পিশাচ... সাজেদুর রহমান

৬. 
শুক্লা চতুর্দশীর
সাজেদুর রহমান 



শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদ মাথার ওপর প্রায়। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর। ঠিক তখন একটি ঘুঘু ডেকে ওঠে। রাত্রিবেলা ঘুঘুর ডাক শোনার কথা না। ঘুঘু অন্ধকার পছন্দ করে না, জ্যোৎস্না পছন্দ করে না। তাদের পছন্দ শান্ত দুপুর।

রাত্রিবেলা ঘুঘুর ডাক শাস্ত্রোক্ত দুর্লক্ষণগুলির মধ্যে অন্যতম। লবামিয়া আমাকে ফিসফিস করে বললেন, এটা হচ্ছে অলক্ষণ। খুবই অলক্ষণ। তারপরেও কী যে হয়েছে—আমি ঘুঘুর ডাক শুনছি।
লবামিয়া আমাকে জয়েন উদ্দিন সাহেবের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। জয়েন উদ্দিন সাহেবের বাড়ি বেতগারি। বগুড়া শয়র থেকে বাসে করে মাস্তানে নামলাম। এখান থেকে যাবো শিবগঞ্জের নাগরবন্দরে। মাস্তানে করতোয়া নদীর ঘাটে এসে দেখি ঘাটে কোন নৌকা নাই। অথচ আজ নৃসিংহ চতুর্দশী, একটি উৎসবের দিন। লোকসমাগম থাকার কথা। দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু এখন নদী ঘাটে কিছু চোখে পড়ছে না।
হতাশ হয়ে ঘাটে বসে আছি আর ভাবছি— ঠিক মত ডাকিনী বিদ্যা জানা থাকলে ভালো হতো। এমন জটিল সময় ডাকিনীরা উড়ি নিয়ে যেতে পারত। ঠিক এই রকম হতাশা-জর্জরিত সময়ে ঘুঘু পাখির ডাক শুনলাম। সেই অতি পরিচিত শান্ত বিলম্বিত টানা-টানা সুর, যা শুনলে মুহূর্তের মধ্যে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। মানুষের শরীরের ভেতরে যে আরেকটি শরীর আছে তার মধ্যে কাঁপন ধরে। লবামিয়া বলল, তখনি মনে হয়েছে একটা কিছু হবে।
আমি হতচকিত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকালাম। এমন কি হতে পারে যে কেউ খাঁচায় করে পাখি নিয়ে যাচ্ছে, সেই পাখি ডেকে উঠল? পলি অঞ্চলের লোকদের পাখি ধরার অভ্যাস আছে। শিবগঞ্জে বিরাট পাখির বাজার। জ্যোৎস্না ক্রমেই প্রখর হচ্ছে। ঘুঘু পাখির ডাক আর শুনছি না। আজকের রাতটা রহস্য দিয়ে শুরু হলো। পাখি রহস্য।
হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। আমার গায়ে পাতলা একটা পাঞ্জাবি। শীত ভালোই লাগছে। আমি আবার বললাম, ভাই, কত দূর?
কাছেই। তবে এই নদী পার হতে হবে।
আঁতকে উঠে বললাম, বলেন কি?
পানি নেই, জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিন।
রাগে আমার গা জ্বলে গেল। এই লোকের সঙ্গে আসাই উচিত হয় নি। আমি জুতো খুলে ধুতি গুটিয়ে নিলাম। হেঁটে নদী পার হওয়ার কোনো আনন্দ থাকলেও থাকতে পারে। আমি কোনো আনন্দ পেলাম না, শুধু ভয় হচ্ছে কোনো গভীর খানাখন্দে পড়ে যাই কি না। তবে নদীর পানি বেশ গরম।
লবামিয়া ফ্যাকাসে হাসি হেসে বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম।
ভদ্রতা করে হলেও আমার বলা উচিত, না, কষ্ট কিসের তা বললাম না! ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। বেঁটেখাটো মানুষ। শক্তসমর্থ চেহারা। এই বয়সেও দ্রুত হাঁটতে পারেন। ভদ্রলোক মৃদুভাষী। মাথার চুল ধবধবে সাদা। নদী পার হয়ে ধুতি নামাচ্ছি, লবামিয়া বললেন, পা চালিয়ে চলেন। শীত কম লাগবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীর তীর ছেড়ে ইট বিছানো সরু রাস্তায় এসে পড়লাম।
আমরা হাঁটছি তো হাঁটছিই। হাঁটতে-হাঁটতে ধর্মতলা পর্যন্ত চলে এলাম। ধর্মতলার গা ঘেঁষে গিয়েছে গাংনুই নদী। কিন্তু এখন নদীটদী কিছু চোখে পড়ছে না। চারদিকে ফিনফিনে কুয়াশা। এখন জায়গাটা ফাঁকা। আমি বললাম, জিরিয়ে নিব নাকি লবামিয়া। উহুঁ, দেরি হয়ে যাবে।
একটি পুরনো ভাঙা দালানের সামনে দুজন থমকে দাঁড়ালাম। বাড়ির চারপাশ ঝোপঝাড়ে অন্ধকার হয়ে আছে। লবামিয়া খটখট করে কড়া নাড়তে লাগল। ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কেউ একজন বলল, কে?
জয়েন উদ্দিনের বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। সঙ্গে সঙ্গে গেট বন্ধ হয়ে গেল। ঘটঘট শব্দে ভেতর থেকে দুটা তালা মেরে দেয়া হল। তালার চাবি দারোয়ানের কোমরে বাঁধা। মানে হল এই গেট আর খুলবে না। দারোয়ান বলল, ভিতরে চলে যান—বলেই সে খুপরিতে ঢুকে গেল।
আমি বিশ্বয় নিয়ে দুর্গ প্রাচীরের ভেতর-বাড়ির দিকে তাকালাম। ইংল্যান্ড হলে এই বাড়িকে অনায়াসে ক্যাসেল বলে চালিয়ে দেয়া যেত। হুলস্থুল ব্যাপার। গ্রিক স্থাপত্যের বড় বড় কলামওয়ালা বাড়ি। টানা বারান্দায় পুরোটাই মার্বেলের। আমি থমকে দাঁড়ালাম। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবকটির চেহারা মলিন। গায়ের শার্টও চেহারার মতোই মলিন। যদিও হাসি-খুশি ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টায় লাভ হচ্ছে না।
আপনি কি তান্ত্রিক সারশূন্য নিঃশঙ্কচিত্ত?
লোকে এরকমই বলে। 
আপনার না সন্ধ্যার দিকে আসার কথা?
ঘাটে নৌকা ছিল না। পায়ে হেটে আসতে হয়েছে।
ও আচ্ছা। আপনি হুজুরের কাছে চলে যান। উনি আপনার জন্যে অস্থির হয়েছেন।
ব্যাপারটা কী বলুন তো?
যুবকটা বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপার আপনি জানেন না?
জি না।
বলেন কী! আমার ধারণা ছিল জানেন। যাই হোক, হুজুরই আপনাকে বলবেন। দয়া করে হুজুরের সঙ্গে কোনোরকম তর্ক বা বাহাসে যাবেন না। উনি যা বলবেন, তাতেই হুঁ হুঁ বলে মাথা নাড়বেন। আসুন আপনাকে দেখিয়ে দি।
যাঁরা অপেক্ষা করছেন তাঁরা সবাই তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। বুঝতে পারছি, এখানে আমি একজন গুরুত্বর্পর্ণ ব্যক্তি। শুধু জয়েন উদ্দিন সাহেব একা না, এরা সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।
জয়েন উদ্দিন সাহেব অসুস্থ—এ খবরও জানা ছিল না। লবামিয়া জয়েন উদ্দিন সাহেবের অসুস্থতার খবর আমাকে দেননি। অসুখ তেমন গুরুতর বলেও মনে হচ্ছে না। বিত্তবানরা গুরুত্বর অসুস্থ অবস্থায় গ্রামে দেশে থাকেন না। শহরে, ক্লিনিকে থাকেন। তাঁদের কপালে নিজ বাড়িঘরে মৃত্যু লেখা থাকে না। তাঁদের মৃত্যু অবধারিতভাবে হবে দেশের বাইরে।
তান্ত্রিক মহাশয়!
হুম।
আপনি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যান। সিঁড়ির সামনের প্রথম ঘরটাই হুজুরের। দরজায় নক করলেই দাসী দরজা খুলে দেবে। আরেকটা কথা, কাঠের সিঁড়ি তো, আস্তে পা ফেলবেন। শব্দ হয় না যেন। সিঁড়িতে শব্দ হলে হুজুর খুব বিরক্ত হন।
আমি যুবকটার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম, আপনি এক কাজ করুন ভাই। আমাকে বরং কোলে করে দোতলায় দিয়ে আসুন। শব্দটব্দ একেবারেই যেন না হয় সেদিকে আপনি আমার চেয়ে ভালো লক্ষ রাখতে পারবেন।
ভদ্রলোক আমার কথায় আহত হল কি না বুঝতে পারলাম না। তাঁর মুখভঙ্গিতে কোনোরকম পরিবর্ত এলো না। আগে যেমন ছিল, এখনো সে রকম আছে। আমি তাঁর নির্বিকার ভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে বললাম, ব্রাদার, আপনার নাম?
আমার নাম ইসাহাক। ইসাহাক মীর। আমাকে ব্রাদার বলবেন না। যান, আপনি দোতলায় যান। শব্দ করেই যান।
কাঠের সিঁড়ি হলেও সিঁড়িতে কার্পেট দেয়া। চেষ্টা করেও শব্দ করা গেল না।



দরাজায় টোকা দেবার আগেই দাসী দরজা খুলে দিয়ে বলল, আসুন। হুজুর জেগেই আছেন। সোজা চলে যান। জুতা খুলে এখানে রেখে যান। আপনার পা দেখি ধুলোভর্তি। এক কাজ করুন, বাথরুমে ঢুকে পা ধুয়ে ফেলুন।
শধু পা ধোব, না স্নান করে ফেলব?
দাসী কঠিন চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। এ বোধহয় ইসাহাক মীরের মতো রসিকতায় স্থির থাকতে পারে না। তবে নার্সের চেহারা সুন্দর। শ্যামলা গায়ের রঙ। চোখে-মুখে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। কিন্তু তবু এমন মায়া জাগিয়ে তুলছে কেন? সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপারটি হচ্ছে, কঠির চোখে তাকালেও তাকে খারাপ লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে কঠিন চোখে না তাকালেই তাকে খারাপ লাগত। আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম, সিস্টার, আপনার নাম জানতে পারি?
আমার নাম দিয়ে কি আপনার প্রয়োজন আছে?
জি আছে। আমি যখন অসুস্থ হব তখন সেবা করার জন্যে আপনাকে রাখব। ডাকলে আসবেন না?
যান, বাথরুমে যান, নিম পাতার ভেজা পানি আছে। ভালোমতো হাতমুখ ধোবেন।
আমি বাথরুমে ঢুকে পড়লাম।
দেখতে রাজপুত্র না হলেও বেশ সুপুরুষ। গেরুয়া রঙের একটা চাদর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন বলেই কেমন যেন ঋষি-ঋষি লাগছে। ঘরটা প্রকাণ্ড। প্রকাণ্ড ঘরের প্রকাণ্ড খাটে একজন সুঠামদেহের পুরুষ—দৃশ্যটা দেখামাত্র মনে চাপ সৃষ্টি হয়। জয়েন উদ্দিন সাহেবের ঘরে ঢুকে সাধু সন্ন্যাসীর আশ্রমের কথা মনে পড়ল। জয়েন উদ্দিন সাহেব শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে উঠে বসলেন। হাত ইশারায় কাছে ডাকলেন। ভদ্রলোকের হাতে পাথর-বিসানো তিনটি আঙটি, এর মধ্যে একটা আঙটি হচ্ছে নীলার।
তারপর দীর্ঘ সময় ‍দুইজন চুপচাপ। উনি কিছু বলছেন না। আমিও না। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরের সাজসজ্জা দেখছি। খাটের পাশে বুক সেলফ। বুক সেলফের বইগুলোর নাম পড়ার চেষ্টা করছি। এত দূর থেকে পড়া যাচ্ছে না। করপুর আরে ধুপের মিশ্র গন্ধ নাকে আসছে। মোটেই ভালো লাগছে না। তাছাড়া জয়েন উদ্দিন সাহেবের চোখ দুটিতে পাখি পাখি ভাব। মানুষের পাখির মতো চোখ এই প্রথম দেখলাম।
সারশূন্য নিঃশঙ্কচিত্ত!
জি।
বোসেন।
বসার জন্যে একটি মাত্র চেয়ার, সেটা ঘরের শেষপ্রান্তে। আমি কি সেখানে বসব না চেয়ার টেনে কাছে নিয়ে আসব তা বুঝতে পারছি না।
চেয়ার টেনে কাছে নিয়ে আসেন। শব্দ হয় না যেন। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ সহ্য হয় না। এমন কি নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও না।
চেয়ার পাথরের মতো ভারি, আনতে গিয়ে আমার ঘাম বের হয়ে গেল। এরচে’ মেঝেতে বসে পড়া ভালো ছিল।
তান্ত্রিক সারশূন্য নিঃশঙ্কচিত্ত!
জি ভাইসাহেব।
আপনার সঙ্গে আমার আগে পরিচয় হয় নি। তবে আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনি নাকি পিশাচ সাধনায় সিদ্ধি পুরুষ। আপনার ঠিকানা পেয়েছি আমার ভাগ্নির কাছ থেকে। সে কালো জাদু বা ডাইনি বিদ্যা নিয়ে খোঁজ রাখে। জাদু বিদ্যা জেনে তার ধারণা হয়েছে আপনি দারুণ বুদ্ধিমান। অনেক বড় বড় সমস্যা নাকি সমাধান করেছেন। তখন ভাবলাম, যাক, ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। বুদ্ধিমান লোকের সঙ্গে কথা বলেও আনন্দ। গাধা টাইপের লোকের সঙ্গেও অবশ্যি কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। যাদের বুদ্ধি মাঝামাঝি, এদের সঙ্গে কথা বলে কোনো আনন্দ নেই। আমার এখানে ডাকায় বিরক্ত হন নি তো?
ভাই সাহেব বলুন, কী করতে পারি।
জয়েন উদ্দিন সাহেব খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। দাসী ঢুকল। মনে হয় কোনো একটা ওষুধ খাওয়াবার সময় হয়েছে। জয়েন উদ্দিন সাহেব চোখ না তুলেই হাতের ইশারায় দাসীকে চলে যেতে বললেন।
সারশূন্য বাবু।
জি ভাইসাহেব।
আপনার কিছু সাহায্য আমার দরকার।
আমি কী চাই সেটা বললে আপনি আমাকে পাগল-টাগল ভাবতে পারেন।
আপনি বলুন। আমি সহজে কাউকে পাগল ভাবি না।
আপনি সহজে পাগল ভাবেন আর না ভাবেন—আমাকে সাবধান হয়েই কথা বলতে হবে। আমি আপনার কাছে কী চাই সেটা বলার আগে আমার অতীত কথা শুনে নিন। আমার জীবনের গল্পটা শুনলে আমাকে আর পাগল ভাববেন না।
বলুন।
মন দিয়ে শুনবেন।
জি ভাইসাহেব, মন দিয়ে শুনব।

জয়েন উদ্দিন সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এলেন। তাঁর চোখের মণি জ্বলজ্বল করছে। মণির সাইজও ছোট। ভদ্রলোকের অসুখটা কী? যক্ষা? যক্ষা রোগীর চোখ জ্বলজ্বল করে বলে শুনেছি। যক্ষ্মা হলে ঘনঘন কাশার কথা। তিনি এখনো কাশছেন না। তিনি ঠাণ্ডা গলায় বলা শুরু করলেন-
তখন আমার বয়স চব্বিশ, এম.এ. পাস করেছি। ধারণা ছিল খুব ভালো রেজাল্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার হিসেবে এন্ট্রি পেয়ে যাব। তা হয়নি। এম.এ.-র রেজাল্ট খুবই খারাপ হলো। কেন হলো তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। পরীক্ষা ভালো দিয়েছি। একটা গুজব শুনতে পাচ্ছি জনৈক অধ্যাপক রাগ করে আমাকে খুবই কম নম্বর দিয়েছেন। এই গুজব অমূলক নাও হতে পারে। অধ্যাপকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো না। দুএকজন আমাকে বেশ পছন্দ করেন, আবার কেউ-কেউ আছেন আমার ছায়াও সহ্য করতে পারেন না।
যা বলছিলাম, রেজাল্টের পর মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবা খুব রাগারাগি করলেন। উর্দু ভাষায় বললেন—ক্যা, আপ পড়েলিখে তো হোঙ্গে। আভি নিকালো।
আমি বললাম, চলে যাচ্ছি। উর্দু বলার দরকার নেই।
এই বলেই ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে পড়লাম। আমি খুবই সচ্ছল পরিবারের ছেলে। কাজেই খালিহাতে ঘর থেকে বের হলাম না। বেশকিছু টাকা সঙ্গে নিয়ে বের হলাম। কোথায় যাচ্ছি কাউকে বলে গেলাম না।
যা-ই হোক, বাড়ি থেকে বের হয়েও খুব একটা দূরে গেলাম না। একটা হোটেলে ঘর ভাড়া করে রইলাম। দেখি সেখানে কাজ করার খুব অসুবিধা সারাক্ষণ হইচই। কিছু-কিছু কামরায় রাতদুপুরে মদ খেয়ে মাতলামিও করে। মেয়েছেলে নিয়ে আসে।
হোটেল ছেড়ে দিয়ে শহরতলিতে একটা বেশ বড় বাড়ি ভাড়া করে বসলাম। এক হিন্দু  জমিদার সাহেব শখ করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। তার শখ হয়তো এখনও আছে, ছেলেমেয়েদের শখ মিটে গেছে। এ-বাড়িতে কেউ আর থাকতে আসে না।
একজন কেয়ারটেকার আছে। বাড়ির পুরো দায়িত্ব তার। লোকটিকে দেখেই মনে হয় বদলোক। আমাকে যে বাড়িভাড়া দিয়েছে মনে হচ্ছে নিজ দায়িত্বেই দিয়েছে। ভাড়ার টাকা মালিকের কাছে পৌঁছাবে বলে মনে হলো না।
বাড়ির নিচ তলায় ইঁদুর বিড়ালের যন্ত্রণায় আমি রাতে ঘুমাই দোতলায়। ছোট্ট ঘর খাট আছে, ড্রেসিং টেবিল আছে, শুধু বাথরুম নেই—এই একটা অসুবিধা। আমার আবার ডায়াবেটিস আছে, কয়েকবার প্রস্রাব করতে হয়। বারান্দায় প্রস্রাব করি। কাজের ছেলেটা সকালে এক বালতি পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়। কাজের ছেলেটার নাম হল কফিল।
সারশূন্য বাবু। আপনি কি পিশাচ দেখেছেন?
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। কিছু বললাম না।
কথা বলছেন না কেন সারশূন্য বাবু, পিশাচ কি কখনো দেখেছে্ন?
বললাম, জ্বি-না।
না-দেখাই ভালো। আমি একবার দেখেছিলাম, এতেই অবস্থা কাহিল। ঘাম দিয়ে জ্বর এসে গিয়েছিল। এক সপ্তাহের উপর ছিল জ্বর। পায়ের পাতা চুলকাতা ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল-অ্যালার্জি। ডাক্তারদের কারবার দেখুন, আমি বললাম, পিশাচ দেখে জ্বর এসে গেছে। তার পরেও ডাক্তার বলে অ্যালার্জি। হিষ্টাসিন দিয়েছিল। অ্যান্টি হিষ্টাসিন কি পিশাচের অষুধ, আপনি বলুন?
প্রথম দিন পিশাচ দুটাকে দেখে ভয় পেয়ে জ্বর হয়েছিল। এখন আর হয় না।
প্রায়ই দেখোন?
জ্বি-না। প্রায়ই দেখি না। ধরেন মাসে, দুমাসে একবার।
এরা আপনাকে ভয় দেখায়?
না, ভয় দেখায় না।
চৈত্র মাসের ছয় তারিখের কথা। রাতে ঘুমাচ্ছি, প্রস্রাবের বেগ হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেল। মাথার কাছে হ্যারিকেন ছিল। হ্যারিকেন জ্বালালাম। তখনি দেখি ঘরের কোণায় দুটা পিশাচ। খুব ছোট সাইজ, লম্বায় এই ধরেন দুই আরাই ফুটের মতো হবে। গজ-ফিতা দিয়ে ম্যাপি নি। চোখের আন্দাজ। দু-এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক হতে পারে।
আমি তখনো ভয় পাই নি। কারণ হঠাৎ ঘুম ভেঙেছে তো, এরা যে পিশাচ এইটাই বুঝি নি। হ্যারিকেনের আলো বাড়িয়ে ভালকরে তাকাতেই মনে হলো, তাদের পায়ে নূপুর। নূপুরের শব্দ করে করছে। আমি গলা খাকারি দিলাম আমি দাঁড়িয়ে পড়লে নুপূরের শব্দ বন্ধ। চুপ থাকলেই নূপুরের শব্দ। তিনবার পরীক্ষা করলাম। তিনবারই এই ঘটনা। আতঙ্কে শরীর জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। কাজেই ধমকের মতো বললাম, এ্যাই, এ্যাই।
তখন কী হল?
ধমক শুনে নাচ থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লে। তারপর মিলিয়ে গেল। পুরো রুমে কেমন পঁচা একটা গন্ধ। তখন বুঝলাম, এরা পিশাচ। ছোট সাইজের পিশাচ। তখন ভয় লাগল। জ্বর এসে গেল।
ইন্টারেষ্টিং লাগছে না। সারশূন্য বাবু?
জ্বি, ইন্টারেষ্টিং।
দুই মাস পর কার্ত্তিক মাস। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কেন জানি সন্ধ্যার পর থেকে ভয়-ভয় করতে লাগল। বিছানায় বসে লিখছি। হঠাৎ মনে হলো কেউ-একজন দক্ষিণের বারান্দায় নরম পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি কে কে বলতেই হাঁটার শব্দ থেমে গেল।
আমি দুর্বলচিত্তের মানুষ নই। তবে যে-কোনো সাহসী মানুষও কোনো কারণে বিশাল একটা বাড়িতে একা পড়ে গেলে একটু অন্যরকম বোধ করে। আমার কেমন অন্যরকম লাগতে লাগল। সেই অন্যরকমটাও আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারছিলাম না। একবার মনে হচ্ছে পানির পিপাসা হচ্ছে আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে না, পানির পিপাসা না অন্যকিছু। অনেক চেষ্টা করেও কিছু বুঝতে পারলাম না। ভয় তারানর জন্যে উচ্চ স্বরে গান গাওয়া শুরু করতেই মনে হয় দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ আমাকে দেখছে। তাকাতেই সরে যাচ্ছে। দুবার আমি বললাম–কে কে?
এই সময় লক্ষ করলাম হারিকেনের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। তেল কমে এসেছে। এক্ষুনি হয়তো দপ করে নিভে যাবে। এতে ভয় পাবার তেমন কোনো কারণ নেই। আরো একটি প্রদীপ পাশের ঘরে আছে। রুপভান টনের বড় একটা জারে কেরোসিন তেল থাকে। সেই জারটি একতলায় রান্নাঘরে। তা ছাড়া মোমবাতি তো আছেই।
আমি নিবুনিবু হারিকেন নিয়ে একতলায় নেমে গেলাম। চা বানিয়ে খেলাম। ফ্লাস্ক ভরতি করে চা নিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। বারান্দায় পা দিতেই বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁত করে উঠল। মনে হলো সবুজ রঙের ডুরে শাড়ি পরা একটি মেয়ে যেন হঠাৎ দ্রুত সরে গেল। মেয়েটার চোখ দুটি মায়া-মায়া। কিন্তু এই অন্ধকারে মেয়েটার চোখ দেখার কথা না। তা হলে আমি এসব কী দেখছি?
বৃষ্টির বেগ খুব বাড়ছে। রীতিমতো ঝোড়ো হাওয়া বইছে। আমি আমার ঘরে আগের জায়গায় ফিরে এলাম। জানালা বন্ধ করে দিলাম। শো শোঁ শব্দ তবু কমল না।
ঠিক তখন বজ্রপাত হলো। প্রচণ্ড বজ্রপাত। সাউন্ডওয়েভের নিজস্ব একটা ধাক্কা আছে। এই ধাক্কায় মোমবাতির কিংবা হারিকেনের শিখা নিভে যায়। টেবিলের উপর হারিকেনের আলো নিভে গেল। হঠাৎ চারদিক গাঢ় অন্ধকার।
আমি তখন পরিষ্কার শুনলাম মেয়েলি গলায় কেউ-একজন বলছে আপনে বাইরে আসেন। আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে? সেই আগের কণ্ঠ আবার শোনা গেল–ভয় পাইয়েন না। একটু বাইরে আইসা দাঁড়ান।
অল্পবয়স্ক মেয়েমানুষের গলা। পরিষ্কার গলা।
আমি আবার বললাম, কে, তুমি কে?
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। মনে হলো কেউ যেন ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। ঘরের দরজা একটু ফাঁক করল।
আমি উঠে বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দায় কেউ নেই। তবু মনে হলো কেউ-একজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে চাচ্ছে কিছুটা সময় আমি বারান্দায় থাকি।
ধুপ ধুপ শব্দ আসছে। শব্দ কোত্থেকে আসছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোদাল দিয়ে কেউ মাটি কোপাচ্ছে। এই ঝড়বৃষ্টির রাতে কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে কে? আমি বারান্দায় রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেলাম, তখন বিদ্যুৎ চমকাল। বিদ্যুতের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম দক্ষিণ দিকের বাঁশবনের কাছে কোদাল দিয়ে একজন মাটি কোপাচ্ছে। যে মাটি কোপাচ্ছে তার পশুর মতো মুখ, হাত-পা মানুষের মতো। 
বিদ্যুৎচমক দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। এক একবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর আমি তাকে দেখছি। সে খুব ব্যস্ত হয়ে মাটি কোপাচ্ছে। গভীর গর্ত করছে। সে কি কবর খুঁদছে। পাশে কাপড় দিয়ে মোড়া লম্বা এটা কী?
পরিষ্কার কিছু দেখছি না। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তখনই শুধু দেখছি। বুঝতে পারছি এটা বাস্তব কোনো দৃশ্য নয়। এই দৃশ্যের জন্ম আমার চেনাজানা জগতে নয়। অন্য জগতে অন্য সময়ে।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছি। মুষলধারে বর্ষণ হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আমি পিশাচকে দেখছি। সে অতি ব্যস্ত। অতি দ্রুত কবর খুঁদছে। কার কবর? সবুজ কাপড়ে মোড়া একটি মৃতদেহ পাশেই রাখা। বৃষ্টির পানিতে তা ভিজছে। এটা কি তার পূজায় বলি দেওয়া কন মৃতদেহ? কী আশ্চর্য, হাত পাঁচেক দূরে মেয়ের একটা ছিন্ন মাথা পরে আছে। মুণ্ডের চোখ খোলা। সেটি একদৃষ্টিতে পিশাচটির দিকে তাকিয়ে আছে।
তিনি স্থির গলায় বললেন আমি সেদিন যা করেছিলাম একজন বুদ্ধিমান যুক্তিবাদী মানুষ তা-ই করবে। আমি ছুটে গিয়েছিলাম সেখানে। প্রচণ্ড ভয়াবহ কোনো ঘটনার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালে মানুষের ভয় থাকে না। একজাতীয় এনজাইম শরীরে চলে আসে। তখন প্রচুর গুকোজ ভাঙতে শুরু করে। মানুষ শারীরিক শক্তি পায়। ভয় কেটে যায়। আমার কোনো ভয় ছিল না। আমি দ্রুত গেলাম ঐ জায়গায়। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে গেলাম।
তারপর কী দেখলেন?
কী আর দেখব? ফিরে আসার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বিকট একটা হাসি শুনলাম। উঠোন কাঁপিয়ে গাছপালা কাঁপিয়ে হো-হো করে কে যেন হেসে উঠল। আমি তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম, কে, কে?
বলেন কী!
ওটা খাটাশ। মানুষের মতো শব্দ করে হাসে। 

পিশাচ সাধনা 

অনেকক্ষণ কথা বলার জন্যেই সম্ভবত জয়েন উদ্দিন সাহেব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি টেবিলের উপর পিতলের ঘণ্টিতে হাত রাখলেন। দাসী ছুটে এলো। তিনি বোধহয় সাইন ল্যাংগুয়েজে কিছু বললেন—দাসী কাসার সাধারণ গ্লাসের চেয়ে একটু বড় সাইজের গ্লাসে করে কী যেন নিয়ে এলো। তিনি এক চুমুক খেয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলেন। যতক্ষণ তিনি চোখ বন্ধ করে থাকলেন ততক্ষণ দাসী কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের ইশারায় বলল, তুমি এই অসুস্থ মানুষটাকে কেন বিরক্ত করছ? বের হয়ে যাও।
জয়েন উদ্দিন সাহেব চোখ খুলে দাসীকে আবার ইশারা করলেন। দাসী চলে গেল। তিনি চাপা গলায় বললেন, নিঃশঙ্কচিত্ত বাবু!
জি, ভাইসাহেব। 
আপনি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছেন?
নিঃশঙ্কচিত্ত কিছু বললেন না। তিনি আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছেন। জয়েন উদ্দিন সাহেব গল্প বলার ক্ষমতা ডালো। গলার স্বরের উঠানামা আছে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ কথা বন্ধ করে। রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসে। এতে গল্পটা আরো জমে যায়।
বলেন দেখি, আমার প্রথমবার পিশাচ দেখা ঠিক কত দিন পরে দ্বিতীয়বার আমি পিশাচকে দেখেছিমাম?

দুই মাস পরে। কালি মন্দিরে।
জয়েন উদ্দিন সাহেব পাখির মতো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। কালীমন্দিরের ব্যাপারটি তিনি বলেন নি। এটা বানিয়ে বললাম। মনে হচ্ছে লেগে গেছে। আমার দু-একটা বানানো কথা খুব লেগে যায়। জয়েন উদ্দিন সাহেব গলা পরিষ্কার করতে করতে বললেন, কালীমন্দিরের এই কথা আপনাকে বলি নি। আপনার জানার কথা না। কোত্থেকে জানলে?
আমি পঞ্চ ইন্দ্রীয়শক্তিতে বললাম। আমার অনুমান খুব ভালো। ইন্দ্রীয়শক্তি আর অনুমান করে পূর্ব ঘটনা অনুধাবন করতে পারি।     
তাই দেখছি। আপনার সম্পর্কে যা শুনেছি তা তাহলে মিথ্যা না। যাই হোক, আমার রাতে ভালো ঘুম হয় না। ঘুমের মধ্যে ভয়ঙ্কর সব স্বপ্ন দেখি। ঘোর লাগা চোখে দেখি- পশুর মতো মুখ, হাতের আঙুল অনেক লম্বা। আঙুলে পাখির মতো নখ। কুচকুচে কালো। নগ্ন। ঘোড়ার মতো শব্দ করতে করতে পিশাচটা এখন খাট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই তো এখন ফিরে আসছে। আবার যাচ্ছে। এখন সে খাটের চারদিকে পাক খেতে শুরু করেছে। পিশাচটা ঘুরছে চক্রাকারে। আবারো সেই চক্র চলে এল। চক্রের হাত থেকে আমার মুক্তি নেই। পশুদের চোখ অন্ধকারে সবুজ দেখায়। পিশাচটার চোখও সবুজ। এ তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে।
আপনার সমস্যা কি এটাই?
না। 
জয়েন উদ্দিন সাহেব গলার স্বর আরো নামিয়ে ফেললেন। তাঁর কথা অস্পষ্ট হয়ে এলো। কথা বোঝার জন্যে আমাকে তাঁর দিকে এগিয়ে যেতে হলো। তিনি বললেন, ইদানীং স্বপ্নের মধ্যে আমি একটা বাচ্চাকে দেখতে পাই। দুই হাত বাড়িয়ে সে আমার কাছে আসতে চাচ্ছে কিন্তু যখনই আমি বাচ্চাটাকে ধরতে যায় কেউ একজন আমাকে বাধা দেয়। বাচ্চাটি তখন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে এবং আমার দিকে এগিয়ে আসে ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে যায়।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। এই শীতের দিনেও আমি ঘেমে একাকার। ঘরে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে সিগেরেট ধরালাম। তামাকের উৎকট গন্ধ। আমি বুঝতে পারছি মনকে শান্ত করতে হবে। স্থির করতে হবে। না, ভয় পেলে চলবে না। 
ব্যাপারটা অন্য ব্যাখ্যাও তো থাকতে পারে…
আপনি কী বলতে চাচ্ছ আমি বুঝতে পারছি। অন্য ব্যাখ্যাও আমি জানি। অন্য ব্যাখ্যা হলো—আমার অবচেতন মন আমাকে সাহায্য করছে।
আপনি এই ব্যাখ্যা বিশ্বাস করেন না?
না।
আপনি মূল সমস্যাটা বলেন। 
তাহলে বলি- মানুষের স্বপ্ন অসম্ভব জটিল হতে পারে। স্বপ্নে দেখলাম, বনের মধ্যে বিশাল এক প্রাচীন মন্দিরে বসে আছি। পর মুহূর্তে পাল্টে গেল দৃশ্যপট। দেখতে পেলাম, হেঁতাল ভরা এক জঙ্গলের কিনারায় দুফুট পাথরের বিকট এক দেবি চন্ডির মূর্তিকে শত শত পিচাস সাধক ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করছে। তাদের মন্ত্র উচ্চারিত হতেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে লাগল। মূর্তির পায়ের কাছে পাথরের বেদিতে সাতটি তরুণীর কাটা মাথা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বেদি, শয়তানের পা। হঠাৎ অনুভব করলাম, মনে হলো, ঘরের তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে গেছে। এক অপার্থিব কুৎসিত ঠান্ডা হাত দিয়ে কে যেন আমার হৃৎপিণ্ড চেপে ধরেছে।
আমার ঘুম ভাঙল। পুরো রুমে কেমন পঁচা একটা গন্ধ। আমি বুঝতে পারছি এটাও স্বপ্নের কোনো অংশ কি না।...না, এটা বোধহয় স্বপ্ন না। বোধহয় সত্যি। আলো জ্বালালাম। আর তখন হীমস্রোত বয়ে গেলো শিরা উপশিরায় যখন দেখলাম এবং আবিস্কার করলাম আমার গায়ে ঘাম নয়, তরতাজা রক্ত।
সারশূন্য বাবু!
জি।
আমি অসুস্থ। ভয়াবহভাবেই অসুস্থ। মৃত্যুর ঘণ্টা ঢং ঢং করে বাজছে। আপনার তো অনুমান ভালো। বলেন দেখি অসুখটা কী?
বলতে পারছি না। আমার অনুমান সব সময় কাজ করে না।
কতদিন বাঁচব সেটা বলতে পারবেন?
জি না।
ভদ্রলোক শীতল গলায় বললেন, আমার জীবনযাপন পদ্ধতি আর দশজন মানুষের মতো না।
তা ঠিক।
আর দশজন মানুষের মতো না হওয়ার পেছনে যুক্তিও আছে। আর দশটা মানুষ অফিস করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে। আমি কিছুই করি না। দিন-রাত ঘরে থাকি। দিনরাত যে ঘরে বসে থাকে তার মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার খেলা করবে এটাই তো স্বাভাবিক।
আমি কি বলবে ভেবে পেল না। ভদ্রলোক বললেন, আমার সমস্যা থেকে মুক্তির একটাই পথ। 
পথটা কী?
খুবই সহজ পথ, আবার এক অর্থে খুবই জটিল। তবে আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। এই জন্যেই আপনাকে খবর দিয়ে আনানো।
পথটা কী বলুন।
দেবি চন্ডি স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছে, অমাবস্যা বা পূর্ণিমা রাতে একটি কুমারী যুবতির লাশ চাই। তার জীবনের বিনিময়য়ে আমার মুক্তি। ব্যাপরটা সহজ না?
জি সহজ।
জটিল অংশটা কী জানেন? জটিল অংশ হলো—কুমারী যুবতি পাওয়া।
আপনাকে এখন কুমারী যুবতিদের ধরে ধরে তাদের বলি দিতে নিতে হবে?
আপনি রসিকতা করার চেষ্টা করবে না সারশূন্য বাবু। Don’t try to be funny. আমি মরতে বসেছি। যে মরতে বসে সে রসিকতা করে না। আপনি আমাকে কুমারী যুবতি যোগাড় করে দেবেন।
কুমারী যুবতি বুঝব কী করে?
ভদ্রলোক পাথরের মতো মুখ করে বলেছেন, সেটা আপনি জানেন, আমি জানি না। আমি খরচ দেব। টাকা যা লাগে আমি দেব।Is it clear?
ভাইসাহেব, আপনার বয়স কত হয়েছে?
ভদ্রলোক হেসে বললেন, সারশূন্য বাবু, নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। আমার বাবা-মা জন্মের দিনক্ষণ লিখে রাখেন নি। আমাকে বলেও যান নি। তবে ৪৮/৪৯ হবে।
অনেকদিন তো বাঁচলেন। আর কত দিন বাঁচতে চান?
অল্প কিছুদিন বাঁচতে চাই।
কতদিন?
ভদ্রলোক হেসে শীতল গলায় বললেন, এই ধরুন। দশ বৎসর।
সারশূন্য বাবু ভেবেছিলেন ভদ্রলোককে বলবেন, দশ বৎসর কেন? তা করলেন না। ভদ্রলোক বললেন, আমি কি আশা করতে পারি আপনি কুমারী মেয়েকে খুঁজে বেড়াবেন?
জি। আমার কাছে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগছে। কাজেই খুঁজব।
আপনাকেও আমি খুশি করে দেব ।will make. You happy. এমন খুশি করব যা আপনি চিন্তাও করতে পারবে না।
আমি ভাইসাহেব এমনিতেই খুশি।
আপনাকে মোট চোদ্দ দিন সময় দেয়া হলো। পনেরদিন পর পূর্ণিমা। তার আগে আপনাকে কুমারী মেয়ে এনে বলির জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
আজ থাক। আপনি ক্লান্ত। বিশ্রাম করুন।
ভাইসাহেব এখন উঠি?
নিচে আমার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলবেন। আপনার ব্যাপার আমি সব বলে দিয়েছি। ওর নাম ইসাহাক। ইসাহাক মীর। ভালো ছেলে। খুব ভালো ছেলে।
জয়েন উদ্দিন সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো খানিকটা ধাঁধায় পড়ে গেলেন। আমি বের হয়ে এলাম। 
বাতাসে পাতিয়া ফাঁদ,
ধরে দিতে পারি চাঁদ।
(অস্মভবকে সম্ভব করার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি বঝাতেই এই প্রবাদ।)    

ম্যানেজার ইসাহাক মীর সাহেবকে আমার খুঁজে বের করতে হলো না। তিনি সিঁড়ির গোড়াতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে সরাসরি অন্য একটা কামরায় নিয়ে গেলেন। এই কামরাটা মনে হচ্ছে ম্যানেজারের অফিসঘর। টেবিলে ফাইলপত্র সাজানো। ইসাহাক মীর বসেছেন হাতল দেয়া জমিদারী চেয়ারে।
সারশূন্য বাবু, বসুন।
আমি বসলাম। ইসাহাক কৌতূহলী হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তান্ত্রিক ইসাহাক নিঃশঙ্কচিত্ত বাবু।
জি।
সারশূন্য বাবু, আপনি কী করেন জানতে পারি কি?
প্রধান কাজ ভূত-প্রেত-ডাইনী-পিশাচীদের সাথা প্রিত করা। বলতে পারেন তাদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে কাজ করিয়ে নেই। এই আমার কাজ।
কালো জাদু-ফাদু না কি যেন ডাইনি দিয়ে জীবিকা নিরবাহ করেন। এম আই রাইট?   
রাইট। ব্লাক ম্যাজিক বিদ্যায় পারদর্শী ম্যাজিসিয়ান পিসি সরকারেরও আমি পিশাচসিদ্ধ কাপালিক ছিলেন। তাঁর জীবিকা এটাই ছিল। ব্রাদার আমিও হোয়াইট ম্যাজিক এবং ব্লাক ম্যাজিক দুটোই জানি। আমি রক্তকালীর ভক্ত আর কিছু না।
ইসাহাক মীর শুকনো গলায় বললেন, জিলাপির মতো পেঁচিয়ে ছাড়া সোজা করে কথা বলতে পারেন না?
সোজা করে বলছি।
আপনাকে হুজুর কী দায়িত্ব দিয়েছেন, তা আমি জানি। হুজুরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালে আমাদের মাথার ঠিক থাকে না। সেই সময় কোনো কিছুই হাস্যকর থাকে না।
খুবই সত্যি কথা।
মৃত্যু ভয়াবহ ব্যাপার। এর মুখোমুখি হলে মাথা এলোমেলো হয়ে যাবারই কথা। কিন্তু অন্যদের কি উচিত সেই এলোমোলো মাথার সুযোগ গ্রহণ করা?
আপনি আমার কথা বলছেন?
আপনাকে কুমারী মেয়ে লোক খুঁজতে বলা হলো, আপনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন?
আমি কাউকে না বলতে পারি না। আপনি যদি আমাকে কিছু করতে বলেন তাও হাসিমুখে করে দেব।
আপনাকে দিয়ে কোনো কিছু করানোর আগ্রহই আমার নেই। তবে ছোট্ট একটা কথা বলার আছে। মন দিয়ে শুনুন।
জি, আমি মন দিয়েই শুনছি।
বড় রকমের বিপদে পড়লে মানুষ আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে যায়। তখন শুরু হয় তন্ত্র, মন্ত্র, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক। অর্থহীন সব ব্যাপার।
আমি হাসলাম। মধুর ভঙ্গির হাসি। ভদ্রলোকের ভূরু আরো কুচঁকে গেল। তিনি টেবিলের উপর রাখা একটা ফাইল থেকে ভাউচার বের করেলেন। স্ট্যাম্প লাগানো ভাউচার। তাতে খস খস করে লিখছেন।
দুপুরের খাওয়া হয় নি। খিদে জানান দিচ্ছে। পকেটে সিগারেট আছে। আমি সিগারেটের জন্যে পকেটে হাত দিতেই ইসাহাক মীর সাহেবের বিরক্ত স্বরে বলল, ঘরের মধ্যে স্মোক করবেন। দুর্গন্ধ হবে।
আমি ইসাহাক সাহেবের কথা অগ্রাহ্য করলাম। পৃথিবীর সব কথা শুনতে নেই। কিছু কিছু কথা অগ্রাহ্য করতে হয়।
সিগারেট ফেলেন।
এ তো দেখি রীতিমতো ধমক। আর্শ্চয! বাড়ির ম্যানেজার আমাকে দেখেই বুঝে ফেলেছে আমি সমীহ পাবার মানুষ নই। জাদুকর ধাপ্পাবাজ মানুষ। আমাকে ধমকালে ক্ষতি নেই।
কী হল, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না? সিগারেট ফেলতে বললাম না?
আমি চট করে ইসাহাক সাহেবকে আপনি থেকে তুমিতে নামি আনলাম। শান্তস্বরে বললাম, তুমি তমাত কাজ করো। ঠিকঠাক ভাউচার লেখ। টাকাপয়সার অংক লেখার সময় বারবার অন্যমনস্ক হলে হিসেবের গরমিল হবে।
সিগারেট ফেলেন।
আমি সিগারেট ফেলে দিলে তোমার আরো ক্ষতি হবে। তখন তুমি আফসোস করবে। বলবে, হায় হায়, কেন সিগারেট ফেলতে বললাম!
ফেলেন সিগারেট।
আচ্ছা যাও, ফেলছি।
আমি সিগারেট ফেলে দিলাম। তবে ফেললাম দেয়ালের পাশের শুভ্র সাদা রঙের কাপড়ের কভারের সোফায়। দেখতে দেখতে কাভার পুড়তে শুরু করল।
বিকট গন্ধ বেরুল।
হতভম্ব ইসাহাক। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। সে চেয়ার ছেড়ে টেবিলর কাটিয়ে দেয়ালের কাছে যেতে জেতে সিটের অর্ধেকটা পুড়ে ছাই। ইসাহাক বিস্মিত হয়ে তাকাচ্ছে। আমি তার দিকে তাকাচ্ছি হাসিমুখে। ইসাহাক ক্লান্ত গলায় বলল, এইটা কী করলেন?
আমি সহজ গলায় বললাম, মন খারাপ করবে না। এই পৃথিবীর সবই নশ্বর। একমাত্র পরম প্রকৃতিই অবিনশ্বর। তিনি ছাড়া সবই ধব্বংস হবে। সাদা কাপড়ের সোফা কভার অতি তুচ্ছ বিষয়। আমাকে হাতমুখ ধোয়ার বেবস্থা কর। আর তুমি, চা খাও। চা খেলে তোমার হতভম্ব ভাবটা দূর হবে।
আমার স্টকে অনেক ধরনের হাসি আছে। এর মধ্যে একটা ধরন হলো—মানুষকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে দেয়া হাসি। ইসাহাক মীর পুরোপুরি বিভ্রান্ত হলেন। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে সহজভাবেই বললেন, এইখানে যে এসেছেন এতে আপনার সময় নষ্ট হয়েছে। আসা-যাওয়ার একটা খরচ আছে। খরচটা দিতে চাচ্ছি। কত দেব?
আমি চুপ করে আছি। খরচ বলতে ত্রিশ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়েছি। ফিরব একই ভাবে।
পাঁচ শ’টাকা দিলে কি আপনার চলবে?
আমি হাসলাম। ইসাহাক মীর একটা ভাউচার বের করে দিলেন। স্ট্যাম্প লাগানো ভাউচার। আমি সই করলাম। তিনি পাঁচ’শ টাকার তিনটে নোট বের করে দিলেন। ঝকঝকে নোট। মনে হচ্ছে এইমাত্র টাকশাল থেকে ছাপা হয়ে এসেছে।
এছাড়াও আপনার খরচ-পত্তর যা লাগে দেয়া হবে। কোন খাতে কত খরচ হলো—এটা জানিয়ে বিল করলেই খরচ দিয়ে দেয়া হবে। বুঝতে পারছেন?
জি পারছি। খরচের ক্যাশমেমো লাগবে না?   
আরো কিছু জানতে চান? এই ক্যাশমেমো কীভাবে লিখতে হবে। কীভাবে সত্যতা প্রকাশ করে-এ-জাতীয় কিছু?
না, আর কিছু জানতে চাই না। আপনাকে যথেষ্ট বিরক্ত করা হয়েছে। ধন্যবাদ।
সারশূন্য বাবু ঘর থেকে বেরুতে গিয়েও বেরুলেন না। আবার ফিরে এসে আগের জায়গায় বসলেন। ম্যানেজার সাহেব কপাল কুচকে বললেন, কি হল?
একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি। জয়েন উদ্দিন সাহেবের পিশাচদ দেবী চণ্ডী, সে কি কখনো তার পিশাচী রূপ নিয়ে আপনার কাছে এসেছিল?
না, আসে নি। আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?
জ্বি, শেষ হয়েছে।
শেষ হয়ে থাকলে দয়া করে যান। দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে আসবেন না।
আমি হাসলাম।
আপনার বিরক্তি উৎপাদন করেছি বলে দুঃখিত।
শুধু বিরক্তি না ভাই, আপনি আরো অনেক জিনিস উৎপাদন করেছেন। তার মধ্যে রাগও আছে। নেহায়েত হুজুরের কাজে আছেন বলে কিছু বলি নি।
সারশূন্য বাবু হাসলেন। ম্যানেজার সাহেব তীব্রগলায় বললেন, হাসছেন কেন?
সারশূন্য বাবু বললেন, আর হাসব না। তবে আমি আসব। সলাল সাতটার দিকে আসব।
ইসাহাক মীর সাহেব রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি দয়া করে যাবার আগে হুজুরের সঙ্গে দেখা করে যাবেন।

কেহ বা কহয়ে ছলে।
নিশ্চয় কহি যে, আনি দেও এবে,
কালার গলার ফুলে।।
পাইলে সে ফুল, চেতন পাইয়া,
তবে উঠবেক বালা।
ভূত-প্রেত আদি, ঘুচিয়া যাইবে,
যাইবে অঙ্গের জ্বালা।।
কহে চণ্ডীদাসে, আন উপদেশে,
কুলের বৈরী যে কালা।
(মহিলাদের খোলা চুলে খারাপ হাওয়া আকৃষ্ট হয়। তার রক্ষামন্ত্র) 

গাংনুই নদের তীরবর্ত্তী বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে দ্বিতল পাকা দালান। গৃহকর্ত্রীর নামানুসারে বাড়ীটির নামকরণ হয়েছিলো ‘ময়না বীথি’। বাংলো প্যার্টের্নের বাড়ির চারদিক গাছ- গাছড়ায় ঢাকা। প্রশস্ত উঠেন। উঠোনের মাঝখানে উঁচু মঞ্চ। বাড়ির লাগোয়া দুটি প্রকাণ্ড কামিনী গাছ। একপাশে কুয়া আছে। উঠোনে দাঁড়াতেই মনে শান্তি-শান্তি একটা ভাব হল। আমি বললাম, এত চুপচাপ কেন? বাড়িতে লোকজন নেই?
আগে অনেক লোকজন ছিল। কিছু মরে গেছে। কিছু চলে গেছে ভয়েতে। এখন আমরা কয়জন আছি! আপনি স্নান করে ফেলুন। কৃশকায় একলোক জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ হাসি হাসি। সেই হাসির আড়ালে গোপন একটা অহংকারও আছে। কিসের অহংকার, কে জানে। লোকটি গামছা, সাবান এবং একটা জলচৌকি এনে কুয়ার পাশে রাখলেন।
রোগা বেঁটে খাটো একজন মানুষ। মাথায় চুল নেই। সামান্য গোঁফ আছে। গোঁফ এবং ভুরুর চুল সবই পাকা। গাত্রবর্ণ পাতিলের তলার মতো কালো। লোকটি বিনয়ে নিচু হয়ে বলল, স্নান করে ফেলুন। সারা দিন পথেঘাটে ঘুরে এসেছেন, স্নান করলে ভালো লাগবে। কুয়ার জল খুব ভালো। দিন, আমি জল তুলে দিচ্ছি।
আপনাকে তুলতে হবে না। আপনার নাম কি?
আমার নাম সরেন। সরেন চন্দ।
এই বলেই সে এগিয়ে এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। বুড়ো একজন মানুষ আমার পা ছুঁয়ে পরণাম করবে, আমি এমন কোনো আচরণ এই বাড়িতে আশা করিনি। খুবই হকচকিয়ে গেলাম। অপ্রস্তুত গলায় বললাম এসব কী করছেন?
লোকটি বিনয়ে নিচু হয়ে বলল, আপনি যোগীপুরুষ, আমি আপনার পায়ের ধুলা।
বলেই সে হাত কচলাতে লাগল। তার বলার ধরন থেকেই বুঝা যাচ্ছে তান্ত্রিক  মানুষের প্রতি তার এ-জাতীয় সমীহ প্রকাশ প্রায়ই সে করে। অতীতে নিশ্চয়ই অনেককে বলেছে। ভবিষ্যতেও বলার ইচ্ছা রাখে।
ঠাকুর, এই লুঙ্গিটা পরুন। ধোয়া আছে। আজ সকালেই সোডা দিয়ে ধুয়েছি। আমার আবার পরিষ্কার থাকার বাতিক আছে, নোংরা সহ্য করতে পারি না। ভদ্রলোক যে নোংরা সহ্য করতে পারেন না, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তার কোমরের কাছে মালকোঁচা দিয়ে পরা নোংরা ধুতি। কাঁধে বিশাল সাদা চাদর। চাদর পরিষ্কার, ঝকঝক করছে। সে কৃশকায়,

কুয়ার পানি নদীর পানির মতো গরম নয়, খুব ঠাণ্ডা। পানি গায়ে দিতেই গা জুড়িয়ে গেল। সারা দিনের ক্লান্তি, জয়েন উদ্দিনের উদ্বেগ, পিশাচ সংক্রান্ত জটিলতা—সব ধুয়ে-মুছে গেল। চমৎকার লাগতে লাগল। তা ছাড়া পরিবেশটাও বেশ অদ্ভুত। পুরনো ধরনের একটা বাড়ি। ঝকঝকে উঠোনের শেষ প্রান্তে শ্যাওলা-ধরা কুয়া। আকাশে পরিষ্কার চাঁদ। কামিনী ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ। এক ঋষির মতো চেহারার কৃশকায় বৃদ্ধ রান্না বসিয়েছেন। যেন বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কোনো দৃশ্য।

সরেন চন্দ রান্না করতে বসেছেন উঠোনে। সঙ্গে তার কন্যা। বয়স চার-পাচ। সেও কৃষ্ণকলি। উঠোনেই পরিষ্কার ঝকঝকে মাটির চুল। সরেনবাবু চুলার সামনে জলচৌকিতে বসেছেন। তার কন্যা থালা, বাটি, হাঁড়ি সবই দেখি দু’বার তিন বার করে ধুচ্ছেন।
খিদেয় চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি নিয়ম মেনে চলি না। কিন্তু আমার শরীর নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা। যথাসময়ে তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা হয়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা জয় করার নিয়মকানুন জানা থাকলে হতো। বিজ্ঞান এই দুটি জিনিস জয় করার চেষ্টা কেন করছে না? আমার চেনা একজন আছে যে তৃষ্ণা জয় করেছে। গত তিন বছরে সে এক ফোঁটা পানি খায় নি। তার নাম শ্রীল উদ্ধারণ দত্ত ঠাকুরের। সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল ঘুমটিতে গেটে তার মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষা করে। আমার সঙ্গে ভালো খাতির আছে।

সারশূন্য বাবুকে খাবার দেয়া হয়েছে। আজকের আয়োজন ভালো। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সাথে এক চামচ ঘি, একপাশে ডিমের সালুন। আলাদা বাটিতে ডাল। ঘিয়ের গন্ধে জায়গাটা ম ম করছে। এখানেই শেষ নয়। বেশি করে পেঁয়াজ রসুন দিয়ে ঝালঝাল করে মুরগির সালুন। সবুজ কাঁচামরিচ সাথে নতুন পেঁয়াজের চাটনি দেওয়া হয়েছে। তরকারির সাথে এই জিনিস মিশিয়ে খেতে খুবই ভালো লাগছে। খেতে খেতে সারশূন্য বাবুর মনে হলো, জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ ভরপেট খাওয়ায়।

সারশূন্য বাবু আরাম করে শুয়ে আছেন মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণের মতো। শুক্লা চতুর্দশীর এই রাতে লক্ষ্মীকর্ণ দিনের কাজ শেষ করে অপরিমিত পান-ভোজন করেন, তারপর ঈষৎ মদ-বিহ্বল অবস্থায় শুতে গেলেন। সারশূন্য বাবু অবশ্য মদ খাননি। লক্ষ্মীকর্ণে পালঙ্কে শুয়ে পরার পরপরি মনে পড়ে রাত পহালেই স্বয়ংবর সভা। আর সেই সভার শিল্পকর্মের তত্ত্বাবধান করা হয় নাই। আজ রাত্রির মধ্যে শিল্পবস্তুটি স্বয়ংবর সভায় প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। মহারাজ মূর্তি তৈরির ফিনিসিং টাচ দিতে চলে গেলেন। আর সারশূন্য বাবু মনে মনে আওরাতে লাগলেন-‘স্বপ্নাকুল জ্যোৎস্না খামারবাড়ি মাথার উপর বর্ষিত হচ্ছে, নর্মদার জলে টলমল করিতেছিল, রাজভবনের পাষাণগাত্রে সুধা-লেপন করিয়াছিল। পুরীর পশ্চাতে আম্রকুঞ্জে একটা বপপীহ পাখি বুক-ফাটা স্বরে ডাকিতেছিল—পিয়া পিয়া পিয়া!’

Comments

Popular posts from this blog

রাক্ষসী, ডাইনী আর যোগিনী পরিচয়ের বাইরে অন্যকিছু

পুণ্ড্রের পাঁচালী -৭ (নরবলির মন্ত্র )

পিশাচী সাজেদুর রহমান