পুণ্ড্রের পাঁচালী-২৮ (তেজস্বিনী-৪র্থ পর্ব )


পুণ্ড্রের পাঁচালী-২৮  (তেজস্বিনী-৪র্থ পর্ব )
সাজেদুর রহমান


মনসার কাহিনীর টানটান একটি অংশ হল লখিন্দরকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া। অনিশ্চিত যাত্রা

সন্ধ্যা হয়-হয় করছে। এখনো হয়নি। আকাশ মেঘলা। ঘরের ভেতর অন্ধকার। সন্ধ্যার সময় ঘর অন্ধকার রাখতে নেই। দ্রিমা লক্ষণ-অলক্ষণ বিচার করে চলে না। বিছানা ছেড়ে উঠতে তার আলসেমি লাগছে বলে বাতি জ্বালানো হয়নি।
সে খানিকটা অস্বস্তির মধ্যে আছে। তার সামনে যে-তরুণী বসে আছে, অস্বস্তি তাকে নিয়েই। তরুণীর লম্বা কালো চুল অন্ধকারে চিকচিক করছিল, আর একটা সাদা শাড়ির জড়িয়ে ছিল বেঁকে থাকা শরীরটার ওপরে। এতক্ষণ সে দুই হাত আড় করে ভাঁজ করে হাঁটুর উপর মাথা গুজে বসে ছিল, কিছুক্ষণ আগে মুখ তুলেছে। দ্রিমা ধাক্কার মতো খেয়েছে। মেয়েটার মধ্যে একটা কিছু আছে রূপের বাইরে অন্য কিছু। এমন রূপসী মেয়ে সে খুব বেশি দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না।
মেয়েটার চোখ দু’টি ছোট ছোট এবং বিশেষত্বহীন। গালের হাড় উঁচু হয়ে আছে, ছোট্ট কপাল কিন্তু কি অদ্ভুত দেখতে। কি মোহময়ী।
আমার নাম হিমানী।
হিমানী?
জি আপা। সন্ধ্যায় ঘরে বাতি জালান নি?  
না দেই নি। কোন সমস্যা?
হিমানী লজ্জিত ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে দ্রিমার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার চোখের সাদা অংশে আলো পড়ায় গম্ভীর দেখালো।
হিমানী, তুমি কি জাদু-মাদু জানো?
জি, মিচ্চিয়ানা গুপ্ত বিদ্যা ডাকিনী মন্ত্র জানি
বলতে বলতে মেয়েটা হাসল। রূপবতী মেয়েদের হাসি বেশির ভাগ সময় সুন্দর হয় না। দেখা যায় তাদের দাঁত তেরা-বেঁকা। কিংবা হাসির সময় দাঁতের মাড়ি বের হয়ে আসে। দাঁত-মাড়ি ঠিক থাকলে হাসির শব্দ হয় বিদঘুটে-হাঁস টাইপ। প্রকৃতি সবাইকে সবকিছু দেয় না। কিন্তু হিমানী নামের মেয়েটিকে দিয়েছে। মেয়েটার হাসি সুন্দর। হাসি শেষ হবার পরেও মেয়েটার চোখে সেই হাসি লেগে আছে। এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। দ্রিমা বিছানায় সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল, হিমানী তুমি নিতান্তই কুসংস্কার নিয়ে আছো।
হিমানী হাসিমুখে বলল, আপনি যখন বলিচ্ছেন তালে হবার পারে। আমি যা বিশ্বাস করি তাই কচ্ছি, যুক্তির কথা বলিচ্ছিনা। একটা সিল্লক কই-  
             চোতে কুয়ো ফাগুনে বান
             নরের মুণ্ডু গড়াগড়ি যান।
দ্রিমা ভেবেই পায় না। ‘চোতে কুয়ো’ মানে কি? খনার বচন মনে হয়। এই প্রবাদের গর্ভে হারানো শব্দের ইতিহাসের ইঙ্গিত আছে কি?
কি পারলেন না? মিচ্চিয়ানা ভাবেন- কখন মানুষের মাথা গড়াগড়ি যায়? 
দ্রিমা পারল না। শুধু এদিক ওদিক চাইল। শেষে হিমানী হেসে বলল, চৈত (চৈত্রে) মাসে ওস (কুয়াশা) দেখা গেলে ধরা লাগবি দেশে রোগবালাই মহামারীর কারণে অনেক মানুষ মরবি (মৃত্যুমুখে পতিত হবে) এই ধরেন বসন্ত রোগের "শীতলা দেবী", কলেরার "ওলা দেবী" নামে মারণ ব্যাধিতে গ্রামের পর গ্রাম উজার হতো।    
হামি ভাবছিনু আপনি পারবেন। এইডা খনার বচন কয়। আরেকটা কই- 
       ধন্য রাজার পুণ্য দেশ
       যদি বর্ষে মাঘের শেষ।
দ্রিমা এইটা জানে। তার পরেও চুপ থাকে। সে ভাবে খনার বচন প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো। এ ছাড়া কৃষিকর্মের জন্য রয়েছে খনার শত শত প্রবচন। অগাধ জ্ঞানের কথা জানাজানি হয়ে যায়। খনার জ্ঞান-গরিমা পণ্ডিতদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি তিনি পণ্ডিত বরাহের জ্যোতিষশাস্ত্রীয় বহু দুঃসাধ্য সমস্যা সমাধান করে দিতে লাগলেন। এতে অপমানিত বরাহ পুত্র-বধুকে বোবা বানিয়ে দেয়ার জন্য পুত্রকে আদেশ করেন।
আপা- খনা খুব জ্ঞানী আছলো? বেটি ছলের বুদ্ধি বেশি থাকা সমস্যা। পুরুষ মানুষ সহ্য করবার পারে না। দেখেন আপন শ্বশুর জামায়কে হুকুম দিলো, যাও বউয়ের জিব্বা (জিহ্বা) ক্যাটা (কেটে) বোবা করে দাও। যেন আও (কথা) কবার না পারে। বাপের কথায় পুতে (পিতার-আদেশে মিহির) এক চাকু দিয়া খনার জিব কাটেকাটা জিবা দিয়ে অক্ত (রক্ত) বারাতে বারাতে সব অক্ত বের হয়ে মরে যায়। খনার কাটা জিব খায় টিকটিকি গুপ্ত জ্ঞান লাভ করে।

পুণ্ড্রের পাঁচালী-২৮  (তেজস্বিনী-৪র্থ পর্ব )  প্রবাদ, প্রবচন, সিল্লক, ছড়া, ছন্দ, রীতি নীতিতে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসে নারীদের অলৌকিক ভুমিকা তুলে ধরবো। নৃতত্ত্বের ছাত্রি  দ্রিমা ও বেদের মেয়া হিমানী নামের দুই নারীর কথোপকথনের ভেতর দিয়ে এগবে ইতিহাস।     


             
খুব অস্থির মনে হচ্ছিল হিমানীকে। কথাবার্তায় অসংলগ্ন না হলেও ভাব ভঙ্গিতে কেমন যেন বেগ্রতা ভাব। কনরকম পরিচয়ের তোয়াক্কা না করেই এক নাগারে কথা বলে যাচ্ছিল, যেন মাঝ পথে ছেড়ে যাওয়া একটা আলাপ আবার শুরু করেছে। আমার দিক থেকে কোনো রকম বাধা ছাড়াই কয়েক মুহূর্ত পার হলো, আমি তখন তার চেহারায় পরিচিতির একটু আভাস খুঁজছিলাম। তারপর হঠাৎ করে যে শব্দটা আমার মনোযোগ কাড়ল তা একটি নাম যা পুণ্ড্র সভ্যতার সংকেত। এই নামটির কথা অধিকাংশ ইতিহাসবিদের কাছে শুনিনি।
আপা ডাকিনীর ধাপের কথা শুনছেন। ‘ডাকিনী’ খুব জ্ঞানী আছল। বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম বিদ্বানের খ্যাতি সমগ্র ভারতে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল আপনি যদি    গকুলের পাসে ভাসুবিহারে কাছে ভালোয় বিহার গ্রামে জান তালে পরেসুসঙ্গ দীঘিনামে একটি প্রাচীন দীঘি দেখবার পারবেন। দীঘির পশ্চিম পারে ইটের দেয়াল এখনো দেখা যায়। প্রবাদ, ইহা সুসঙ্গ নামক রাজা এই দিঘি আর দেয়াল তইরি করেন।
সুসঙ্গ রাজা গুপ্তচরের মাধ্যমে জেনেছেন, দেখে সবাই ডাকিনীর জ্ঞানের কথা কয়। সম্মান করে। তার কথা কেউ কয় না। তাই রাজা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করল। তার লোকজন বলতে লাগল, ডাকিনী নাকি রাজনিষ্ঠ নয়। প্রতি রাতে নিয়ম করে শয্যাসঙ্গিনী হলেও, সে নাকি তারই ভগিনীপতির সাথে লুকিয়ে প্রায়ই তাঁর সাথে মিলিত হয়, একে অপরকে বাহুডোরে বেঁধে প্রেমালাপ করে।
রাজার লোকজন কণ্ঠে বলল, ‘কেউ কী সেটা নিজেই যাচাই করতে চান’?
রাজার কথা লোকে বিশ্বাস না করলেও কেউ যাচায়ের সাহস করল না। এদিকে
রাজা জানা আছে ডাকিনী কথার পিঠে কথা বলার কায়দা জানে অন্য নারীদের মতো নির্বাক, সঙ্কুচিতা এ নয়। মনে মনে শঙ্কিত হলেন। তাই সময় না দিয়ে রাজা বিচার করলে। বিচারে ক্রুদ্ধ গলায় বললেন রাজা তাহলে ঠিকই শুনেছি আমি...... তুমি বেশ্যা!   
বিচলিত হলো না ডাকিনী। হাসিমুখেই বলল আপনি তো আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। চোয়াল শক্ত করে বলল, আপনার বিরুদ্ধে কিন্তু ষড়যন্ত্র করি নি আমি প্রতিরাত্রে বিদ্যা চর্চা করেছি। আপনাকে সময় দিতে পারি নি আমি। আপনি তো বিদ্যা অর্জন চানও নি রাজা, শুধু তোষামোদ চেয়েছেন।
ধমকে উঠেছিলে রাজা। তোমার গায়ের বসন...যায়গা-জমি সবই আমার দেওয়া! আমার অর্থ! আর এসবই তুমি কাজে লাগিয়েছ অন্য পুরুষের চোখে মনোহারী হয়ে উঠতে!      
রাজ ভাবলেন, এত লোকসমাজে মাঝে কথা বলা চলবে না এই পাপিষ্ঠাকে। ধীর, কাঁপা পায়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি, আর পেছনে পড়ে রইল রাজার সৈন্যের তীব্র দৃষ্টি।
পরেরদিন সকালে দীঘির পারে এসে জমায়েত হলো রাজমিস্ত্রিদের প্রধান সৈন্য আর তার অনুচররা। তাদের সঙ্গে ইট, চুন-সুরকি। রাজার একটা বিশেষ আদেশ পেয়েই এসেছে তারা। ডাকিনীকে দীঘির পারে সাথে দাঁর করিয়ে তার সামনে দেয়াল গাঁথা শুরু করল।
সবার প্রত্যাশা ছিল মেয়েটি হয়তো চিৎকার করে উঠবে, প্রাণভিক্ষা চাইবে, প্রাণভয়ে পালানোর চেষ্টা তো করবে অবশ্যই। সেজন্য তাই দুজন সশস্ত্র প্রহরীও মজুদ ছিল। কিন্তু ডাকিনী কোনো আর্তনাদ করল না, পালানোর প্রচেষ্টাও না। বরং একটা অদ্ভুত কাজ করতে শুরু করল সে। নিজের মনে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল।
দেওয়াল উঠে চলল। ধাপে ধাপে, ইটের পর ইট। শুধু শেষ ইটটা গাঁথার আগে জীবন্ত কবরের ভেতর থেকে অস্ফুটে ভেসে এলো হা ঈশ্বর।
তেজী ডাকিনীর শৌর্যবীর্যের কাহিনী শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল দ্রিমা। কিংবদন্তী অনুযায়ী খনা আর ডাকিনী দুই গল্পেরই সারমর্ম তাদের মৃত্যুর কারণ ছিল তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা।

২০১৪ সালে ডিসেম্বরে এক সন্ধ্যে বেলায়, দ্রিমার গ্রামের বাড়ির দরজায় কালো চামড়ার এক আগন্তক এসে দাঁড়াল। দড়ি পাকানো শরীর। আলুথালু চুল। গলার হাড় ভেসে উঠেছে। নাম হিমানী। দেখে মনে হচ্ছিল বয়স দ্রিমার কাছাকাছি- উনিশ। দ্রিমার একুশ।
হিমানী এসেছে শিবগঞ্জের সোনাদেউল থেকে। এই প্রথম তার দ্রিমার সাথে দেখা। হিমানী কাণ্ডকারখানা কিছুই তার মাথায় এখনো ঢুকছে না। একটু আগে সে অদ্ভুত অশ্লীলতা ধাঁধা বলেছে।
আপা, ধাঁধা মানে ধোঁকা। কি বলেন? আচ্ছা কন তো-
আকাশ থেকে পড়ল ডুঙ্গি
দৌরে যাইয়া গোয়া সুঙ্গি।
দ্রিমা ভ্রু কুঁচকে থাকে। হিমানী বলে, তাল গো আপা তাল। তাল গাছ থাকে পরে আর মানসে দৌরে যায়ে তাল পায়েই নাকত লিয়ে সঙ্গে। পাকা হলে লিবি না হলে ফালে দিবি। পলির মানসেরা তাল’ক কি কয় জানেন? হি হি হি...
দ্রিমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে পলি কোন এলাকাকে বলে?      
ডাবুর পলি অঞ্চলে পরছে। পলির মানুষ গাংনুই নদীর চরের থাকে। আর হামরা উচায় থাকি। বেতগারি, সনাদেউল- হামরা খিয়ারের মানুষ। পলি আর খিয়ারের ভাষার পারথিক্ক আছে। খিয়ারের মানুষ কয়, বৃষ্টি আচ্ছে। আর পলির মানুষের কয়, ঝরি আসিচ্ছে। হি হি হি...।


প্রতীকী ছবি সাঁওতাল বিদ্রোহ 

আগা বেলে ডাবুর পাছা বেলে খিয়ার
দ্রিমা আর হিমানী নামা পলি হয়ে ডাবুর পথ ধরে হাঁটছে। কথা ছিল তারা দুপুর পর্যন্ত ঘুরবে। দুপুরে আলুপোড়া দিয়ে খিচুড়ি খাবে। হঠাৎ সে মত বদলালো। দুপুরে খাবে না। অনেক কাজ বাকি। আখ্যান, ছড়া, মন্ত্র, ধাঁধা ও প্রবাদ সংগ্রহে বর্ষাপুকুর, তিয়াইল হয়ে পাছা বেলে গোড়নায় চলে যাবে।
পথে কিছু উটক ঝামেলা হচ্ছে। গাঁয়ের লকেরা অতিরিক্ত কৌতূহলী। পুরুষেরা তাদের কৌতূহল চেপে রাখলেও মেয়েরা তা করছে না। ‘কুট থাকে আসিচ্ছেন? কুটি জাবেন? এ বারে কথা কন না ক্যা? হিমানী উত্তর দিচ্ছে। কিন্তু হিমানীর জবাবে তারা সন্তুষ্টা না। তারা দ্রিমার মুখ থেকে শুনতে চায়। এতে হিমানী বলল, ক্যা বারে হামি কচ্ছি তাতে হচ্ছে না। এক মহিলাকে বলে বসল, বেটিছল কি হামাগেরে মানুষ মনে করিচ্ছে না। উত্তরে হিমানী বলল, হামি কই মা মা; মা কয় আঠার নাং।
দ্রিমা কঠিন গলায় বলল, চুপ কর।
দ্রিমা অনেকক্ষণ হলো বসে আছে। যে ঘরে তাকে বসানো হয়েছে সেটা বসার ঘর না। অতি গেরস্তদের বসার ঘরে অনেক কায়দা-কানুন থাকে। দেয়ালে হস্ত শিল্পের ছোঁয়া থাকে। যে এই কাজ করেছে তার ছবি বাঁধান থাকে। ওষুধ কম্পানির ক্যালেন্ডার, বড় দেয়াল ঘড়ি, জানালায় সাড়ি কেটে পর্দা ঝোলাল, অনেক কিছু। এই ঘরে অনেক কিছু নেই।
বসার প্লাস্টিকের সস্তা চেয়ার আছে। চেয়ারের কাভার আছে। কয়েকটা জায়গায় সেলাই খুলে গেছে। কিছু পুরন আমলের কাঠের চেয়ার আছে। ঘোরের এক পাসে বিসাল স্টিলের সোকেস। সোকেসে থরে থরে কাঁচের থালা বাসন।
বসবার ঘরের কাছেই মনে হয় রান্না ঘর। ভাজাভুজির গন্ধ আসছে। হিমানী আহ্লাদী গলায় বলল, আপা এক কাম করিছি?
কি?
কখন ধরে ভাজিচ্ছে। আপা যা ভাজিচ্ছে তা যাতে ঠিক মত না হয় তার মন্ত্র পরিছি। মন্ত্রডা শুনবেন। অবশ্য মন্ত্র কলে ধক (কার্যকারিতা) থাকে না। তার পরেও শনেন।
আওলা চাল বকের পাক
যেমন পিঠা তেমন থাক
এই মন্ত্র পরলে কি হয় বল্লা,
এটি হলো তৈরি খাবার নষ্ট করার মন্ত্রএখন খাবার খালে বদহজম হবি।
ও আচ্ছা। কেন করলা? 
হামাগেরে অনেকক্ষণ বসে থুইছে। এডা অত্যাচার লয়। কি যে করিচ্ছে।    

যে ভদ্রলোক দ্রিমাদের বসিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছেন তার আচার-আচরণ অবশ্য ভালো। চেহারায় কোমলতা আছে। বিনয়ী কথাবার্তা। স্কুল শিক্ষকরা মাঝে মাঝে বিনয়ী হতে দেখা যায় তবে তা স্কুল পরিদর্শকের সামনে, বাড়িতে আসা অতিথিদের সামনে নয়। দ্রিমা তাকে বলেছে- স্যার আমি নৃতত্ত্ববিদ। এখানকার ঐতিহাসিক জনপ্রিয় আখ্যান, লোকোক্তি বা জনশ্রুতি, লোককাহিনী খুজে বেড়াচ্ছি- আপনি যদি সহযোগিতা করেন।
                        
ভদ্রলোক বললেন, (হাসি মিখে) আপনার কি কোনো কার্ড আছে?
আমার কোনো কার্ড নেই। স্যার আমার কিছু লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমি সেগুলো নিয়ে এসেছি।
হামি একটা কাম করিচ্ছিনু। গরুক পানি খাওয়াচ্ছিনু। এনা দেরি হবি।
আচ্ছা হাতের কাজ সেরে আসেন। সমস্যা নাই।
চা খাবেন?
চা খেতে পারি।
চা পাঠাচ্ছি।
ভদ্রলোক উধাও হয়েছেন পনেরো মিনিট আগে। চা এখনো আসেনি। দ্রিমা ঘড়ি দেখল। তার আগে দেখে নিল দরজার ফাক দিয়ে ভেতর বাড়ির যতটা দেখা যায়।
চা নিয়ে এক তরুণী ঢুকেছে। আলাদা প্লেটে তেলের পিঠা জাতীয় কিছু। গেরস্ত বাড়িতে তেলের পিঠা সব সময় সুন্দর সেফে হয়। এই পিঠার সেফ কেমন যেন; মনে হচ্ছে হেলাফেলা করে পিঠা বানানো হয়েছে।
অবজ্ঞায় বানানো পিঠা মনে করে মুখে দিয়ে দ্রিমা মুগ্ধ হোল। ত্যাড়া-বেঁকা সাইজের পিঠাটা খেতে দারুণ সুস্বাদু। ভালো মানের চাউলের গুড়া। আখের গুড়ের গন্ধ আসছে। হতে পারে নিজেরাই আখ মারায় করে গুড় বানিয়েছে। এদের হয়ত আখের চাষ আছে। খাটি গেরস্ত।


ভদ্রলোক কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন, পিঠাটা ঠিক মতো হচ্ছিল না। পাকান পিঠার এই একটা বিষয়- যেদিন হবি না তো হবার লয়। বাড়িআলি অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করল- শেষ তক হামি হাত লাগানু তাও হলো না।
হিমানী মিটি মিটি হাসছে আর বির বির করে বলল, কইছিনু না...  
দ্রিমা বলল, স্যার পিঠা ভালো হয়েছে। কি ধানের চালের গুড়া? আর আখের কগুরের কি সুন্দর গন্ধ। খুব মজা হয়েছে।
সালনা ধানের।

দ্রিমা অতি দ্রুত মূল বিষয়ে কথা তুল্ল। ভদ্রলোকের নাম হাশেম আলী খন্দকার। তিনি চন্দনপুর হাই স্কুলেত ইতিহাসের শিক্ষক। এলাকায় তাকে ভোলা মাস্টার বলে ডাকে। ভোলা মাস্টার বললেন, মহাস্থান গড়ের কোলে ছোট্ট একটা পৌরাণিক গ্রাম- চাঁদপুর। এখন চাঁদপুর চন্দনপুর গ্রামের তিন দিকে লালমাটির উঁচু উঁচু গড় আছে। মানে মাটির ঢিবি; এখনো গেলে দেখবার পাবেন। তিন পাশে তিনটি গড় থাকায় মানসে এডাকে তিন টেউড়ি কয়। কথিত আছে, মহাভারতের কুন্তির পাঁচ ছেলের মেঝটা ভীম থাকতেন এই গ্রামে। আর ঐ যে তিন টেউড়ি, তিন মাথার ঐ গড় তিনটি হলো ভীমের চুলা। যেখানে দৈত্যকায় ভীমের খাবার রান্না হতো।

হিমানী জানায়, এটি ভীমের জঙ্গল আছে। সেই কথার সুত্র ধরে ভোলা মাস্টার বলেন, মহাভারতের গল্পের চরিত্রগুলো এখানেই বাস করত। কীচক, মরচা, হাতিবান্দা, চককানু, পয়রানপুর, পরমান্দপুর, কাঠগাড়া, কুড়াহার ফেনিগ্রাম, গোকুল লিয়ে অনেক স্থানিক কাহিনী, পশুকাহিনী, বীরকাহিনী, সন্তকাহিনী, পুরাকাহিনী প্রচলিত আছে। হামরা পুরাণকথা দাদী-নানীর কাছ থাকে শুনছি।
বলে রাখা ভালো, ছেলে ভোলানো ছড়াকারদের পরিচয় বা নাম জানা যায় না। তাঁরা নারী কী পুরুষ, তা-ও বোঝার উপায় নেই। তবে কেউ কেউ বলেন যেহেতু ছেলেপুলে মানুষ করার নারীসমাজের কাজ সেহেতু তাদের মাধ্যমেই রচিত ও প্রচারিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সভ্যতার গোপন সংকেত  ও নারী সমাজ

আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে- দাদী-নানীরা মুখে মুখে ছন্দে বা পয়ারে নাতী-নাতনদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় এই ছড়ায় আছে ভীমপালের পরাজয়ের ইতিহাসের সংকেত পাই। আমাদের যে প্রাচীন রণধ্বনি আজ আগডুম বাগডুমের নার্সারি রাইম হয়ে থেকে গেছে, সেই ছড়া থেকেও বোঝা যায়, ডোম জাতি ছিল বাঙালির যুদ্ধজয়ের অগ্রণী সেনা।
পাখির চখে গোকুল মেধ

আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
খোল মৃদঙ্গ ঝাঁঝর বাজে;
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি।
ঢুলি গেল সেই কমলাপুলি।
আগডুম অর্থ যে ডোম সৈন্য সবার আগে যায়। আর ঘোড়াডুম হলো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ডোম সৈন্য। সঙ্গে বাজে তিন ধরনের বাদ্যঢাক, মৃদং এবং ঝাঝর। বলাই বাহুল্য, এই বাদ্যগুলো বাজানো হয় শোভাযাত্রা বা যুদ্ধযাত্রার সময়। তাই প্রথম দুই ছত্রে মল্লবাজদের ডোম সৈন্যের কথা হয়তো মনে পড়া স্বাভাবিক। মধ্যযুগের ধর্মমঙ্গলেও ডোম সৈন্যদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

প্রথম ছত্র দুটিতে বেশ একটা বীরত্বের ছোঁয়া লেগে আছে। কিন্তু পরের ছত্রগুলো থেকে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ শোভাযাত্রা দেখতে পাই। সাওতাল পরগনার পাওয়া এই ছড়ায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকে বীর রসের ছবি দেখতে পাননি।     

কমলাফুলির টিয়েট।
সূর্যি মামার বিয়েতা।

তবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকে মনে করেন দুটো পৃথক ছবিকে কেটে একসঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়েছে ছায়াচ্ছন্ন মোহময় এক পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে। এমনও তো হতে পারে, আগে (সামনে) ডোম, বাগে (পাশে) ডোম, ঘোড়া ডোম সাজে; মানে যুদ্ধের বর্ণনা৷ ডোম হল সেই বাঙালি যোদ্ধা, যার ভয়ে পঞ্চনদ জয় করেও এ পারে আসেননি ম্যাসিডনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার? দেখা যাক ইতিহাস কী বলে৷ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাঙ্গালার ইতিহাসে লিখছেন; নাগপূজক কয়েকটি জাতি বাঙ্গালা হইতে এবং ভারতের উত্তরাঞ্চল হইতে তামিলকম্ দেশে যায়৷
ইতিহাস অনুযায়ী, আনুমানিক ১০৭৫ সালের দিকে পাল বংশের রাজা ছিলেন রামপাল। উত্তরের জেলায় নীলফামারীর ডোমন নগর ছিল তার রাজধানী। সিংহাসনের অধিকার নিয়ে ভীমপাল আর রামপালের মধ্যে বেশ বড় ধরনের যুদ্ধ বেধেছিল। ভীম পালের সৈন্যদের বলা হতো ডোম সৈন্য।
গবেষকদের ধারণা, রামপালের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধযাত্রার ছবিই আঁকা হয়েছে এই ছেলে ভোলানো ছড়াতে। বলে রাখা ভালো, এই যুদ্ধে ভীমপাল পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন। বিজয়ী রামপালও বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তাঁর নাম থেকেই দিনাজপুরের রামসাগর নামের উৎপত্তি।

রামসাগর নামের উৎপত্তি কথায় পুন্ড্রনগর খ্যাত বগুড়ার নামকরণের প্রচলিত মুখরচক কাহিনী শোনালেন প্রবীণ সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ আব্দুর রহিম বগরা। তিনি জানান, বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের স্থানিক নাম ছিল 'বগ্ড়ী' বঙ্গ, বরেন্দ্র, মিথিলা, বাঢ় ও বগ্ড়ী। শেষোক্ত 'বগ্ড়ী' অংশে নৃতাত্ত্বিব জাতিগোষ্ঠী। এই বাগদি শব্দটিই অপভ্রংশ 'বগ্ড়ী' রূপ ধারণ করতে পারে। কালে রূপান্তরিত এই 'বগ্ড়ী''বগুড়া' উচ্চারণে স্থির হয়েছে বলেও একটি ধারণা রয়েছে।
      
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘বেণের মেয়ে’ উপন্যাসে বাগদীদের গৌরবের চিত্র একেছেন। ‘বাগদীদের সাহস অসীম, তাহাদের সম্মুখে কেহ আসিতে সাহস করে না, এলেই সৰ্ব্বনাশ’। বৌদ্ধ আমলের অবসান আর হিন্দুবাদের উত্থান কালের পটভূমিতে ‘বেণের মেয়ে’কে কেন্দ্র করে বাঙ্গালায় গুভাজু আর দেবভাজুতে যুদ্ধের বর্ণনায় একটি গানের উল্লেখ করেছেন।
গান উঠিল-
বাজতে বাজতে পড়লো সাড়া,
সাড়া গেল বামন পাড়া
ডাল মৃগল ঘাঘর বাজে

এই গানকে বাগদীদের রণসংগীত বলেছেন। বাঙ্গালায় গুভাজু আর দেবভাজুতে লড়াই। বঙ্গদেশকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত ছিল। বাঙ্গালায় তখন অনেক রাজ। তার মধ্যা গঙ্গার উপর, ঠিক ত্ৰিবেণীতে একটা বাগদী রাজ্য। রূপা রাজার সেনায় বাগদীর সংখ্যা এক লক্ষ বাগদী ও পাঁচ হাজার ডোম যোদ্ধা।
সেই রাজা বল্লাল সেনের আমল থেকে আজও ছড়িয়ে আছে ছেলেভুলানো কথকতায় আগডুম বাগডুম/ ঘোড়াডুম সাজে। কালে কালে মুখে মুখে এই ছড়াটি অনেক গুলি চেহারা পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ হুগলি-অঞ্চলে সাওতাল পরগনায় যেভাবে ছড়াটি পেয়েছেন বিক্রমপুরের ভদ্রগৃহস্থ থেকে সংগৃহীত ছড়ার পাঠ অনেক ভিন্ন। তবে কনটি মূল পাঠ তা বলতে না পারায় অন্য পাঠগুলি বাদ দেওয়া যাবে না বলে মনে করছেন সবাই।
আগডম বাগডম ঘোড়াডম সাজে।
ডান মেকৃড়া ঘাঘর বাজে। 
বাজতে বাজতে পড়ল টুরি।
টুরি গেল কমলাপুরী।             

আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে’– এই ছত্রটির কোনো পরিষ্কার অর্থ আছে কি না জানি না। তবে ভাষার যে ক্রমশ কিরূপ রূপান্তর ঘটেছে তার একটা হিসেব করতে পারি। আমাদের ভাষা এবং সমাজের ইতিহাস-নির্ণয়ের পক্ষে এই ছেলে ভোলানো ছড়া বিশেষ মূল্য থাকতে পারে।
বাঙালির প্রাচীন জীবনের ভাঙা-গড়া, ওঠানামা নিয়ে তৈরি ছড়ার সংখ্যা অসংখ্য। এদের মধ্যে সবচেয়ে মিষ্টি হলো ছেলে ভোলানো ঘুম পাড়ানি ছড়া। সম্ভবত এই ছেলে ভোলানো ছড়াগুলো নারীর মাথা থেকেই বেরিয়েছে। কারণ বাচ্চাদের ঘুমা পারানর দায়িত্ব মেয়েরাই পালন করে থাকে। অসাধারণ এক চুম্বকীয় শক্তির মহচ্ছন্ন ধাঁধা, ছড়া ও প্রবাদ অশান্ত শিশুকে শান্ত করার জন্যই- ইতিহাস বা ইতিহাসের গল্প বলার জন্য নয়। তবে মানতেই হবে এই ছড়াগুলোর আড়ালে প্রাচীন বাংলার সত্য কথা আছে।           



একটি মিথ ও তার সত্য-সত্যের অনুসন্ধান

ভালুকগাছি এলাকার প্রবীণ মহির মির্জা লুঙ্গি কাছা মেরে খালি গায়ে নিমগাছের নিচে উবু হয়ে বসে আছেন। গায়ে নিমের বাতাস লাগানোর ব্যাবস্থা। কবিরাজ এই বিধান দিয়েছে। কবিরাজের নাম মোজাউল্লা বেদান্ত শাস্ত্রী। মির্জা সাহেবের হজমের সমস্যা কিছুই খেতে পারেন না।
সকালে এক ঘণ্টা নিমের বাতাস। দুপুরে চায়ের চামুচে এক চামুচ নিমপাতার রস। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে নিমগাছের ছাল ভেজানো পানি। এই চিকিৎসার নাম নিম্ব চিকিৎসা। চিকিৎসা সাতদিন চলবে। সাতদিন পর অন্য বিধান। আজ চিকিৎসার তৃতীয় দিন।
মির্জা সাহেব দূর থেকে দ্রিমাকে দেখলেন। তার মেজাজ ভয়ংকর খারাপ ছিল। মেজাজ ঠিক হতে শুরু করল। তিনি আশেপাশে তাকালেন। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটি এসে বসবে কোথায়? মাটিতে নিশ্চয় বসবে না? তার মেজাজ আবার খানিকটা খারাপ হলো। তার এই বাড়িতে খুব কম করে হলেও পাঁচজন লোক। আশেপাশে কেউ নেই এটা কেমন কথা?
রাখাল চুন্নুকে এখন অবশ্য দেখা যাচ্ছে। শীতল পাটি হাতে দৌড়ে আসছে। মির্জা সাহেবের মেজাজ ঠিক হলো। পুরপুরি না, তবে কাজ চালাবার মতো।
দ্রিমা বলল, আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনি প্রথম বলেছেন লোক কাহিনীখ্যাত কিংবদন্তীর চাঁদ সওদাগরের নৌকা।  
মির্জা সাহেবের বলল, আপনি নৌকা দেখেছেন।
প্রাথমিক কাজ শেষ। মালবাহী বিশাল নৌকা ভালভাবে দেখা হয়নি। গ্যাপ আছে। আপনার কথা জানতে এসেছি।
রাজশাহীর পুঠিয়ায় হোজা নদী সংস্কার ও খননের সময় প্রাচীন কালের একটি মালবাহী বিশাল নৌকার সন্ধান পাওয়া গেছে। এক সময় হোজা নদী দিয়ে চাঁদ সওদাগরসহ পুঠিয়া-তাহেরপুরের রাজ-রাজারা সফর করতেন। আমাদের ধারণা, সে সময়ের খড়স্রোতা এই নদীপথে যাওয়ার সময়ে মালামালসহ বিশাল আকৃতির এই নৌকাটি এখানে ডুবে যায় এবং কালের আবর্তে সেটি মাটির নিচে চাপা পড়ে।
তবে বিশেষজ্ঞরা এই ধারণায় সমর্থণ দেননি।
স্থানীয়দের ধারণা এটি। লখিন্দরের পিতা চাঁদ সওদাগর হড়াই, গড়াই, কুমার ইত্যাদি নৌপথে চলাচল করতেন। চাঁদ সওদাগরকে নিয়ে অত্র এলাকায় একটি প্রবাদ শোনা যায়-
সব নদী খান খান
হড়াই নদী সাবধান
হড়াই নদীতে চাঁদের বাণিজ্যের নৌকা ডুবে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক মনসামঙ্গল কাব্যধারার একটি কিংবদন্তী চরিত্র চাঁদ সওদাগর সার্বিক অর্থেই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে তিনি ছিলেন প্রাচীন চম্পক নগরের একজন ধনী ও ক্ষমতাশালী বণিক।

মনসার কাহিনীর টানটান একটি অংশ হল লখিন্দরকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া। অনিশ্চিত যাত্রা। যেখান থেকে এসেছে ভাসান। এছাড়াও সর্পদেবী মনসার পূজা, ধর্মীয় মেলা, টিকে থাকা ঐতিহ্য, স্থানি লোকাচার নিয়ে আরো কিছু রুপকথা প্রচলিত রয়েছে।
মহাস্থানের চালু ইতিহাস আর প্রচল কিংবদন্তির বাইরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মনসা-মঙ্গল কাব্যের নানা আনুষ্ঠানিকতা প্রচলিত আছে। এগুলো বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোক নাটকের সম্পদ। এদের আছে আলাদা পরিবেশন রীতি, আলাদা আঙ্গিক।  
 ধনভাণ্ডার ঢিবির একাংশ 

কালজয়ী উপাখ্যান বেহুলা-লখিন্দরের স্মৃত বিজড়িত মহাস্থানের বেহুলার বাসর ঘর একটি কাল্পনিক মনুমেন্ট। যাকে ঘিরে রয়েছে অত্যন্ত জনপ্রিয় মিথ। সেই মিথের পেছনে সত্য খুজছে দ্রিমা আর সহকারী হিমানী।

এক অনার্য নারীর বেহুলা। যে যমলোক থেকে ফিরিয়ে এনেছে তার স্বামীকে। শুধু তাই নয় তার ছয় দেবর মানে চাঁদ সদাগরের ছয় পুত্রকেও। বেহুলা কলার ভেলায় করতোয়া নদী পথে সর্গে গিয়েছিলে। ফিরেছেন সেই পথা।
ঐতিহাসিক কাল থেকে মহাস্থানগড় থেকে করতোয়া বেয়ে সব দেশে যাওয়ার পাথ ছিল। চাঁদ সওদাগর এই পথে সাগর পাড়ি দিয়ে বাণিজ্যে যেতেন
চাঁদ সওদাগর বাণিজ্যপ্রেমী, ধনাঢ্য, বহুল আলোচিত ঐতিহাসিক বণিক বিপ্রদাস পিপলাই বা বিজয় গুপ্ত এর দুশো বছর পর যখন মনসা মঙ্গল কাব্য রচনা করেন তখন ঐতিহাসিক চাঁদ সওদাগরকে নায়ক চরিত্রে দেখি আর মনসা দেবীর পূজার কাহিনীকে দেখতে হয় লোককথা হিসেবে
মসলা, মসলিন, হস্তশিল্পসহ পসার ভর্তি করে তার সপ্তডিঙ্গা মধুকরে শ্যাম (থাইল্যান্ড, মালয় (মালয়েশিয়া) লঙ্কা (শ্রীলঙ্কা), জাভা (ইন্দোনেশিয়া) ইত্যাদি সমুদ্রপাড়ের দেশে বাণিজ্যতে যেতেন
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে একাদশ শতাব্দীর সেন শাসনামলে, কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে চতুর্দশ শতকে সুলতানি শাসনকালের আন্তর্জাতিক বণিক চাঁদ সওদাগর। যার বাস চম্পক নগর বা বর্তমানে চাঁপাই নগর যা বঙ্গদেশে অবস্থিত ছিল।
চম্পক নগর মহাস্থানের কথায় হতে পারে? শিবগঞ্জ উপজেলার ষষ্ঠীতলা ধাপ থেকে ২০০ মিটার দক্ষিণ পশ্চিমে গোনরাই বিলের দক্ষিণ পাড়ে কাছাকাছি স্থানে ধনভাণ্ডার ঢিবি নামে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা আছে।
ধনভাণ্ডার ঢিবির দৈর্ঘ্য ৪৫ মিটার, প্রস্থ ৩০ মিটার ও উচ্চতা প্রায় ৯ মিটার। স্থানীয় লোকদের বিশ্বাস এখানে এক সময় চাঁদ সওদাগরের ধনভান্ডার ছিল। এই ঢিবির প্রাচীন ইট-এর প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়নি। কারণ উৎখনন করা হয়নি।
উৎখনন করা হয়েছে গোকুল মেধ নামে একটি জায়গা। মহাস্থানগড়ের ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং বগুড়া শহরের ৯ কিলোমিটার উত্তরে বগুড়া-রংপুর সড়ক থেকে ১ কিলোমিটার দূরে বেহুলার বাসরঘর বা লখিন্দরের মেধ নামে পরিচিত স্থানটিতে খনন করে একটি সারিবদ্ধ অঙ্গনে ১৭২টি আয়তাকার বদ্ধঘরের সন্ধান মিলেছে।
গোকুল মেধের এই স্তুপের কিছু পশ্চিমে এগোলেই দেখা মেলে বেহুলার বাসর ঘর স্মৃতিচিহ্নের। তার থেকে কিছুটা পুর্বে পাওয়া যায় ২৪ কোণ বিশিষ্ট এক বিরাট চৌবাচ্চা স্নানঘর। জানা যায় যে মধুনিশি পর এই চৌবাচ্চার জলেই বেহুলা শুচিতা-স্নান করতেন।
বেহুলা-লক্ষিন্দরের বাসর হলো বাংলা পৌরাণিক কল্পের এক অবিসংবাদিত কাহিনী। কাহিনীমতে বেহুলা করতোয়া নদীতে তার স্বামীর দেহ নিয়ে ভেলায় ভাসান দেন ইন্দ্রলোকে যেয়ে তার আবেদন ব্যাখ্যা করতে, তাদের দুই প্রাণের পুনর্মিলনের আরাধনা সাঁধতে। ইন্দ্রলোকে পৌছাবার পর দেবতাদের সামনে বেহুলা তার আকুল মিনতি পেশ করেন। কঠোরতা সত্ত্বেও, দেবতারা অবশেষে লক্ষ্মীন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেন এবং বেহুলা তার স্বামীকে নিয়ে ফেরত আসেন। এই দুটি প্রাণের বাসর হয় এই গকুল মেধ বা বেহুলার বাসরঘরে।
পৌরণিক গল্পে আছে নেপাই ধোপানী ছিল লখিন্দরের বাড়ির ধোপা। লোহার বাসরঘরে কাছাকাছি নেপাই ধোপানীর ধাপ নামে একটা ঢিবি আছে। পৌরণিক গল্পের মিল পাওয়া যায় না ঠিকই তবে এই এলাকা যে বৌদ্ধদের মঠ ছিল তা ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। সেই হিসাবে 'নেপাই ধোপানীর ধাপ' কেটে ফেলছে স্থানীয়রা।
আরেকটি বিস্মৃত প্রত্ন স্থানের কথা জানাল। কানচ গাড়ি বা কানচ কূপ। জনশ্রুতি আছে বেহুলার মৃত স্বামী লক্ষ্ণীন্দর এখানকার কানচ কূপের পানির মাধ্যমে জীবন ফিরে পেয়েছিল।
চাঁদ সওদাগরকে যে পানিতে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিল মনসা তার নাম কালীদহ সাগর। কালীদহ সাগর মহাস্থানের একটি বিল বিশেষ। প্রাচীন এই কালীদহ সাগরে প্রতিবছরের মার্চ মাসে হিন্দু ধর্মালম্বীদের রারুন্নী স্নান অনুষ্ঠিত হয়। স্নান শেষে পুণ্যার্থীগণ সাগরপাড়ে গঙ্গাপূজা ও সংকীর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

জাতিস্মরগানে লক্ষ্মীন্দর আর বেহুলাকে নিয়ে কবির সুমন সুর বেঁধেছেন
কালকেউটের ফণায় নাচ্ছে লক্ষ্মীন্দরের স্মৃতি
বেহুলা কখনও বিধবা হয় না, এটা বাংলার রীতি
ভেসে যায় বেলা এ বেলা ও বেলা একই শবদেহ নিয়ে
আগেও মরেছি আবার মরবো প্রেমের দিব্যি দিয়ে

চাঁদ সওদাগরের পুত্র লক্ষ্মীন্দর; আর তার সতীর্থ ব্যবসায়িক সাহার কন্যা বেহুলা কাহিনীর ভেতর কিছু দুর্লভ উপাদানের খোঁজ করতে গিয়ে দ্রিমা ঝামেলায় পরে। স্থানিয় কুসংস্কারের প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল সে।    

বেহুলার বাসরঘর নামে পরিচিত গকুল মেধ 

কুসংস্কার এবং কতিপয় মানুষের প্রলাপ

হিমানী ঝাল মুরি মাখাচ্ছে। তার মুখ হাসি হাসি। দ্রিমা হিমানীকে ফেসবুকের ম্যাসেনজারে আসা এক ম্যাসেজ পড়ে শুনাচ্ছে। কবিরাজের নাম মোজাউল্লা বেদান্ত শাস্ত্রী।   

ম্যাডম
আপনার প্রকাশিত নিবন্ধ হাতে পেয়েছি। আপনার লেখা পড়ে যার পর নাই হতাস হয়েছি। আপনি আমাদের পবিত্র বিশ্বাসকে অপমান করেছেন। আপনার লেখার কোন মূল্য নাই। পাঁচ টাকার ছেড়া আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো নোট দিয়েও কেনা যাবে না। আপনি যে খান বাড়ী বড় ফকির উত্তরাধিকারিণী বলে পরিচয় দেন সেই পরিচয়কেও অপমান করেছেন।
আমি খবর নিয়ে জেনেছি, আপনার দাদীর বাবা বড় ফকির ঝার-ফুক দিতেন। ফকরান্তি করতেন। তিনি জিনে ধরা রোগীর জিন ঝারতেন। আপনার মতো জ্ঞানপাপিকে ধর্মে কথা বলবার প্রয়োজন আমি বোধ করছি না। ইসালাম ধর্মে বিশ্বাসীরা জিনের অস্তিত্ব সিকার করে। আমি দেশের মানুষকে জানাতে আপনি শিক্ষিত কুলের কলঙ্ক। আর তাই আপনার পত্রিকায় পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠাব।

ইতি
কবিরাজের মোজাউল্লার
পক্ষে এলাকাবাসী       

ম্যাসেজ শেষ করে দ্রিমা বলল, পতিক্রিয়া কেমন দেখলি?
হিমানী বলল, সত্যি ইংকা করবি?
দ্রিমা বলল, করতে পারে। অন্য আইডি থেকেও আমার বিষদগার ছরাচ্ছে। সেই পোস্টে শুধু গালাগালি।

কবিরাজের মোজাউল্লার সাথে ঝামেলা বাধার কারণ খুব তুচ্ছ।
কবিরাজ তার রুগীকে গোসল দিচ্ছে। যথেষ্ট আয়োজনের গোসল। নাইলনের দরি দিয়ে দু’হাত বেঁধে চল্লিশঅর্ধ এক নারীকে দাঁত দিয়ে কাঁসার বদনা তুলতে বলা হচ্ছে। পানি ভর্তি ভারী বদনা তুলতে পারছে না রুগী। এদিকে অনবরত তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। ঠাণ্ডায় মহিলাটির গলা বসে গেছে। সেই বসা গলায় কাকুতি-মিনতি করছে।
দ্রিমা কাছে গিয়ে বলল, এমন ভারী বদনা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে তুলতে বলছেন; কবিরাজ সাহেব আপনি কি তুলতে পারবেন?
কবিরাজ মুখ কালো করে বলল, এরচেয়ে ছোট সাইজের বদনা নেই। আমি কি করবো।
প্লাস্টিকের বদনা নেন।
এইবার কবিরাজের ধৈর্যছুঁতই ঘটল। সে গায়ের পানি মুছতে মুছতে বলল, আপনাকে সম্মান দেখাচ্ছি তো, এইটাই আমার নিয়োম।

দ্রিমা বিরক্ত হয়ে বলল, ঠিক আছে জিন ঝাড়বেন। এখন পানি ঢালা বন্ধ করেন। এই সময়ে এমন অপচিকিৎসা মানা যায় না। অসহ্য।

কবিরাজ বলল, নাস্তিকদের কাছে তো ধর্ম বলতেই অসহ্য। আমাকে আমার কাজ করতে দেন। আপনি বিদায় হলে ভালো হয়।
দ্রিমা সরে এলো। স্থানিয় থানায় ঘটনা জানালো। পুলিশ এসে কবিরাজকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো। এর ঘণ্টা খানিক বাদে মির্জা সাহেবসহ গণ্যমান্য বেক্তিরা ছুটিয়ে আনলো।
কালিদহ সাগরে স্নান  

কুসংস্কারের (Superstiotion) বেড়াজালে লোকসমাজের অসহায় মানুষ আষ্টে পৃষ্টে বাঁধা। এই কুসংস্কার প্রথা আমাদের সমাজ ও ধর্ম সত্য রীতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই যেমন- ভোলা মাস্টারে বাড়ি থেকে ফিরে রাতে দ্রিমার পেট খারাপ করল। তাই দেখে হিমানী বলল, কইছিনি না মন্ত্র পড়ছি... এখন বিশ্বাস করলেন?
দ্রিমা হিমানী বোঝানর চেষ্টা করলো। বলল, খালি পেটে তেলের জিনিশ খাওয়া, রোদের মধ্যে ঘুরাঘুরি করা কিংবা খাবার পানির কারনে এমন হতেই পারে।
দ্রিমা বুঝল উল্টো। বলল, মন্ত্রের মধ্যে জাদুশক্তি আছেজাদুমন্ত্র গুপ্তবিদ্যা, যাক কয় ডাকিনীবিদ্যা। সবকিছুতে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়। শিষ্য ছাড়া অন্যকে মন্ত্রশিক্ষা দেওয়া যায় না। হামি শিখছি হামার মায়ের কাছত।             

অদ্ভুত কুসংস্কারের বীজ বাংলায় সেই প্রাচীন কালে পোঁতা হয়েছে। রোগ-বালায়ের নিবারক আর্যদের তুলনায় এখানকার নারী সুশোভন ও আদর্শকি ছিল। অবাক ব্যাপার মাত্রি তান্ত্রিক সমাজের চিত্র পাল্টে যায় আর্য আগমনে।     
ডাকিনীবিদ্যার নারী ছিল পূজিত। কালে কেলে সে আধ্যাত্মিক চেতনার অধিকারী ডাকিনীকে ডাইনী বলে ভয়ংকিরি নারী বলে গণ্য হতে লাগলো। আর এই অপবাদে শত শত নারীকে পুরিয়ে মারা হয়েছে বা হচ্ছে।
হিমানীর মা তেমনি ডাকিনীবিদ্যার একজন ছিলেন। হিমানী জানায়, ডাকিনীবিদ্যার অতিব ভয়ঙ্কর সাধনা। ভূতপ্রেত থেকে মুক্ত থাকার জন্য শরীরবন্ধন মন্ত্র, বন্ধনমন্ত্র, বাঘ ও সাপের মুখখিলানী’, বন্যা প্রতিরোধ’, চোর থেকে সম্পদ রক্ষার জন্য চোরবন্দী, নারী-পুরুষ পরস্পরকে বশ করার জন্য আছে বশীকরণ মন্ত্রএবং অন্যের ক্ষতি করার জন্য বাণমারা মন্ত্রআছে
আর্যদের প্রতিহিংসাবৃত্তি প্রচলনের আগে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ছিল ডাকিনীদের মন্ত্র প্রতিরোধক এবং কতক প্রতিষেধক। সেই রহস্য ময় বিদ্যার ধারক হিমানী আমার কাছে বিশেষ কিছু না হলেও খিয়ার অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশিষ্ট জন।         
 চাঁদসদাগরের কথিত ধন ভাণ্ডার ছিল এই খানে 

লৌকিক পুণ্ড্রবর্ধনের অলৌকিক নারীদের কাহিনী

লৌকিক জগতের অলৌকিক সম্পর্কে থাকা হিমানীর মতো নারীদের কুহকজাগানো ঘটনায় ভরা মহাস্থানগড়ের চার পাসে। এই ছোট্ট অঞ্চলটুকু ভেতর কত যে রহস্যজড়ানো কাহিনী আছে... এসব ভাবছিল দ্রিমা। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।

হ্যালো দ্রিমা।
জি বলছি।
কেমন আছিস?
ভালো। আমি কার সাথে কথা বলছি?
গলা চিনতে পারছিস না?
ও আচ্ছা আনিস। তুই একেক সময় একেক নাম্বারে কথা বলিস চিনব কিভাবে?
এই নাম্বার তো পুরনো। তোর কাছে থাকার কথা। মোবাইলে নাম ওঠেনি?
খেয়াল করি নি।
ঠিকই খেয়াল করেছিস। মাঝখানে ভাব নিলি।
বিশ্বাস কর। খেয়াল করি নি। খদার কসম।
কথায় কথায় খোদাকে ডাকিস না। উনাকে শান্তিতে থাকতে দে। উনাকে মিথ্যার সাক্ষী করে পাপের বোঝা বাড়াস না।
কি বলতে চাস বলে ফেল।
নাটক দেখতে যাবি? প্রত্ন নাটক মহাস্থানের কথা তো শুনেছিস। নাট্যকার সেলিম মোজহার আর লিয়াকত আলী লাকী নির্দেশক। নাটকে তিনশতাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রী, মহাস্থানের গৌরবোজ্জ্বল আখ্যানের ভিতর দিয়ে সমগ্র বাঙলার মহাস্থান হয়ে ওঠার গল্প।
নাট্যকার সেলিম মোজহার বাংলাদেশের প্রথিতযশা না।
হলেও এই একটি নাটকই তাকে উত্তীর্ণ করেছে নাট্যকারের পরিচয়ে।
আসলে কি জানিস মহাস্থান হাজার হাজার বছর ধরে নারিদের দৃপ্ত ইতিহাস আছে। আমার শঙ্কা নারীদের কথা সেভাবে উঠে আসেনি। প্রাচীন শিকারযুগ থেকে শুরু করে বদিকযুগ, আদিবাসি পর্ব, রামায়নের গীত, কালিদাসের কাব্য, চর্যাপদ, সুফিসামা, বৈষ্ণব পদাবলী, ব্রাহ্মসংগীত, লোকগান, বৃটিশ বিরাধী আন্দোলন, ব্রতচারীদের গান নারীদের বিশাল অবদান আছে।
তুই হয়ত জানিস, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ইতোপূর্বে নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এবং নরসিংদীর উয়ারি-বটেশ্বর স্থাপনা নিয়ে এরকম দুইটি প্রত্ননাটক মঞ্চস্থ করেছে। হাজার বছরের বাঙলার নাট্য উপস্থাপনরীতি অনুসরণ করা হয়েছে এতে। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকের সে মানুষগুলো যেন আবার জেগে ওঠে। চড়ক পূজা, বনশিকার, সামগান ও যজ্ঞে যেন দর্শক হারিয়ে যায় সভ্যতার ঊষালগ্নের জীবনভূমিতে।
এ অঞ্চলে যে কত মধু ও বিষাদের ঐকতান, বেদনা ও হাসাহাসির অর্কেস্ট্রা, ইয়ত্তা নাই তার। এখানে শায়িত আছেন হযরত শাহ্ সুলতান বলখী (রহ.)। আছে তাহার স্মৃতি বিজরীত মাজার ও মসজিদ, আসে হাজার হাজার মাজার জিয়ারতকারী ও ভক্ত-আশেকান, এ পটভূমিতে অবস্থিত প্রত্মতাত্ত্বিক যাদুঘর, বহুল আলোচিত ভাসুবিহার, হিন্দু সম্পদায়ের তীর্থস্থান শিলাদেবীর ঘাট, রয়েছে জীবন্তকূপ। যে কূপে মৃত মানুষ ফেলে দিলে জীবিত হত বলে প্রবাদ রয়েছে।

মিথের পুন-নির্মাণ, কিংবা কোনো কিংবদন্তি হয়ে ওঠা চরিত্রকে মিথের মতো করে উপস্থাপন, অথবা রূপকথার কোনো চরিত্র অথবা ঘটনার পুন-উপস্থাপন একটু কঠিন ও চর্চাসাপেক্ষ কাজ। সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যের শিকড় প্রোথিত।
একদিকে যেমন আছে রাজা-বাদশা, জমিদার, প্রভৃতি উচ্চ শ্রেণির শাসন- শোষণের চিত্র, অন্যদিকে আছে কৃষক, জেলে, তাতীঁ, কামার, কুমার, নাপিত, ছুতার, বৈদ্য, ডোম, চাড়াল, প্রভৃতি দরিদ্র ও অন্ত্যজ শ্রেণির নির্যাতন ও দারিদ্রতার চিত্র।

দেখা যায় শত শত মানুষের জ্বরাগ্রস্ততা, অনাবৃষ্টি, ফসলহীন, খাবারহীন, সাধারণ মানুষের মধ্যে হাহাকার। এর মাঝে পুণ্ড্রের রাজার রাজমহলে বা কার্তিকের মন্দিরে নৃত্য পটিয়সী দেবদাসী কমলা নাচে।

পুন্ড্রনগরের যোগীর ধাপনিবাসী ষোড়শী শ্রীলেখা কিংবা পদ্মাদেবীর লুপ্তপ্রায় কাহিনীকথায় অথবা খুলনার ধাপ ও লহনার ধাপের মহয়সি নারীদের লোকভাষা বা জনশ্রুতি অতীত নারীসমাজের অন্তর্জীবন ও বহির্জীবনের বিচিত্র পাই। বেনের মেয়ের কাব্য প্রতিভা আর খনার বচনে অতীত দিনের আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির টুকরো টুকরো রঙচটা ছবি পাই। রবীন্দ্রনাথ এদের বলেছেন ইতিহাসের চূর্ণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ছেলেভুলানো ছড়া বাংলা ভাষায় ছেলে ভুলাইবার জন্য যে-সকল মেয়েলি ছড়া প্রচলিত আছে, কিছুকাল হইতে আমি তাহ সংগ্ৰহ করিতে প্রবৃত্ত ছিলাম। অনেক প্রাচীন ইতিহাস প্রাচীন স্মৃতির চুর্ণ অংশ এই-সকল ছড়ার মধ্যে বিক্ষিপ্ত হইয়া আছে, কোনো পুরাতত্ত্ববিৎ আর তাহাদিগকে জোড়া দিয়া এক করিতে পারেন না, কিন্তু আমাদের কল্পনা এই ভগ্নাবশেষগুলির মধ্যে সেই বিস্মৃত প্রাচীন জগতের একটি স্বদূর অথচ নিকট পরিচয় লাভ করিতে চেষ্টা করে।      

###
সাজেদুর রহ্মান



Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান