তেজোময়ী তিন ললনা


পুণ্ড্রের পাঁচালী-২৯ (তেজস্বিনী-৫ম পর্ব)
সাজেদুর রহমান
তেজোময়ী তিন ললনা


পুণ্ড্রের পাঁচালি লেখালেখিতে কিছু শাখা-উপশাখা তৈরি হয়েছে। একটি প্রধান শাখা- ‘তেজস্বিনী’ ‘তেজস্বিনী’ সম্পর্কে একটা ঘটনার কথা বলি। আমি তখন মহাস্থান নিয়ে জানতে শুরু করেছি। মহাস্থানগরের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলি ঘুরে ঘুরে দেখছি।

এক সন্ধ্যাবেলায় আমি গকুলে খুল্লনার ধাপ বসে আছি। নিজের হাতে খুড়ে স্থাপনার ইটের দেয়ালের খানিকটা উন্মুক্ত করেছি। ইটের সারি মাথা চাড়া দিয়ে অস্তিত্ব প্রকাশ করছে- এই দৃশ্য দেখে মজা পাচ্ছি এবং মনে মনে খুল্লনা নামের ঐতিহাসিক নারীকে নিয়ে ভাবছি।
      ভাবনার এই পর্যায়ে আমি একটু কেঁপে উঠলাম। আমার কাছাকাছি এসে টহল পুলিশের জিপ থমকে দাঁড়াল। তারা দলে চার জন। দুজন দুজন করে জিপ থেকে নামল এবং এমন ভঙ্গি করল যেন পৃথিবীর সবচে’ বড় ক্রিমিনালকে পাওয়া গেছে। দলের একজন ধমকের সঙ্গে বলল, কে ওখানে? পরিচয় কি?
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। অত্যন্ত বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, আমি সাজু। আপনাদের অবস্থা কি, ভালো?
   পুলিশের পুরো দলটাই হকচকিয়ে গেল। উর্দি পরা মানুষদের অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যে-কোন কথা জিজ্ঞেস করলে এরা ভড়কে যায়। যে-কোন ভড়কে যাওয়া প্রাণীর চেষ্টা থাকে অন্যকে ভড়কে দেয়। কাজেই পুলিশদের একজন আমার দিকে রাইফেল বাগিয়ে ধরে কর্কশ গলায় বলল, পকেটে কি রাখলি?

আমি আগের চেয়েও বিনয়ী গলায় বললাম, কিছু নেই। আমার পকেট ফুটো।
সেয়ানাগিরি করছিস? ফাজিল। চড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেব।
     দাঁত ফেলতে চান ফেলবেন। ডেন্টিস্ট আর পুলিশ দাঁত ফেলবেন না তো কে ফেলবেতবে দাঁত ফেলার আগে প্লিজ একটু যাচায় করবেন কি? সত্যি পকেট ফুটো।

একজন এগিয়ে এলো। সারা শরীর হাতাহাতি করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গীদের একজনকে বলল, ওস্তাদ আসলেই সত্যি পকেট ফুটো।
যাকে ওস্তাদ বলা হচ্ছে সে সম্ভবত দলের প্রধান এবং সবচেয়ে সিনিয়র। সে বলল, এই হারামজাদা মেকানিক। মেকানিকদের  মিস্ত্রী। মিস্ত্রীদের যন্ত্রপাতি পকেটে রাখতে রাখতে পকেট ফুটো হয়ে যায়। এই চল থানায় চল।
আমি তৎক্ষণাৎ জিপের দিকে যাওয়ার ভঙ্গি করে বললাম, জি চলুন। আপনারা কোন থানার আন্ডারে? শিবগঞ্জ থানা?
পুলিশের দলটা পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেল। থানায় যাবার ব্যাপারে আমার মতো আগ্রহী কোনো আসামী তারা বোধহয় খুব বেশি পায় না।
কি নাম বললি?
সাজু।
কি করিস অন্ধকারে?
পূরাকৃত্তি দেখতে এসেছি।
রাতেরবেলায় পূরাকৃত্তি দেখতে এসেছি?
পূরাকৃত্তি সব সময় দেখা যায়।

ওস্তাদ যাকে বলা হচ্ছে সেই পুলিশ এগিয়ে আসছে। পেছন থেকে একজন বলল, ওস্তাদ বাদ দেন। গাঁজা-মাজা খায়। কসে দুইটা চড় দিয়ে চলে আসেন।
ওস্তাদেরও মনে হয় সে-রকমই ইচ্ছা। লোকাল বাসের গ্লাস ভাঙা এবং গালে চড় কসার আনন্দ প্রায় কাছাকাছি। টহল পুলিশের ওস্তাদ এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে কেন?
সজোরে একটা চড় খেলাম। চোখে জোনাকিপোকা দেখার মতো চড়। কান তালা লেগে গেল। ওরে বাবারে বলে চিৎকার দিতে গিয়ে দিলাম না। ওস্তাদ চড় মেরে চলে যাচ্ছিলেন। আমি অমায়িক ভঙ্গিতে বললাম, আরেকটা চড় দিয়ে যান। না হলে বৌ বাঁচবে নাবৌ মরলে নারী নির্যাতন মামলার সম্ভাবনা আছে। আমি আদালতে যেতে চাই না।                                              

পুলিশের দল স্পষ্টত ঘাবড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে গেছে ‘ওস্তাদ’। আমি বললাম নিরীহ মানুষকে চড়-থাপ্পড় খেয়ে চলে যাবেন এটা কেমন কথা?
এই তুই চাস কি?                    
আমি আন্তরিক ভঙ্গিতে বললাম, আরেকটা চড় দিয়ে দেন, বসায় চলে যাই।
পুলিশের দল কিছু না বলে জিপে উঠে পরল। আমিও তাদের অনুসরণ করছি। মানুষের ভয় চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে, এদেরও তাই হয়েছে। জিপ দ্রুত চালু করে হুস করে চলে গেল। আমি প্রায় গলা ফাটিয়ে বললাম, ভাইজান, আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে। সি ইউ এগেইন। জিপের পেছনে বসা দুজন পুলিশ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। আমার সামান্য কথার মর্মার্থ নিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করবে। আজকের রাতের টহল ভালো হবে না। আজ তারা সূতাকেও সাপ দেখে ভয় পাবে।              
বিস্ময়ের ব্যাপার- পুণ্ড্রের পাঁচালি-২৯ অধ্যায়ে তেজস্বিনী পঞ্চম পর্বে এসে পৌঁছেছি। পাঁচালি প্রতিটি পরবেই নতুন কিছু দেবার চেষ্টা করেছি। ‘তেজস্বিনী’ এই পর্বটা পদ্মার ঢিবি (পদ্মদেবীর বাসভবন), লহনার ধাপ, খুল্লনার (খুরনা) ঢিবির শুলুকসন্ধান করব
নৃত্য রত গপি- জামিনি রায় ১৯৫০

খুল্লনা-লহনা দুই বোনের এক পতি
নৃত্যগীতে পটীয়সী পদ্মবতী
      
১. মন্দীভূত
লহনার বয়স আমার চেয়ে এক প্রহর বড়। তার জন্মের ঠিক এক প্রহর পর জন্ম হয় এবং দারুণ একটা হৈচৈ শুরু হয়। ধায়মা লুতফন অবাক হয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, আরে, যমজ কন্যা দেখি। ঠিক তখন দমকা বাতাসে কুপী নিভে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। আমরা দুই বোন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকি। ধায়মা লুতফন কুপী জ্বালিয়ে দেবার জন্য চেঁচাতে থাকেন। আমার ঠাকমা ছুটে ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে পানির একটা জালা উল্টে ফেলেন।
আমার জন্মের সময় পানির জালা উল্টে গিয়েছিল বলে পিতা আমার নাম রাখেন খুল্লনা। যার অর্থ খুদ্র জলযান ভাসার স্থানলহনা অপরাহ্ণে জন্মের পর খুব কাঁদছিল, তাই তার নাম কান্না। এইসব নাম অবশ্য টিকল না। কাব্যিক ধারায় হল। একজন হল লহনা। তার সাথে মিল রেখে সায়াহ্নে জন্ম নেওয়া আমি হলাম খুল্লনা। তার কয়েক বছর পরে জানলাম খুল্লনা মানে সুগন্ধি আর লহনা মানে বিপদ।  

লহনা খুব সুন্দরী। লহনার দিকে একবার চাইলে হঠাৎ চোখ ফেরানো যায় না। লহনার মধ্যা পাকা সবরি কলার মতো একটা লালচে ছোপ থাকায় চুলার তাপে কিংবা গরম রৌদ্রে মুখ রাঙা হয়ে উঠলে বড় সুন্দর দেখায়। ভালো কথা, লহনার বিয়ের কথা চলছে। ছেলে বিরাট বড় বণিক। জয়পতির পুত্র ধনপাতি সওদাগর। চাঁদ সওদাগরের ছিল সপ্তডিঙ্গা আর ধনপতির চৌদ্দডিঙ্গা। তাদের প্রধান ডিঙ্গার নাম ছিল মধুকর। আমকেও সুন্দরী শ্রেণির মধ্যে সহজে ফেলা যায়। লহনা প্রবল ঈর্ষা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলেছে, তোর

আমাদের বাড়ির সামনের নদীর নাম কালীদহ। এই নদী করতোয়ার শাখা। বর্ষায় ভীষণা আর শীতে ক্ষীণকায়। সেবার কালীদহে প্রচুর পানি ছিল। সেই পানি বেয়ে মধুকর ডিঙ্গা এসেছিল। ধনপাতি আমার বোন লহনাকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। ওদের বিয়ে হতে দশ দিন লেগেছিল। তো লহনা চলে যায়। আমি তার কথা ভাবি। আমি ভাবি আমার মতো। নিজেকে কল্পনা করছি নববধূ বেসে। আমার গায়ে তখন লাল শাড়ি এবং পায়ে আলতা।        

খুল্লনার ধাপের একাংশ 

দিবানিশি চলে সাধু তিলেক না রহে।
উত্তরিলা সদাগর শ্ৰীকালীদহে॥
২. স্বর্গারূঢ়া
আমি ঘুরে-ফিরে একটাই সবপ্ন দেখি-আমি অপরিচিত একটা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। বিশাল নদী। বড় বড় ঢেউ ভরা নদী। নদীর ওপাশে আবছা-সব জোছনায় থৈ থৈ করছে। হঠাৎ মাঝ নদীতে কি যেন দেখা গেল। ঢেউয়ের প্রবল টানে ভেসে যাচ্ছে। খুল্লনা দেখতে পারছে না তবু পরিষ্কার বুঝতে পারছে ঢেউয়ের টানে যে জিনিসটা ভেসে যাচ্ছে তা একটা মৃতদেহ। মৃতদেহটা খুল্লনার চেনা। খুব চেনা। মৃত মানুষ প্রশ্নের জবাব দেয় না। তবু খুল্লনা চিৎকার করে উঠল—কে কে কে?
স্বপ্নে সবই সম্ভব। মৃতদেহ কথা বলল। অনেক কষ্টে ঢেউয়ের উপর উঠে বসল। ক্ষীণ গলায় বলল, খুল্লনা আমি। ওরা আমাকে মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছে। তুমি আমাকে বাঁচাও।                                          
খুল্লনা আতঙ্কে অস্থির হয়ে বলল, আমি কি করে তোমাকে বাঁচাব? তুমি তো মরেই গেছ।
বাঁচাও খুল্লনা বাঁচাও। মিনতি করছি।
এই সময় নদীতে ঢেউ বেড়ে গেল। জলে প্রবল টান উপস্থিত হল। শোঁ-শোঁ শব্দ হতে লাগল। মৃতদেহটি ভাঁটার টানে তীব্র গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। অনেক অনেক দূর থেকে সে ডাকছে- খুল্লনা খুল্লনা।                               
খুল্লনা নদীর পাড় ঘেঁসে ছুটতে শুরু করেছে। খানাখন্দক ঝোপঝাড় ভেঙে সে ছুটছে। মনে হচ্ছে সে আর দৌড়াতে পারবে না। হুমড়ি খেয়ে পড়বে। মৃতদেহ এখনো তাকে ডাকছে। মৃতদেহের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। সেই স্বর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। খুল্লনার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না।
এ অবস্থায় খুল্লনার ঘুম ভাঙল। তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। জেগে ওঠার পরেও সে অনেকক্ষণ ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপল। তার ভয়ের অনেকগুলি কারণের একটি হচ্ছে, যে যুবকের মৃতদেহটি ভেসে যাচ্ছিল সেই যুবক তার চেনা। যুবকের নাম-ধনপাতিদেখেছিল তার বোন লহনার বিয়েতে। তার গায়ে ছিল লাল রঙের গলাবন্ধ কুর্তা। স্বপ্নেও সে একই কুর্তা ছিল, তবে তার রঙ ছিল কালো।

তীব্র ভয় অনেকটা যেমন হঠাৎ করে আসে তেমনি হঠাৎ করে চলে যায়। রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার খুল্লনার ভয় কেটে গেল। শুধু যে ভয় কাটল তা নয়, হাসিও পেতে লাগল। তার মনে হল সে এমন কিছু ভয়ঙ্কর স্বপন দেখেনি। নদী দেখেছে। নদী কোন ভয়ঙ্কর জিনিস নয়। খুল্লনা ঠিক করল আজ লহনার বাড়িতে যাবে। কতদিন তাকে দেখেনি। লহনার বিয়ে হয়েছে দুই বছর।  খুল্লনার পরিস্কার মনে আছে- ছোটবেলায় সে যার কথা ভাবত রাতে তাকেই স্বপ্ন দেখত। সেই স্বপ্নগুলিও হত ভয়ঙ্কর।
ধনপতির প্রধান ডিঙ্গা মধুকর 

খুলনার রূপ দেখি ভাবে রম্ভাবতী।
আমার খুলনা কল্প আঁধারের বাতি।
৩. চন্দ্রাস্ত
আমাদের মায়ের নাম রম্ভাবতী। নামের সঙ্গে তার চেহারার কোনো সঙ্গতি নেই। রোগা, বেঁটে একজন মানুষ। বেঁটেরা সচারচর কুঁজো হয় না। তিনি খানিকটা কুঁজো। ব্যাক্তিবিশেষর সামনে তাঁর কুঁজোভাব প্রবল হয়। আমি সেই ব্যাক্তিবিশেষর একজন। তিনি কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে আলাদা চোখে দেখেন।
মা জলচকিতে গুটিসুটি মেরে বসে আছেন। বদনায় করে জল খাচ্ছেন। এই মহিলাকে আমি কখনো ঘোটিতে করে জল খেতে দেখি নি। আমি কাছে এসে হাসিমুখে বললাম। মা, শরীর ভালো?
মা যেভাবে চমকালেন তাতে মনে হলো, সাত আসমান ভেঙে পড়েছে। বদনার জল তাঁর শাড়িতে পড়ে গেল। আমি বললাম, হোল কি?
বিব্রত গলায় মা বললেন, মন্ত্র পরা পানি খাচ্ছি।
খুব ভালো। বেশি বেশি মন্ত্র-পুত পানি খান। পণ্ডিতেরা বলেছেন- প্রতিদিন মন্ত্র-পুত পানি খেলে খারাপ বাতাস আকৃষ্ট হয় না।
রম্ভাবতী উঠে বসলেন। মুখ শুকনো করে বললেন, আমার মন সকাল থেকে কু ডাকছিলমনে হচ্ছিল আজ ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে। কেউ খুব খারাপ কোন খবর নিয়ে আসবে। খুল্লনা মায়ের পাসে বসল। সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, সবই চণ্ডীদেবীর ইচ্ছে। দেবী-মা যা করেন মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই করেন। উনি পরম করুণা ময়ি।
যদিও রম্ভাবতী তাঁর জীবনে চণ্ডীদেবীর পরম করুণার তেমন কোন পরিচয় পাননি। তাঁর কাছে প্রায়ই মনে হয়- চণ্ডীদেবী পাষাণ হৃদয়ের মহিলা-সবার দুঃখ কষ্ট তাঁকে বিচলিত করে না।                                                                                
খুল্লনা গত রাতের স্বপ্নের কথা মাকে জানিয়ে, আজ লহনাকে দেখতে যাবার কথা বলল। খুল্লনার এই যাবার কথায় বুক ধবক করে উঠল। কেন যে এমন হল, তার মানে রম্ভাবতী জানে না।

লহনার আনন্দের কোন সীমা নেই। খুল্লনার আসার খবর প্রথম যখন শুনলেন তখন থেকেই সে ব্যাকুল হয়ে পথের দিকে চেয়ে আছে। দূরে খুল্লনাকে দেখেই ছুটে বের হল। রাস্তার উপরেই খুল্লনাকে জড়িয়ে ধরেছে। লহনা কপট ধমক দেচ্ছে- তোর আমার কথা মনে করিস না- এত দিন পরে মনে পড়েছেযা তোর সাথে কথা বলব না।
খুল্লনা হাসি মুখে বলল, বুবু রাগ করিস না।

খুলনায় রূপ দেখি সাধু হবে ভোয়।
ওই ছাড়াইৰে তোমার স্বামীর কোল
৪. সুষুপ্ত
খুল্লনা এসেছে শুনে ধনপতি এসেছে দেখা করতে। ঘরের উঠোনে খুল্লনার সঙ্গে দেখা। ধনপতি হকচকিয়ে গেল। পাখা হাতে উঠোনে বসে বাতাস করছে ফুটফুটে এক পরী। ধনপতি কিছু বলার আগেই খুল্লনা বলল, আমার সওদাগর বোন-পতির শরীর ভালো?
হ্যাঁ শরীর ভালো। এমন করে বিনা খবরে এলে?
খুল্লনা হাসি মুখে বলল, আজি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দুঃস্বপ্ন দেখে ভালো লাগছিল না।
দুঃস্বপ্ন দেখেছ?
খুল্লনার হাসি আরো বিস্তৃত হল। মাথার বেণী দুলিয়ে বলল, আপনি ভাবছিলেন কি বোনকে বিয়ে দিয়েছি তার কথা মনে করবো না? আপনি মস্ত বণিক, আপনারও বিপদ হতে পারে। আমার বোনের সংসারে রাহুর গ্রাস হতে কি পারে না?
কি বল তুমি, রাহুর কুদৃষ্টি কি পরেনাই? আমার বংশ রক্ষা কি হচ্ছে?
সবার তো হয় না। মা-চণ্ডী কৃপা না করলে কিছু হয় না।
আমি শৈব ভক্ত। মা-চণ্ডীকে দিয়ে কিছু হবে না। আমি চণ্ডীদেবীর ঘট ভেঙেছি।     
              পুণ্ড্রের তান্ত্রিক নারী কল্প চিত্র                        


খুল্লনা গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করল, ধনপতি চণ্ডীদেবীর নাম খুব তুচ্ছ ভরে উচ্চারণ করছে। শৈব ভক্ত বলে পরিচয় দিচ্ছে এক ধরণের অহংকার নিয়ে। চণ্ডীদেবীর ঘট ভেঙে যে পাপ করেছে তারই ইঙ্গিত কি স্বপ্নে পেয়েছে। ধনপতি কৌতুহলী হয়ে বলল, কি ব্যাপার মুখের হাসি ফুরল নাকি? তবে তোমার আগমনে বড়ই আনন্দ হচ্ছে খুল্লনা। বড় আনন্দ।
আমারো আনন্দ হচ্ছে। পিঠাপিঠি বোন আমরা। সারাক্ষণ একসাথে থাকতাম। কতদিন পরে দেখলাম। বোন আমরা সুখে আছে।  আছে না?
অবশ্যই আছে। অবশ্যই আছে। তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। তুমি অনেক সুন্দর হয়েছ।                 
সুন্দর হচ্ছে মানুষের চোখে। যার চোখ সুন্দর তার সব সুন্দর। আপনার চোখ সুন্দর।
  
ধনপতির কথা শুনে দাসী দুর্বলা বিষণ্ণ মুখে লহনার ঘরে গেল। ধনপতির মুখে খুল্লনার রুপের প্রসংসা ভালো লক্ষণ নয়। তার মনে খটকা লাগল। লহনা সন্তান দিতে পারছে না। এই তাড়নায় ধনপতি কি খুল্লনার প্রতি আসক্ত হয়ে পরবে?

দু-সতীনে প্ৰমবন্ধ দেখিয়া দুর্বল।
হৃদয়ে লাগিল দাসীর কালকূটজালা৷
... লহনার প্রতি দুর্বলার উপদেশ।
ভূপালী-রাগি। গুমাহ শুনহ। হের লহুন বেণ্যানি।
আপনি কয়িলে নাশ আপনা। আপনি৷
... অবশেষে ওই তোর বধিবে পরাণে

৫. লহনা দুর্বলা-র কথা অগ্রাহ্য করল না।          
  আমি একটা খুন করার এই সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নিয়ে ফেললাম। কদিন খুব অস্থির-অস্থির লাগছিল। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর অস্থির ভাব পুরোপুরি কেটে গেল। একধরনের আরামদায়ক আলস্যে মন ভরে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। ভাদ্র মাসের সায়াহ্ন। আকাশে মেঘ আছে। লালচে রঙের পাতলা মেঘের আস্তর। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত যে মুহূর্তে নেয়া হল, সেই মুহূর্তটা অপূর্ব। এই গাঢ় লাল, এই হালকা হলুদ, আবার চোখের নিমিষে লালের সঙ্গে খয়েরি মিশে সম্পূর্ণ অন্য রঙ। রঙের খেলা যিনি খেলছেন মনে হয় তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। মনটা একটু খুঁতখুঁত করছে।
আমার চোখ আকাশের দিগন্ত রেখায় আটকে গেছে। আমি তাকিয়ে আছি। একসময় দুর্বলা আমার কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বলল, মহামাতা কি দেখছেন? দুর্বলা আমার দাসী। সে ধবধবে একটা সাদা চাদর গায়েদিয়ে জড়সড় হয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা চাদর গায়ে জড়ানো বলেই বোধহয় তাকে দেখাচ্ছে একটা বিড়ালের মতো। বিড়ালের একটি গুণ তার আছে, সে অসম্ভব ধূর্ত। দাসীদের মধ্যে নিম্নশ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তির দাস-দাসীই বেশি। এরকম ধূর্তের সংখ্যা কম।
খুট খুট করে টোকা পড়লো দরজায়।
দাসী দুর্বলা বলল, কে?
জবাব এলো, রানী লহনাকে ডেকেছেন ধনপতি।

লহনাকে ঘড়ে ঢুকতে দেখে ধনপতি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।
বড় রানী লহনা! এসো এসো।
লহনা ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতে লাগলো। ঘড়ের কোনের দিকটা অন্ধকার হয়ে আছে। খুল্লনা আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল। খুল্লনা অভিমানী স্বরে বলল, একজন রূপ দেখিয়ে তোমাকে পাগল করে দিয়েছে। আমকে তো মনেই পরে না।
হা লহনা, খুল্লনা তোমার সতীন হলেও সম্পর্কে দুই বোন তোমরা। সব সতীনের মতো আচরণ করো না। এখন বলি কেন ডেকেছি, আমি সিংহলে বাণিজ্যে যাচ্ছি। সংসারের সব দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। খুল্লনাকে দেখে রেখো। জান তো সে অসুস্থ।
জানবো না? কি বলেন। বৈদ্য ডেকেছেন। ঠিক বলছি তো?
লক্ষ্য রাখবে খুল্লনার দিকে, লহনা তোমার ভরসাতেই রেখে যাচ্ছি।

লহনা বেরিয়ে এলো। রাত প্রায় গভীর হয়েছে। ঘড়ে ঢোকার আগে দুর্বলাকে ডেকে পাঠাল। ধনপতির যাত্রা ভাগ্য খুলতে শুরু করেছে কি না তা দুর্বলার সঙ্গে না বসা পর্যন্ত বলা যাবে না। দুর্বলা আসতেই ঘড়ের দরজা বন্ধ করে পরামর্ষ করতে বসল।                                        

খুল্লনা বেশির ভাগ সময় বনে-জঙ্গলে থাকে 

দুৰ্ব্বলায় বচনে লহনার অতিমান।
কাণে সোণ দিয়া তার সাধিল সন্মান
৬. চন্দ্রাতপে
ভোরবেলাটা অস্বস্তিকর এক দৃশ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। ধনপতির মহলের দরবার হলে রানী খুল্লনা দাঁড়িয়ে আছেন কাঠ হয়ে। সামনে তার বড়রানী লহনা। লহনা মুখে ছোট্ট একটি হাসি। তার হাতে ধনপতির চিঠি। এর মাঝে হাসির কি আছে?
লহনা সবার সামনে ধনপতি চিঠি পড়ছেন। চিঠিটা ধনপতি বাণিজ্যে যাবার আগে সংসারের সব দায়িত্ব তাকে দিয়েছেন সে সংক্রান্ত। খুল্লনাকে লহনা চিঠি দেখিয়ে
শীতল স্বরে বললেন, বিশেষ কিছু না। ধনপতি ছোট রানিকে কয়েকটি কাজ করতে বলেছেন। তুমি আজ থেকে ছাগল চরাবে। আর বাড়ির কাজ করবে। গোয়াল ঘড়ে থাকবে। আমি যা বললাম ঠিক তাই লেখা আছে চিঠিতে।
চিঠির নিচে ধনপতির সাক্ষর দেখে খুল্লনার মুখ সাদা হয়ে গেল। খুল্লনা তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি ধনপতি এমন চিঠি লিখেছেন? লহনা বলল, কাজ ঠিক মতো করতে হবে। না করলে কিভাবে করিয়ে নিতে হয় তা আমার জানা। খুল্লনা জবাব দিল না। সে দ্রুত তার নিজের অবস্থা বুঝে নিতে চেষ্টা করছে। সামনে বসে থাকা মহিলাটা কথাবার্তা বলছে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে।
খুল্লনা, এই চামড়ার চাবুক দেখতে পাচ্ছ? এই চাবুক এখন আমি তোমাকে দেখাচ্ছি। কাজে ভুল হলে তোমার পিঠে পরবে।
কি ঠাণ্ডা কণ্ঠস্বর। কোন সন্দেহ নেই এই মহিলা তাকে মারতে কিছু মাত্র দিধা করবে না। খুল্লনা দেখল বড়রানী আসন থেকে উঠে বাঁ দিকের দেয়ালের কাছে চাবুকের কাছে সরে যাচ্ছে। দুর্বলা অনুসরণ করছে। খুল্লনার ইচ্ছে হল প্রাণপণে চেঁচিয়ে লহনাকে সাবধান করে। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন স্বর বেরুল না।

কোন দিনে মিলে লোণ কোন দিনে তেল।
অনুদিন সাধুর অন্তরে শোক-শেল
৭. অশ্রুমতী  
আজকের দিনটি ঠাণ্ডা। সোনালী রদ্দুরে একটুও ত্যাজ নেই, হিমেল বাতাস বইছে ধীর লয়ে, করতোয়ার পটভূমিকায় টিলাশ্রেণী স্পট দৃশ্যমান। গত কয়েকদিন একটানা বৃষ্টি হওয়ায় বনভূমির পরিবেশ বড় মনোরম। তবু খুল্লনা ঘামতে লাগলো।
ছাগল চরানোর ব্যাপারে খুল্লনার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। ভাসা ভাসা একটা ধারণা যে, ছাগল ঘাস-পাতা খেতে খেতে যেদিক সেদিক যেতে পারে- নিজের খাবার খুঁজতে গিয়ে নিজেই অন্য কোন পশুর খাবার হয়ে রাখালকে বিপদে ফেলতে পারে। সব সময় চোখে চোখে রাখতে হয়। লিন্তু এই ছাগলের পাল খুব শান্ত এবং তারা দল বেঁধে থাকে। খুল্লনা করতোয়ার প্লাবনভূমিতে গজিয়ে ওঠা ঘাস ছাগলগুলি ছেড়ে রেখেছে।  

শীত কেটে গিয়ে বর্ষা এসে গেল। খুল্লনা ঘরবাড়ি প্রায় ত্যাগ করলেন। বেশির ভাগ সময় বনে-জঙ্গলে থাকে। বারামদেউলের পাশের গ্রাম গোরনায় ঘন বন আছে। এখন এই বনেই তাঁর অবস্থান। তাকে দেখে আগের খুল্লনা বলে চেনা যায়না। এর মাঝে একদিন সামান্য ঝামেলা হল। পাল থেকে দুটি ছাগল হাড়িয়ে গেল।         
খুল্লনা ছাগল খুঁজতে বনে বনে ঘুরে আর কাঁদে। সে চার-পাঁচদিন পরপর অষ্টমঙ্গলার পূজা করল। খুল্লনার পূজায় দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সমস্ত বিপত্তি থেকে রক্ষা করেন। দেবী চণ্ডীরই উদ্যোগে খুল্লনা হারিয়ে যাওয়া ছাগল সর্বশীকে ফিরে পান। খুল্লনার এই রীতি অনুসরণ করে আজ একবিংশ শতাব্দীতেও বাঙালি রমণীরা সংসারের মঙ্গলার্থে দেবী মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত ও পূজা করে চলেছে।

দেখতে দেখতে এক বছর পার হিয়। কার্তিক মাস। অল্প অল্প শীত পড়ছে। রাতের দ্বিপ্রহর। বড়রানী খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছেন- হঠাৎ শুনলেন উঠন থেকে দুর্বলাদাসী ডাকছেন- রানী’মা, রানী’মা- রানী’মা জেগে আছেন?
কি হয়েছে?
রানী’মা আমি দুর্বলাএকটু বাইরে আসবেন?
রানী’মা অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর বাতের ব্যাথাবৈদ্য সাবধান করেছে, খবর্দার ঠাণ্ডা লাগানো যাবে না। তিনি ভাবলেন দুর্বলাদাসীর কথায় সায় দেবেন না। এই দাসী ইদানিং বেশি কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে। বিশেষ করে ধনপতির চিঠি জাল করার বুদ্ধি দেওয়ার পর থেকে।                 
দুর্বলাদাসী আবার কাতর গলায় বললেন, একটু বাইরে আসুন রানী’মা- দেখেন কি কাণ্ড হইছে। খুব জরুরী ব্যাপার।     
রানী’মা চরম বিরক্তি নিয়ে বাইরে এলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, দুর্বলাদাসীর কোলে সদ্য প্রসূত শিশু। খুল্লনা তার পাশে মাদুরে শুয়ে আছে। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় দৃশ্য। তার বোন সন্তান প্রসব করেছে। তার জন্য বংসের বাতি নিভে যাওয়ার মত দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে না।
রানী’মা দেখুন বংসের বাতি।
রানী’মা জবাব দিতে পাড়লেন না। প্রথম কয়েক মুহূর্ত মনে হচ্ছিল চোখের ভুল। এখন তা মনে হচ্ছে না। ফকফকা চাঁদের আলো। দিনের আলোর মত সব দেখা যাচ্ছে। তিনি পরিষ্কার দেখছেন- শিশুটি শূনে হাত-পা ছুঁড়ছে। এইত হাসতে হাসতে খানিকটা কাঁদার ভাব করছে। সাঁতার কাটার মত অবস্থায় বাচ্চাটা শুয়ে আছে। কি আশ্চর্য!
রানী’মা দেখতে পাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
রানী’মা খুল্লনার পাশে বসলেন। সস্নেহে বললেন, আমাকে জানাস নি কেন?
খুল্লনা দুর্বল স্বরে বলল, আজ হঠাৎ করে ব্যাথা উঠল। বন থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে আসছি হঠাৎ তলপেটের প্রচণ্ড ব্যাথা দম বন্ধ হলো। দেখতে দেখতে শরীরটা হালকা হয়ে গেল। ফুটফুটে শিশুর মুখ পেট ফুড়ে বেড়িয়ে এলো। কিভাবে যেন দুর্বলাদাসী আমকে খুঁজে পেলো। আমরা প্রথমেই ভাবলাম আপনাকে দেখায়।

রানী’মা শিশুটির নাম রাখলেন শ্রীমন্তশ্রীমন্ত পিতাকে সিংহলের রাজার হাতে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে আনেন।  
পট চিত্র 

কিমিত্যপাস্যাভরণানি যৌবনে
ধৃতং ত্বয়া বার্ধকশোভি বল্কলম্।
বদ প্রদোষে স্ফুটচন্দ্রতারকা
বিভাবরী যদ্যরুণায় কল্পতে।।
          -কুমারসম্ভব
৮. প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস
পুণ্ড্রের খুল্লনা ও লহনার ধাপের অলিন্দে ব্যাবসায়িক পরিসদ পরিবৃত্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন বণিক চাঁদ সাওদাগর ও ধনপতি সাওদাগর। সেন আমলে ভারতের মধ্যে এই দুজন আন্তর্জাতিক ব্যাবসায়িক বেক্তত্তকিংবদন্তী অনুসারে গুপযুগের পুণ্ডরীক নামের বণিকদের বংশধর।
চাঁদ সওদাগর ও ধনপতি সওদাগরের কাহিনী আজ ঐতিহাসিক সত্য বলে পরিচিতি লাভ করেছে। সকল মঙ্গল কাব্যেরই নায়ক সওদাগর। এ মধ্যে চাঁদ সওদাগর, ধনপতি ও তার পুত্র শ্রীমন্ত অন্যতম। চাঁদ সওদাগরের ছিল সপ্তডিঙ্গা আর ধনপতির চৌদ্দডিঙ্গা।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পূর্বকালে পুণ্ড্রবর্ধন মহাসমৃদ্ধিশালী নগর ছিল। এককালে যবদ্বীপ হইতে রোমক পর্যন্ত সর্বদেশের বণিকেরা বাণিজ্যার্থ এই মহানগরে মিলিত হইত। কিন্তু বঙ্গীয় দশম একাদশ শতাব্দীতে সপ্তগ্রামের প্রাচীন সমৃদ্ধির লাঘব জন্মিয়াছিল। ড. নীহাররঞ্জন চাঁদ সওদাগরের বর্ণনা মতে চাঁদ সওদাগরের বাড়ি বর্তমান বগুড়া। মঙ্গল কাব্যের বর্ণনায় যে কলিদহের কথা বলা হয়েছে তা এখন বগুড়ার করতোয়া নদীর খাতে কলিদহের সাগর বল পরিচিত। ধনপতি ছিলেন তাঁর বন্ধু।

পরিবারে খুল্লনা-লহনার কাহিনী চণ্ডীমঙ্গলের বণিকখণ্ড বর্ণিত। এই দুটি কাহিনী আনুমানিক একাদশ শতকে রচিত। ধনপতি-লহনা-খুল্লনার কাহিনী চণ্ডিমঙ্গল কাব্যের আদি কবি হলেন মানিক দত্তের রচনাতিনি ১৪শ শতকের কবি ছিলেন। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মুকুন্দ রামের উপাধি ছিল কবিকংকণ। রাজা রঘুনাথ রায় তার কবি প্রতিভার জন্য এ উপাধি দেন। তাকে দুঃখ বর্ণনার কবি এবং জীবন রসিক কবি বলা হয়।
কবি কঙ্কণ-চণ্ডী ধনপতির উপাখ্যান হয়ত সবই গল্পকথা। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রামাণ্য ইতিহাসকার পন্ডিত দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন- চন্ডীমঙ্গল’-এর এই কাহিনী মূলত নিগৃহীত মানবতার জীবনকথা। উচ্চ-নীচ ভেদ, আর্য-অনার্য দ্বন্দ্ব ইত্যাদি তৎকালীন সমাজের বিষয়গুলি প্রকাশ পেয়েছে। এসব গাঁথায় যেসব দেব-দেবীর মহিমা প্রচারিত হয়েছে তারা কেউই আর্যদের দেবতা নন। এঁরা লৌকিক দেবতার সঙ্গে পৌরাণিক দেবতার সংমিশ্রণে সৃষ্ট বাঙালির নিজস্ব দেবতা। বহিরাগত আর্যদেবতাদের বিরুদ্ধে অনেক সংগ্রাম করে এঁদেরকে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হয়েছে। আর্যদেবতাদের বিরুদ্ধে এই বিজয়ের কারণে মঙ্গলকাব্যের মঙ্গলশব্দটি বিজয়অর্থেও গ্রহণ করা হয়।
লৌকিক -পৌরাণিক দেবতার সংমিশ্রণে সৃষ্ট বাঙালির নিজস্ব দেবতা 

লহনা খুল্লনা নিয়া শুনিবে বচনে॥
অভয়ার চরণে মজুক নিজ চিত
শ্ৰীক বিকঙ্কণ গান মধুর সঙ্গীত৷
৯. স্তূপ করা কালের চিহ্ন
খুল্লনা ও লহনার ধাপের সামনে এসে দাঁড়ালাম তা নিতান্তই ধ্বংসস্তুপ। রাজরানীরা এ-জাতীয় বাড়িতে থাকে না। লহনার ধাপ খুঁড়েও একটা মন্দিরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। মহাস্থানগড় থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে সেকেন্দ্রাবাদ মৌজায় অবস্থিত। লহনার ঢিবির পূর্বে দৈর্ঘ্য ছিলো ৭২ মিটার, প্রস্থ ৪২ মিটার ও উচ্চতা ৬ মিটার। বর্তমানে এটির দৈর্ঘ্য ৬০ মিটার, প্রস্থ ৫৪ মিটার ও উচ্চতায় ৩ মিটার।
এঢিবিটির চেয়ে দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতায় বড় খুল্লনার ধাপ। এই ঢিবিটি দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণে চেঙ্গিসপুর গ্রামে অবস্থিত। পরিখায় এখন সবুজ ঘাসের বিছানায় লালচে পাতাবাহার দিয়ে ফুল বানানো হয়েছে। খুল্লনার ঢিবির দৈর্ঘ্য ৯০ মিটার, প্রস্থ ৮৭ মিটার ও উচ্চতা ৬ মিটার।  
দোতলা সমান এই ঢিবির একতলার সব কিছু আবলুপ্ত। একতলাটা মনে হয় পূজামণ্ডপ না বসত বাড়ি। ঢিবির উপর একটা বাগান দেখা যাচ্ছে। ডালিয়া গাধা ফুলের গাছ সার দিয়ে লাগানো হয়েছে। কঞ্চিঘেরা পাদদেশে পেঁয়াজের চাষ হচ্ছে।       

বুঝিতে না পারি এই কন্যার চরিত।
হেন বুঝি কিবা মোরে বিধি বিড়ম্বিত৷
     
মাথা ঘুরে যাবার মতো পরপর কয়েকটি ব্যাপার ঘটে গেছে। স্থানিয় জনশ্রুতিতে খুল্লনা চাঁদ সওদাগরের পত্নী। চণ্ডীমঙ্গলে পাচ্ছি ধনপালির পত্নী। এখানেই শেষ না। কোথাও খুরনার ধাপ, কোথাও খুল্লনার ধাপ আবার কোথাও খুল্লানা। স্থানিয় জানায়, বাঘো পাড়া গ্রামে আরেকটি ধাপের নাম হল খুলনার ধাপএই ধাপ খুঁড়েও একটা মন্দিরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এই ধাপের নাম কেন ধনপতি সদাগরের এর স্ত্রীর নামে করা হয়েছে সেটা জানা যায় না।
খুল্লানা ধাপের পাসেই পদ্ম দেবীর ভিটে।  

কিবা উষা কিবা উমা কিবা অরক্ষান্ধতী ভবানী
...ডাকিনী হাকিনী কিবা মোহিনী
যোগিনী কাজুরের কামিখ্যা কিবা ইন্দ্রের ইন্দ্ৰাণী॥
১০. অশরীর
পদ্মদেবীর ভিটে এখন আর যাওয়া যায় না।
   জল-কজঙ্গলাকীর্ণ। বর্ষার শুরুতেই ধাপে পানি উঠে গেছে। উত্তর পশ্চিমে পানের বরজ। বরজের কান্দি ধরে খুব সাবধানে ধাপের আশেপাশে যাওয়া গেলেও এখন আর কেউ যায় না। ধাপের দক্ষিণে খুব সাপের উপদ্রপ হয়েছে। অজগরের কাছাকাছি গায়ের রং, তবে খর্বাকার চন্দ্রবোড়া নামে এক ধরনের সাপ দেখা যাচ্ছে।
চন্দ্রবোড়ার আরেক নাম রাসেল ভাইপার। আইইউসিএন কয়েকবছর আগে ঘোষণা দিয়েছিল রাসেল ভাইপার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অদ্ভুত বিষয় পদ্ম দেবীর ভিটেই চন্দ্রবোড়ার সাপ দেখা গেছে। বনবিভাগের সাপ বিশেষজ্ঞ বলেছে, এই সাপের বিষ খুব মারাত্মক। এর বিষের প্রতিষেধক নেই।
গত বর্ষায় ময়নার মায়ের একটা গাবিন গাই সাপের দংশনে মারা গেছে। তবু নিয়ামুল পদ্মার ভিটায় যাবার জন্য এক সকালে সরফা বেওয়ার বাড়ি এসে উপস্থিত। সরফা বেওয়ার খুন্তি নিয়ে সে যাবে পদ্মার ভিটায়। তার সঙ্গে গোটা দশেক বরশি।   বরশি কটি পেতে দিয়ে সে চলে আসবে। সরফা বেওয়া চোখ কপালে তুলে বলল, তোর মাথা খারাপ হইছে রে নিয়ামুল। এই চিন্তা বাদ দে।
সরফা বেওয়া নিয়ামুলের কোন যুক্তিই কানে তুললেন না। ব্যাপারটাতে ভয়ের কিছুই নেই। লোহার খন্তা হাতে থাকলে সাপ খপ যে কিছুই করতে পারবে না সরফা বেওয়াকে তা বোঝান গেল না। আমার মন মেজাজ ঠিক নাই।
তার মন মেজাজ ঠিক নাই কথাটা খুব সত্যি। গুজব শোনা যাচ্ছে পদ্মার ভিটা কাঁতিতে তাদের এক কানি জমি আছে। যেখানে পানের বরজ আছে। সরকার নাকি একয়ার করে নেবে। গত বছর জমি মেপে গেছে। 
সরফা বেওয়া নিয়ামুলকে বিকেল পর্যন্ত বসিয়ে রাখলযতবার নিয়ামুল উঠতে চায় ততবারই সে তাকে টেনে ধরে বসায়। জমি রক্ষায় কি করনীয় সেই ব্যাপারে পরামর্শ চায়। যেন নিয়ামুল খুব একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি নিয়ামুল বড়দের মত গম্ভীর গলায় বলে, আমীনকে তোমার পান পড়া খাওয়াও।
পানের বিষয়টা সরফা বেওয়া অনেক বার মনে হয়েছে। কিন্তু কাকে দিয়ে দেব তা ঠিক করতে পারছিল না। নিয়ামুলকে দিয়ে কাজটা করা যায়। সরফা বেওয়া হঠাৎ গলার স্বর নামিয়ে বলল, তুই দিয়ে আসতে পারবি? সুগান পুকুরে আমীন থাকে বলে শুনছি।
আচ্ছা।
কাজটা করতেই হবে কিন্তু।
আচ্ছা।
কেউ যেন না জানে।
পদ্মদেবীর ভিটে
           
নিয়ামুলের বড় মায়া লাগে। সরফা বেওয়া আয়ের উৎস বলতে ওই পানের বরজ। সরকার যে সহসা এ ধরনের ভূমি অধিগ্রহণ করছে না তা সে জানে না।
তোমার জমি কেউ নিতে পারবে না। এই কথায় সরফা বেওয়া ভরসার হাসি দিল।
ফুফু দাও না তোমার খোন্তা। যাবো আর আসবো।
আজকে না। দেখে আয় তোর পদ্মার ভিটে। দেরি করিস না।
দেরি হবে না।
পদ্মার ভিটেই উঠতেই চোখে পরল, ছোটখাটো ফুটবল মাঠের সাইজের এক তলা বাড়ির সমান উচু ঢিবী খানাখন্দক পানিতে ডুবে একাকার। বাঁশের ঝোপ আর জংলি গাছ এমন ঘন হয়েছে- চার দিকে দিনেমানেই অন্ধকাত। কেমন যেন একটা গুমট ভাব। পানি থেকে ভেবসা পচা গন্ধ।
জংলা জুড়ে ভিটিতে জলজ গাছের রাজত্ত। এর মধ্যে কল্মিলতা আর ভেট ফলের আধিপত্য। সাপলা-সালুক-পদ্ম আছে কিনার ঘেঁসে। খন্দকের মাঝামাঝি সনের জন্মেছে। সেই সব ঠেলে নিয়ামুলের ভেলা নিয়ে এগুতে দারুণ কষ্ট হচ্ছেজঙ্গল এরিয়ে দ্রিমা বিক্ষিপ্তভাবে ভেসে বেড়াতে লাগল। এক জায়গায় সউল মাছের ঝাঁক। এখানে এত সউল মাছ আছে তা ভাবতেই পারেনি। পানির উপরে থোকা থোকা জলপিপে ভাসছে। সেই জলপিপে খেতেই সউলের দল ভির করেছে। নিয়ামুল টপাটপ চার পাঁচটা সউল মাছ ধরে ফেলল।
এমন সময় অদ্ভুত একটা কাণ্ড হল। হঠাৎ চারদিকে সচকিত করে পাখপাখালিরা ডেকে উঠল। শিকারের বন্দুকের গুলির ছোড়ার শব্দে যেভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ডাকাডাকি করে তেমন হল। উত্তরের দিকের বাঁশঝাড়ে দমকা হাওয়ার ঝাপটা বিচিত্র একটা হা হা শব্দ তুল্ল। তার পর নিয়ামুল শুনল একটা বালিকা যেন খিল খিল করে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক নিশ্চুপ। গাছের পাতাটিও নড়ে না। চারদিক সুনসান।
নিয়ামুল ভয়ে কাতর স্বরে বলল, কে ওখানে? কে?
আর তখন তার চোখে পড়ল লহনার ভিটের কাছে যেখানে জল শ্যাওলার ঘন সবুজ হয়ে আছে সেখানে মাথার চুল এলিয়ে উপুর হয়ে মেয়েটা ভাসছে। অসম্ভব ফর্সা তার একটা হাত ছড়ান। হাত ভর্তি গাড়ঢ রঙের রেশমি চুড়ি। এই সময় প্রবল একটা বাতাস এল। মেয়েটি ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসতে লাগল নিয়ামুলের দিকে। যেন ডুব সাঁতার দিয়ে ধরতে আসছে তাকে।
আকাশ পাতাল জর নিয়ে বাড়ি ফিরল নিয়ামুলঅনর্গল বমি করছে। চোখ গাড়ঢ রক্তবর্ণ। লোক জন ঠিক চিনতে পারছে না। কি হয়েছে জানতে চাইলে নিয়ামুল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ইমাম বদরুল আমিন দোয়াদরুদ পড়ে নিয়ামুলের মাথায় ফু দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে মা? বলেন তো।
ভয় পেয়েছি হুজুর।
কি দেখেছেন?
নিয়ামুল কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, একটা মেয়ে মানুষ সাঁতার দিয়ে আমাকে ধরতে আসছিল। হাত বোঝায় লালা চুড়ি।
প্রচণ্ড ঝড় হল সেই রাতে। ঘন ঘন বিজলি চমকাতে থাকে। খবর আসল সরাবি তলার দোষ লাগা তালগাছে বজ্রপাত হয়েছে।
মহাস্থানে রটে গেল, পাগালা নিয়ামুল ভরা সন্ধায় গিয়েছিল পদ্মার ভিটেতে। গিয়ে দেখে পরীর মতো একটা মেয়ে নেংটা হয়ে সাঁতার কাটছে। নিয়ামুলকে দেখে সেই মেয়ে খলবল করে পানির নিচে ডুব দিল।
নিয়ামুলের জ্বর সারতে অনেক অনেক দিন লাগল। মহাস্থান মাজারের খাদেমে নিজে এসে তাবিজ দিলেন। ঘর বন্ধ করলেন। সরাবি তলার তালগাছে যে থাকত সে জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছে। পদ্মার ভিটেয় এসে আশ্রয় নেওয়া বিচিত্র না।

অনেকদিন আগে নিয়ামুল আমাকে পদ্মার ভিটেয় এনে ঢিবির ঝোপঝাড় দেখিয়ে বলেছিল, যখনি সময় পাই ভিটেয় এসে ঢিবির দিকে তাকিয়ে থাকি, এতে মন শান্ত হয়। ক্ষুদ্র জীবনে বিসাল স্মৃতি ধারণ করে বেঁচে আছি। বুঝলেন? বুঝে থাকলে মাথা ঝাঁকান।
আমি মাথা ঝাঁকাই। যে ঝাঁকুনিতে হ্যাঁ-না থাকে।       
নিয়ামুল অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি সব সময় রহস্য করেন কেন?

কৃষ্ণের গীতক জয়দেব নিদ্গতি
রূপক তালে চেবে নাচে পদ্মাবতী।
১১. মেয়েটা
পদ্মাবতী হচ্ছে সেই ধরনের মেয়ে যার জন্য চাঁদা তুলে কিছু একটা করতে কারোর আপত্তি থাকে না। ছেলেরা গভীর আগ্রহ এবং আনন্দ নিয়ে এদের নৃত্য গীতির আয়োজন করে কাছে যায় এবং জানে এই জাতীয় মেয়েদের সঙ্গে তারা কখনই ঘনিষ্ঠ হতে পারবে না। এরা যথা সময়ে রাজা-ধনপতির পছন্দ করা একটা ছেলেকে বিয়ে করবে, যে ছেলে সাধারণত থাকে জৌলুসে।    
পাল আমলের নারী প্রতিরূপ  

পদ্মাবতী নিয়ে চমকপ্রদ কাহিনী রচনা করেছেন লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেবএর রচনাকাল ১২ শতক পুণ্ড্রের কবির কাব্যটিতে ‘সেকশুভোদয়ায়’ আর ‘সাকাংক্ষ পুণ্ডরীকাক্ষ’ সর্গে বলা হচ্ছে- পুণ্ড্রবর্ধনের কার্তিকেয় মন্দিরে যে নৃত্যগীত হত পদ্মাবতী সেই দলে নাচতেন এবং জয়দেব মৃদঙ্গ বাজিয়ে গাইতেন। জয়দেব স্বয়ং সঙ্গীত বিশারদ ছিলেন এবং ভরতানুমোদিত নৃত্যগীত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। গীতগোবিন্দ গাইবার ও নাচবার জন্য জয়দেবের দল ছিল। তিনি ছিলেন দলের অধিকারী।
জয়দেব-গৃহিনী পদ্মাবতী প্রাকবিবাহ-জীবনে কুশলী নটী ছিলেন এবং সংগীতে এই জুটি খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল      
     
কৃষ্ণের গীতক জয়দেব নিদ্গতি
রূপক তালে চেবে নাচে পদ্মাবতী

গড়ের পশ্চিম অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক কালীদহ সাগর এবং গড়ের পশ্চিম অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক কালীদহ সাগর এবং পদ্মাদেবীর বাসভবন পদ্মার ঢিবি কিংবা পদ্মবতীর ধাপ একটি প্রাচীন স্থাপনা পদ্মার বাড়ির আয়তন ছিলো দৈর্ঘ্য ৯০ দশমিক  ৯০ মিটার, প্রস্থ ৬০ মিটার ও উচ্চতা ৩ দশমিক ০৩ মিটার এই গোলাকার ঢিবিটি ক্রমান্বয়ে পাশের সমতলভুমির সাথে মিশে গেছে   

১২. এপিগ্রাফ

অনেক দিন পর পুণ্ড্রের পাঁচালিতে ‘তেজস্বিনী’ এই পর্বটা লিখতে গিয়ে সেই টহল পুলিশ দলের কথা মনে পরছে। ওই ঘটনার তিনদিন পরে সন্ধ্যাবেলায় থানার পাসে পুলিশ ব্যারাকে গেলাম। তিন সংখ্যাটার মাঝে ম্যাজিক আছে। স্বর্গ-মর্ত-পাতাল, শৈশব-যৌবন-বার্ধক্য, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। তিনকাল, ত্রিভুবন, ত্রিনয়ন।
টহল পুলিশ দলের ওস্তাদ আমাকে দেখে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল। আমি মধুর ভঙ্গিতে বললাম, কেমন আছেন ওস্তাদ?
সে জবাব দিল না। পিচ করে থুথু ফেলল। থুথু পড়ল তার পায়ের উপর। আমি বললাম, ওস্তাদ আজ আপনার জন্য বিশেষ দিন। সকজ লেটার-এর উত্তর দেবার শেষ দিন। আর কয়েক ঘনটা বাকি আছে। কাজেই আমি ঠিক করেছি এই সময়টা আপনার সঙ্গে থাকবো। ওস্তাদ সরু চোখে তাকিয়ে আছে। সরু চোখের দৃষ্টি এমনিতেই তীক্ষ্ণ হয়। আজ আরো তীক্ষ্ণ লাগছে। ওস্তাদ সিগারেট বের করে ধারল। আমি অমায়িক গলায় বললাম, আমাকে একটা সিগারেট দেন তো।
  ওস্তাদ বিরক্ত গলায় বলল, কেন আমাকে বিরক্ত করছেন। ওই দিনের ঘটনার জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
বলতে বলতে সে আবার থুথু ফেলল। এবারো থুথু গিয়ে পরল তার গায়ে। আমি বললাম, নিজের গায়ে থুথু ফেলেন না। গা থেকে দুর্গন্ধ বের হবে। আমি ঠিক করেছি এই অবস্থায় আপনাকে দারোগার সামনে নিয়ে যাবো। দারোগা সাহেব আবার ছুঁচিবাই সভাবের। সে থুথুর গন্ধ ধরে ফেলবে। একটু আতর লাগান, সুন্ধি জর্দা দিয়ে পান খান, কিছু এলাচ রাখতে পারেন।

টহল পুলিশের ওস্তাদ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। তার হাতের সিগারেট নিভে গেছে। কিন্তু চোখে আগুন জ্বলছে। আমি ব্যারাকের বারান্দায় রাখা বেঞ্চে বসে পরলাম। সন্ধ্যা হচ্ছে। বেঞ্চে বসে সন্ধার দৃশ্য দেখতে ভাল লাগার কথা। ওস্তাদের মুখ ভর্তি থুথু। মনে হচ্ছে যে পদ্ধতি ব্যাবহার করতে হয় থুথু ফেলতে জন্য। আমি সামনে বসে থাকায় সে থুথু ফেলতে পারছে না।               

আচ্ছা, পুলিশ জনগণের এত সেবা করে, জোনগণ কেন পুলিশদের করে না?   

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান