আল মাহামুদে পাই, রবীন্দ্রনাথে নাই

পুণ্ড্র পাঁচালী -২৭
আল মাহামুদে পাই, রবীন্দ্রনাথে নাই

বগুড়ার নওয়াব পরিবারের সংগ্রহশালায় কবিগুরুর নিজের হাতের লেখা ইংরেজী কবিতা 


… terrible nouveauté!
Tout pour l’oeil, rien pour les oreilles!
            … কি ভয়ানক আবিষ্কার!
সকলই চোখে পড়িতেছে, কানে কিছুই পশিতেছে না! - শার্ল বোদলেয়র

আপনারা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, প্রধান ও জনপ্রিয় সাহিত্যিকরা পুণ্ড্রবর্ধনকে উপজীব্য করে কিছু রচনা করেন নি। কেনো করেন নি? পুরনিক নগর  পুণ্ড্রবর্ধনকে বাদ দিলে বাংলার ইতিহাস অসম্পূর্ণ মনে হয়। বড় প্রতিভার কাছে সহানুভূতি পায়নি। কেউ কেউ অস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছেন। এভাবে উপেক্ষা করাটা পুণ্ড্রের প্রতি অবিচার করা হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদী এই সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ বাংলার সর্ব প্রাচীন এই নগর ও তার গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে যদি লিখতেন তাহলে ব্যাপারতে কি দাঁড়াত? তার অক্ষরের শক্তিতে পশ্চিমা দুনিয়া পুণ্ড্রনগরের জনজীবন সজীব হয়ে উঠত। অথবা হুমায়ূন আহমেদ লেখায় যে যাদুময়তা কাজ করে। সেই ভাষায় পুণ্ড্রের গৌরব গাঁথা লেখা হলে পাল্টে যেত ইতিহাস।  
বাংলার প্রধানতম লেখকগণ কেনো তাদের নাটক, চলচ্চিত্র, গল্প, উপন্যাস, গীতরচনা্য বগুড়ায় ট্রয়ের মতো নগরী প্রাচীর দিয়ে ঘেরা শহর মহাস্থান নিয়ে কিছুই লেখেননি? উচ্চাঙ্গ সাহিত্যে অবহেলিত প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর একটি পুণ্ড্রনগর          
প্রবল অনুমান পুণ্ড্রনগরের ভাস্কর্য ছাড়াও নাট্যশাস্ত্রে ক্ষেত্রে ভরতইতিহাস অনন্য অবদান রেখেছে। দর্শন চর্চায় এই নগরের গৌরবময় কি ইতিহাস রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন না? অথচ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে এই সত্য পাই না।
কেন পাই না এই প্রশ্ন করা মানে এমন না যে আমি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি বুঝি। কেন পুণ্ড্র নগরের ইতিহাস বিবৃতিতে ব্যাবহার হোল না রবীন্দ্রনাথের মত বড় সাহিত্যিকের রচনায়- এই আলোচনা তুলতে চাই।       
যে প্রশ্ন তুলতে কেউ চায়নি। সাহিত্যের বাণিজ্যায়নের বিপরীতে ইতিহাসের স্পর্শকাতর বিষয়ের কথা বলে এ দেশের বড় বড় সাহিত্যিকগণ এড়িয়ে গেছেন। নিম্ন বর্গের মানুষের কথা না লিখে ইউরোপ আর আরবের ইতিহাস লেখায় আগ্রিহি হয়েছেন।
আশার কথা জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ শামসুল হক আর আল মাহমুদসহ অন্তত কিছু প্রকৃত লেখক বিজ্ঞাপন ও প্রচারে প্রলোভিত না হয়ে পুণ্ড্র নিয়ে লেখালেখি করেছেন।       

সত্যি বলতে বাংলার ঐতিহাসিক সাহিত্যিক সম্বন্ধে খুব কমই জানি।
উচ্চাঙ্গ সাহিত্যের নিতান্তই নাদান। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলছেন, আমার প্রকাশে/ অনেক আছে অসমাপ্ত/ অনেক ছিন্ন বিচ্ছিন্ন/ অনেক উপেক্ষিত?
এ কথার ভেতর দিয়ে পুণ্ড্র পাঁচালী -২৭ পর্বে ‘আল মাহমুদে পাই রবীন্দ্রনাথে নাই’ যে প্রশ্ন তুলতে চাই পুণ্ড্রবর্ধন নগরের ইতিহাস কেন উপেক্ষিত?  
প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনের জনজীবন নিয়ে স্পষ্ট ইতিহাস তুলে ধরেছেন কবি আল মাহমুদ


মহত্তম সাহিত্যে পুণ্ড্রনগর
ঐতিহাসিক সাহিত্যের সামনে দাঁড়ালে খানিকটা লজ্জা লাগে। আমাদের মহত্তম ও বহুল পঠিত আখ্যানে পুণ্ড্রের কথা খোঁজার চেষ্টা করি। বোদ্ধারা এমন ভাব করেন, সেখানেই সবকিছু আছে। কথাসাহিত্যিকদের যে-দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে উৎসারিত হয়ে আমাদের ইতিহাস আশ্রিত সাহিত্যে পুণ্ড্রবর্ধন অনিবার্য ভাবেই আসার কথা ছিল তা আসেনি।  
এইসব অন্ত্যজ শ্রেণির আখ্যান যে সব কথাসাহিত্যিক তুলে ধরেছেন তার মধ্যে জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, সত্যেন সেনে, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসে, মহাশ্বেতা দেবী, সেলিনা হোসেন, হরিশংকর জলদাস বিখ্যাত।
প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনের জনজীবন নিয়ে স্পষ্ট ইতিহাস তুলে ধরেছেন কবি আল মাহমুদ। তাঁর সোনালি কাবিন ক্যাবে বলছেন -       
একদা তারাই জেনো গড়েছিলো পুণ্ড্রের নগর
মাটির আহার হয়ে গেছে সব, অথচ জনিনি
কাজল জাতির রক্ত পান করে বটের শিকড়।

অন্তত খ্রি.পূ. ষষ্ঠ শতকে পুণ্ড্রনগরে এক দার্শনিকের খ্যাতি পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পরে। সাংখ্য দর্শনের জনক মহামুনি কপিল। তাঁকে স্মরণ করেই কবি আল মাহমুদ সোনালি কাবিনকবিতায় লিখছেন-   
সে -কোন গোত্রের মন্ত্রে বলো বধূ তোমাকে বরণ 
করে এই ঘরে তুলি? আমার তো কপিলে বিশ্বাস
প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ?

র্য আক্রমণ প্রতিহত করা সাহসী পুণ্ড্র বাসির কথা বলছেন-
অতীতে যাদের ভয়ে বিভেদের বৈদিক আগুন/ 
করতোয়া পার হয়ে এক কঞ্চি এগোতো না আর
 ... শোষকের খাড়া ঝোলে এই নগ্ন মস্তকের পরে।
পূর্ব পুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়াড়,
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।
মুখ ঢাকে আলাওল রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।   

কবি প্রাচীনকালে নগরীটির মর্যাদার ইতিহাস তুলে ধিরেছেন-
আমারও আবাস জেনো লোহিতাভ মৃত্তিকার দেশে
পূর্ব পুরুষেরা ছিলো পাট্টীকেরা পুরীর গৌরব,
... শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।      
... আমার নিঃশ্বাসে কাঁপে নক্শাকাটা বস্ত্রের দুকূল?

সোনালি কাবিন কবিতায় প্রাত্যহিক জীবনের কর্মকোলাহল, আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নকল্পনার সাথে পৌরাণিক জীবনের সমন্বয় ঘটিয়েছেন কবি আল মাহমুদ। তাই তিনি লোক-কাহিনীর গভীর থেকে বাংলার রূপকে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করেছেন।
মাৎস্যন্যায়ে সায় নেই, আমি কৌম সমাজের লোক
সরল সাম্যের ধ্বনি তুলি নারী তোমার নগরে,
কোনো সামন্তের নামে কোনদিন রচিনি শোলোক

...মুকুন্দরামের রক্ত মিশে আছে এ-মাটির গায়,
আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুড়
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরূহ,
জ্ঞানের প্রকোষ্ঠে দেখো, ঝোলে আজ বিষণ্ণ বাদুড়
অতীতে বিশ্বাস রাখা হে সুশীলা, কেমন দুরূহ?
কী করে মানবো বলো, শ্রীজ্ঞানের জন্মভুমি এই
শীলভদ্র নিয়েছিলো নিঃশ্বাসের প্রথম বাতাস,
... তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।

আল মাহমুদ ইতিহাসবোধকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়েছেন এবং কবিতায় তা রূপায়ণের মধ্য দিয়ে বাংলার বৃহত্তর সমাজকে তুলে ধরতে পেরেছেন স্বতঃউচ্চারণে। তার চাইতে স্বপ্নকল্পনায় এগিয়ে প্রাচীনকালের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন জীবনানন্দ দাশ।   
জীবনানন্দ তার ‘বনলতা সেনকবিতায় বলেছেন-
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;




পুণ্ড্রনগরের ঐতিহাসিক কালিদহ সাগর নিয়ে রূপসী বাংলা কাব্যে লুকোচুরি খেলেছেন-
কালীদহে ক্লান্ত গাংশালিখের ভিড়ে যেন আসিয়াছে ঝড়,
আসিয়াছে চণ্ডীদাস-রামপ্রাসাদের শ্যাম সাথে সাথে তার:
শঙ্কমালা, চন্দ্রমালা: মৃত শত কিশোরীর কঙ্কনের স্বর।  
ইতিহাসের ঐতিহাসিক চরিত্রকে তিনি তাঁর কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তিনি বল্লান সেন, রায়গুণাকর, দেশবন্ধু, চন্দ্রশেখর, রামনাথ ইত্যাদি ঐতিহাসিক চরিত্রের উল্লেখ করেছেন-
মধুকুপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির পাড়ে গৌরী বাংলার
এবার বল্লাল সেন আসিবে না জানি আমি- রায়গুণাকর
আসিবে না- দেশবন্ধু আসিয়াছে খরধার পদ্মায় এবার,
রূপসী বাংলাকাব্যের জীবন অথবা মৃত্যুকবিতার চরণ উদ্ধৃত করা যায়: জীবন অথবা মৃত্যু চোখে রবে- আর এই বাংলার ঘাস/ রবে বুকে; এই ঘাস: সীতারাম রাজারাম রামনাথ রায়-/ ইহাদের ঘোড়া আজো অন্ধকারে এই ঘাস ভেঙে চলে যায়/ এই ঘাস: এরি নিচে কঙ্কাবতী শঙ্খমালা করিতেছে বাস:। লোক-কাহিনীর এই ব্যবহার কবিতাকে বৃহত্তর মানব সমাজের সমীপবর্তী করে তুলেছে এখানে।

চিন্তায় ও মননে জীবনানন্দ ছিলেন ইতিহাস ও ঐতিহ্য-সচেতন কবি। রবীন্দ্রকবিতার বিপরীতে যে-নতুন ধারায় কবিতা রচনার সূত্রপাত তাঁরা করেছিলেন, তা মূলত ছিলো ইউরোপীয় কাব্যচেতনার অনুগামী। সেই সময়ে জীবনানন্দের চিন্তায় যে-রহস্যের বিচ্ছুরণ দেখা যায়, তা মূলত লোক-পুরাণ ও ঐতিহ্যেরই রূপায়ন।

বিশ শতকের তৃতীয় দশকে বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের মত কবিদের দারা সূচিত হয় ব্যাপক পরিবর্তন। প্রচলিত কাব্যধারার মোহজাল ছিন্ন করে মাথা তুলে দাঁড়ায় আধুনিক জীবনবোধের অন্য এক নবতর প্রকাশ। এই সময়ের প্রতিবাদী কবিকুল সমবেত কণ্ঠে সোচ্চার হলেন জীবনের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরতে। তাঁরা সমাজমুখী উচ্চারণে জাগিয়ে তুললেন সমাজকে। সেই কালের ধারাবাহিকতার কবি সৈয়দ শামসুল হক। তাঁর ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় দেখতে পাই সেই প্রতিফলন।
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
   
বাংলার লোক-ঐতিহ্যের এবং লোক-পুরাণের অনুষঙ্গ আধুনিক বিন্যাসে উঠে আসে-
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
... অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হলো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?

হাজার বছরের সভ্যতাকে সৈয়দ শামসুল হক খনন করে উপস্থাপন করেন তাঁর এই কবিতায়। আর এই কাজে তিনি দক্ষতার সঙ্গে মিথকে ব্যবহার করতে পেরেছেন (১৯৩৫-২০১৬) আয়নাবিবির পালায়। পুরাণ, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য- মাটি ঘেঁষা জীবন উত্তাপ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতার অন্যতম উপাদান।

একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়
একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়।

এই কবিতায় প্রাচীন বাংলার এক সাহসী বীরের বিজয় সেনের কথা জানতে পারি। যে কিনা সিংহল তথা শ্রীলংকা জয় করেছিলেন। এমনি বীরগাঁথা জানি বরেন্দ্র অঞ্চলের বিদ্রোহী কৈবর্ত। তিনি কৈবর্তদের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম করেছিলেন।

এই গৌরবকে উপজীব্য বেস কয়েকটি উপন্যাস রচিত হয়েছে। এর মধ্যে সত্যেন সেনের বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৬৯),হরিশংকর জলদাসের ‘মহনা’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসে তিনি কৈবর্তদের স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবকে পাশ কাটিয়ে মহীপালের রাজ্য হারানোকে বলেছেন নিছক প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের ফলাফল।   

কৈবর্তদের ইতিহাস- গৌড় বঙ্গের রাজধানী বরেন্দ্রীর ইতিহাস। সময়ের শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক শওকত আলী (১৯৩৬) তাঁর প্রদোষে প্রাকৃতজন’ (১৯৮৪) উপন্যাসটিতে আটশত বছর পূর্বে রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে সামন্ত-মহাসামন্তদের দ্বারা প্রাকৃতজনদের অত্যাচারিত জীবন-চিত্রের কাছে আমাদের নিয়ে যান। প্রদোষে প্রাকৃতজনউপন্যাসের অন্যতম মূল একটি বিষয় যা আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে তা হলো এই যে, প্রাকৃত মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গের বিকাশ ও পরিণতি রূপায়নের মাধ্যমে একজন শিল্পীর সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা যে কতটা রুদ্ধ ছিলো এবং সেই পরিস্থিতি যে এখনও বর্তমান তা-ই প্রকাশ করেছেন লেখক। লক্ষণ সেনের সময়ে যখন মৃৎশিল্পের কাজ প্রায় অবলুপ্ত তখন তাঁর গুরু বসুদেব তাঁকে বিল্বগ্রামে সুধীমিত্রের ইচ্ছায় মৃৎফলক বানানোর কাজে ডেকে নেন।   

বাংলা সাহিত্যে মহাশ্বেতা দেবীকে ব্যতিক্রমী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, যে-ক্ষেত্রটির জন্য তাঁকে এ-আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে, তা হলো তাঁর আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা। সবচেয়ে বড় বিষয়, বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনবৃত্ত নিয়ে সাহিত্য রচনায় মগ্ন আর কেউ থাকেননি।
সম্ভবত সর্বাধিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস তিনিই রচনা করেছেন। তাঁর উলেস্নখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে হাজার চুরাশীর মা, সংঘর্ষ, রুদালী, গাঙ্গর, অরণ্যের অধিকার, অগ্নিগর্ভ, চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর, তিতুমীর, আঁধার মানিক, ঝাঁসীর রাণী, গণেশ মহিমা, নীলছবি, বেনেবৌ, শালগিরার ডাকে, কবি বন্ধ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু, আসামী, স্তন্যদায়িনীসহ শতাধিক গ্রন্থ।


ঐতিহাসিক উপন্যাস মাত্র, ইতিহাস নয়। যেমন সেলিনা হোসেনের উপন্যাস নীল ময়ূরের যৌবন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক নিদর্শন চর্যাপদের উপর ভিত্তি করে রচিত উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র কাহ্নুপাদ।
রাজা বুদ্ধমিত্রের প্রাসাদে পাখা দোলানোর কাজ করে কাহ্নুপাদ। সে একজন দাস। ক্লান্তিকর পরিশ্রমে নিজে ঘর্মাক্ত হয়েও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাখাটানার কাজ করে রাজসভা শীতল রাখে। রাজকর্মচারী হওয়ার সুবাদে যদিও কিছুটা সম্মান আছে সমাজের সাধারণ মানুষের ভেতর, কিন্তু সেটা এক ধরনের আত্মপীড়নের মতো। কাহ্নুর মনের জ্বালা বেরিয়ে আসে গানের সুর হয়ে,
আলি এঁ কালি এঁ বাটে রুন্দেলা। তা দেখি কাহ্নু বিমনা ভইলা।।  

এই দাসের শ্রেণি সংগ্রাম নিয়ে ময়ূরের যৌবন উপন্যাসটি রচিত। চির-সংগ্রামী এই জনপদের ইতিহাসের আরেক ক্রান্তিকালীন সময়ের নিুবর্গীয় সমাজ নিয়ে লেখা সেলিনা হোসেনের নীল চাঁদবেনে (১৯৮৪), কালকেতু ও ফুল্লরা (১৯৯২) প্রভৃতি।  

বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক ক্রান্তিকালের পটভূমিকায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা। অনেকটা সদ্য অতীতের ইতিহাসের শরীরে মিথকে কাব্যিক ঢঙে উপস্থাপন করেছেন ছোটগল্পের রাজপুত্র খ্যাত ইলিয়াস।
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি গোয়েন্দা গল্প লেখক শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের কালিদাসের জীবনী নিয়ে কল্পনাশ্রয়ী উপন্যাস কুমারসম্ভবের কবি অভিজিৎ সেনের রহু চণ্ডালের হাড় উপন্যাসে অসম যুদ্ধে পরাভূত সাঁওতাল বাজিকরদের আদি পুরুষ রহু। কবি মাকিদ হায়দারের ‘পুণ্ড্রের কেচ্ছা’ প্রবন্ধ অন্যতম।   

বিস্ময়াভিভূত আচ্ছন্নতায় ডুবে জাকির তালুকদার ‘পিতৃ গ্রিহ’ উপন্যাস বরেন্দ্রের সজিব মানুষের ইতিহাস লিখেছেন। একই ভাবে বিপুল আনন্দে আপ্লুত পুণ্ড্র সভ্যতার ইতিহাসের মাঝে স্নান করে কাজী রাফি ত্রিমোহিনী বলেছেন। নব্বইয়ের দশকের  কবি শামীম রেজা ইতিহাস আর গল্পের বাঁকে গড়ে তুলেছেন এক বর্ণিল ক্যানভাস।
ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনায় অভিষিক্ত হয়ে এসব সমকালীন লেখকদের পূর্বসূরি প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-৮৫) বিশীর জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার (১৯৩৮) ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-৭০)তিন খর উপন্যাস উপনিবেশ (১৯৪৪)। সম্ভবত ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার ধারাটি ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের (১৮২৭-৯৪) ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাস অঙ্গুরীও বিনিময় ও সফল স্বপ্নকে এই ধারার প্রথম উপন্যাস হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।   
পরবর্তীকালে এ-ধারায় লেখা উপন্যাসের মধ্যে অমিয়ভূষণ মজুমদারের (১৯১৮-২০০১) চাঁদবেনে (১৯৯৩ গ্রন্থাকারে প্রকাশ), দীনেশচন্দ্র সেন, সুকুমার সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, কুমার শরৎকুমার রায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শৌরীন্দ্রকুমার ঘোষ, রমাপ্রসাদ চন্দ, শ্রী হরগোপাল দাশকুণ্ডু, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রমেশচন্দ্র মজুমদার, শম্ভুনাথ কুণ্ডু, সুকুমারী ভট্টাচার্য, আবদুল মমিন চৌধুরী অন্যতম।

এসব প্রাজ্ঞ লেখকের রচনায় উপেক্ষিত পুণ্ড্রনগর। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এসব লেখকের রচনা তেমন সারা জাগাতে না পারলেও কবি বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৮২ সালে ময়মনসিংহে চাকরি করতে আসার সুবাধে আনন্দমঠনামে বিখ্যাত উপন্যাস লিখে সাহিত্য জগতে তথা বুদ্ধিজীবী মহলে আলোচনা সমালোচনার যে ঝড় তুলে ছিলেন। ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে সমালোচকের বিরোধ থাকলেও শিল্পবস্ত্ত হিসেবে উপন্যাসটি স্বীকৃত।
বিদ্রোহী কৈবর্ত 

জনপ্রিয় সাহিত্যিকের ওজুহাত

বাংলা কথাসাহিত্যে অবিসংবাদিত জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি মধ্যাহ্ন উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আমি লিখি নিজের খুশিতে। আমার লেখায় সমাজ, রাজনীতি, কাল, মহানবোধ, এইসব অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি এসেছে কি আসেনি তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। ইদানিং আমার মনে হয়, আমার কোনো সমস্য হয়েছে। হয়তোবা ব্রেনের কোথাও শর্টসার্কিট হয়েছে। যে কোনো লেখায় হাত দিলেই মনে হয়, চেষ্টা করে দেখিনা সময়টাকে ধরা যায় কি না।
হুমায়ূন আহমেদের এই কথার মধ্যদিয়েই তার লেখক সত্তার জবাবদিহিতা এবং মনোভাব সম্পর্কে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানা যায়। আমি ইতিহাসের বই লিখছিনা। গল্পকার হিসেবে গল্পই বলছি। মুক্তভাবে দুহাত ভরে লিখে তিনি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে জিনিয়াস নাম হুমায়ূন আহমেদ সম্রাট হুমায়ূনের জীবনালেখ্য বাদশাহ নামদার আর বঙ্গবন্ধুর ১৫ আগস্ট হত্যা কাণ্ড নিয়ে দেয়াল ঐতিহাসিক উপন্যাস কি না এরকম প্রশ্ন সচরাচর কানে আসে। হুমায়ূন আহমদ  যখন স্বগতোক্তি করেন, তিনি গল্প বলছেন, ইতিহাস রচনা করছেন না। তখন, এ ধরনের তর্কের অবতারণা বৃথা।

সৈয়দ মুজতবা আলী, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শিল্পনৈপুণ্যের অলৌকিক ক্ষমতায় সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ ও কালজয়ী সব উপন্যাস। এসব লেখকের যে কোনো লেখাই একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে কোনো পাঠকই উঠতে পারেন না।     
কিংবদন্তী কথাশিল্পী কৌতূহলবশত ইতিহাসের অপূর্ব সংমিশ্রণ পুণ্ড্রবর্ধন নিয়ে সিরিয়াস কিছু লেখার চেষ্টা করেন নি। একটা বিস্ময়কর ঘটনাই নয়, রীতিমতো হতাশার। বাংলার বাইরের মিথনির্ভর, এবং সম্ভবত বাঙালি মুসলমানের ভেতর সব চেয়ে বেশি পঠিত উপন্যাস মীর মোশারফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু। এখানে ব্যবহৃত হয়েছে ধর্মীয় মিথ।
এরূপ ইতিহাসে রোমান্স ও কল্পনা মিশিয়ে উপন্যাস রচনা করেছেন। কবি বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পৌরাণিক মিথের ব্যবহার হয়েছে তাঁর আনন্দমঠ ছারাও দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকু-লায় (১৮৬৬), রাজসিংহ। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার দিক থেকে কবি বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মত উত্তুঙ্গ অবস্থানে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কবি উপন্যাসএক নিচু জাতির ডোম থেকে কবি হয়ে-ওঠার কাহিনি পাই সেখানে।
শিল্পনৈপুণ্যের অলৌকিক ক্ষমতার কথাসাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই সময়, একা এবং কয়েক জন, প্রথম আলো’ ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস।
এই উপন্যাসের মূল নায়ক সময়, একটি বিশেষ সময় যেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ঘটনা ও চরিত্রগুলো চিত্রিত। মাইকেল মধু সুদন, রবীন্দ্রনাথ মত কিংবদন্তী কথাশিল্পী ও আসাম-বাংলার নিবিড় আয়োজন থাকলেও উপেক্ষিত পুণ্ড্রনগর।
ইতিহাসধর্মী কথাসাহিত্য ইতিহাসে অসাধারণ ও কালজয়ী উপন্যাসের- তালিকায় কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অবিসংবাদিত স্বনামধন্য লেখক- পর্যালোচনা করলে অদ্ভুত একটা চিত্র পাই। যেখানে জনপ্রিয় সাহিত্যিকের পুণ্ড্রনগর নিয়ে না লেখার ওজুহাত বোঝা যায়।
প্রাচীনকালেই জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা কবি কালিদাস তার রচনায় পুণ্ড্রনগর রাখলেও কালজয়ী রবীন্দ্রনাথ সহানুভূতি দেখাননি। আর বিংশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ শামসুর রাহমানের কবিতায় আবহমান বাংলার প্রকৃতি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিথের সহাবস্থান শনাক্ত করা যায়।
সৈয়দ মুজতবা আলী ও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে শিক্ষকতা করলেও লেখননি পুণ্ড্রের ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস
এমন স্বনাম ধন্য লেখকদের উদাসীনতার চাইতেও সাংঘাতিক লজ্জার কথা আছে। বিদ্রোহী কৈবর্তনামে উপন্যাস উচ্চবর্গীয় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি লেখা। সত্যেন সেন বিদ্রোহী কৈবর্ত উপন্যাসে তিনি কৈবর্তদের স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবকে পাশ কাটিয়ে মহীপালের রাজ্য হারানোকে বলেছেন নিছক প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের ফলাফল।
 সম্ভবত সর্বাধিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক রচনা করেছেন মহাশ্বেতা দেবী

বড় মাপের লেখকদের এমন প্রান্ত জনের অবজ্ঞা আমাদের কি পরিমাণ ক্ষতি করছে তার একটা উদাহরণ দেই। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যকর্ম চর্যাগীতি আবিস্কার করেন। এ গীত গুলির ভাবভাষা ছিল বৌদ্ধ সহজিয়া গুরম্নদেব রহস্যময় আধ্যত্বচেতনার বাঙ্ময় ভাবের বাংলা প্রকাশ। আশ্চর্য এই যে, এই রাহুল সাংকৃত্যায়ন জানালেন এর ভাষা হিন্দি। ডঃ জয়কান্ত মিশ্র মৈথিলি ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস রচনাকালে ১৯৪৯ সালে দৃঢ়ভাবে বলেন, চর্যাপদ মৈথিলি ভাষার প্রাচীন সম্পদ।  ১৯৬৫ সালে ডঃ খগেশ্বর মহাপাত্র ‘চর্যাগীতিকা’ ওড়িয়া ভাষার গ্রন্থে চর্যাপদে ওড়িয়া ভাষার প্রাধান্যের কথা বলেন।
উড়িয়া ভাষা বর্তমানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে এই চর্যাপদকে তাদের ভাষার আদি নমুনা হিসেবে দাবি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ফলে এক ধাক্কায় বাংলা ভাষার ইতিহাস থেকে নির্মমভাবে কেটে উড়িয়ে দেওয়া হল চারশো বছর, আমাদের বৃক্ষ শেকড়চ্যুত হল আরও একবার
বাংলা সাহিত্যের হসত্দলিখিত পান্ডুলিপির এই বিষ্ময়কর আবিষ্কারটি ছিল বাঙ্গালিদের জীবনে এক গৌরবময় অধ্যায়। সাহিত্যের ঐতিহাসিক বাস্তুচুতির আগ্রাসিনের বিরুদ্ধে কোনো বাঙ্গালীকে উদগ্রীব হতে দেখা যায়নি। এই প্রতীবাদ হীনতার কারণ খুঁজতে গিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলতে চাই, যে প্রশ্ন তুলতে কেউ চায়নি।
     
যে প্রশ্ন তোলেনি কেউ

বেশিরভাগ বাঙালিরই তো বাঙালি পরিচয় নিয়েই কোনও তাপোত্তাপ নেই তো ইতিহাসের নির্দিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন করবে কি? বড় কবিদের মধ্যে মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও অমিয় চক্রবর্তীর রচনার কথা মনে পড়ে। এই সব স্বনামধন্য লেখকদের কেউ প্রশ্ন করেনি, কেনো তারা ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে বাংলার প্রাচীন নগরের কথা বলেনি। সবচেয়ে বড়ো পোড়নিক শহর পুণ্ড্রবর্ধন কেনো তাদের গল্পে উঠে এলো না?
এটা সামান্য দুঃখের কথা না। চরম বেদনার কথা আধুনিক কালের শক্তিমান কবি বাংলার পুরাণের চেয়ে পাশ্চাত্য তথা গ্রিক পুরাণের ব্যবহারে ছিলেন অধিক উৎসাহী। সৈয়দ মীর মশাররফ হোসেন মধ্য প্রাচ্চের মিথ লেখেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিথ-পুরাণের ভাঙাগড়ার ফলে হয়ে আমাদের লেখকরা কি দ্বিতীয়টির জাতক?
সাহিত্যের অর্থনীতিতে নিম্নবর্গের ইতিহাস কি লোকসানি বিনিয়োগ? নাকি ইতিহাসের স্পর্শকাতর বিষয় থেকে গা বাঁচানো নিতি? এর পেছনে নিজেদের ঠেলাঠেলিতে সিদ্ধান্ত হীনতা দায়ী।

সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে আমাদের হাজার বছর আগে পূর্বপুরুষরা আমাদের জন্য যে গৌরবের সমাচার রেখে গেছেন, তাকে সঠিকভাবে ও শৈল্পিক একটি উপন্যাসের মাধ্যমে আমাদের জাতির সামনে উপস্থিত করার প্রচেষ্টা বোধহয় সফল হবে না। তার জন্য অন্য প্রতিকূলতার চাইতে আমার নিজের শক্তির অভাবই বেশি বলে মনে হচ্ছে আমার। ইতিহাসের মূল কাহিনিকে পূর্ণ অনুসরণ না করা হলে তা ঐতিহাসিক উপন্যাস হবে না।
মনে হচ্ছে আমাদের লেখকদের দক্ষতার তুলনায় বড় বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তারা এক একটি সাহিত্যিক প্রকল্প হাত নেয়, এমন একটি উপন্যাস লেখার কাজ হাতে নেয় যে উপন্যাস কোনোদিনই তাদের সীমিত মেধার পক্ষে লিখে ওঠা সম্ভব হবে না। তাই মাঝে মাঝে কোন লেখকের প্রতি লেখাতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করি। কিন্তু কী এক অমোঘ টানে বার বার ফিরে আসতে হয় খালি হাতে।
সময়ের মূল প্রবণতা এবং ইতিহাসের মৌল সত্য একত্রিত করতে গিয়ে লেখকদের এই দুর্বলতা কাটবে কবে?
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যদি কয়েক লাইনে বলতে হয় তাহলে তা এই, প্রথমে চর্যাপদের কথা বলতে হয়। সেই অহংকারের দলিল দায়িত্বশীলদের উদাসীনতায় হরণ হয় তখন প্রশ্ন জাগে এই অপলাপের বিরুদ্ধে বাঙালি লড়বে কি?
প্রশ্ন গুলি বিব্রতকর হলেও ইতিহাসের বিকৃতি এড়াতে, আত্ম পরিচয়ের স্বার্থে, বিষের দরবারে মর্যাদা পূর্ণ প্রতিষ্ঠার লক্ষে প্রশ্ন গুলি তোলা প্রয়োজন।
রবীন্দ্রনাথের  মত বড় প্রতিভার কাছে উপেক্ষিত পুণ্ড্রনগর 

ডানা ছাটা ইতিহাসে পুণ্ড্র ভাবনা  
কবিকুলশ্রেষ্ঠ কালিদাস, মধ্যযুগের মহাকবি সন্ধ্যাকর নন্দি একালের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ। তাঁরা সকলেই দেশের ইতিহাস যে মানুষের জীবনধারা, মানুষের জীবনযাত্রা ছাড়া আর কিছু নয়, তা রবীন্দ্রনাথ হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। ভারিত তীর্থ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ –
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য,
হেথায় দ্রাবিড় চীন
শকহুনদল পাঠান মোগল
এক দেহে হল লীন।
... এসো হে আর্য, এসো অনার্য,
ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনায় তাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ভারত বর্ষের যে ইতিহাস আমরা পড়ি এবং মুখস্ত করিয়া পরীক্ষা দিই, তা ভারতবর্ষের নিশীথকালের একটা দুঃস্বপ্ন কাহিনী মাত্র।...সেই ইতিহাস পড়িলে মনে হয়, ভারতবর্ষ তখন ছিল না, কেবল মোগল-পাঠানের গর্জন মুখর বাত্যাবর্ত শুষ্কপত্রের ধ্বজা তুলিয়া উত্তর হইতে দক্ষিণে এবং পশ্চিম হইতে পূর্বে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।
অনেকটা বিস্ময় ও কিছুটা হতাশা নিয়ে প্রসঙ্গিত হলো রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস চর্চায় পুণ্ড্রাশ্রিত সাহিত্য কি ছিল না?
অড্র মাগধি নাট্যরীতি, পট চিত্র, নাথ সাহিত্য চর্যা গীতি, পাল ভাস্কর্য সহ সংস্কৃতির সমস্ত শাখায় পুণ্ড্রর্ধনের প্রভাব যেভাবে এসেছে তাতে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ানোর কথা না।           
আর্য এবং আর্যপূর্ব রূপকথার গল্পে গানে কবিতায় নাটকে আক্ষানে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক উত্থানপতনের পুণ্ড্র নগর ও তার মানুষের কথা অতিলৌকিক প্রকাশও কি তিনি দেখেন নি?  
তাঁর মত প্রতিভার কাছে পুণ্ড্রা লোকের উপেক্ষা কি বাংলা সাহিত্যের জন্য আরাম দায়ক?

Comments

Sajedur Rahman said…
ভালো লেগেছে

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান