষের রূপ ধরা রাক্ষসীকে বলা হয় মনুষ্য-রাক্ষসী। রাক্ষস-রাক্ষসীরা
মানুষ ভক্ষণ করার কথাও বর্ণিত আছে। কখনো কখনো অসুরী এবং রাক্ষসীকে প্রায়শই
সৈনিকের রূপে দেখানো হয়েছে। পরবর্তীতে, কিছু রাক্ষসী অত্যন্ত বল
অর্জন করে নাইকা বা প্রতিনায়িকা হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিল। রাক্ষসদের সঙ্গে মানবদের
বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হত৷ মহর্ষি পুলস্তর পুত্র বিশ্রবা রাক্ষসী কেকশীকে বিবাহ
করেন৷
অতীত
বঙ্গ রাজার প্রাসাদে রাক্ষসী থাকত (এখানে রাক্ষসী মানে কোন বৈদ্য
বা সার্জন মেনে নিতে হবে)। নাম ছিল তার জরা।
সংস্কৃতে
জরা শব্দের মানে হছে বৃদ্ধাবস্থা। এই রাক্ষসীও অনেক
জ্ঞানের ভারে বৃদ্ধা হয়েছিলেন।
হে
নারি! যে মাংসভোজী রাক্ষস অথবা যে রোগ বা উপদ্রব তোমার যোনি আক্রমণ করে, রাক্ষসনিধনকারী অগ্নি স্তোত্রের সাথে মিলিত হয়ে সে সমস্ত বিনাশ করুন। (ঋক-১০/১৬২/২)।।
মহাভারতের
পাণ্ডব নায়ক ভীম হিড়িম্বা নামে এক রাক্ষসীর স্বামী ছিলেন। হিড়িম্ব একজন রাক্ষস
ছিল। সে ছিল মানব ভক্ষণকারী। রাবণবধের পরে যুদ্ধক্ষেত্রে আগত মন্দোদরী বিলাপ
করিয়া বলিয়াছে যে,
“এই স্থানে আমাকে অবগুণ্ঠনহীনা দেখিয়৷ তুমি ক্রুদ্ধ হইতেছ না,
আমি পদব্রজে এই স্থানে আসিয়াছি, তোমার প্রিয়
স্ত্রীগণ অবগুণ্ঠনবিহীন হইয়া পুরীর বাহিরে আসিয়াছে, ইহা
দেখিয়া কেন ক্রোধ করিতেছ না?” ৬|১১৩
সত্য
যুগ-এর এসব কাহিনী থেকে তারকা, সোমালি, কৈকসী, পুষ্পোৎকটা আর রাকা রাক্ষসী পরিচয়
জানি। কৃষ্ণ বেসকয়েক জন রাক্ষসী বধ করেন গকুলে। এছাড়াও দিতির পুত্ররা দৈত্য এবং অদিতির
পুত্ররা আদিত্য,
দেব বা সুর কাহিনী পাই।
অমিত
তেজসম্পন্না সংগ্রামী স্বপ্নবতি কর্মিষ্ঠা নারীদের আর্যরা রাক্ষসী-অসুরিনী-দানবী বলে
গালি দিয়েছেন। তাদের সেই অপবাদ মানব মস্তিস্কে গভীরতম ক্ষত তৈরি করেছে। যার
প্রভাবে ডাইনীকে আজ জন শত্রু ভাবা হয়। মাঝে মাঝে খবরে দেখি ডাইনী অপবাদে নারীকে
পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
আর্যদের
লেপে দেওয়া কালিমা মুছে নারীদের ত্যাজে ইতিহাস লেখা জরুরী। সময় বয়ে যায়।
ডাইনী অপবাদে নারীদেক হত্যা
সভ্যতা
প্রবর্তনের সমসাময়িক কালে এই অসুর জাতির এক বৃহত্তম অংশ পূর্ব ভারতে এক নতুন
সভ্যতা প্রবর্তন করেন। সেই সভ্যতার নির্মাণসঙ্গিনী নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি
ব্যাপারটি
রীতিমত কৌতুককর ও ভয়াবহ।
গ্রামীণ
মানুষ মনে করে, ডাইনীরা নানা ছলাকলা জানে। তারা ক্ষতিকারক মন্ত্র জানে। এরা বাণ
মেরে শত্রুকে প্রচন্ড অসুস্থ করে ফেলতে পারে। এমনকি মেরেও ফেলতে সক্ষম। তাই কোন রোগীর
রোগ না সারলে ডাইনীদের সন্দেহ করা হয়।
এই
ধরনের সন্দেহ বসত ডাইনী অপবাদে নারীদেক হত্যা ঘটনা সমাজে বিরল নয়। নির্যাতনের
নিষ্ঠুরতা প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ডের সাধারণ অর্থনীতির সাথে এত গভীরভাবে জড়িত ছিল যে
একদম সাথে সাথেই নির্যাতন সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
প্রাচীন
কালে ডাকিনী বা ডাইনী নারী যে সমমান পেত মধ্য যুগে এসে তারাই অর্থহীন অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। এই পরিবর্তিত মানুষিক অবস্থার
অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ব্যাখ্যা আছে। মনবিজ্ঞানীদের মতে, যেহেতু -শুরু থেকেই এ
বিদ্যার ওপর পুরুষদের তুলনায় নারীদের বিশ্বাসটাই ছিল বেশি। এ কারণে বিভিন্ন সমাজে
নারীদেরকেই এ বিদ্যা চর্চা করতে দেখা গেছে। এ কারণে অনেক সময় তাদের ডাকিনী, যোগীনি
নামেও ডাকা হয়েছে।
ইতিহাস
ও সমাজতত্ত্বের নিরিখে আমাদের দেশের তন্ত্র ও শক্তিসাধনার ইতিবৃত্ত এখনও প্রকৃত
অধিকারীর মনোযোগ পায়নি। যার কারণে নারীদের এই জাতিয় অপবাদ দিয়ে নির্যাতনের ঘটনা
এখনো ঘটে চলছে। এমন এক লোমহর্ষক কাহিনী মস্থান এলাকায় শুনেছি।
খুলনার ঢিবি
বছর
দশেক আগে খুলনার ধাপ নামে এক ঢিবিতে এক মাসের বেবধানে দুজন কিশোরের লাশ পাওয়া যায়।
জানা যায়, রক্ত শূন্যতার কারণে ওই কিশোরদের মৃত্যু হয়েছে।
দুটি মৃত্যু সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে
পরে। হাটে-মাঠে-ঘাটে ছড়াতে থাকা সংবাদের ডালপালা গজায়। সপ্তাহ গড়াতে না গড়াতে
মাস্তানের হাটে এক হাটুরে জানায়, খুলনার ঢিবির ঝপা থেকে যে রাখাল বালক প্রথম
লাস দেখে সে তার আপন ভাতিজা।
ভাতিজা
তাকে বলে, লামারী নামের এক মহিলা
দুজন কিশোরকে মেরেছে। ভয়ে এত দিন সে কাউকে বলেনি। কারন লামারী তাকে বলেছে, কাউকে বললে, তার বংস শুদ্ধ বিনাশ করবে।
মাস্তানের ভরা হাটে সবাই বলাবলি করছে,
লামারী
একটা ডাইনী। হাটুরেরা আরও বলছে যে, তন্ত্র সাধনায় কিশোর বয়সের মানুষে রক্ত লাগে। সেই হাটুরে তার ভাতিজার বরাদ দিয়ে বলে, লামারী একাই কিশোর দুজনের রক্ত পান করে এবং রক্তপানের ফলে
তাঁর গাত্রবর্ণও রক্তের মতো লাল হয়ে যায়।
স্থানীয়দের
নিপাট বিশ্বাস এই ডাইনী বেছে বেছে কিশোরদের পান করে। তাই সব কিশোর ডাইনীর হাত থেকে সুরক্ষার তান্ত্রিকের
শরণাপন্ন হল। দেখা গেল তারা তান্ত্রিকের কাছ থেকে ‘রাম কবচ নিয়েছে। গলায় পরেছেন অষ্টধাতু রক্ষাকবচ। তাঁর বিছানার নিচে সরিষা দানা,
দরজায় বুলিছে লোহার শিকল। ডাইনীরা সরিষা এবং লোহা ভয় পায়। তারা আগুনও ভয় পায়।
ডাইনীর
বিচার হওয়া দরকার। তান্ত্রিক
হরিশংকর বিচার
করবেন। স্থানিয় জনপ্রতিনিধি বিচারের দিন খিন এলান করে। সেই থেকে হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় লামারীকে মণ্ডপের এক প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে। প্রকোষ্ঠের বাইরে আক্রসি
জনতার ভীর।
সেই
ভীর ঠেলে তান্ত্রিকের সহকারী হরান মণ্ডপের প্রকোষ্ঠে আসাযাওয়া
করতে হচ্ছে। হরানকে বলা হয়েছে
সে যেন
জনতাকে শান্ত রাখার
চেষ্টা করে।
লামারীর পাহারায় অস্ত্ৰধারী গ্রাম পুলিশ
দেওয়া হয়েছে।
তান্ত্রিক-জননেতা
চলে এসেছে। বেলা দ্বিপ্রহর। শাস্তিপ্রদান অনুষ্ঠান দেখার জন্যে
উৎসুক মানুষের ঢল দেখা যাচ্ছে। তাদের চোখে কৌতূহল এবং শঙ্কা। লামারিকে হাতে-পায়ে শিকল বাধা অবস্থায়
বিশাল
মঞ্চে তোলা হয়েছে।
লামারী চিৎকার করে বলল,
আমি ডাইনি নই... মা কালির দিব্বি। আমি কাউকে...
লামারীর কথার উত্তর
দেবার প্রয়োজন মনে করল না কেউ। তান্ত্রিক হরিশংক লামারিকে ‘শুদ্ধ করতে’ মল খেতে বাধ্য করল। এরপর তাঁকে নগ্ন করে পিটিয়ে মেরে ফেলে। মেরে ফেলার আগে
আরেকটা দরকারি কাজ সেরে নেওয়া হল। গরম লোহার শিক দিয়ে ডাইনির চোখ উপড়ে নিয়েছিল হরান। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার
পর পুড়িয়ে ফেলার নিয়ম।
নিয়মটা
প্রমাণ নষ্ট করার কারণে নাকি অন্য কারণে বলা মুশকিল। এ নিয়ে কারো মাথা বেথা নেই।
এক পক্ষীয় বিচারে মধ্য বয়স্কা দরিদ্র নারীর ডাইনী অপবাদে লোমহর্ষক কাহিনী গ্রামের মানুষের
মুখে আজও ফেরে।
নারীর
প্রতি যে নৃশংস হত্যা ঠাণ্ডা মাথায় উদ্ভাবন ও প্রয়োগ জেনে কে না কাঁপে? বলতে হয় আমাদের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক পরম্পরা।
পুণ্ড্র থেকে কামাখ্যা জ্ঞানী থেকে পিশাচী
বৃষ্টি-ধোয়া
অরণ্য আর পাহাড়ে ঘেরা কামাখ্যায় পৌঁছতে গেলে ডিঙোতে হয় একটি সেতু। এই সেতু পেরলেই
মন্দির। কিংবদন্তি আর প্রভূত পরিমাণে পুরাতত্ত্বের নিদর্শন-সমৃদ্ধ মন্দির। ঢুকলেই
গা ছমছম করে উঠবে,
এমনটাই জানাচ্ছেন কামাখ্যা থেকে ঘুরে আসা মনুষজন।
কামাখ্যায়
প্রবেশের পর থেকেই নাকি ছেঁকে ধরে গল্পরা। বংশ পরম্পরায় এখানকার তান্ত্রিকরা
একদিকে যেমন মারণ-উচাটন-বশীকরণ-জাতীয় অভিচার ক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন, তেমনই
তাঁদের চিকিৎসায় বহু মানুষ দুরারোগ্য অসুখ থেকে মুক্ত হয়েছেন। শহরের কিংবদন্তি
প্রবেশ করা মাত্র শোনাতে থাকবে, উড্ডীয়ানতন্ত্রের কথা। যার
সঠিক প্রয়োগে মানুষ উড়তে সক্ষম হয়।
ব্রহ্মপুত্রকে
ছুঁয়ে রেখেছে মায়ংয়ের পাথুরে তীর। এই পাথরের গায়েই রয়েছে অসংখ্য দেব-দেবীর মূর্তি।
সিঁদুর-চর্চিত মহাকায় কিছু মূর্তির সামনে দাঁড়ালে ভুলে যেতে হবে ২১ শতক, ভুলে
যেতে হবে প্রগতির মন্ত্র। একটু হাঁটাহাঁটি করলেই এমন এক জায়গায় পৌঁছে থমকে
দাঁড়াতে হয়, যেখানে নাকি কয়েক দশক আগেও নরবলি হয়েছে।
গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলাই যায়। তাঁরাও তাঁদের গ্রামের ঐতিহ্য নিয়ে
গর্বিত।
আবহমান
কাল ধরে ভারতের একটা বড় অংশের মানুষ বিশ্বাস করে এসেছেন, কামরূপ-কামাখ্যা
হল এমন এক দেশ, যেখানে আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যাদু। না,
সেই জাদুর প্রকৃতি আমাদের গ্রাম-শহরের মঞ্চে দেখা জাদুর মতো
একেবারেই নয়।
এক
সময় পুণ্ড্র আসাম এক দেশ ছিল। কামরূপ রাজত্ব খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সাল থেকে ষোড়শ
শতাব্দী পর্যন্ত আসাম,
পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ, বিহার, ভুটান ও বাংলাদেশের কিছু অংশ জুড়ে ছিল।
দেশ
এক হলেও দুই অঞ্চলের ডাকিনীদের পরিচয় ভিন্নতা পাই। পুণ্ড্রে ডাকিনীরা প্রশংসা পেতো
আর আসামের কামাখ্যায় ডাকিনীরা ভয়ার্ত পিশাচী বলে আখ্যা পায়। বিস্ময়কর এই
পার্থক্যের কারণ কি?
কামরূপ-কামাখ্যা
বা আসামের প্রাচীন নাম ‘প্রাগজ্যোতিষপুর’। মহাভারতে উল্লিখিত প্রাগজ্যোতিষপুরের
রাজা মায়াবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। কথিত আছে এখানকার তান্ত্রিকরা নাকি একসময়ে
রুখে দিয়েছিল ইসলামী আক্রমণ। এঁদের কারণেই প্রাগজ্যোতিষপুর-কামরূপ-কামাখ্যা বা
আসাম ছিল অপরাজেয়।
কামরূপ
কামাখ্যা,
নামটা যে কোনও বাঙালির খুব পরিচিত। অন্য কোনও কারণে নয়, এই জনপদ নিয়ে বিবিধ কল্পকাহিনী রয়েছে। কথিত আছে কামাখ্যা মন্দিরে
ডাকিনী-যোগিনী থাকে যারা যাদু বিদ্যায় পারদর্শী। এখানে কোনও পুরুষ কোনক্রমে
পৌঁছাতে পারলে তার আর নিস্তার নেই, কোনওভাবেই সে জাদু ভেদ
করে বের হয়ে আসতে পারেনা। সারাজীবন তার সেই সব যোগিনীদের দাস বা যৌন দাস হয়ে থাকতে
হয়। আর কেউ যদি সৌভাগ্যক্রমে সেই মায়াপুরী থেকে বের হয়ে আসতে পারে তাহলে ফিরবে
ঠিকই কিন্তু যৌবন তার কামরূপ কামাখ্যায় রেখে আসতে হবে।
এমনও
অনেকের কাছে শুনেছি যে পুরুষরা অনেক সময় নিছক কৌতুহলবশত বা তন্ত্রমন্ত্র শেখার
জন্য যায়। কিন্তু সেখান থেকে মন্ত্র শেখার পর বের হবার রাস্তা আর খুঁজে পায়না। বহু
সাধনার পর হয়তোবা পথ খুঁজে বের হয়ে আসতে পারে কেউ তাও পারেনা। যারা বের হয়ে আসেন
তারা অনেক বড় তান্ত্রিক হয়ে যান সাধনা বলে।
Dakini
Vidya ডাকিনী সাধনা হচ্ছে চেনাবতী ডাকিনী সাধনা। এটি হচ্ছে আসামের
প্রাচীন ডাকিনী সাধনা বা ডাকিনীবিদ্যার মধ্যে অন্যতম। আর পুণ্ড্র-বঙ্গে
বজ্রজানিদের প্রধান দেবী তারা। ইনি ছিলেন বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বদের স্ত্রী।
মাতঙ্গিনী পিশাচী ডাকিনী যোগিনী-প্রমূখ তুচ্ছ দেবীও বজ্রযানীদের আরাধ্য ছিল।
বজ্রযানীগণ বিশ্বাস করতেন দেবদেবীদের করূণা ভিক্ষা করে লাভ নেই। এদের বাধ্য করতে
হবে।
বাঙ্গালী নারীর গৌরব যাত্রা...
পুন্ড্রবর্ধন
নগরের নারীদের শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। য়ুয়ান-চোয়াঙের
কালে পুণ্ড্রবর্ধনে বিশটি বিহারে তিন
হাজারের উপর শ্রমণ
ছিল। এসব বিহারে সাত’শ মহাযানী শ্রমণ এবং পূর্ব-ভারতের অনেক খ্যাতনামা আচার্যের
অধিষ্ঠান ছিল সংঘারাম।
অধ্যয়ন-অধ্যাপনা
তো করতেনই,
তাহা ছাড়া মহাযান ন্যায় ও দর্শন, ব্রাহ্মণ্য
তীৰ্থিক শাস্ত্রাদি, ব্রাহ্মণ্য তন্ত্র, শব্দবিদ্যা; ব্যাকরণ, জ্যোতিষ
প্রভৃতির অধ্যয়ন-অধ্যাপনাও হইত। পুঁথি নকল ও অনুবাদ করা, বৌদ্ধ
বজ্রযানী-তান্ত্রিক দেবদেবীর ছবি আঁকা (ফা-হিয়েন এই ধরনের ছবি আঁকাও অভ্যাস
করিয়াছিলেন তাম্রলিপ্তির বিহারে) প্রভৃতিও বিহারের ভিক্ষুকদের অন্যতম অনুশীলনের
বিষয় ছিল। প্রত্যেক বিহারের ছোট বড় গ্রন্থাগারও ছিল।
চিনা
প্ররিব্রাজের তথ্য মতে পুণ্ড্রবর্ধন-রাজধানীর প্রায় তিন মাইল দক্ষিণে ছিল পো-চি-পো
বিহার; সুপ্ৰশস্ত ও আলোকজজুল ছিল ইহার অঙ্গন, সুউচ্চ ছিল
ইহার মণ্ডপ ও চূড়া। মহাস্থান-সমীপবর্তী ভাসূ-বিহারের ধ্বংসাবশেষই বোধ হয়
য়ুয়ান-চোয়াঙ-বর্ণিত পো-চি-পো বিহার।
এ-অনুমানও
খুব অযৌক্তিক নয়;
নালন্দা-মহাবিহারের ইতিহাস এবং প্রত্নসাক্ষ্যই তার প্রমাণ। ই-ৎসিঙের
প্রায় সমসাময়িক: আচার্য বন্দ্য সংঘমিত্রের একটি বিহার ছিল, এ-খবর
পাওয়া যায় দেবখঙ্গের আশ্রফপুর লিপিটিতে।
য়ুয়ান-চোয়াঙের
কালে পুণ্ড্রবর্ধন ছাড়াও সমতটে ত্রিশটি, তাম্রলিপ্তিতে দশটি, কযঙ্গলে ছয়-সাতটি এবং কর্ণসুবৰ্ণে দশটি বিহার ছিল। সপ্তম শতকে যখন য়ুয়ান-চোয়াঙ কযঙ্গল,
পুণ্ড্রবর্ধন, কামরূপ, সমতট, তাম্রলিপ্তি এবং কর্ণসুবর্ণ ভ্ৰমণে এসেছিলেন তখন বৌদ্ধ, নিগ্ৰস্থ ও ব্রাহ্মণ্য
শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার হচ্ছিল। এই সব জনপদের লোকদের জ্ঞানস্পাহা ও জ্ঞানচর্চার তিনি
ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন।
মনে হয়, ষষ্ঠ-সপ্তম
শতকের আগে বাঙালী পণ্ডিত-সমাজ সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রাপধারার সঙ্গে ভালো করে আত্মীয়তা স্থাপন করতে
পারেনি। চেষ্টাটা
বোধ হয় আরম্ভ
হয়েছিল আরও কয়েক
শতাব্দী আগে
থেকে এবং বৌদ্ধ
সংঘারাম এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মকেন্দ্রগুলি ক্ষুদ্র বৃহৎ শিক্ষায়তন হিসেবে গড়ে
উঠছিল।
সমসাময়িক
বাঙালীর শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যান্য সুবৃহৎ কেন্দ্র
ছিল জগদ্দল, সোমপুর, পাণ্ডুভূমি, ত্ৰৈকূটক, বিক্রমপুরী, দেবীকোট, সন্নগর, ফুল্লহরি,
পণ্ডিত, পট্টিকেরক প্রভৃতি বিহারে; এ-সংবাদও পাইতেছি তিব্বতী বৌদ্ধ গ্ৰন্থতালিকা হইতেই।
এই পর্বের নালন্দা, ওদন্তপুরী এবং বিক্রমশীল মহাবিহারও বাঙালী ও বাঙলা দেশের রাষ্ট্ৰীয়
ও সংস্কৃতি সীমার অন্তর্গত। বিক্রমশীল বিহারের প্রতিষ্ঠাতাই তো ছিলেন পাল-রাজ ধর্মপাল
স্বয়ং এবং ওদন্তপুরী ও নালন্দায় এ-পর্বের বিদ্যাখী ও আচার্যদের অধিকাংশই বাঙালী।
তারনাথের
ইতিহাস এবং সুমপোর পাগ-সাম-জোন-জঙ-গ্রন্থের সাক্ষ্যেও সুপ্রমাণিত নিগু-মা
নামের এক মহিলা অধ্যাপিকার কথা। তৈলিকপাদের প্রধান শিষ্য ছিলেন নারো, ন্যারোপা,
ন্যারোৎপা, নাড়োপা, নাড়,
নাড়পাড়া, প্রভৃতি নামে পরিচিত জনৈক
সিদ্ধাচার্য। তাহার অন্য দুইটি নাম বা উপাধি ছিল জ্ঞানসিদ্ধি ও যশোভদ্র। নাড়োপা
জাতে ছিলেন শুড়ি।
কথায়
বলে, ‘অতীশ না
থাকলে ভারতবর্ষ অন্ধকার’। এই শ্রেষ্ঠতম বঙ্গ সন্তানকে যারা দিক্ষা দিয়েছেন তাদের মধ্যে একজন নারী
আছে। সেই আদ্যিকালের প্রেক্ষিতে বিষয়টা কতো বড় বিস্ময়য়ের, ভাবা যায়!
###
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
সাজেদুর রহমান
গণমাধ্যম কর্মী
০১৯১২০৭৮৫৯৩
sajedurrahmanvp@gmail.com
Comments